#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
ঊনচল্লিশ
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আছে খোদেজা৷ মানুষ বলে না অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর? খোদেজা কেমন পাথর হয়ে রইলো৷ হকবাক, হতভম্ব, বিমূঢ় সে৷ এ কি সেই জোবেদা যাকে সব টা নিয়ে মানুষ করেছে সে?
এটা কি সেই জোবেদা যার জন্য নিকৃষ্ট পাপ করতেও হাত কাঁপেনি?
তার ছোট্ট জোবেদা তাকেই আজ মে’রে ফেলতে চাইছে?
চোখে মুখে নেই কোনো ক্লেসের ছাপ৷ শুধু এক রাশ হিংস্রতা আর হিংস্রতা৷
খোদেজা চায় না পাপ নিয়ে ম’রতে সে চেষ্টা চালালো চোখ খুলে রাখার তবুও যেন বারংবার বন্ধ হয়ে আসছে৷
আকষ্মিক এক কান্ড ঘটলো,কক্ষে প্রবেশ করলো কেউ৷ জোবেদা বুঝে উঠার আগেই চুলে টান খেলো৷ হুট করেই কেউ চুল ধরে ছিটকে সরালো জোবেদা কে৷
ভরকালো কেমন আঁতকে উঠলো৷ মানুষ টি কে দেখে হাত পায়ে কম্পন ধরলো৷
মধুলতা দাঁড়িয়ে আছে৷ পিছনে আছে আকবর৷ ভয়ার্ত নয়নে তাকালো৷ এবার কি করবে সে? পালাবার তো পথ নেই৷
“কি করছেন খালা এসব? আম্মা কে খু’ন করতে চাইছেন আপনি?”
আকবর এর ব’জ্র কন্ঠে জোবেদা কেঁপে উঠলো৷ মস্তিষ্ক শূন্য তার৷ ভেবে পায় না কি করবে৷ কেলেংকারী ঘটে গেছেতো৷
রাবেয়া ছুটে এসে শাশুড়ী কে পানি দিলো৷ হাত পায়ে মালিশ করতে করতে বললো,
“আম্মা, ঠিক আছেন আপনি? কি হয়েছে? খালা আপনাকে মা’রতে চাইছে কেন?”
খোদেজা ফস করে নিশ্বাস ছাড়লো৷ স্বস্তি পেলো যেন৷ মনে হচ্ছিলো এখনি জান টা যাবে৷
মধুলতা শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে এখান দিয়েই ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলো হুট করেই খোদেজার চিৎকার শুনে ছুটে আসে৷ মধুলতার ছুটে আসা দেখে আকবর আর রাবেয়া ও আসে৷
আকবর চৌধুরীর বুকটা কেঁপে উঠলো মধুলতা না থাকলেতো যা তা হয়ে যেতো৷
কিন্তু হুট করেই কি হলো? আনমনে বললো সে,
“মধুলতা না দেখলে তো কেলেংকারী হয়ে যেতো৷ কি হইছে আম্মা? বলেন আমায়৷”
খোদেজা কোমল চোখে মধুলতার পানে তাকালো, অথচ এই মেয়েটাকে কত কিছু করেছে সে৷সংসার ছাড়া করেছে৷ আর এই আকবর কে তো নিঃসঙ্গ করে দিতে চেয়েছিলো৷ আজ এই ছেলেই তার জন্য মায়া দেখাচ্ছে৷ শুধু কি আজ? বরং বরাবরি এই ছেলে তাকে মাথায় তুলে রেখেছে৷
আকবর চৌধুরী ফের হুংকার তুলে বললো,
“আপনার সাহস দেখে আমি হতবাক খালা৷ আপনি কি চাইছেন বলেন তো?”
জোবেদা শুকনো ঢোক গিললো৷ মধুলতা হাসলো ক্ষানিকটা বললো,
“কি হলো ব্যাপার টা আম্মা? আপনার প্রাণ প্রিয় বোন যে আপনার ডান হাত সে কি না আপনাকে মা’রতে চাইছে? ভাবা যায় এখানে এসে এমন দৃশ্য দেখতে পাবো বুঝতেই পারিনি৷ ”
খোদেজা গভীর ভাবে ভাবলো কিছু৷ অতঃপর খোদেজা এবার রাবেয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
“আমারে উঠতে সাহায্য কর তো মা৷ ”
রাবেয়া উঠতে সাহায্য করলো খোদেজা কে৷ মধুলতা একবার সে দিকে তাকিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে এখান থেকে প্রস্থান করতে চাইলো৷ তার আগেই ডাক পরলো তার খোদেজা বললো,
“শাহনাজ আমার তোমার সাথে কথা আছে৷ ”
মধুলতা যেতে নিয়েও থামলো৷ মনে পরলো মহিলা তাকে বিয়ের আগে থেকেই শাহনাজ বলে ডাকতো৷ এখন আবার এত আদিক্ষেতা কিসের?
