ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা আটত্রিশ

0
162

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

আটত্রিশ

প্রেমিক মন আজ বড়ই জীর্ণশীর্ণ৷ হৃদয় প্রেয়সীর কথা শ্রবণ করার আশায় ব্যাকুল প্রায়৷ সহস্রবার মেয়েটাকে ডাকলো কিন্তু শুনলো না মেয়েটা৷ সিক্ত হৃদয় বড়ই বেহায়া আজ৷
মানতে নারাজ মেয়েটা কথা বলছেনা কেন? সে ডাগর ডাগর চোখ জোড়া আজ কেন কথা বলে না? তার লাজুকলতা আজ তাকে দেখে কেনো লজ্জা পায় না? রেগে দু চার বানী শুনিয়ে দেয় না?
ঠিক থাকলেতো এতক্ষণে কতশত কথা শুনিয়ে ক্ষ্যান্ত হতো৷
ভোর হয়েছে সেই ঘন্টাক্ষানেক আগে আজ অম্বরে রৌদ্রমেঘের মিলন মেলা চলছে৷ ঝলসানো রোদ ও নেই কৃষ্ণ কালো আঁধার ও নেই৷
অম্বরের ন্যায় তাদের তাদের জীবনেও অন্ধকার কাটেনি৷ ঝলমলে নয় এখনো সব কিছু কেমন আবছা অস্পষ্ট৷

মানুষ নিজের জীবনের সমীকরণ মেলাতে পারেনা অন্তরিক্ষের ভাবমূর্তি বুঝবে কি করে?শাহওয়াজ ভোর হওয়া দেখলো নিজের চেম্বারে বসে৷ ময়ূরাক্ষীর অবস্থা মধ্যরাতে একটু নিয়ন্ত্রণে এসেছে রক্তক্ষরণ একটু নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো কিন্তু সকালেই হুট করে বেড়েছে৷ ডাক্তার ছয়টার ফ্লাইটে উঠেছে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ল্যান্ড ও করেছে৷

“আসবো স্যার?”
নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসলো শাহওয়াজ নার্সের কথায়৷
ঘরিতে সারেটা বাজে৷ একটু আগেই ময়ূরাক্ষীর কাছ থেকে এসেছে৷
শাহওয়াজ ঘড়ি পরখ করে বললো,
“আসুন৷ ”
মেয়েটা এলো৷ ভাবলো বলবে কি না পরক্ষণেই বললো,
“স্যার নয়টা বাজে চেকআপ আছে তিনতলার পেশেন্ট এর৷ এগারোটা বাজে একটা সার্জারী আছে৷”

তপ্ত শ্বাস টানলো শাহওয়াজ৷ কত দায়িত্ব, আজ যেন পেরে উঠছে না কিছু৷ অথচ সবার উর্ধ্বে কাজ কে প্রাধান্য দিতো শাহওয়াজ৷ আজ কেন কিছুতেই মন বসছে না?
সায় দিলো সে৷ নার্সটা বেরিয়ে গেলো৷ অতঃপর স্টেথোস্কোপ টা নিয়ে হাটা দিলো এখন যাবে মৃদুলার কাছে মেয়েটার কি অবস্থা তা দেখতে৷ পরিস্থিতি যেমনই হোক কাজ তো ফেলে রাখা যাবেনা৷
চিকিৎসা তো দিতেই হবে এদিকে সে নিজেই হয়ে উঠছে মুমূর্ষু রোগী৷

