গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:3
রুমে বসে ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে অনামিকা…বাবা মার কথা ওর খুব মনে পড়ছে…
— “আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা, আমি তোমার সম্মান হয়তো বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না, আমি নিরূপায় আমাকে ভুল বুঝোনা…আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালবাসি…চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি হয়ে গেলো তোমাদের ছাড়া আছি, না জানি তোমরা এখন কতটা চিন্তা করছো আমার জন্য…”
ছোট্ট ভাইপোর কথা মনে আসতেই কান্নার গতি আরও বাড়লো অনামিকার…কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাওয়ার উপায় হয়…তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়লো…একপর্যায়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেলো জানতেও পারলোনা ও…
দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো অনামিকার…চোখ মুখ কুঁচকে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে ও…পরক্ষণেই বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো…জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে…অনামিকা বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলে একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখতে পেলো…
— “আপনি কে?? কালকে তো আপনাকে দেখিনি..”
— “ম্যাডাম আমি এই বাড়িতে কাজ করি, কাল আমার বরের শরীরটা খারাপ থাকায় কাল আসিনি…”
— “এখানে কেনো এসেছেন?? আমার কাছে আপনার কি কাজ?? নাকি আপনার স্যার বললেন আমাকে দিয়ে আজ বাড়ির সব কাজ করানোর জন্য…”
কাজের মহিলাটা নিজের নাক কান মুলে জিভ বার করলো…
— “এসব কথা মুখে আনাও পাপ, আপনি তো আমাকে হুকুম করবেন..যখন যেটা বলবেন সেটাই পৌঁছে যাবে আপনার কাছে…”
অনামিকা খুব বিরক্ত হলো এই কথাগুলো শুনে…সকাল সকাল মেজাজটাই বিগড়ে গেলো..
— “আপনি যান,এখন আমার কিছু প্রয়োজন নেই…”
— “কিন্তু ম্যাডাম স্যার যে বললেন আপনি সারারাত কিছু খাননি, তাই আপনাকে ডেকে নিয়ে ডাইনিং রুমে যেতে বললেন…”
প্রান্তিকের প্রসঙ্গ উঠতেই কালকের কথা মনে পড়ে গেলো ওর…রুম থেকে বেরিয়ে গটগট করে চলে গেলো…
প্রান্তিক ডাইনিং টেবিলে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো…অনামিকাকে খুব জোড়ে আসতে দেখে প্রান্তিক আরচোখে তাকালো ওর দিকে…অনামিকা এসে প্রান্তিকের কাছে দাঁড়ালো…
— “কেনো আটকে রেখেছেন আপনি আমাকে?? আমি এভাবে থাকতে পারিনা…আমার খুব অস্থির লাগছে… বনের পাখিকে বন্দী করলে যেমন লাগে আমার ঠিক তেমনই কষ্ট হচ্ছে…”
— “ এই বাড়িটা অনেকটা বড়ো, যখন মন চাইবে যেখানে ইচ্ছে যাবে…বাইরে সুইমিং পুল,বাগান সব আছে… একঘেঁয়ে লাগলে ঘুরতে যাবে, তবে হ্যাঁ একদম চালাকি করার চেষ্টা করবেনা…প্রায় কুড়ি জনেরও বেশি সিকিউরিটি আছে এখানে, তুমি চাইলেও পালাতে পারবেনা…”
অনামিকার প্ল্যান ফেল করায় মুখ বেজার হয়ে যায় ওর, পরক্ষণেই আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ও প্রান্তিককে…
— “আমার কিছু জিনিস লাগবে…”
— “কি লাগবে??”
— “আপনি আপনার কাজের মাসীকে পয়সা দিয়ে দিন,উনি এনে দেবেন আমাকে…”
প্রান্তিক মুহূর্তেই বুঝে গেলো অনামিকার কি লাগবে…অনামিকার থেকে চোখ সরিয়ে ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো আবার…
— “তোমার রুমে বেডের ডানদিকের ড্রয়ারটা খুললেই তোমার সব প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে যাবে,যদি আরও কিছু লাগে তাহলে একটা লিস্ট করে দিও…”
অনামিকা বাধ্য মেয়ের মত ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই প্রান্তিকের কথায় থমকে যায় ও…
— “তারমানে আগামী পাঁচদিনও তুমি আমার হাত থেকে বেঁচে গেলে??”