মধুলতা কিছু বলবে তার আগেই জোবেদা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“বুবু তুই আমারে কথা দিছিলি৷ ঠিক করতাছিস না এসব৷”
খোদেজা তাচ্ছিল্য হাসলো৷ মধুলতাকে ইশারা করে তার পাশে বসতে বললো৷ মধুলতার কৌতুহলতা বাড়লো মনে হচ্ছে মহিলা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে নয়তো তার প্রাণ প্রিয় বোন এত ভয় পাচ্ছে কেন? হুট করেই কি হলো দু-জনের মাঝে যে একজন আরেকজন কে খু’ন করতে চাইছে৷ বেশ ভাবার বিষয়৷
মধুলতা বসলো পাশে গিয়ে, আকবর চৌধুরী ও এগোতে নিলেই জোবেদা পালাবার ফন্দি আঁটে আকবর ধরে ফেলে বলে,
“খালা আপনি নিকৃষ্ট হলেও আপনার সাথে আমি নিকৃষ্টের মত কাজ করতে চাই না৷ আশাকরি পালানোর চেষ্টা করবেন না৷ আর পালালেও বিশেষ লাভ হবে না নিচে পুলিশ রয়েছে আপনি বের হওয়ার আগেই ধরে ফেলবে৷”
জোবেদা নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ খোদেজা এবার বলা শুরু করলো,
“আকবর আমার নারি ছেড়া ধ্বন না তাই ওরে কখনো আমি মন থেইকা ভালোবাসতাম না, ওরে বোঝাইতাম শুধু ওরে আমি ভালোবাসি৷ ওরে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যায় সব সময় আমার মাথায় এইটা চলতো৷ আমার স্বামী যখন মা’রা গেলো তখন আমার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পরলো তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চিন্তাই পইরা গেলাম৷ রাজত্য যে সব আকবর এর নামে ও কি দিবো ওর সৎভাই বোনরে?
তখন জোবেদা বুঝাইলো আকবররে আমার অন্ধ ভক্ত বানাইতে হইবো তারপর এমন পরিস্থিতি করতে হইবো ও যেন নিঃসঙ্গ হইয়া যায়৷ ওর তোমার সাথে বিয়ার মত ছিলো না আমার, আমি চাইতাম আকবর এর জন্য আমার বোনের মাইয়া রাবেয়ারে আনতে তাহলে আমার দল টা শক্ত হইবো এ বুদ্ধিটাও জোবেদার ছিলো৷ কিন্তু আকবর তোমায় বিয়া করে৷
বিয়ার পর ভাবছি এইবার বুঝি কিছু করা যাইবো না কিন্তু আশার আলো পাইছি তোমাদের বিয়ার ছয় বছর পর! দারোয়ান আমাদের সাহায্য করছে৷ দারোয়ানের ঘরের পিছনে দর্শনার সাথে কথা বলতাছিলা তখনি চাইছিলাম তারাইতে৷ আকবর ও বাড়ি ছিলোনা৷ কিন্তু বিশেষ লাভ হয় নাই আকবর বিশ্বাসী করে নাই৷ সে বার বাচ্চা টা ও নষ্ট হইছে ডাক্তার কে হাত কইরা বলাইলাম তোমার আর বাচ্চা হইবো না৷ এসব করার পর ও আকবর তোমারে ছাড়তে নারাজ আছিলো৷
এর মাঝেই আমার পোলা রুম্মন তোমার ওই হিন্দু বন্ধুবির পিছনে লাগে৷ রুম্মন আমার পোলা আছিলো তাই চিন্তা ও বেশি আছিলো কোনো কিছুতেই ও মাইয়াটারে ছাড়তে রাজি আছিলো না৷
সে বছরই তোমারে তারাইতে আমরা সক্ষম হই একদিন বোনের বাড়ি চলে যাই আর আসবোনা বলে আকবর তখন ও গলে নাই বিয়া করতে রাজি ছিলো না৷ চলে যাওয়ার পর জোর করে সে বাড়িতে অসুস্থের নাম কইরা নিয়ে যাই ওইখানে ওরে বিয়ে দেই রাবেয়ার সাথে৷ আমি ভাবছিলাম রাবেয়া আমাদের কথা শুনবো তুমি চইলা যাওয়ার পর ভাবছি আকবর নিঃসঙ্গ হইয়া পরবো তখন কৌশলে এই রাজত্য আমার নামে লেইখা নিমু৷
কিন্তু রাবেয়া কখনো আমার পক্ষে ছিলো না, এর মাঝেই রুম্মন ওর মাইয়ারে বিয়ে করে৷ ভাইঙা পরি আমি৷
রুম্মন আমার পোলা আছিলো তাই আমি চাইতাম না ও এমন মাইয়ারে বিয়া করুক৷ ওরা গ্রাম ও ছাড়ে৷ রুম্মন বিয়ে করার পর জোবেদার মাইয়া আত্ম’হ’ত্যা করে৷ রুম্মন রে জোবেদার মাইয়া ভালোবাসতো, রুম্মনের বউ নিয়া রুম্মন যখন আবার আসে এখানে তখন দর্শনার এলাকার মোরলরে দিয়া আমিই মাইর খাওয়াই৷
