গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:4
পাঁচটা দিন আরও কেটে গেছে…অনামিকা প্রান্তিকের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ এখনও খুঁজে চলেছে…প্রান্তিক যখন অফিসে থাকে অনামিকা তখন সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায় এই ভেবে যে সে যদি এখান থেকে বেরোনোর পথ পেয়ে যায়…এখন পড়ন্ত বিকাল…ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিকালের ঝোড়ো হাওয়া উপভোগ করছিলো অনামিকা…তখনই পম্পা আসে ছাদে…
— “ম্যাডাম নিচে কেউ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, বলছে নাকি খুব দরকার…আপনি কি একবার কথা বলবেন লোকটার সাথে??”
— “আমি কথা বলবো?? কিন্তু ওনার পার্সোনাল….”
— “স্যার তো এক্ষুনি চলে আসবেন,আমি কি তাহলে লোকটাকে আউটহাউসে নিয়ে গিয়ে বসাবো??”
— “নাম জিজ্ঞাসা করেছো লোকটার??”
— “হ্যাঁ বললো প্রীতম সেন…”
নামটা শুনে চমকে উঠলো অনামিকা…এটা কি ওর চেনা সেই প্রীতমই…আর একমুহুর্তও দাঁড়ালোনা ও ছাদে….ছুটে নিচে নেমে এলো….প্রধান দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে একজন পিছন করে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটির সাথে কথাকাটাকাটি করছে….বুকের মধ্যে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেলো ওর…
— “ক…কি হচ্ছে এখানে??”
অজ্ঞাত লোকটা সহ সমস্ত সিকিউরিটি ঘুড়ে দাঁড়ালো…চমকে উঠলো অনামিকা লোকটাকে দেখে…এটা সত্যিই প্রীতম…খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো ও…একজন সিকিউরিটি এগিয়ে এলো ওর কাছে…
— “আপনি কেনো বাইরে বেরিয়ে এলেন ম্যাডাম,স্যার জানতে পারলে খুব রাগ করবেন…আপনি ভিতরে যান…আমরা এদিকটা সামলে নিচ্ছি…”
— “ওনাকে ভিতরে আসতে বলুন…”
ড্রয়িং রুমে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে প্রীতম আর অনামিকা…অনামিকার চোখে আনন্দের অশ্রু… প্রীতমের চোখে ভয়…অনামিকা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রীতমকে…
— “আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো প্রীতম…প্লীজ আমাকে নিয়ে চলো…আমি গত ছয়দিন যাবত এখানে আটকে আছি, আমাকে ওই প্রান্তিকের থেকে অনেক দূরে পালিয়ে নিয়ে চলো প্লীজ…”
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে প্রীতম…এখানে এসে অনুশোচনা করছে ও…কারণ ও জানে ও যদি এখন কোনো চালাকি করে প্রান্তিক ওকে মেরে ফেলবে…অনামিকা প্রীতমের বুক থেকে মাথা তুললো….
— “আমাকে তোমার ফোনটা দাও প্রীতম, আমি বাবাকে ফোন করবো…যাতে খুব তাড়াতাড়ি এখানে পুলিশ নিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়…প্রান্তিক আসার আগে আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে…প্লীজ চলো…”
প্রীতম অনামিকার হাত দুটো নিজের শরীর থেকে সরিয়ে দিলো…অনামিকা অবাক চোখে তাকালো প্রীতমের দিকে…
— “প্রান্তিক স্যার কোথায় অনু??”
— “তুমি প্রান্তিককে চিনলে কি করে?? আর ওনার সাথেই বা তোমার কি দরকার প্রীতম??”
— “সেটা আমি প্রান্তিক স্যারকেই বলবো, তোমাকে বলার কোনো প্রয়োজন বোধ করছিনা…”
অনামিকা প্রান্তিকের দুই বাহু চেপে ধরলো…
— “প্রীতম আমি তোমাকে ভালোবাসি, আগামী বছর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা..”
প্রীতম অনামিকার হাতদুটো ঝিনকে ফেলে একটু দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো…
— “যেই মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় একটা অবিবাহিত ছেলের সাথে ছয়টা রাত কাটিয়েছে এরপর সে বাড়ি ফিরে গেলেও তাকে আমি বিয়ে করবো এটা তুমি কি করে ভাবলে অনু??
— “এসব তুমি কি বলছো প্রীতম?? বিশ্বাস করো আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হয়নি…আমি এখনও তোমারই আছি…”
— “একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর একটা নারী একশো পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টারও বেশি একসঙ্গে আছে,আর তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হয়নি সেটা আমাকে মানতে হবে??”
— “তুমি বিশ্বাস করো প্রী….”
