তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:18

0
345

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:18

প্রান্তিক আর অনামিকা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হসপিটালের কেবিনের মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো নিজেরাও জানেনা..হঠাৎ ডক্টরের আগমনে ধ্যান ভাঙলো দুজনের। একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে দুই প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো দুজন…ডক্টর হাসি মুখে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো…
— “কি প্রান্তিক বাবু এত লজ্জা পেলে হবে? তাহলে এখন আমি যেই খবরটা দেবো সেটা শুনলে কি করবেন?”

প্রান্তিকের মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠলো,করুন চোখে অনামিকার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো…
— “ক..কি খবর ডক্টর?”

— “কতদিন বিয়ে হয়েছে??”

— “নয়মাস,কিন্তু বিয়ের সাথে এই খবরের কি সম্পর্ক আছে?”

ডক্টর হেসে প্রান্তিকের পিঠ চাপড়ে দিলো,
— “আগামী সাতমাস পর আপনাদের ঘরে নতুন সদস্য আসতে চলেছে..”

বিষয়টা প্রথমে দুজনের কারোরই বোধগম্য না হলেও যখন বুঝতে পারে তখন প্রান্তিক আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে… ছুটে গিয়ে অনামিকার দুই কাঁধ ধরে…অনামিকার চোখ দেখেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা ওর অজানা ছিলো…
— “তুমি বুঝতে পেরেছিলে ,তাহলে আমাকে আগে বলোনি কেনো?”

— “আমি জানতাম না, এখনই ওনার মুখ থেকে জানলাম..”

প্রান্তিক অনামিকাকে ছেড়ে ডক্টরের কাছে গিয়ে ওনার হাতদুটো ধরে মুঠো করে,
— “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর ,এই মুহূর্তে এই খুশির সংবাদ টা আমাদের জন্য দরকার ছিলো অনেক…থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ…”

— “আমরাও বিষয়টা ভেবে দেখিনি,কিন্তু আজ সকালের দিকে ম্যাডাম বারবার বমি করছিলেন..কয়েকবার মাথা ঘুরিয়ে পরেও গিয়েছিলেন…তখন সন্দেহ হতে একটা ইউরিন টেস্ট করাই, তখনই সিওর হই…”

— “আমি ওকে আজই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো তো ডক্টর?”

— “না আমরা চাইছি আজকের রাতটা অবজার্ভেশনে রেখে কাল সকালে ছুটি দিয়ে দেবো…”

— “ঠিকাছে…”

ডক্টর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে প্রান্তিক অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে…
— “থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে এরকম একটা খুশির খবর শোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য…আমি বাবা হবো,এই ক্রিটিক্যাল সময়ে এর থেকে ভালো খবর কিছু হতে পারেনা…”

প্রান্তিক অনামিকাকে ছেড়ে চোখের কোণে লেগে থাকা আনন্দের অশ্রুটা হাতের পিছন দিয়ে মুছে নিলো,
— “আমাকে এখন যেতে হবে,তুমি সাবধানে থাকবে…”

— “কোথায় যাবে?”

— “আমাদের সন্তানকে একটা বিপদমুক্ত পৃথিবী দেওয়ার জন্য পৃথিবী থেকে কয়েকটা আবর্জনাকে পরিষ্কার করতে যাবো…”

— “যা করার সাবধানে করবে,মনে রেখো তুমি ছাড়া আমার আমার আমাদের সন্তানের আর কেউ নেই..”

প্রান্তিক অনামিকার গালে হাত রেখে ভরসা দিলো,তারপর বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে…প্রান্তিক চলে যেতে অনামিকা নিজের ডানহাত টা পেটের ওপর রাখলো,চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকলো নিজের সন্তানের উপস্থিতি…

.

.

