আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি #তানিয়া_মাহি(নীরু) #পর্ব_১৬

0
255

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৬

” আমার আর ইহানের মধ্যে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে। তুই কাকে চাইছিস বল, আমাকে নাকি ইহানকে? ”

রাইয়ানের কথায় রায়া সাফ সাফ জানিয়ে দেয়,” আমার জীবনে আমি তোমাদের দুজনকেই চাই। এখানে ফয়সালা তোমার হাতে, তুমি আমার জীবনে থাকতে চাও কি না। আমি তোমাদের কাউকেই ছাড়তে চাই না। তোমাদের দুজনের মধ্যে একজন আমার নিজের ভাই আর অন্যজন আমার স্বামী। দুজন আমার কাছে দুরকম স্পেশাল।”
” তুই আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবি না রায়া।”
” বাড়িটা তোমার নয়। এটা আব্বুর বাড়ি। আব্বু যদি আমাকে নিষেধ করে এখানে আসতে তাহলে আমি ভেবে দেখব।”
” তুই আজ থেকে আমার বোন না। আর তাছাড়া আমি আমার চিরশত্রুকে কখনো ভালোও থাকতে দেব না। সবকিছু কেড়ে নিয়েছে ও আমার থেকে।”
” কেউ তোমার থেকে কিছু কেড়ে নেয় নি ভাইয়া। তুমি সবকিছু অবহেলায় হারিয়েছ। নিজের দিকটা একটু ভেবে দেখো। কী কী করেছ তুমি খেয়াল করো।”
” ছোটবেলা থেকে আব্বু-আম্মু যেমন আমার ভুল নিয়ে পড়ে ছিল এখন তুইও ওরকমই করছিস। আমার দিকটা আমাকেই বুঝতে হলো, তোরা তো কেউ বুঝলি না একটুও। আমাকেই কেন সবকিছু বুঝতে হবে? ছোটবেলা থেকে আমি পড়াশোনা কম করতাম জন্য সবসময় কথা শুনতে হতো। বড় হওয়ার পর ইহান বাহিরে পড়তে গেল জন্য আমাকেও পাঠানো হলো। ও ফিরে এসে ব্যবসার পাশাপাশি আব্বুর সাথে রাজনীতিতে পা রাখলো। আব্বুও ওকেই বেশি ভালোবাসতে শুরু করল। সবদিক থেকে আমিই পিছিয়ে গেছি এমনকি ভালোবাসার দিক থেকেও।”

রাবেয়া বেগম এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও আর চুপ থাকতে পারেন না। ছেলেটা যে তার নিজের। ছেলে যেমনই হোক সে তার গর্ভে ধারণ করা। রাবেয়া বেগম রাইয়ানের কাছে গিয়ে বলেন,” অনেক তো হলো এবার থাম বাবা। দেখ তুই ইহানকে যেমন ভাবিস, ছেলেটা সেরকম না। আমি জানি আমার ছেলে কোন ভুল করবে না। রায়া ইহানের সাথে খুব ভালো আছে।”

শামসুজ্জামান উঠে ছেলের দিকে এগিয়ে আসেন। ছেলের কাধে হাত রেখে বলেন,” তুই কিছুই হারাসনি বাবা, তুই নিজের জিদের জন্য সবকিছু থেকে দূরে সরে গেছিস। তুই একবার তোর বাহিরের এই শক্ত আবরণ ছুড়ে ফেলে নরম হয়ে সবার সাথে মিশে দেখ, দেখবি সব তোরই আছে। ইহানকে আমি, আমরা ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু তোর চেয়ে বেশি না। তুই ছেলে হয়ে কখনো আমাদের বোঝার চেষ্টাই করিস নি। একটু বোঝার চেষ্টা কর ইহান আর তোর তুলনা কোনদিন করা হয়নি। ইহান তোর শত্রু না, তোর থেকে কিছু কেড়েও নেয়নি।”

রাইয়ান কিছু না বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়। রায়া তার বাবার কাছে গিয়ে বলে,” আব্বু, ভাইয়া কোন অঘটন ঘটাবে না তো?”