— “না সাতদিন”
অনামিকা প্রান্তিকের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা না করে সিঁড়ির কাছে চলে গেলো….প্রান্তিক পিছন থেকে বললো…
— “ পনেরো মিনিটের মধ্যে নিচে আসবে,কাল সারারাত কিছু খাওনি….তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার সন্তানেরও আসতে দেরি হবে,তাই এখন থেকে নিজের খেয়াল রাখো…”
অনামিকা চলে যাওয়ায় মিনিট পনেরো পর প্রান্তিক উঠে দাঁড়ায়…তৎক্ষণাৎ ফোনটা বেজে উঠলে ফোনটা রিসিভ করে ও…
— “আবার ফোন করেছো কেনো?? তোমার সব টাকা তো আমি দিয়ে দিয়েছি…”
— “একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের দাম মাত্র দশ টাকা লাখ হতে পারেনা স্যার, আমার আরও টাকা লাগবে…”
— “আমাদের মধ্যে তো প্রথমে দশ লাখেরই কথা হয়েছিলো…”
— “প্রথমে যাই কথা হোকনা কেনো, এখন আমার আরও পনেরো লাখ টাকা লাগবে…নইলে অতনু আঙ্কেলকে বলে দেবো তার মেয়ে আপনার কাছে আছে…”
প্রান্তিক মুহূর্তের মধ্যেই রেগে যায়…
— “প্রান্তিক মজুমদারকে ভয় দেখাচ্ছো তুমি??প্রান্তিক মজুমদার কাউকে ভয় পায়না, অতনু পালকে তো না’ ই…আর শোনো অনামিকা পাল এখন কাগজে কলমে প্রান্তিক মজুমদারের সম্পত্তি…কেউ চাইলেও তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবেনা…”
— “আমি ওটা বলতে চাইনি স্যার, আমার মা খুব অসুস্থ…দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে…দুজন কিডনি ডোনারও পাওয়া গেছে…শুধু টাকার জন্য অপারেশনটা থেকে আছে…”
— “হসপিটালের অ্যাড্রেসটা আমাকে মেল করো, তোমার মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব আমার…”
— “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার,আপনাকে অনেক ধন্যবাদ…”
প্রান্তিক ফোনটা কেটে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো…পিছনে ঘুরতেই অনামিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো ও…
— “এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিলে??”
অনামিকা প্রান্তিকের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো…
— “কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি??আমার বাবার সম্পর্কে কাকে কি বলছিলেন??”
— “যে তোমাকে পেতে সাহায্য করেছে আমায়…”
— “কে সে?? কে আমার এত বড় সর্বনাশটা করলো?? কে, নাম বলুন তার…”
প্রান্তিক নিজের ফোনটা আবার বের করে কল রেকর্ডিংটা চালু করলো…শেষের কথাটা ছাড়া সবটা শুনলো ও…
— “এই গলাটা আমি আগেও শুনেছি,এটা খুব চেনা স্বর আমার…”
— “এই গলা যার সে’ ই তোমাকে আমার কাছে পঁচিশ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে…”
অনামিকার খুব ঘৃনা হলো সেই লোকটার প্রতি…অনেক মনে করার চেষ্টা করে শেষমেশ বুঝতে যখন বুঝতে পারলো এটা কার গলার স্বর তখন যেনো ওর পৃথিবীটাই থমকে গেলো…
— “প্রী..প্রীতম??”
নামটা বলেই আবার নিজেকে সংশোধন করলো অনামিকা..
— “না না এটা প্রীতম হতেই পারেনা, এটা অন্য কেউ… বলুননা এটা কে??”
— “কেউ না, পেয়েছো জিনিসগুলো??”
— “হ্যাঁ, আপনি বলুন না এটা কে??”
— “আমাকে প্রশ্ন করার সাহস তোমাকে কে দিলো অনামিকা, চুপচাপ খেতে বসো আর নেক্সট টাইম আমাকে প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য দেখাবে না…”
অনামিকা আর কথা বাড়ালোনা,চুপচাপ গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লো..তবে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো ওর…এই প্রশ্নের উত্তর ওকে খুঁজতেই হবে….
প্রান্তিক বসলো অনামিকার মুখোমুখি…
— “পম্পা দি,আমাদের ব্রেকফাস্ট টা দিয়ে যাও…”
— “একটা রিকোয়েস্ট করবো??”
— “কি??”
