ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা সাইত্রিশ

0
172

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

সাইত্রিশ

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাসি, নির্বাক হয়ে আছে৷ ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে৷ সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো এখন কি হবে? ওই ময়ূরাক্ষী এখানেও জিতে যাবে? এতক্ষণে খোদেজাও এসেছে জোবেদার সাথে৷ এ মহিলাকে দেখে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে মধুলতার৷
এ মহিলাটার জন্যই উনত্রিশ বছর আগে সব শেষ হয়েছে আজ ফের এই মহিলাটার জন্যই হয়েছে এসব৷

“কি বলছো কি শাহওয়াজ আমার মেয়ে কি করেছে? মুখ সামলায়া কথা কও ভাইজানের ছেলে বকে মেনে নিবো সব এ কখনো হবে না৷”
হাসির বাবার কঠিন স্বরে রাগ বাড়লো শাহওয়াজ এর৷ কঠিনত্ব প্রগাঢ় হলো মুখশ্রীতে৷ হুংকার তুললো বললো,
“আপনার মেয়ে কে জিগ্যেস করুন সে কি করেছে৷ ”
হাসি কাচুমাচু খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ শাহওয়াজ এবার দাতেদাত পিষে বললো,
“আমি যখন ওখানে গেলাম তখন ময়ূরাক্ষীকে খুঁজছিলাম আশেপাশে, হুট করেই তখন কানে আসে আমার ওর কথা৷ আমি স্পষ্ট শুনেছি ও কুলা’ঙ্গার টা কে ফোনে বলছিলো, ” শাহওয়াজ ভাইজান এখানে চলে এসেছে আপনি এখন বাড়িতে ঢুকতে পারেন৷ মেইন দরজা আটকে নিয়েন৷ নিজেকে দেওয়া সেই থাপ্পড় টা মাথায় রাখবেন ভাইজান ছাড়বেন না ওই মেয়েকে৷”

শাহওয়াজ এর কথা শুনে বিস্মিত হলো সবাই৷ জোবেদা অলগেছো শুকনো ঢোক গিললো তার বোধহয় চলে যাওয়াই ঠিক৷ তার নাতী শেষে কি না এই মেয়ের সাহায্য নিলো? কি বোধবুদ্ধি হীন ছেলে বাবা৷
আকস্মিক ঠা’স করে একটা শব্দ হলো৷ হাসির গালে থাপ্পড় পরেছে এবং সেই থাপ্পড়টি দিয়েছে খোদেজা৷ অবাক না হয়ে পারলো না মধুলতা সহ সবাই৷ এ মহিলার আবার কি হলো? নাকি নতুন চাল৷
হাসির বাবা মা চুপসে গেলো৷ যেন কিছু বলতে পারলো না আর৷

মধুলতা এগিয়ে গেলো জোবেদার দিকে৷ মধুলতা কে দেখে জোবেদা শুকনো ঢোক গিললো, যেন কোনো তীর তেড়ে আসছে তার দিকে৷ কাছে গিয়ে দাড়ালো জোবেদার ফিসফিসিয়ে আক্রোশ নিয়ে বললো,
“ভালো আছেন খালা? মনে আছে আমায়?”
মধুলতার চোখ যেন অগ্নিকূপ তাকিয়েই ভস্ম করে দিবে সব৷ ঝলসে দিবে নিমেষে৷
জোবেদা নিজের গম্ভীর্যতা বজায় রেখে খানিকটা জোরেই বললো,
“বড় বউ ভালো আছো?”
মধুলতা ফের একই ভাবে বললো,
“মেয়েটার কিছু হলে ছাড়বোনা আপনাকে বলে দিলাম৷ তখন আপনি বেঁচে গেলেও এখন ছাড়বোনা৷ সুদে আসলে ফিরিয়ে দিবো৷”

এর মাঝেই রেহান এলো৷ বৃষ্টিতে কাক ভিজে হয়ে আছে৷ সে ঢাকা গিয়েছিলো ময়ূরাক্ষীর খবর পেয়ে ছুটে এলো৷ এসেই জিগ্যেস করলো,
“ময়ূর কোথায়?”
উত্তর দিলো না কেউ৷ শাহওয়াজ কঠিন হয়ে স্থান ত্যাগ করলো৷ প্রেয়সী যে অবস্থাতেই থাকুক তার জন্য অন্য কারো চোখে সে মায়া দেখতে পারবে না৷ রেহান দূর্বল চিত্তে ফ্লোরেই বসে পরলো সে অবস্থায়৷ কি হলো মেয়েটার? কি করে হলো? ঠিক হবে তো মেয়েটা?