শামসুজ্জামান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” ভাই হয় সে তোর। বোনের বা বোনের সংসারের ক্ষতি সে করবে না। ওর ভেতরে যে ভুল ধারণাটা আছে সেটা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে। ওকে আর কোথাও যেতে দেব না আমি। রাইয়ান আমাদের সবার যত কাছাকাছি থাকবে তত সবাইকে বুঝতে পারবে। তুই একদম নিশ্চিত থাক মা, তোর ভাই এমন কিছুই করবে না যাতে তুই কষ্ট পাস।”

রায়া তার বাবাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। শামসুজ্জামান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকেন রাইয়ান কি সব বুঝবে!
____

হেমন্তের শেষের দিকে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বসন্তের আগমণ ঘটবে। আর এর মাঝেই কেটে গিয়ে বেশ কিছু মাস। গতরাতেই রায়া ইহানের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। ইহান সাড়ে ছয় মাসের জন্য দুবাই যাবে কাজের সূত্রে। ইন্টারন্যাশনাল একটা প্রজেক্টের কথা চলছে। সে সূত্রেই তাকে বাহিরে যেতে হচ্ছে। বিকেলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা তার।

রায়া গতকাল ক্যালেন্ডারে তারিখ খেয়াল করে হিসাব করে কিছু একটা আন্দাজ করে বিকেলেই বের হয়ে প্রেগন্যান্সির কিট সংগ্রহ করে রেখেছে। ভোর হতেই সে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। ইহানও তার সাথেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মসজিদে চলে গিয়েছে। রায়া নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ সেখানেই বসে থাকে। সে যেটা সন্দেহ করছে সেটা কি আসলেই সঠিক কি না সেটা নিয়ে ভাবছে সে। যদি কোনভাবে সেটা ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে বিষয়টা একটু মর্মান্তিক হবে তাই সে কাউকে কিছু জানায় নি।

রায়া জায়নামাজ ছেড়ে উঠে প্রেগ্ন্যাসির কিট হাতে নিতেই ইহান চলে আসে৷ ইহানকে দেখে সে কিটটা লুকিয়ে ফেলে। ইহানের প্রতিদিনের অভ্যাস ফজরের নামাজ আদায় করে এসেই রায়াকে নিয়ে হাটতে বের হয়। সকাল বেলার আবহাওয়াটা দুজনেরই উপভোগ করা হয়। আজকেই তো ইহান চলে যাবে আর কতগুলো মাস দুজনের একসাথে থাকা হবে না সময় কাটানো হবে না তাই আজকে যেন কোনকিছুর অন্যথা না হয়, কমতি না থাকে তাই ইহান রায়ার কাছাকাছি এসে বলে,” বের হওয়ার জন্য রেডি?”

রায়া আমতা আমতা করে বলে,” আ আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।”
” কোথায় যাবি?”
” ও ওয়াশরুমে যাব।”
” যাহ, এসব আবার বলতে হয় নাকি!”
” আপনিই তো জিজ্ঞেস করলেন, আমার কী দোষ?”
” আচ্ছা আচ্ছা যা। আমি অপেক্ষা করছি।”
” হুম।”

রায়া ইহানকে অপেক্ষায় রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়। কোন অন্যায় না করেও আজ কেমন যেন ভয়ে তার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনই সবকিছু উল্টেপাল্টে যাবে।
ওয়াশরুমে গিয়ে পাঁচ মিনিট হয়ে যাওয়ায় ইহান দরজার কাছে এসে বলে,” সূর্য উঠে যাচ্ছে। এতক্ষণ কে ওয়াশরুমে থাকে? এই তুই কি ফোন নিয়ে গেছিস ভেতরে?”

