গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:11
রাত দশটা বেজে সতেরো মিনিট, প্রান্তিক বেল বাজিয়েও কোনো শব্দ না পেয়ে ভাবে অনামিকা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই শুনতে পায়নি…ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢোকে ও…ভিতরটা পুরো অন্ধকার, ড্রয়িং রুমে শুধু একটা নিয়ন আলো জ্বলছে…
— “অনু? কোথায় তুমি? এভাবে বাড়িটা অন্ধকার করে রেখেছো কেনো? অনু??”
প্রান্তিক ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে লাইটের সুইচটা অন করলো…অনামিকার রুমে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে অনামিকাকে পেলনা…সব রুমগুলো খুঁজলো… না পেয়ে ডাইনিং রুমে এসে দেখে টেবিলে দুপুরের এঁটো প্লেটগুলো এখনও ওই অবস্থাতেই পড়ে আছে…টেবিলের ওপর অনামিকার ফোনটা দেখে অবাক হয় ও…
— “ফোনটা এভাবে ফেলে রেখেছে কেনো এখানে?? কোথায় গেলো মেয়েটা? কোনো বিপদ হয়নি তো??”
পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে অনামিকাকে, অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ থেকে শুরু করে পার্কিং জোন,কোথাও খুঁজে না পেয়ে বিদ্ধস্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ফেরে প্রান্তিক…হঠাৎ কিচেনে বাসনের শব্দ শুনে কিচেনে গিয়ে একটা লম্বা স্বাস নেয় প্রান্তিক…পিছন থেকে গিয়ে অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে..অনামিকা নিজের কাজ থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে…
— “কি হয়েছে আপনার?? ”
ফোঁপানোর শব্দ পেয়ে আরও অবাক হয় অনামিকা… প্রান্তিককে ছাড়িয়ে সামনে ঘুরে প্রান্তিকের মুখটা তুলে ধরে…
— “আপনি কাঁদছেন?? কেনো প্রান্তিক? কি হয়েছে??”
প্রান্তিক হাত দিয়ে চোখ মুখে নাক টানলো…
— “কোথায় ছিলে তুমি?? আমি কোথায় কোথায় তোমাকে খুঁজেছি জানো?? আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো……”
প্রান্তিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই অনামিকা বলে উঠলো..
— “আপনার মনে হয়েছিলো আপনাকে বোকা বানিয়ে আমি পালিয়ে গেছি, তাইতো?”
— “না,আমার মনে হয়েছিলো আমি হয়তো আবার তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব অনু…এই কদিনে তুমি আমার অভ্যাসটা খারাপ করে দিয়েছো…”
অনামিকা আবার নিজের কাজ করতে করতে দায়সারা ভাবে বললো..
— “এটা আপনার প্রবলেম,আপনার বিশ্বাসটা বড্ড নড়বড়ে মিস্টার প্রান্তিক..”
প্রান্তিক অবাক হলো অনামিকার কথায়, ওর কথার মানেটা বুঝতে পারলো না প্রান্তিক…
— “মানেটা একটু বুঝিয়ে বলবে বউ?”
অনামিকা প্লেটগুলো ধুয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলো…তারপর ডেস্ক থেকে আটার বোয়াম নামিয়ে পরিমাণ মতো আটা নিলো একটি পাত্রে…
— “আপনি বেরোনোর আগে আমাকে কি বলে গিয়েছিলেন মনে আছে?”
প্রান্তিক একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেলো ফোনের বিষয়ে অনামিকাকে ও কি বলে গিয়েছিলো…জিভ কামড়ালো ও…অনামিকাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো…
— “বউ কি আমার ওপর একটু অভিমান করেছে??”
— “একটু নয় অনেকটা”
— “তাহলে কি করলে আমার বউয়ের অভিমান ভাঙবে?”
অনামিকার মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠলো…
— “আইস ক্রিম ”
প্রান্তিক চোখ রাঙ্গাল…
— “কালকে জ্বরে কাতরাচ্ছিলে আর আজ আইস ক্রিম খাবে? নেভার…”
অনামিকা রাগে প্রান্তিকের হাতগুলো সরিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো..
— “আর কোনোদিন আপনি আমার অভিমান ভাঙাতে আসবেননা…কাকিমার বাড়িতে গিয়ে বসে ছিলাম ভালোই ছিলো..”
— “তুমি কাকিমার বাড়িতে ছিলে? জানলে কি করে কাকিমার ফ্ল্যাট কোনটা?”
— “আপনি যান তো এখান থেকে, আমাকে কাজ করতে দিন..”
অনামিকার অভিমান ভাঙাবে কিভাবে সেটা ভেবেই চলেছে প্রান্তিক, তবে এখন কিছুতেই আইস ক্রিম খেতে দেবেনা ও অনামিকাকে…হঠাৎ প্রান্তিকের মাথায় একটা দারুন আইডিয়া খেলে গেলো..
— “এই বউ, আইস ক্রিমের বদলে ফুচকা হলে চলবে??”