।।

শীতল পরিবেশেও টুপ টুপ করে ঘাম ঝড়ছে শাহওয়াজ এর কপাল বেয়ে৷ চোখে মুখে আতংক হাত কম্পিত এই প্রথম কোনো রোগীর কাছে থাকতে হাত কাঁপছে শাহওয়াজ এর৷
ময়ূরাক্ষীকে লাইফ সাপোর্টার এর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ মেয়েটাকে যে এমন পরিস্থিতিতে ও দেখতে হবে কে ভেবেছিলো?
এ স্ট্রোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে লাইফ সাপোর্টার চিকিৎসা দেওয়া হয়৷
সংকোচনের মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করা এবং হৃৎপিণ্ডের উপরে এবং যদি প্রয়োজন হয়, ধমনীতে চাপ বিন্দুতে চাপ দেওয়া হয়
এর পাশাপাশি সিটি স্ক্যান ও করে দেখতে হয় হেমোরেজের পরিমাণ কি অনেক কি না। ময়ূরাক্ষীর রক্তক্ষরণের পরিমাণ অনেক , এবং এটি চাপ তৈরি করছে প্রবল৷

ডাক্তাররা ও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছেন না, রোগীর বয়স ও কম৷ একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে৷ এদিকে তাও কোনো উন্নতির সুরাহা নেই৷
ঘরির কাঁটা তখন দুইট কাছাকাছি দিশা না পেয়ে দ্রুত কিছু ওষুধপত্র দিয়ে প্রেশার কমানোর জন্য চিকিৎসা শুরু করলো।
এদিকে আবহাওয়া ক্ষানিকটা ঠিক হয়েছে৷ সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি ছিলো সবেই বৃষ্টিটা কমলো৷ সব ঠিকঠাক থাকলে ডাক্তার সকালে ফ্লাইটে বাংলাদেশ আসবে৷ ওষুধ দেওয়ার ঘন্টা খানেক পর ফের টেস্ট করে দেখতে হবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না পরিস্থিতি৷

শাহওয়াজ ক্লান্ত পায়ে করিডোরে এলেন৷ জীর্ণশীর্ণ মন তার৷ হৃদয় বড়ই ব্যাকুল আজ৷ মা আগ্রহ নিয়ে বসে আছে, আকবর চৌধুরী, রাবেয়া, রুম্মন চৌধুরী মিনারাও বসে আছেন৷ মৃদুলার মা মৃদুলার সাথে আছে৷ মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই অক্সিজেন দেওয়া৷ সে ও তো বাচ্চা৷

বাকি সবাই চলে গেছেন৷ হসপিটালে খোদেজাও আছেন একটা কেবিনে আছেন আপাতত তার প্রেশার বেড়েছে৷ সে ও বায়না ধরেছে বাড়ি যাবে না৷ মহিলার ভাব মূর্তি বুঝতে পারছে না শাহওয়াজ৷
শাহওয়াজ এসে বসলো মায়ের পায়ের কাছে ফ্লোরেই বসলো মাথা দিলো মায়ের কোলে রুপা তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে৷
সে মধুলতার পাশেই বসা, মায়ের কোলে মাথা দিয়েই বলছে,
“মাথা টিপে দাও আম্মু৷ মাথা ব্যাথা করছে৷”
ছেলের এমন কন্ঠে ক্ষানিকটা কেঁপে উঠলো মধুলিতা৷ ছেলে এতটা কেন ভেঙে পরেছে? মধুলতা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“ময়ূরাক্ষী ঠিক হবেতো বাবা? আমরা ওকে এখানে কেন ফেলে রেখেছি? অন্তত ঢাকা আমাদের হসপিটালে নিয়ে যাই?”
শাহওয়াজ চোখ বন্ধ এখনো আঁখিদ্বয়ের কার্নিশ বেয়ে মধুলতার পায়ে পরলো কয়েক ফোটা পানি৷ মধুলতা অবাক হলেন, তার বুঁক কেমন কাঁপলো৷ তার ছেলেতো এমন না৷ তার হাসিখুশি চঞ্চল ছেলের কি হলো? অজানা আতঙ্ক ভর করলো৷
মায়ের কোলে মাথা রেখেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত কন্ঠে বললো,
“এ হসপিটালটা বেশ ভালোই আম্মু, এখানে সব রকম ব্যাবস্থা আছে৷ তা ছাড়া ঢাকা থেকেও তো ডাক্তার এসেছে ওকে নিয়ে যেতে পারলে আমিও কি এখানে রেখে দিতাম? ওর অবস্থা ভালোনা আম্মু, ভালোনানা৷ নিয়ে যাওয়ার সময় নেই আম্মু৷ রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না৷”
শেষ এরকথা গুলো বলতে গিয়ে কাঁপলো শাহওয়াজ এর কণ্ঠনালী৷ মধুলতাও বুঝলো ছেলে তার নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে৷ প্রেম রোগ৷ প্রণয় ব্যাধি যা মানুষ কে তিলে তিলে পঙ্গু করে তোলে৷
মরণ ব্যাধি থেকেও মারাত্মক এ রোগ৷ মরণ তো সব কিছুর ইতি ঘটায় আর এ প্রণয় যন্ত্রণা মানুষ কে ভেতর থেকে মুমূর্ষু রোগীতে পরিনত করে৷ বেঁচে থাকতেও মানুষ লা’শ হয়ে বাঁচে৷ দীর্ঘশ্বাস হয়ে তীরের মত বিঁধে চিরকাল বুকে৷