মৃদুলার রুমে প্রবেশ করলো শাহওয়াজ, সাথে আরো একটা ডাক্তার আর নার্স৷ মৃদুলা বেশ ভালো রিকোভার করেছে৷ সকালে নিজে নিজে চোখ মেলেও তাকিয়েছে৷ অথচ ওকে নিয়েই ভয় ছিলো বেশি৷
টুক টুক করে তাকিয়ে আছে মৃদুলা৷ রুপা রেহান ও আছে৷ শাহওয়াজ কে দেখে ঠোঁট ভে’ঙিয়ে কেঁদে দিলো মেয়েটা৷ যে মেয়েটার ঠোঁট থেকে হাসি সরতোনা সে আজ কাঁদছে৷ শাহওয়াজ যেতেই দূর্বল কন্ঠে বললো,
“ভাইজান ময়ূরবু কই? বুবু তোমারে কল দিছিলো তুমি কেন আসলা না? কেন বাঁচাইলা না আমাদের?”
বলেই মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠলো৷ ধ্বক করে উঠলো শাহওয়াজ এর বক্ষ৷ কথাটায় যে কত যন্ত্রণা ছিলো প্রতিটা মানুষ যেন ঠাহর করতে পারলো৷ সবাই চুপ করতে বললো মেয়েটা কে শুনলো না মেয়েটা৷
মৃদুলা ফের কম্পিত কন্ঠে ছোট ছোট করে বললো,
“বুবু আমারে পালাইতে বলছিলো ভাইজান আমি বুবুরে রাইক্ষা কেমনে পালাই? ওই সয়তান টা আমার বুবুরে…”
বলতে বলতেই মেয়েটার শ্বাসকষ্ট উঠলো৷ শাহওয়াজ কাছে গিয়ে অক্সিজেন মাস্কটা পরিয়ে বললো,
“হুস, কথা বলে না মৃদুলা৷ কান্না করে না কিছু হয়নিতো৷ উত্তেজিত হয় না৷ ”
মৃদুলা শুনলো না, অবাদ্ধ হয়ে মাস্ক টা সরিয়ে দিলো৷ হাপাতে হাপাতেই বললো,
“ময়ূরবু কই ভাইজান? বুবু কেন আসলোনা? বুবু কি নাই ভাইজান? আমার বুবু কই৷”
ঢুকরে উঠলো রুপা টুপটুপ করে রেহান, শাহওয়াজ এর মত পুরুষদের চোখ থেকেও পানি ঝরলো৷ মৃদুলার বয়স কম হলেও মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমান৷ মেয়েটা যেন অল্পতেই বিচলিত হয়ে পরলো দিশা না পেয়ে ইনজেকশন দিতে হলো ঘুমের৷ শান্ত হলো যেন এতে মেয়েটা৷
,,

ডাক্তার এলো নয়টায়৷ এসেই ছোটোখাটো একটি মিটিং করলো ফের সিটি স্ক্যান করানো হলো৷ রিপোর্ট দেখে জানালো খুব শীঘ্রই অপরেশন শুরু করতে হবে৷ এমনিতে পুরো একটা রাত এমনি এমনি পার করেছে৷ ময়ূরাক্ষীর অপরেশন দশটায় শাহওয়াজ এর ইম্পর্ট্যান্ট একটা অপরেশন আছে এগারোটায়৷
শাহওয়াজ যেন আরো খেই হারালো, ময়ূরাক্ষীর অপরেশন এর সময় থাকতে পারবে না সে?
নিজের কাজে মনোনিবেশ করবে কি করে? অপরেশন এর হুট করেই একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো ডাক্তার কাগজ পত্র সামনে দিলো শাহওয়াজ এর৷ রোগীর কন্ডিশন ভালোনা অপরেশন এর মাঝে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে এ দাই ডাক্তারের না৷
শাহওয়াজ জানে এটা প্রতিটা ডাক্তার নর্মাল অপরেশন এর সময় ও করে কিন্তু ময়ূরাক্ষীর অবস্থা যে ঠিক নেই৷ তার উপর বারো ঘন্টা যাবত ওষুধ দিয়ে দিয়ে রকটা রোগীর মস্তিষ্কের র’ক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করছে সে রোগীর বেলা তো আরো কঠোর নিয়ম হবেই৷
শাহওয়াজ পাগলামি শুরু করলো সে কিছুতেই সই করবে না৷ একটা ডাক্তার হয়ে হুট করে এমন ভেঙে পরা টা বেশ দৃষ্টি কটু৷
তবুও ডাক্তার হলেও সে পরিশেষে মানুষ অনুভূতি তো আছেই৷ শাহওয়াজ রাগে সে কাগজটা ছিড়ে ফেলতে চেয়েছিলো৷ পরক্ষণেই ডাক্তার বোঝালো তার এমন পাগলামো সাজে না লোকে মন্দ বলবে৷
শাহওয়াজ এর মা ও বোঝালো অতঃপর সই করলো সেখানে তবে সই টা শাহওয়াজ করেনি মধুলতা করেছে৷
তার চোখের সামনে দিয়ে তার প্রেয়সীকে অপরেশন থিয়েটারে ঢুকালো সে চেয়ে দেখলো শুধু৷ আজ সঙ্গ দিতে পারলো৷ না৷