রায়া ইহানের ডাকে সাড়া না দিয়ে কিটের দাগ পর্যবেক্ষণ করছে। একদাগ স্পষ্ট বোঝা গেলে দ্বিতীয় দাগ স্পষ্ট হবে কি না সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে কিটে দ্বিতীয় দাগ দেখা দিতেই রায়ার চোখে পানি দেখা দেয়। রায়ার চোখে পানি দেখা দিলেও মুখে যেন হাসির রেখা স্পষ্ট।

রায়া প্রেগ্ন্যাসির কিট হাতে নিয়েই বাহিরে চলে আসে। ইহান ততক্ষণে পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে কালো রঙের টিশার্ট পরে নিয়েছে। রায়াকে দেখেই হাতে ঘড়িটা ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসে। এত দেরিতে বের হয়েছে বলে কিছু বলবে ঠিক তখনই সে খেয়াল করে রায়ার চোখে পানি। রায়া চোখের পলক ফেলতেই চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

রায়াকে কান্না করতে দেখে অস্থির হয়ে যায় ইহান। রায়ার দুই বাহুতে হাত রেখে রায়ার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেয করে,” কী হয়েছে রায়া? তোর চোখে পানি কেন? আমি কোন ভুল করেছি?”

রায়া কিছু বলছে না দেখে ইহান আবার বলে,” প্লিজ কান্না করিস না রায়া। বল আমাকে, কী হয়েছে তোর?”

রায়া চোখের পানি মুছে হাসতে থাকে। দারুণ স্নিগ্ধ সে হাসি। কান্না করার পরই রায়ার হাসি দেখে দ্বিধায় পড়ে যায় ইহান। শুকনো ঢোক গিলে রায়াকে আবারও প্রশ্ন করে ইহান, ” কী হয়েছে রায়া? তুই ঠিক আছিস তো?”

রায়া হাসতে হাসতে বলে,” কেন আমার ব্যবহারে কী মনে হচ্ছে আমি পাগল বা আমাকে জ্বীনে ধরেছে এমন কিছু?”

ইহানও এবার মজার ছলে বলে ওঠে,” তুই নিজেই যেহেতু এভাবে বলছিস তাহলে আমার সন্দেহ ভুল। এবার বল তো কী হয়েছে?”
” কিছু হয়নি তবে হবে।”
” কী হবে?”
” সেটা তো আমি জানি না আর হওয়ার আগে জানতেও চাই না।”
” মানে? কীসব বলছিস বল তো? মাথা ঠিক আছে? আমার বউ কি পাগল হয়ে গেল?” পাবনা দিয়ে আসব?”
” ধুর, নিন এটা দেখুন।”

রায়া ইহানের হাতে প্রেগ্ন্যাসির কিট ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। ইহানের হাতে কিটটা উল্টো হয়ে থাকায় সোজা করে দেখতেই ইহানের চোখ বড়বড় হয়ে যায়। একপ্রকার চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ” আমার বউ, মা হবে?”

রায়া ভ্রু কুচকে বলে,” অন্য পুরুষ হলে বলে উঠত ‘ আমি বাবা হতে চলেছি!’ আর আপনি?”

ইহান নিজেকে এবার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। আজ তার অসম্ভব আনন্দের দিন। এই দিনটা হয়তো নারীর সাথে পুরুষকেও আনন্দ দেয়। নারী যেমন প্রথমবারের মতো মাতৃত্ব কী সেটা বুঝতে পারে ঠিক তেমন বাবার দায়িত্বটা কী সে সম্পর্কেও একটা পুরুষ আন্দাজ করতে পারে।

কিছুক্ষণ পর ইহান রায়াকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রায়ার হাতে একটা চুমু খেয়ে হাতটা বুকের সাথে ধরে রেখে বলে,” এক অন্যরকম খুশি তুই আমাকে আজ দিলি রায়া। আমি বাবা হব, ছোট ছোট আঙুল আমি ছুঁয়ে দেখতে পারব, তোর পরে সে হবে আমার নিজের মানুষ, আমার আর তোর অংশ।”

রায়া ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। ইহান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ” তুই এখানে বসে থাক, আমি আম্মিকে খবরটা দিয়ে আসি।”
কথাটা বলে ইহান মায়ের রুমের দিকে রওয়ানা দিয়ে দেয়। রায়ার খেয়াল হতেই ইহানকে ডেকে বলে,” প্রেগ্ন্যাসির কিটটা তো দিয়ে যান, ওটা তো আপনার হাতে।”

#চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here