বেশ ক্ষানিক্ষণ সময় পার হলো শাহওয়াজ উঠলো৷ এতক্ষণ বৃষ্টি ছিলো তাই যেতে বলেনি কাউকে কিন্তু এখন তাদের বাড়িতে পাঠাতে হবে এখানের রুলস ঢাকার মতই শাহওয়াজ এর পরিচিত বলে কতৃপক্ষ কিছু বলেনি৷ কিন্তু শাহওয়াজ রুলস ব্রেক করতে পছন্দ করে না৷
তার উপর তার মায়ের মাইগ্রেন এর সমস্যা আছে রাত জাগলে ব্যাথা হয়৷
শাহওয়াজ মায়ের পানে তাকিয়ে বললো,
“আম্মু তোমার এখন যাওয়া উচিত, হসপিটালের পাশেই একটা হোটেল আছে বেশ রাত অব্দি খোলা থাকে সেখানে দিয়ে আসি তোমায়? এখন তো আর এত দূর বাংলোতে যেতে পারবে না৷ ঘুমানো উচিত তোমার৷ ”
অতঃপর আকবর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
“আপনাদের ও যাওয়া উচিত৷ এখানে রাতে স্টে করার নিয়ম নেই৷”
মধুলতা ছেলের পানে তাকিয়ে বললো,
“মেয়েটার এ অবস্থা ফেলে কি করে যাই? থাকি না বাবা? কথা বলে নিচ্ছি কতৃপক্ষের সাথে৷”
রুপাও বায়না ধরলো সে ময়ূরাক্ষীকে ফেলে কোথাও যাবে না৷ অতঃপর না পেরে রাজি হলো শাহওয়াজ৷ মা আর রুপাকে বললো তার চেম্বারে গিয়ে যেন বসে৷ বলেই পা বাড়াবে ঠিক তখন রেহান এলো তার পিছু অইছু৷ রেহান কে দেখে ভ্রু কুঁচকালো শাহওয়াজ৷ শাহওয়াজ কিছু বলবে তার আগেই রেহান বললো,
“মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারলেনা ভাইয়া,অথচ ওর চোখে তোমার জন্য আমি অগাধ ভালোবাসা দেখেছি৷”
শাহওয়াজ নিরব৷ ফের শোনা গেলো রেহানের কন্ঠ,
“কসম ওকে যদি শুধু তুমি ভালোবাসতে জীবনেও আমি তোমার হতে দিতাম না৷ জোর করে হলেও আমার রাখতাম কিন্তু আফসোস৷ তুমি ওকে নিয়ে নাও ভাইজান তবুও ওকে বাঁচিয়ে দাও৷”
শাহওয়াজ থমথমে হয়ে তাকিয়ে রইলো ক্ষানিক্ষণ অতঃপর সে আবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো প্রেয়সীর দিকে৷ মেয়েটা তাকে একেবারেই দূর্বল করে ছাড়লো৷

ময়ূরাক্ষীর অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে খারাপ পর্যায়ে যাচ্ছে রক্তক্ষরণ বাড়ছে ওষুধেও কাজ হচ্ছে না৷ ডাক্তাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করেই যাচ্ছে এ পর্যন্ত কেউ স্বস্তিতে বসতে পারেনি৷ মধ্যরাত চলছে আশাহত হচ্ছে ডাক্তাররা বারংবার৷
শাহওয়াজ ময়ূরাক্ষীর পানে তাকালো পূর্ণ দৃষ্টিতে, মুখে মাস্ক পরিহিত৷ মুখিটা কেমন ফেকাসে হয়ে আসছে৷ হুট করেই নার্স কিছু ইশারা করলো৷ ডাক্তাররা মেশিনটার দিকে তাকিয়ে পালস চেক করলো অতঃপর ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“পরিস্থিতি হাতের বাইরে শাহওয়াজ মনে হয় না…..”

চলবে,

[গল্প প্রায় শেষ এর দিকে৷ সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করুন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here