— “কি হচ্ছে এখানে?? আর প্রীতম তুমি এখানে কেনো এসেছো…”
প্রান্তিককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে প্রীতম এগিয়ে গেলো তার কাছে…অনামিকা পাথরের মূর্তির মত শুধু চেয়ে রইলো প্রীতমের দিকে…প্রান্তিক আরচোখে অনামিকাকে দেখে আবার প্রীতমের দিকে তাকালো…
— “তুমি এখানে কি করছিলে??”
— “স্যার আপনিই তো একটু আগে আমাকে ফোন করে আসতে বললেন…”
— “ওহ হ্যাঁ খেয়াল ছিলোনা, তুমি একটু এখানে বসো…আমি চেঞ্জ করে আসছি…”
প্রান্তিক প্রীতমকে বসতে বলে অনামিকার কাছে গিয়ে হাতটা ধরলো ওর…কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা অনামিকার মধ্যে…
— “কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবেনা অনামিকা, ওপরে চলো..”
প্রান্তিক অনামিকার হাত ধরে ওপরে যেতে লাগলো…অনামিকা পিছন ঘুরে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে প্রীতমের দিকে…চোখ দিয়ে অবাধ্য জলরাশি গুলো না চাইতেই গড়িয়ে পড়ছে ওর…
.
.
নিজের রুমে হাঁটু মুড়ে কাঁদছে অনামিকা…পাঁচদিন আগে প্রান্তিকের বলা কথাগুলো ওর বড্ড মনে পড়ছে…তারমানে সত্যিই প্রীতম প্রান্তিককে সাহায্য করেছে…
— “আসতে পারি??”
অনামিকা মুখ তুলে তাকাতেই প্রান্তিককে দেখতে পেলো…চোখের জলটা মুছে নিলো ও সঙ্গে সঙ্গে…
–“ এখন আর কেঁদে কি হবে অনামিকা, প্রীতমকে জীবন থেকে মুছে ফেলো..”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো অনামিকা প্রান্তিকের দিকে…
— “এইসব আপনার চাল তাইনা?? আপনিই প্রীতমকে ভুল বুঝিয়েছেন … আপনি ওর ব্রেন ওয়াশ করেছেন…”
প্রান্তিক তির্যকভাবে হাসলো…
— “তুমি খুব বোকা অনামিকা…খুব বোকা…”
অনামিকা বিছানা থেকে উঠে এসে প্রান্তিকের শার্টের কলার চেপে ধরলো…
— “কেনো করছেন আপনি আমার সাথে এমন?? আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার?? আপনি তো জানতেন আমি প্রীতমকে ভালবাসি…গত তিন বছর ধরে একটা সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখছি…কেনো সেটা এভাবে ভেঙে দিলেন আপনি প্রান্তিক? কেনো?? কি পাচ্ছেন এগুলো করে??”
প্রান্তিক উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে…
— “যে তোমার বিনিময়ে দশ লাখ টাকার ডিল করে আমার সঙ্গে, সে তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে অনামিকা?? আমাকে দোষ দেওয়ার আগে ব্রেন ওয়াশ আর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখো…যাইহোক তোমাকে আমি এত কথা কেনো বলছি..রেডী হও ডক্টরের কাছে যাবো…”
— “ডক্টরের কাছে কেনো যাবো ? আমার তো কিছু হয়নি..”
— “কলকাতার সেরা গাইনোকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি, যত দেরি করবো আমার বেবি আসতে তত দেরি করবে… তাই এখন থেকেই ডক্টরের সঙ্গে কনসাল্ট করে নেওয়া ভালো…”
অনামিকা প্রান্তিকের জামার কলার ছেড়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো…
— “আমি কোথাও যাবোনা,কোনো বেবি আসবেনা…”
প্রান্তিকের খুব রাগ হলো…
— “জেদ করোনা অনামিকা,তোমার বাবা কিন্তু খুব অসুস্থ..যেই ডক্টর ওনার ট্রিটমেন্ট করছেন তিনি কিন্তু আমার একটা কথায় তোমার বাবাকে ভুল ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে পারে…”
আঁতকে উঠলো অনামিকা, ওর বাবার শরীর খারাপ..নিশ্চই ওর জন্য চিন্তা করে করে এইসব হয়েছে…
— “আমি যাবো ডক্টরের কাছে, তবে বাবার যিনি ট্রিটমেন্ট করছেন তাকে বলুন যেনো বাবাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেয়…”
বিজয়ের হাসি হাসলো প্রান্তিক…
— “রেডী হয়ে নিচে এসো, আমি গাড়িতে ওয়েট করছি…”
প্রান্তিক অনামিকার রুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসে….সোফায় বসে কাউকে একজনকে ফোন করে…
— “এখন কেমন আছে ও,আগের থেকে কিছুটা ইমপ্রুভ করেছে??”
