ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা পঁয়ত্রিশ

0
332

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

পঁয়ত্রিশ

প্রকৃতি শীতল৷ ঝড়ো হাওয়া এখনো বইছে তবে তান্ডবহীন৷ শীতল পরিবেশ গায়ে হীম ধরা ঠান্ডা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির দেখা মিলছে৷ মনরম পরিবেশ৷ বাইরের টিপটিপিয়ে পরা বৃষ্টির প্রতিটা শব্দ যেন বক্ষেও বারি খাচ্ছে৷
নাজুক আজ মন মেজাজ, নিজের চেম্বারে বসে আছে জানলার পাশে৷ চার ঘন্টা ময়ূরাক্ষী অপরেশন থিয়েটারে ছিলো৷ এখন আইসিইউতে রাখা হয়েছে৷ ডাক্তার মিটিং বসবে সন্ধ্যার পর৷ এখন অব্দি এক বার ও ময়ূরাক্ষীর কাছে যায়নি শাহওয়াজ, এই চঞ্চল মেয়েটির নেতিয়ে পরা রুপ দেখতে পারবে না শাহওয়াজ৷

শাহওয়াজ লন্ডন নিজের স্যার কে কল দিয়েছে সে আসতে পারবে না তবে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত থাকবে৷
শরীর এর অন্য জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হলেও মাথার থেকে রক্তক্ষরণ হয়নি যার জন্য ভয় পাচ্ছে সবাই৷ এ পরিস্থিতিতে ব্রেইন হেমারেজ এর সম্ভাবনা থাকে বেশি৷ শাহওয়াজ এর ভাবনার মাঝেই নক করলো দরজা শাহওয়াজ গম্ভীর স্বরে বললো,
“আসুন!!”
আকবর চৌধুরী ঢুকলো ছেলের চেম্বারে৷ ঢুকতেই নজর গেলো মধুলতার একটা ছবি যা দেখে প্রেমে পরেছিলো সে৷ সেই ছোট্ট মধুলতা৷

এর মাঝেই শাহওয়াজ বললো,
“বসুন!”
আকবর চৌধুরী মাথা ঝুলিয়ে চেয়ার সরিয়ে বসলো৷ বসতেই চোখ গেলো টেবিলে থাকা নেইম প্লেটটার উপর৷ “ডা:শাহওয়াজ প্রহর ” গর্বে যেন বুকটা ভরে উঠলো ছেলের নামের সামনে ডাক্তার শব্দটা দেখে৷ সামনেই বসা তার ছেলে৷ চেম্বারের একাং জুরে আছে ট্রফি পাশেই ছবি দেওয়া কখন কোন ট্রফি জিতেছে৷ ছোটো বেলারো ছবি আছে এখানে৷

এবার আকবর চৌধুরী ঠিকঠাক হয়ে বসলেন বললেন,
“বলো কেন ডেকেছো?”
শাহওয়াজ চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে প্রশ্ন করলো,
“দর্শনা দাস উমা৷ মানে প্রিয়দর্শিনী আন্টি কোথায়?”
আকবর চৌধুরী নড়েচড়ে বসলেন কি যেন ভাবলেন বললেন,
“প পালিয়েছে৷”
স্পষ্ট মিথ্যে কথা যা বুঝতে শাহওয়াজ এর বেগ পেতে হলো না৷ কঠিন হলো শাহওয়াজ এর মুখশ্রী তেঁতে উঠে বললেন,
“মিথ্যা কথা পালায়নি সে৷ সত্যিটা বলুন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পর কি হয়েছে জানতে চাই আমি৷”
আকবর চৌধুরী ফের কিছু বলবে শাহওয়াজ কঠিন স্বরে বলে,
“আমি সত্যি জানতে চাই আশা করি মিথ্যে বলবেন না৷”

আকবর চৌধুরী তপ্তশ্বাস টানলেন৷ ছেলে তার নাছোড়বান্দা বুঝতে পারলেন৷এবং ছেলে যে প্রায় সিংহভাগ জানেন তাও বোধগম্য হলো৷ সে বলা শুরু করলো না পেরে,
“রুম্মন ছিলো আমার সব থেকে আদরে৷ আম্মা আমার নিজের মা না হলেও নিজের মায়ের মতই ভালোবেসেছে৷ আমি কখনো চাইনি নিচু জাত যার ধর্ম ভিন্ন তার সাথে ওর বিয়ে হোক৷ তার উপর ওই এলাকার মোড়লের সাথে আমাদের ঝামেলা ছিলো৷ বিয়ের পর প্রিয়দর্সশিনী আর রুম্মন যখন ঢাকা থেকে এত বছর পর এলো তখন সেই মোড়লের ছেলে রুম্মন কে মেরে বাড়ির সামনে রেখে যায়৷
তখন ওরা প্রিয়দর্শিনীর বাড়িতে থাকতো৷ সে দিন কে রুম্মন কে বাড়িতেই রেখে দেই পরের দিন প্রিয়দর্শিনীও আসে মা কে রাজি করিয়ে ওকেও এ বাড়িতে রাখি৷ ওর যখন নয় মাস কি ভেবে জানি ভোর বেলা পালায় বাড়ি থেকে সেদিন মাঝ রাস্তায় আমাদের সাথে দেখা হয়৷

