#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৮
ইহান রুমের দরজায় পৌঁছতেই দেখে রায়া এশার সাথে হাসছে। হাসিটাও কেমন অন্যরকম৷ বারবার হাত দেখছে সে। ইহান এগিয়ে গিয়েই জিজ্ঞেস করে,” কী হয়েছে? চিৎকার দিলি কেন?”
এশা হাসতে হাসতে বলে,” ওই যে আপু বিছানায় হাত দিয়েছে মাথার বালিশের দিকে আর বিড়াল হাতে খামচি দিয়ে ধরে ফেলেছে তাই চিৎকার দিয়েছে ভয়ে।”
ইহান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ইরিনা বেগমও ততক্ষণে চলে এসে সব শুনে নিয়েছেন। ইরিনা বেগম রায়াকে বলেন,” বেশি ভয় পেয়েছিস? হাত কি কে*টে গেছে?”
রায়া স্পষ্টভাবেই জবাব দেয়, ” না বড়মা, আমি এশার সাথে কথা বলতে বলতে পিছনে না তাকিয়ে বালিশ নিতে গিয়ে এমন হয়েছে। দেখিনি জন্য হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে গেছি।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। এবার যা রুমে যা, রেস্ট নে একটু তাহলে ভালো লাগবে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি কিন্তু শোনো সকাল থেকে তোমরা যেমন করছো, আমার মনে হচ্ছে আমি অসুস্থ মানুষ। এত যত্ন নেওয়ার কিছু নেই।”
” খারাপ শাশুড়ী হতে বলছিস?”
” না, তা কখন বললাম?”
” এই সময়ে মেয়েদের যত্নের, ভালোবাসার প্রয়োজন হয়। এখন যা রুমে যা, তোর এসব যেহেতু ভালো লাগছে না তাহলে তোর জন্য দজ্জাল শাশুড়ি হওয়াই উচিৎ। ”
” আমার ভালো শাশুড়িই লাগবে। শ্বশুর তো বেঁচে নেই যে শাশুড়ী খারাপ হলে শ্বশুরকে আরেকটা বিয়ে দেব।”
” ইহান, রায়াকে নিয়ে যাবি তুই? ”
রায়া হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইহানও রায়ার পিছু পিছু রুমে চলে যায়। রায়া সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে। আশেপাশে তাকিয়ে ইহানের ব্যাগপত্র না দেখে জিজ্ঞেস করে,” আপনার ব্যাগপত্র কোথায়? বের হবেন কখন?”
ইহান রায়ার দিকে এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে রায়ার কোলে মাথা রেখে বলে,” বউকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
রায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,” কী বলছেন? যাবেন না মানে?”
” যাব না মানে যাব না।”
” কিন্তু কেন?”
” বাহিরে গেলে অনেকটা সময় ওখানে থাকতে হবে যেটা আমি একদমই চাই না।”
” সত্যিই যাবেন না নাকি আমার সাথে মজা করছেন?”
” আমি আমার বাচ্চার মাকে রেখে কোথাও যাচ্ছি না। আমি তোর এই অবস্থায় তোর পাশে থাকতে চাই রায়া। তুই যেন একাকিত্ব কী সেটা বুঝতে না পারিস তার জন্য আমি সবসময় তোর কাছে থাকব। ”
” পৃথিবীর সব পুরুষ কি তার ব্যক্তিগত নারীর প্রতি এত যত্নশীল? ”
” সেটা জানি না কিন্তু তোর ব্যক্তিগত পুরুষ খুব ভালোবাসতে জানে।”
” এই ভালোবাসা সারাজীবন আমার জন্যই রেখে দিয়েন। এই ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিয়েন না কখনো।”
” ভালোবাসা একেক জনের জন্য একেক রকম। তোর জন্য যে ভালোবাসা সেটা শুধু তোর জন্যই।”
” ভালোবাসি আপনাকে, আপনার চেয়েও বেশি।”
ইহান মুচকি হেসে রায়াকে আবারও জড়িয়ে ধরে তার সাথে একদম মিশে যায়। রায়া ইহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে৷
________
ইহান সন্ধ্যা পর রায়াকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে রায়ার মনটা ভালো রাখতে। অনেকগুলো দিন দুজনের একসাথে বের হওয়া হয় না। প্রেগন্যান্সির খবর শুনে কেউ রাজিই হতে চায় গাড়িতে চড়তে দিতে। তাই দুজন হাটতে বের হয়েছে, হেটে হেটেই সামনের মাঠটায় এসে বসে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে।
রায়া আর ইহান বসে বসে গল্প করছিল এমন সময় মাঠের পাশের স্টলে কারো তর্কবিতর্ক শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা*রামারি হাতা*হাতি শুরু হয়ে যায়। মানুষ জমতে শুরু করেছে। ইহান আর রায়া সেদিকেই তাকিয়ে আছে। স্টলের মানুষগুলোর গলার আওয়াজ বাড়তে থাকে।
রায়া হঠাৎ করে চিৎকার করে বলে ওঠে,” ভাইয়া!”