— “আমি আমার বাবার সাথে একবার কথা বলতে চাই, আমার গুবলু বাড়ি পৌঁছেছে কিনা দেখতে চাই আমি…”
— “সেটা তুমি তোমার বাবাকে ফোন না করেই জানতে পারবে,তোমার বাড়ির সামনে অলরেডী আমার পাঁচজন লোক আছে,যারা তোমার বাড়ির প্রত্যেককে ফলো করছে…তুমি যদি একটু কিছু ভুল করো তাহলে তোমার ফ্যামিলি মেম্বার কমতে থাকবে…”
— “নাআআআআ আপনি ওদের কিছু করবেন না,আপনার সব কথা শুনবো আমি…শুধু ওদের কিছু করবেননা…”
— “গুড”
.
.
অনামিকা নিজের রুমে বসে বসে গল্পের বই পড়ছিলো, এগুলো প্রান্তিক ইচ্ছে করেই এখানে রেখেছে…এই সময় প্রান্তিক এলো ওর রুমে…অনামিকা প্রান্তিককে দেখে নিজেকে গুছিয়ে বসলো…
— “লাঞ্চে আমার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে, পম্পা দি বিরিয়ানি বানাতে পারেনা, এখন আমি অফিসে যাচ্ছি…ফিরে এসে বিরিয়ানি খাবো…রান্না টা করে রাখবে…”
— “কিন্তু আমি তো বিরিয়ানি বানাতে…”
অনামিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তিক বলে ….
— “পারো তুমি বিরিয়ানি বানাতে…তোমাকে গত ছয়মাস ধরে নজরে রেখেছি আমি ,তোমার সম্পর্কে সব জেনেই তোমাকে আমার কাছে এনেছি …বাধ্য মেয়ের মত যা বলবো তাই করবে…”
— “চিকেন না মটন??”
— “মটনে আমার অ্যালার্জি, চিকেন বিরিয়ানি করো…সঙ্গে চিলি পনির, চিকেন চাপ আর শেষে রায়তা…”
— “আমি কিন্তু বাকি এগুলোর রান্না জানিনা…”
— “ওগুলো পম্পা দি করবে, আর শোনো এখন থেকে প্রত্যেকদিন রাতে তুমি আমার সঙ্গে আমার রুমে থাকবে…”
আঁতকে উঠলো অনামিকা,এইসময়টাও কি প্রান্তিক ওকে ছাড়বেনা….
— “কিন্তু এখন তো আমার পি….”
— “আমার মর্জির মালিক আমি, আমার যখন যা ইচ্ছে করবে তখন তাই করবো…”
প্রান্তিক রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অনামিকা একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো ঐদিকে….
— “প্রান্তিক মজুমদার তোকে আমি ছাড়বোনা, আমার জীবন তুই নরক বানাতে চাইছিস ,আমি সেই নড়কেই তোকে টেনে আনবো…”
হঠাৎই প্রান্তিক আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো…অনামিকা ভয়ে শুকনো একটা ঢোঁক গিললো…
— “আমার সাথে চ্যালেঞ্জ নিতে এসোনা তুমি, আমি যে কি জিনিস সেটা তুমি এখনও জানোনা…আমাকে নরকে টানতে চাইলে ওই নড়কের আগুনেই জ্বলতে হবে তোমাকে…জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে তুমি,তবুও তুমি এই প্রান্তিক মজুমদারের কিছুই করতে পারবেনা…আর মনে রেখো তোমার পুরো বাড়ি আমার হাতে বন্দী…”
— “আপনার এই ফাঁকা আওয়াজে ভয় পাইনা আমি, আপনি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এগুলো বলছেন…”
অনামিকার কথা শুনে প্রান্তিক হাসলো…ফোনটা বের করে একটা ভিডিও চালালো যেখানে দেখা যাচ্ছে অনামিকার বাবা বাড়ির সামনের দাঁড়িয়ে পুলিশের সাথে কথা বলছে,অনামিকার মা বাড়ির ভিতরে বসে কাঁদছে আর বৌদি শান্তনা দিচ্ছে তাকে…ওর দাদা অফিসের জন্য বেরোচ্ছে তার ছেলেকে আদর করে…সেগুলো দেখে ভয় পেলো অনামিকা….প্রান্তিক তির্যকভাবে হাসলো…
— “এখনও মনে হচ্ছে আমি ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি??”
— “আমার ভুল হয়ে গেছে, আর কখনও এমন বলবোনা…আপনি যা বলবেন তাইই শুনবো…”
— “মনে থাকে যেনো!!”
(সবাই বড়ো বড়ো কমেন্ট করো দেখি,যাতে আমি একটু লেখার এনার্জি পাই….)