সেদিন ওর অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমরা হসপিটাল নিয়ে যাই৷ প্রিয়দর্শিনী মধুলতার যেমন প্রিয় ছিলো আমিও ওকে বোনের মতই দেখতাম৷ আমি জানি ও এ বাড়িতে সেইফ না তাই ওকে থাকতেও বলিনি কিন্তু আমি চাইনি আমাদের বাড়ির মেয়ে ওই ছোট্ট বাড়িতে থাকুক তাই বলেছি আমাদের কাছে যেন দিয়ে দেয়৷ সে দিন ও রাজি না হলেও পরবর্তীতে নিজ থেকেই ময়ূরকে নিয়ে আসে আমাদের বাড়িতে সেদিন বাড়িতে আমি মা, জোবেদা খালা আর রাবেয়া ছাড়া কেউ ছিলো না৷ প্রিয়দর্শিনী জানায় ওদের বাড়িতে ওর থাকাও এখন কষ্টসাধ্য মেয়েকে রাখলে মেয়ের যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যাবে৷ সে দিন আমায় আমানত হিসেবে ময়ূরকে তুলে দেয়৷ ছেলে না হওয়ায় মা ময়ূরকে মানতে নারাজ ছিলো আমি জোর করায় আমায় শর্ত দেয় ময়ূরকে রাখতে পারবো কিন্তু রুম্মনের মেয়ে হিসেবে না আশ্রিতা হিসেবে৷ সে আবার রুম্মনের বিয়ে দিবে৷ দিশা না পেয়ে সে কথাতেই রাজি হতে হলো৷ এরপর প্রিয়দর্শিনীর কি হয়েছে আমি জানিনা ওর বাবা মা বলেছিলো ও নাকি বাড়ি যায়নি৷ ”

আকবর চৌধুরী থামলো, সামনে থাকা গ্লাসটার ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করলো৷ শাহওয়াজ এর দৃষ্টি এখনো তীক্ষ্ণ৷ সামনে থাকা স্টেথোস্কোপ টা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“এটা আংশিক বাকি টুকু বলুন? আসলেই কি জানেন না? নাকি জেনেও বলতে চান না?”
আকবর চৌধুরী হাসলেন৷ ছেলে তার থেকেও এক ধাপ উপরে৷ সে আসলেই জানেনা প্রিয়দর্শিনী কোথায় মেয়েটা আদৌ এখনো ঠিক আছে কি না৷
আকবর চৌধুরী বললো,
“আমি সত্যিই জানি না৷”
সে এত দিন নিজের সব কিছু দিয়ে মেয়েটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু আসলেই সে ব্যার্থ মানুষ৷ পারলো না, নিহানের খোঁজ চলছে সে থানায় গিয়েছিলো৷ অফিসারটা শাহওয়াজ এর সাথে একটু কথা বলতে চায় কিন্তু ছেলেটার ব্যাস্ততায় বলতে পারেনি৷

রুম্মন চৌধুরী পায়চারি করছে, তার যে অনেক প্রশ্ন এখনো মনে৷ ভাই বা শাহওয়াজ কাউকেই কিছু জিগ্যেস করার সুযোগ হয়নি৷ ময়ূরাক্ষী তার মেয়ে? তার সন্তান? তাই এত দিন ওর চোখের দিকে তাকালে বুকটা কেঁপে উঠতো? তাহলে প্রিয়দর্শিনী কোথায়? কেন তাকে তার মেয়ের কথা জানানো হয়নি?

মিনারা রুম্মন চৌধুরীর একটু দূরেই বসে৷ সে শূন্য মস্তিষ্কে বসে আছে৷ তার মাথায় শুধু ঘুরছে শাহওয়াজ এর বলা কথাটা “রুম্মন চৌধুরীর একমাত্র কন্যা৷”
ময়ূরাক্ষী রুম্মন চৌধুরীর মেয়ে? তার মানে রুম্মন চৌধুরীর আগে বিয়ে হয়েছিলো? আর ওই প্রিয়দর্শিনীই তার স্ত্রী ছিলো? তাহলে এত দিন সে ধোয়াশার মাঝে ছিলো? মিথ্যের মাঝে ছিলো? এ জন্যই রুম্মন তাকে কখনো ভালোবাসেনি? এ জন্যই রুম্মন তাকে কখনো স্ব-ইচ্ছায় স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি?
তাহলে এত লুকোচুরি কেন? কোথায় ময়ূরাক্ষীর মা? আর ময়ূরাক্ষীকে কেনই বা আশ্রিতা হিসেবে রাখা হয়েছিলো? রুম্মন কি জানতো এ কথা? না দেখে তো মনে হচ্ছে তার সন্তানের কথা সেই জানতো না৷ কিন্তু কেন?