ইহানা রায়ার হাত ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,” কী হয়েছে রায়া?”
” ভাইয়া ওখানে আছে৷ ভাইয়ার গলা শুনেছি আমি।”
” রাইয়ান!”
” হ্যাঁ, আমার ভাইয়া। প্লিজ গিয়ে দেখুন না।”
” তুই নিশ্চিত রাইয়ানের গলা শুনেছিস?”
” আমি আমার ভাইয়ার গলা চিনব না?”
” তোকে একা রেখে আমি যাব কীভাবে?”
” আপনি প্লিজ আমার ভাইয়াকে দেখুন। আমি এশাকে কল দিয়ে এখানে আসতে বলছি। দুই, চার মিনিটেই চলে আসবে। ”
” আমার সাথে আয়, আমি গাড়িতে তুলে দেই। বাসার সামনে গিয়ে নেমে বাড়িতে ঢুকেই আমাকে কল দিবি।”
” ঠিক আছে।”
ইহান তাড়াতাড়ি করে রায়াকে একটা রিকশাতে তুলে দেয়। রিকশাওয়ালাকে ধীরে ধীরে যেতে বলে, ভাড়াটা দিয়ে দেয়। রিকশা চলতে শুরু করলে ইহান এবার স্টলের দিকে দৌঁড় দেয়।
ইহান স্টলে পৌঁছেই দেখে দুজনের মধ্যে মা*রামারি হচ্ছে। দুটোই তার পরিচিত মুখ। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে রাইয়ান আর আরেকজন শাওন। রাইয়ান শাওনের কাছে পরাজিত হচ্ছে দেখে দুজনকে ছাড়িয়ে নিতে এগিয়ে যায়। ওখানে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দুজনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আবার কেউ ভিডিয়ো করছে।
ইহান এগিয়ে এসে শাওনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আশেপাশের কয়েকজন ইহানকে দেখে সরে দাঁড়ায়। ইহান একটা জোড়ে শ্বাস ফেলে চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করে, ” কী হচ্ছে এখানে?”
রাইয়ান এবার প্রথম ইহানের সাথে কথা বলে। বাহু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলে,” এই কু**ত্তারবাচ্চা আমার বোনকে নিয়ে নোংরা কথা বলেছে। ওর বাঁচার অধিকার নেই।”
ইহান এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গতবার নোংরা একটা কাজ করতে চেয়েছিল। চারমাস জে*লে থেকে এসে আবারও জল ঘোলা করতে চাইছে। ইহান অ*গ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শাওনের দিকে।
শাওন বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,” কী, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? এখন কি তুই আমাকে মা*রতে আসবি? আমার এক্স প্রেমিকার ভাইয়ের মতো আবার মা*র খাইতে আসিস না।”
ইহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” কী বলেছিস তুই আমার বউকে নিয়ে?”
শাওন হাসতে হাসতে ইহানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,” যা বলেছি সত্যি বলেছি। তোর বউ আমার প্রেমিকা ছিল। ছয়মাসের মতো সম্পর্ক ছিল, বাড়ি কাছাকাছি, যখন ইচ্ছে দেখা, ছোঁয়া, চুমু….”
শাওন তার কথা শেষ করতে পারে না। ইহান শাওনের শার্টের কলার ধরে মুখের ওপর ঘু*ষি দিতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সবাই ইহানের হাত থেকে শাওনকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়। শেষমেশ রাইয়ান ইহানকে ছাড়িয়ে নিতে সফল হয়। রাইয়ান শক্ত করে ইহানকে ধরে আছে। ইহান ছুটোছুটি করছে শাওনকে আবার মা*রার জন্য।
ইহান চিৎকার করে বলতে থাকে,” কু**/ত্তারবাচ্চা তোর সাহস কী করে হয় আমার বউকে নিয়ে কথা বলার? চাইলেই কারো গায়ে কালি লাগানো যায় তাই না? আমি ইহান বেঁচে থাকতে আমার বউয়ের গায়ে এক ফোঁটা কালি ও লাগতে দেব না। আর একদিন যদি আমার বউকে নিয়ে কিছু বলেছিস সেদিনই আমি তো জিভ টে**নে ছি**ড়ে ফেলব।”
দুপক্ষের কাউকেই স্থীর রাখা যাচ্ছে না। দুজন দুজনের দিকে ছুটে আসতে চাইছে। হয়তো ছেড়ে দিলেই তুলকালাম কিছু বাধিয়ে ফেলবে দুজন। কয়েকজন মিলে ইহানকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ওদিকে শাওনকে নিয়ে তার বন্ধুরা বেরিয়ে যায়। শাওন ইহানের দিকে ফিরে তাকিয়ে শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় কিছু বলে যায়।
জায়গা খালি হয়ে যেতেই রাইয়ান ইহানকে ছেড়ে দেয়। ইহান সাথে সাথে স্টল থেকে বেরিয়ে আসে। রাইয়ানও সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ধীরে ধীরে ইহানের পিছনে এসে দাঁড়ায়।
রাইয়ানের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ইহান বলে ওঠে,” আমাকে ধরলি কেন? ওকে আজ আমি শেষ করে দিতাম। মাসে মাসে চাঁদে চাঁদে ঝামেলা বাধাতে এলাকায় আসে জানো**য়ারটা।”
” স্যরি ইহান।”
” এখন স্যরি কেন বলছিস?”