অন্ধকার অমাবশ্যার রাত, চারিদিকে শুনশান নীরবতা…শুধু মাঝেমাঝে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে…পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে সোনিয়া..কয়েক হাত দুর থেকে ওকে নজরে রেখেছে প্রান্তিক আর ওর পুরো টিম…প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে একজন মহিলা এগিয়ে এলো সোনিয়ার কাছে…সোনিয়া উঠে দাঁড়িয়ে একটা শুকনো ঢোঁক গিললো…
— “ম..মা”

— “বেশি সময় নেই,যা বলার তাড়াতাড়ি বল…নাহলে এক্ষুনি ভোরের আলো ফুটে যাবে…”

— “এত.. এতো দ..দেরি ক..করে এলে কেনো ত..তুমি?”

সোনিয়ার কথা বলার ধরনে ওর মায়ের সন্দেহ হলো ,
— “তুই এমন তোতলাচ্ছিস কেনো সোনি? কিছু লুকাচ্ছিস আমার থেকে?”

— “ম.. মা ”

— “কি ম্যা ম্যা করছিস? যেটা বলার জন্য ডেকেছিস সেটা তাড়াতাড়ি বল…”

হঠাৎ চামেলী নিজের মাথার পিছনে ঠান্ডা কিছু অনুভব করলো, দেখার জন্য ঘুরতে গেলেই একটা ভারী কন্ঠস্বর কানে এলো ওর…
— “ডোন্ট মুভ,পুরো পার্কটা পুলিশ ঘিরে ফেলেছে…তাই পালানোর চেষ্টা করবেনা…”

চামেলী নিজের দুটো হাত ওপরের দিকে তুললো,রাগী দৃষ্টি বর্ষণ করলো সোনিয়ার ওপর…
— “তুই আমার সাথে চালাকি করলি সোনি? এর ফল তোকে ভুগতে হবে…তোকে আমি ছাড়বোনা..”

সোনিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়ালো,
— “মুনিয়া বিপদে আছে মা,ওকে বাঁচানোর জন্য এটা আমাকে করতেই হতো…”

— “পরের মেয়ের জন্য তুই তোর নিজের মায়ের সঙ্গে বেইমানি করলি সোনি?”

— “যেদিন একটা কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট পুতুলকে তুমি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে সেদিন থেকেই আমি যে ওকে বড্ড ভালোবাসি মা, নাই বা হলো রক্তের সম্পর্ক ,ওকে তো আমি আমার নিজের বোনের মতনই ভালোবেসে এসেছি…ওকে কিভাবে মরতে দিই বলো?”

চামেলী খুব জোড়ে চর মারলো সোনিয়ার গালে,
— “আজ তোর জন্য আমার এত বছরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে…তোকে আমি খুন করে ফেলবো…”

কয়েকজন মহিলা পুলিশ এসে চামেলিকে আটক করে, আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রাখে যাতে পালানোর চেষ্টা করলেও পালাতে না পারে…চামেলী ছটফট করতে থাকে…সোনিয়া নিজের চোখের জলটা মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ওর সামনে…
— “মুনিয়া কে মা?? কি ওর আসল পরিচয়? অনামিকা আর মুনিয়া একইরকম দেখতে কিভাবে হয়?”

— “খুব সাহস বেড়ে গেছে তোর সোনি, আমাকে প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য ভুলেও দেখাবিনা…”

— “মুনিয়ার আসল পরিচয় কি মা?”

— “শোন তাহলে মুনিয়া হলো তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ির মেয়ে,অনামিকার যমজ বোন…আজ থেকে বাইশ বছর আগে আমি ওকে হসপিটাল থেকে চুরি করে এনেছিলাম…”

— “কোনো মায়ের কোল খালি করার ব্যবসা কি সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো মা তোমার?”