আকবর চৌধুরী বের হতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো রুম্মন শাহওয়াজ এর কেবিনে আজ সাহস নিয়ে মনিরাও ঢুকলো৷ আজ হওয়ার হবে এখান থেকে সে যাবে না৷ মনিরাকে দেখে রুম্মন কিছু বললো না৷ ওর ও জানা দরকার ওকেও তো ঠকিয়েছে সে৷
শাহওয়াজ এর বেশ ক্লান্ত লাগছে তবুও অনিচ্ছাকৃত সব টা জানাতে হলো রুম্মন চৌধুরীকে৷ আশ্চর্য হয়ে বসে রইলো সে৷
তার মেয়ে তার সামনেই ছিলো অথচ পিতৃ স্নেহ দিতে পারেনি কখনো খারাপ ব্যাবহার করে গেছে৷ ওই আইসিইউতে পরে থাকা মেয়েটাই তার অস্তিত্ব৷ টুপ টুপ করে গড়িয়ে পরলো কয়েক ফোটা পানি চোখ থেকে বললো,
“প্রিয় কোথায় শাহওয়াজ?”
শাহওয়াজ ততপ শ্বাস টেনে বললো,
“জানি না মেঝোবাবা, কিছুতো রহস্য আছে৷ হয়তো আপনার ভাই কিছু জানে বলতে চাইছে না৷ আপনার মা ও হয়তো জানে৷”
থমথমে হয়ে বসে রইলো রুম্মন চৌধুরী হুট করেই কি যেন হলো শাহওয়াজ এর সামনে মিনারার হাত আঁকড়ে ধরলো ভা’ঙা কন্ঠে বললো,
“আমারে মাফ করে দাও মিনারা আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করছি৷ অনেক কিছু লুকানোও হয়েছেএর জন্য আমি শাস্তি পেয়েছিও মেয়েকে সামনে দেখেও চিনিনি৷ জানতাম আমার সন্তান মৃ’ত৷ দয়া করে আমার উপর থাকা ক্ষোভ এর জন্য আমার মেয়েকে অভিশাপ দিও না৷ ওরে যে এখনো আমি আদর করতে পারিনাই৷”

মিনারা আঁতকে উঠলো৷ সত্যি এসব শোনার পর তার রাগ হচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে৷ কিন্তু ওইটুকুনি মেয়েকে সে কি করে অভিশাপ দিবে? লোকটা কি পাগল? মিনারা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“আমারে কি তোমার মায়ের মত ভাবছো? না গো এত নিষ্ঠুর নই আমি৷ওইটুকুনি মেয়েকে আমি কেন অভিশাপ দিবো?
কিন্তু সব কিছুর মাঝেও আফসোস হয় জানো এত কিছুর মাঝে আমার দোষ টা ছিলো কি? আমার কাছে সব কেন লুকানো হয়েছে? আমার জীবন টাকে কেন নষ্ট করা হয়েছে?”

রুম্মন চৌধুরী নিষ্পলকে তাকিয়ে রইলো কি বলবে সে? সে তো বিয়েই করতে চায়নি৷ ভাই জোর করে করিয়েছে বলতেও বারণ করা হয়েছে৷
রুম্মন চৌধুরীর ভাবনার ঘোর কাটলো হুট করেই মেয়ের চিন্তা ভর করলো চিন্তিত হয়ে বললো,
“মেয়েটা ঠিক হবেতো শাহওয়াজ?”
শাহওয়াজ অনিমেষে চেয়ে রইলো৷ মৌনতা গ্রাস করলো৷ সে জানে না কিছু জানে না৷ রুম্মন চৌধুরীর পুরুষালি মন দূর্বল হলো৷ শক্তপোক্ত মানুষটাও কান্নারত হয়ে তাকিয়ে রইলো৷
রুম্মন মিনারা উঠে বেরিয়ে গেলো উত্তর না পেয়ে শাহওয়াজ ক্লান্ত মনে ঠায় বসে রইলো৷ এর মাঝেই কাণে এলো রুম্মনকে বলা মিনারার অদ্ভুত এক আবদার,
“আপনার মেয়ে টা কে আমায় দিবেন?আমি বুকে আগলে রাখবো কথা দিচ্ছি৷”
তাচ্ছিল্য হাসলো শাহওয়াজ৷ এখন এসব মায়া দেখিয়ে লাভ কি? মানুষ আসলেই স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না৷

..
দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর পর এ গ্রামে পা রাখলো শাহনাজ মধুলতা, দৃষ্টিপটে ভেসে উঠলো কতশত স্মৃতি৷ কালো গাড়িটা থেকে নামতেই আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত এক মুখের সাথে পরিচয়৷ যে মধুলতাকে দেখেই ঝাপটে এসে জড়িয়ে ধরলো৷ হতভম্ব হয়ে রইলো কিছুসময়৷

চলবে,

[আপনাদের অনুরোধে এত ব্যাস্ততার মাঝেও আজ দিলাম৷ সত্যি আমি প্রচুর ব্যাস্ত আপনারা কেন এত রেগে যান? আমি চাই রেগুলার দিতে ব্যাস্ততায় এক দিন গ্যাপ দেই৷ আশাকরি গঠনমূলক মন্তব্য করে আমার খুশি করে দিবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here