” আমি তোকে আমার বোনের সাথে মেনে নিতে পারছিলাম না।”
” কাকে মেনে নিতে পারতি শাওনের মতো ছেলেকে? আমি কিছু না করেও সারাজীবন তোর কাছে দোষী। আমি সবকিছুতে ভালো জন্য কেউ তুলনা দিলেই আমিও ভিলেন হয়ে যাই সবার কাছে।”
” তুই আমার জায়গায় থাকলে আমার অবস্থাটা বুঝতি।”
” তুইও আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি দোষ না করেও দোষী হতে ঠিক কেমন লাগে!”
” স্যরি।”
ইহান এবার রাইয়ানের দিকে ফিরে দুই হাত দিয়ে রাইয়ানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে,” কীসের স্যরি হ্যাঁ? তোর এসব বা***লের স্যরি আমি চেয়েছি? এখন কেন স্যরি বলছিস? দেশে আসার পর যে এতগুলো মাস চলে গেল, আমার সাথে একদিন দেখা করেছিস? রায়ার সাথে সেদিনের ঝামেলার পর কথা বলেছিস? ওর চোখের পানি দেখেছিস তুই? ও সবকিছু পেলেও ভাইয়ের দূরত্ব সহ্য করতে না পেরে মন খারাপ করে থাকে, সেই খবর রেখেছিস তুই? বাড়িতে নতুন একটা প্রাণ আসছে শুনেও একদিন এসেছিস আমাদের বাড়িতে? এতকিছুর জন্য ক্ষমা পাবি ভেবেছিস? কখনো না। নেভার, এভার।”
রাইয়ান ঝড়ের গতিতে এসে ইহানকে জড়িয়ে ধরে। ইহান থেমে যায়। গলা দিয়ে তার আর কোন শব্দ বেরোচ্ছে না। সেই ছোটবেলায় দুজন কাধে কাধ মিলিয়ে দুজন চলাফেরা করেছে। এরপর ছোট ছোট বিষয়ে দুরত্ব বাড়তে বাড়তে দুজনের দেখা হওয়াটাও বন্ধ হয়ে যায়। রাইয়ানের মনে জন্ম নেয় ইহানের প্রতি চরম ক্ষো**ভ। আর এরপর দুজন দুজনের থেকে শত শত মাইল দূরে। মনের দূরত্বও বেড়েছিল অনেক।
ইহান রাইয়ানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রাইয়ান কিছুতেই ছাড়ছে না। এতগুলো বছর পর ভাই ভাইকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তে পারছে না। এতগুলো বছরের ক্ষো**ভ, রাগ আজ মিটিয়ে নিচ্ছে। রাইয়ান ছাড়ছে না দেখে ইহানও এবার রাইয়ানকে জড়িয়ে ধরে৷ দুজনের চোখ টলমল করছে। পুরুষদের তো কাঁদতে নেই। পুরুষদের হতে হয় লোহার ন্যায় কঠোর৷
কিছুক্ষণ পর রাইয়ান ইহানকে ছেড়ে দিয়ে বলে,” আমি এতদিন ভুল ছিলাম। আমার বোনের জন্য তুই-ই একদম পারফেক্ট। আমার বোনটাকে ভালো রাখিস। যদি কখনো ওকে কাঁদাস তাহলে কিন্তু আমি তোর জান নিয়ে নেব ইহান।”
#চলবে…….
গল্পেটা আর বেশি বড় হবে না, হয়তো বিশ পর্বের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সবাই পাশে থাকবেন। যারা আমার পেইজ ফলো দেন নি তারা প্লিজ ফলো দিয়ে রাখবেন যেন পরবর্তী গল্প মিস না করেন।