— “তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারিসনা,খুন করে ফেলবো তোকে…”

প্রান্তিক এবার চামেলীর সামনে এসে দাঁড়ালো…
— “নিজেকে খুব চালাক মনে করো তুমি চামেলী মন্ডল, এতগুলো বছর ধরে কয়েক হাজার মেয়ের সাথে তুমি এই একই খেলা খেলে যাচ্ছো..এবার তোমার দিন শেষ হবে চামেলী…”

চামেলী হো হো করে হেসে উঠলো…
— “কিচ্ছু করতে পারবিনা তোরা আমার, আমার ক্ষমতার কাছে তোরা সব চুনোপুটি…”

— “প্রান্তিক মজুমদারের সাথে চ্যালেঞ্জ নিসনা চামেলী…গত ছয় বছর ধরে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছি আমি,আজ অনামিকাকে তুলে তুই সেই আগুনে ঘি ঢেলেছিস। এত সহজে আমি নিভভোনা কিন্তু…”

— “প্রতিশোধ ? কিসের প্রতিশোধ?”

— “আমার বোনের সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়ার প্রতিশোধ,আমার বোনকে অক্ষম করে দেওয়ার জন্য প্রতিশোধ…আজ আমার মত যদি প্রতিটা দাদা একত্রিত হয় ভেবে দেখেছিস কি হবে তোর? কি হবে তোর সাম্রাজ্যের?”

চামেলী অবাক নয়নে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “কে তোর বোন?”

— “প্রণতি মজুমদার, যে ছয় বছর আগে প্রীতমের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জীবন শেষ করেছে…”

— “ওহ তাহলে তুই এইজন্যই অনামিকাকে কেনার এত বড়ো নাটকটা করলি আমার সাথে??”

— “হ্যাঁ, তোমার যাতে ফাঁসি হয় সেই ব্যবস্থা করবো আমি…নিয়ে যাও ওদের দুজনকে…”

চামেলী আর সোনিয়ার হাতে হাতকড়া পড়ায় মহিলা পুলিশ, সোনিয়া প্রান্তিকের কাছে এগিয়ে আসে..
— “আমার বোন কোথায় প্রান্তিক?”

— “জেলে ”

— “ও এইসবের মধ্যে নেই প্রান্তিক,ওকে ছেড়ে দাও…”

— “সেটা কোর্ট ডিসাইড করবে, ভুল কাজের কেমন পরিণাম হয় দেখলে তো বৌদি? নিজের তিন বছরের ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলে তুমি…”

নিজের ছেলের কথা ভেবে সোনিয়া কাঁদলো, যেই ছেলে মা ছাড়া কিছু বোঝেনা সেই ছেলে একা একা থাকবে কি করে ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে ওর…
— “কোর্ট যদি আমার ফাঁসির রায় না শোনায় তাহলে আমি ফিরে আসবো, ফিরে আসবো আমি সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ হয়ে…সোনিয়ার বেস ফেলে বর্ণালী হয়ে ফিরে আসবো আমি…”

প্রান্তিক মৃদু হাসলো,
— “নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো দেখে ভালো লাগলো,এটা যদি আগে বুঝতে পারতে তাহলে এতগুলো মেয়ের জীবন অকালে শেষ হয়ে যেতনা,আর বর্ণীশও একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ পেতো বড়ো হয়ে ওঠার জন্য…”

— “এতদিন মায়ের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচেছি,যখন যা বলেছে তাই করেছি…দিনশেষে আমিও যে একটা মেয়ে সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম…এবার আমি আর কারোর মেয়ে হয়ে নয় আমার গুবলুর মা হয়ে বাঁচবো…যতদিন না ফিরে আসছি আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো প্রান্তিক…”

.

.