আমি এতটাই নিচে নাইমা গেছিলাম তখন কবিরাজ রে দিয়া কালো জাদু ও করাইছি৷ দর্শনারে খু’ন করার কথাও ভাবতাছিলাম৷ আমার মাথায় এ কথাটা ঢুকায় দেয় জোবেদা নিজেই এর আগেই দর্শনা পালায় বাচ্চা হয়৷ আবার ওই মাইয়াই হয় পোলা হইলে আমি সত্যি মাইনা নিতাম৷
পোলা হইলেতো সব সম্পত্তি রুম্মনের পোলাই পাইতো৷ আকবর রে দিয়ে বলাই দর্শনা আর সে বাড়ি ঢুকতে পারবে না৷ কিন্তু কিছুদিন পরই বাচ্চা নিয়া আসে দর্শনা, ওই বাচ্চারে নিয়া ও ওর বাড়িতে থাকতে পারতাছিলো না৷ কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না আকবর বলে আশ্রিতা হিসেবে রাখবে৷
ওর আসল পরিচয় কেউ জানবে না৷
জোবেদা আকবর রে শিখায় দিলো মানুষ রে যেন বলে রুম্মন এর মৃত বাচ্চা হইছে আর দর্শনা পালাইছে৷ আকবর বাচ্চাটারে রাখার জন্য রাজি হয়৷
কিন্তু সেই দিনি যে দর্শনার শেষ দিন ছিলো৷ বিশ্বাস করো বউমা দর্শনা চইলা যাইবো শুইনা আমি খু’ন করার কথা মাথাতেও আনি নাই৷
কিন্তু ওই জোবেদা মাইয়াডারে মাইরা ফালাইছে৷ ও বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ওরে বলছে পুকুরপাড় রুম্মন বইসা আছে৷ পুকুরপার আগ্রহ নিয়া যায় মাইয়াটা গেছিলো জোবেদা নিজের মাইয়ার প্রতিশোধ নিতে আমার কথাও শুনে নাই আমারে ঘরে আটকায়া ও পুকুরপাড় গেছে মাথায় আঘাত কইরা পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলছে৷ খু’ন করছে ময়ূরাক্ষীর মা রে৷”
বলতে বলতেই ঢুকরে উঠে খোদেজা৷ জোবেদা কাচুমাচু খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ শেষ রক্ষা আর হলোনা বুবু বলেই দিলো৷ আক্রোশে ফেটে পরছে জোবেদা ওর ভুল হয়েছে প্রমান মেটানোর জন্য এই মহিলারেও মে’রে ফেলা উচিত ছিলো৷
এখানে থাকা সবাই বিস্মিত৷ মধুলতা পাথরের ন্যায় বসে রইলো৷ মাথা কাজ করছে না তার৷ বেশ কিছুক্ষণ বসে তপ্ত শ্বাস নিয়ে উঠলো৷ আকবর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাতে দাত পিষে বললো,
“আপনি কি এই মহিলাকে নিয়ে যেতে পুলিশ ডাকবেন? নাকি আরেকটা খু’ন হবে এখানে?”
..
তিন ঘন্টা হলো অপরেশন থিয়েটারে আছে শাহওয়াজ৷ মনের জোর না থাকলেও হাত চলছে৷ শরীর এর জোরে কাজ করে চলেছে৷ এ রোগীর বেঁচে থাকার উছিলা এখন সে, সৃষ্টি কর্তা তাকে উছিলা হিসেবে রেখেছে এবং সে সৃষ্টিকর্তা ইশারায় কাজ করছে৷ আর তার ভালো থাকার কারণ আরেকটা অপরেশন থিয়েটারে, এটাও সৃষ্টিকর্তার হাতে৷ মেয়েটার কি অবস্থা সে জানে না৷ সৃষ্টিকর্তা কি চায় সে জানে না৷
এ ও জানেনা সে ডাক্তার উছিলায় সব কিছু ঠিক হবে কি না৷ সৃষ্টিকর্তা সব আগের মত দিবেনা? প্রেয়সীর সে চঞ্চল দৃষ্টির আর দেখা পাবে না?
চোখ ঝাপসা হলো শাহওয়াজ এর৷ নিজেকে সামলে নিলো, হাত চালালো৷ দীর্ঘ সারে তিন ঘন্টা পর কৃত্রিম হাসি মুখে বের হলো অপরেশন থিয়েটার থেকে৷ রোগীর আপনজন দের কৌতুহল আর এক বুক আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো বেরিয়েই বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ, অপরেশন সাকসেসফুল৷”
অতঃপর কোনো মত পা চালিয়ে ছুটলো সে ও এক বুক আশা নিয়ে৷ সে যেতেই দেখলো ডাক্তার অবজারভেশন রুম থেকে বের হচ্ছে৷ শাহওয়াজ কে দেখে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে হিন্দিতে বললো,
” অপরেশন সাকসেসফুল আশাকরছি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে যাবে৷ মাথায় আঘা’ত পেয়েছেতো একটু সময় লাগবে৷ তবে এ পর্যারে রোগীদের জ্ঞান ফেরার পর অনেক সমস্যা হয় প্যারালাইজড হওয়ার ও সম্ভাবনা থাকে৷ দোয়া করতে থাকো৷”
চলবে,