এদিকে জোবেদা এই সুযোগেই অপেক্ষায় ছিলো যেন সবাই অন্য দিকে মনোনি করবে আর সে এখান দিয়ে পালাবে৷ কাল ছেলেকে দিয়ে টিকিট কাটিয়েছে আজ সে বিকেলে দেশ ছাড়বে৷ কিন্তু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই ঘটলো বিপত্তি৷
সামনে এসে দাড়ালো রেহান৷ শক্ত কন্ঠে বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
জোবেদা কিছু বলার আগেই আকবর চৌধুরী এলেন৷ চোখমুখ জুড়ে গম্ভীর্যতা৷ কাটকাট কন্ঠে বললো,
“হসপিটালের বাইরে পুলিশ আছে খালা, তোমার নাতীকে যে পর্যন্ত পাওয়া যাবেনা সে পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি অন্য ব্যাবস্থাবকরবো৷”

।।

“আমি সব বইলা দিমু, আমার আর এত বোজা সহ্য হইতাছে না৷ বয়স তো কম হয় নাই মরার সময় হইয়া গেছে, পাপের বোজা নিয়া আমি মরতে পারমু না৷ ”
খোদেজার কথায় আঁতকে উঠলো জোবেদা৷ সে তার ছেলেকে ফোন করছিলো৷ এখান থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে৷ এত দুঃশ্চিন্তার মাঝে কি বলছে আবার তার বোন?
হুট করেই বোনের কথা কর্ণকুহর হতে কেঁপে উঠলো৷ ভীত হলো চোখ মুখ৷
কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে আক্রোশ নিয়ে বললো,
“পাগল হইছছ বুবু? কি বলতাছোছ এগুলা? মাথা খারাপ নাকি?”

খোদেজা শোয়া থেকে ধরে ধরে উঠে বসলো৷ হসপিটালেই আছে তারা৷ সবে বারোটা বাজে ঘরিতে৷ ময়ূরাক্ষীর খবর আসেনি এখনো৷ ৷
খোদেজা অনুতপ্ত, কেন যেন এসব আর সহ্য হচ্ছে না৷ অনেক তো হলো এসব তার জীবনে আর কি আছে? শেষ সময় এত পাপ বইতে পারছে না সে৷ শরীর যে অকার্যকর হয়ে পরছে ঢের আন্দাজ করতে পারছে৷
অন্যায় তো কম করেনি৷ পুরো জীবনটা ভরাই তার অন্যায় দিয়ে৷ প্রাচুর্যের পিছু ছুটতে ছুটতে যে পাপের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে এত দিন এর খেয়াল তো ছিলোই না৷
চোখে পট্টি পরে ছিলো৷ তা ছাড়া মধুলতা এসেছে কেলেংকারী হবে এবার৷ তান্ডব চালাবে সে জানে৷ তার আগেই নিজের দিক নিজেই ক্লিয়ার করা ভালো৷ তার জন্য তার ছেলে মেয়ে সব থেকে যদি বঞ্চিত হয়? তারপর দেখবে একুল আকুল দুকুলি গেছে৷ না না এটা সে চায় না৷
খোদেজার জবাব না পেয়ে জোবেদা একই কন্ঠে বললো,
“কি হইছে? কথা বলতেছিস না কেন বুবু? বল?”
খোদেজা গম্ভীর স্বরে বললো,
“তোর কথায় চলতে চলতে পুরা জীবনটা পাপ দিয়া ভইরা ফালাইছি৷ এই পাপ নিয়া আমি মরবার পারুম না৷আর উপর তোর নাতী কি একটা কান্ড ঘটাইলো পুরো জখম ফের তরতাজা কইরা তুললো৷ মধুলতা এবার কেউরে ছাড়বো? আমি আজই বলমু আকবররে,আমি আগেভাগে বললে ও বুঝবো সামাল দিতে পারবো মধুলতারে৷৷”