অনামিকা আর প্রান্তিক এখন দাঁড়িয়ে আছে অতনু বাবুর বাড়ির ড্রয়িং রুমে, প্রান্তিকের বলা একটা কথায় পুরো বাড়ি যেনো নীরবতায় ছেয়ে গেছে…প্রান্তিক শুধু বলেছিলো..
— “কাকিমা সেদিন তোমার যমজ মেয়ে হয়েছিলো,তার মধ্যে একজন অনামিকা , ও কুড়ি সেকেন্ডের বড়ো আর ওর ছোট বোনকে সেদিন চুরি করেছিলো বৌদির আসল মা…ওর নাম মুনিয়া…”

নীরবতা ভেঙে অতনু বাবু প্রান্তিকের সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরলো,
— “সে কোথায় প্রান্তিক? আমাদের আরেক মেয়ে কোথায়?”

প্রান্তিক মাথা নিচু করে ফেললো,
— “সরি কাকু মুনিয়াকে আমি অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হয়েছি, ও এখন জেলে আছে…”

দুই পা পিছিয়ে গেলো অতনু বাবু…
— “কি করেছে ও? ওকে কেনো জেলে পাঠিয়েছিস তুই?”

— “ওর অপরাধ এখনও প্রকাশিত হয়নি তবে ও মিথ্যে পরিচয়ে অনামিকা সেজে আমার বাড়িতে ঢুকেছিলো ,সেইজন্যই ওকে কাস্টেডিটে নিয়েছি আমি…”

অতনু বাবুর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো, টলে টলে গিয়ে উনি বসে পড়লেন সোফায়…অনীশ প্রান্তিকের কাছে গিয়ে হাত জড়ো করলো,
— “জানি আমার আর বর্ণালীর অপরাধের কোনো ক্ষমা হয়না, আমাদের জন্যই আজ প্রণতি……পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস..”

প্রান্তিক অনিসের মুঠো করে রাখা হাতদুটো ধরলো,
— “প্রণতি বেঁচে আছে অনীশ দা, তবে ছয় বছর ধরে ও কোমায় আছে…”

উপস্থিত সবাই ভীষণ পরিমাণে অবাক হলো,প্রান্তিক তাই নিজেই বলতে শুরু করলো,
— “ওকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই মিথ্যে নাটকটা আমাকে করতে হয়েছিলো, আচ্ছা এইসব কথা বাদ দাও তো…একটা গুড নিউজ আছে তোমাদের সবার জন্য…”

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে,প্রান্তিক অনামিকার দিকে তাকাতেই দেখে ও লজ্জায় মাথা নিচু করেছে আগেই…
— “অনীশ দা তুমি মামা হতে চলেছো…”

এই একটা কথা যেনো বাড়িতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনলো, সবার মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো…প্রান্তিক কথাটা বলে নিজেও লজ্জা পেলো…অনীশ চোখের জলটা মুছে হাসলো প্রাণখুলে…
— “তাহলে তো এই খুশিতে এক্ষুনি মিষ্টিমুখ করতে হবে সবাইকে,আমি এক্ষুনি টাটকা মিষ্টি কিনে আনছি…”

অনীশ যেতে গেলে প্রান্তিক বাঁধা দেয়,
— “আমার গাড়িতে মিষ্টি রাখা আছে…”

সুতপা দেবী এতক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়ের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয়…
— “আমার মেয়েটা কবে এত বড়ো হয়ে গেলো? এখন সেও মা হবে…অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেলো তোর অনু…খুব ভালো থাকিস মা..”

অনামিকা সুতপা দেবীকে জড়িয়ে ধরলো, এ যেনো এক নতুন অনুভূতি…জড়ানো কন্ঠে অনামিকা বললো,
— “আশীর্বাদ করো মা যেনো তোমার মতই আমি আমার সন্তানকে আগলে রাখতে পারি নিজের সবটা উজাড় করে…আমি যেনো তোমার মতোই একজন ভালো,দায়িত্বশীল মা হয়ে উঠতে পারি…”

( #নোটিশ: সুখবর দিলাম ,আজকে কিন্তু সবার বড়ো বড়ো কমেন্ট আশা করছি…যারা কোনোদিন কমেন্ট করোনা আজকে অন্তত একটা করে কমেন্ট করে যেও)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here