ওপর প্রান্ত থেকে একটা ভারী পুরুষ কণ্ঠ বলে ওঠে…
— “না প্রান্তিক, কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই..আগের মতই আছে…আমার মনে হচ্ছেনা ও আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে…”
— “ওকে তো উঠে দাঁড়াতেই হবে ডক্টর, আমার জন্য ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে…ওর এই অবস্থার জন্য যে বা যারা দায়ী তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে…”
ওপর প্রান্তের মানুষটা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো…
— “এই উইকে তুমি একদিনও আসোনি, সময় করে একদিন এসো…আমি বুঝতে পারি ও এদিক ওদিক চেয়ে শুধু তোমাকেই খোঁজে…”
— “আমি দু একদিনের মধ্যেই আসবো ডক্টর, ওকে বলে দিও আমি আসবো…”
.
.
গাড়ি থেকে নেমে চমকে ওঠে অনামিকা…এদিক ওদিক চেয়ে বুঝতে পারে প্রান্তিক ওকে ভুল বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে…
— “আপনি আমাকে এয়ারপোর্টে কেনো নিয়ে এসেছেন?? আমি কোথাও যাবনা ”
অনামিকা এয়ারপোর্টের পার্কিং এরিয়া থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে গেলে প্রান্তিক ওকে চেপে ধরে…
— “একদম বাড়াবাড়ি করবেনা, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে…”
অনামিকা খুব ভেঙে পড়ে,এতদিন একসাথে না থাকলেও পরিবারের অনেক কাছে ছিলো ও,কিন্তু প্রান্তিক এবার ওকে সবার থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইছে…
— “আমি কলকাতা ছেড়ে যাবো না প্রান্তিক,আপনি আমাকে আটকে রাখুন,মারুন ,ধরুন তবুও এখানেই রাখুন…আমি আমার পরিবারের থেকে দূরে যাবনা…একমিনিট আপনি আমার পাসপোর্ট পেলেন কোথায়??”
— “প্রীতম দিয়েছে, যাইহোক চলো… চেকিং করতে টাইম লাগবে ..এক ঘন্টা পর আমাদের ফ্লাইট… আর হ্যাঁ বেশি চালাকি করতে যাবেনা, এইমুহুর্তে তোমার বৌদি আর ভাইপো রাস্তায় আছে…বাবারবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে তারা…”
অনামিকা চুপ করে গেলো, ওর দুর্বল জায়গায় বারবার আঘাত হানে এই লোকটা…
— “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে সেটা জানতে পারি??”
— “অস্ট্রেলিয়া”
অনামিকার মুখে কিছুক্ষনের জন্য এক অন্যরকম আনন্দ দেখা যায়…অস্ট্রেলিয়া হলো অনামিকার ড্রিমপ্লেস,ওখানে যাবে ও…তবে যে এভাবে ওর স্বপ্নপূরণ হবে ভাবেনি…একজন বন্দিনীর মতো দেশ ছাড়তে হচ্ছে ওকে…
— “এসো আমার সঙ্গে…”
প্রান্তিক অনামিকার হাত ধরলো…পিছনে প্রান্তিকের দুজন লোক ওদের লাগেজ গুলো বয়ে নিয়ে এলো গেট অবধি…তারপর প্রান্তিক ওদের টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো…ওরা দুজনেই এগিয়ে গেলো বাকিটা পথ…
সমস্ত চেকিং কমপ্লিট করে ওরা গিয়ে বসলো কলকাতা থেকে দিল্লিগামী একটা প্লেনে… এখান থেকে দিল্লি তারপর ওখান থেকে সোজা অস্ট্রেলিয়া…শুধুমাত্র পরিবারকে বাঁচাতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনামিকা একটা অচেনা ,অজানা মানুষের সঙ্গে পাড়ি দিলো এক অজানার পথে…নিজের আপনজনদের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে সে…নিজের জীবনটাই যেনো ও প্রান্তিকের হাতে তুলে দিয়েছে…একটা পুতুলের মত বাঁচবে ও…যে যেমনভাবে খেলতে চাইবে ওকে সেভাবেই খেলা দেখাতে হবে…কলকাতা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনামিকার চোখ ভারী হয়ে উঠলো..প্লেনের জানালা দিয়ে একবার নিজের শহর ,নিজের জন্মস্থানকে শেষবারের মত দেখে নিলো ও…হয়তো আর কোনোদিন এখানে আসা হবেনা ওর…
(কাল তোমাদের মন্তব্যে আমি অনেক এনার্জি পেয়ে গেছি ,তাই তাড়াতাড়ি লিখে ফেলেছি এই পর্বটা, এবার তোমরা আবারও বড়ো বড়ো কমেন্ট করে আমাকে আরও এনার্জি দাও দেখি…)