জোবেদা রেগে গেলো আরো তবে এটা রাগ দেখানোর সময় না৷ বুবুকে তাকেই বোঝাতে হবে সাত পাঁচ৷ এখন যদি সব বলতে যায় ওর ব্যাপার ও জানাজানি হয়ে যাবে৷ এই বুড়ি মরবে সাথে ওকে ও মারবে৷ জোবেদা বিচক্ষণী মানুষ তাই ভেবে কোমল কন্ঠে ফিসফিস করে,
“তুই আকবর রে সব বলবি? মাথা গেছে? জানিস না ও কেমন? তোর ছেলে মেয়ের কথা ভাববি না? এইসব জানলে আকবর তোদের আর চৌধুরী বাড়িতে রাখবো?এটাইতো ভয় মধুলতা আছে এহন তো তোর কথা বুঝবো না কিছু৷ ভুইলা যাইছ না এহনো চৌধুরী বাড়ি আকবরের নামে৷ বুবু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর৷ আমারটা বাদই দিলাম তুই এসব বললে তোর পোলা মাইয়া কানাকড়ি ও পাইবোনা৷”

বলে ফস করে নিশ্বাস নিলো৷ এইতো দূর্বলতায় আঘাত করেছে৷ এইবার যদি মাথা মোটা টায় বোঝে একটু৷ সব তো করছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য না হয় এত ঠান্ডা মাথায় কথা এর সাথে বলে কে?
এত বছর যাবত কত গুটি চাললো এখন সব ভেস্তে যাবে? না না কিছুতেই না৷
খোদেজা ভাবছে কিছু৷ সে বিছানা থেকে নামলো এবার৷ জোবেদা ভাবলো কাজ হয়েছে হয়তো৷ কিন্তু না তাকে বিস্মিত করে দিয়ে খোদেজা বললো,
“তর কথা আমি কিছুই শুনমু না৷আমি জানিনা তুই আমার সাতপাঁচ কেন বুঝাইতাছছ৷ এহনি যামু আমি আকবরের কাছে৷ ”
বলে পা বাড়াতে নিলেই জোবেদা রেগে গেলো আকাশ চুম্বি৷ খপ করে চুল পেঁচিয়ে ধরলো৷ খোদেজা “আ” করে উঠতে মুখ চেঁপে ধরে বেডে ফেললো৷
বয়স্ক শরীর টা নিমেষে কাবু হলো যেন৷ খোদেজা বিস্ময় এর শীর্ষে যেন৷ তার আদরের বোন টা এত বড় হয়ে গেলো? তাকে আঘাত করতেও দ্বিধা করছে না৷ খোদেজা ভয়ার্ত কন্ঠে কোনো মতে বললো,
“কি করছিস কি জোবেদা?”
বলা শেষ হতেই মুখটা আরো শক্ত করে চেঁপে ধরলো৷ খোদেজা খেয়াল করলো তার সেই শক্তপোক্ত শরীর টা আর নেই তাইতো কিঞ্চিৎ নিজেকে সামলানোর ও উপায় নেই৷
জোবেদা দাতে দাত চেঁপে ফিসফিসিয়ে বললো,
“বুবু মরার কথা বলতাছিলি না? তোর নাকি পাপের বোজা সহ্য হচ্ছে না? তোর পাপের বোজা আমিই শেষ করে দিচ্ছি আর বহন করতে হবে না তোর৷ আমি তোর যন্ত্রণা মিটিয়ে দিচ্ছি৷ বলেই গলাটা চেঁপে ধরলো খোদেজার৷ বড় বড় হলো করে তাকালো চোখে মুখে নিমেষে যেন আঁধার নেমে আসছে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম৷

চলবে,

[গল্প শেষ পর্যায় সাজাতে সময় লাগে তাই দিতে দেরি হয়৷ অথচ আপনারা বুঝতে চান না ভাবেন ইচ্ছে করে দেই না৷ একটা পর্ব লিখতে এমনো সময় যায় দু-দিন লেগে যায়৷ আপনারা ভাবেন গল্প লেখা খুবই সহজ কিন্তু কতযে ভেবে এক এক টা শব্দ লিখতে হয় হয়তো বুঝেন না৷ আমার কথা খারাপ লাগলে দুঃখিত৷ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here