অনামিকা চট করে প্রান্তিকের দিকে ঘুরে পড়ে…অনামিকার মুখের হাসি দেখেই প্রান্তিক বুঝে যায় ওর আইডিয়াটা কাজে দিয়েছে…
— “আমি দু মিনিটে রেডী হয়ে আসছি…”
অনামিকা যেতে গেলে প্রান্তিক ওর হাত ধরে আটকায়…
— “এখানে ফুচকা পাওয়া যায়না..”
অনামিকা প্রান্তিকের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নিজের থেকে…
— “যে জিনিস দিতে পারবেননা বলেন কেনো?”
— “কে বলেছে দিতে পারবোনা? আমি তো নিজেই আমার বউয়ের জন্য ফুচকা বানাবো..এক্কেবারে হোমমেড অ্যান্ড হাইজিন…”
অনামিকা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায় প্রান্তিকের দিকে…
— “আপনি পারেন ফুচকা বানাতে?”
— “আগে পারতাম না,কিন্তু বউয়ের পছন্দের কথা ভেবে বছরখানেক হলো শিখে নিয়েছি…”
— “আমি রাতের খাবারটা বানিয়ে নিই,তারপর আপনি করবেন…”
— “তুমি তো আটা মাখছো,ওটা আমাকে দাও আর রাতের খাবার বানাতে হবেনা, দুপুরে তো তিন প্যাকেট বিরিয়ানি আনিয়েছিলাম, এক প্যাকেট তো এখনো ফ্রিজে আছে ,ওটাই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেবো…”
……………….
একটা সপ্তাহ কেটে যায়…এই এক সপ্তাহে প্রান্তিক অনামিকার ভালোবাসা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে….প্রান্তিকের এত যত্ন ,ভালোবাসা পেয়ে অনামিকা যেনো আরও বেশি ভালোবেসে ফেলছে প্রান্তিক কে…
রাত বারোটা বেজে গেছে তবুও প্রান্তিক এখনও বাড়ি ফেরেনি,অনামিকা ড্রয়িং রুমে বসে আছে দরজার দিকে তাকিয়ে, খুব চিন্তা হচ্ছে ওর প্রান্তিকের জন্য…হঠাৎ প্রান্তিককে দরজা খুলতে দেখে ছুটে গেলো ও…
— “কোথায় ছিলেন আপনি? বাড়িতে যে একটা মানুষ চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছে,ফোন করে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করলেন না…”
প্রান্তিক ভিতরে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়…ওর হাতে থাকা প্যাকেটটা অনামিকার হাতে দেয়…
— “এখন কি ভেবেছেন এগুলো দিলে আমি আপনাকে আর কিছু বলবোনা? ”
— “খুলে দেখো…”
অনামিকা প্যাকেটটা খুলে একটা লাল রঙের বেনারসি, সাথে কিছু সোনায় গয়নার বাক্স আর একটা গাছকৌটো পায়…
— “এগুলো কি? কি হবে বেনারসি আর গয়না দিয়ে?”
— “আজ আমরা বিয়ে করবো,বাঙালি রীতি মেনে..”
অনামিকা প্রান্তিকের গায়ে হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো…
— “শরীর ঠিক আছে তো আপনার? রাত সাড়ে বারোটার সময় কি ভূত চাপলো আপনার মাথায়??”
প্রান্তিক অনামিকাকে নিজের কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো…
— “অনেক কষ্ট করে খুঁজে খুঁজে একজন বাঙালি পুরোহিত পেয়েছি বউ, উনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন…একটা কুড়িতে বিয়ের লগ্ন আছে একটা,আমরা ওই লগ্নেই বিয়ে করবো…”
অনামিকা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “সত্যি?”
— “হুম বউ সত্যি, তুমি রেডি হতে শুরু করো,আমি ততক্ষন পুরোহিত মশাইকে আমার বাইশ তলার ফ্ল্যাটে রেখে আসি, এসে তোমাকে সাজিয়ে দেবো..”
*
শাড়িটা প্রায় পড়েই ফেলেছে অনামিকা,শুধু কুঁচিটা একা একা সামলাতে পারছেনা ও…কিছুতেই ভাঁজে ভাঁজে কুঁচি পড়ছেনা, তাই বিরক্ত হয়ে কুঁচিটা হাত থেকে ছেড়ে দেয় ,ফলে শাড়িটা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, প্রান্তিক রুমে ঢুকে অনামিকাকে এই অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ঘুরে পড়ে…
— “এভাবে কেনো দাঁড়িয়ে আছো স..সব খ.. খু..খুলে?”
অনামিকা করুন মুখ করে বলল…
— “এতো ভারী শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই,তাই একা একা কুঁচি করতে পারিনা..”
— “আমি কি কোনোভাবে হেল্প করতে পারি?”
অনামিকা একবার নিজের দিকে তাকালো, তারপর আমতা আমতা করে বললো…
— “হুম ,কিন্তু চোখ বন্ধ রাখবেন আপনি..”
— “চোখ বন্ধ করে কীভাবে কুঁচি ধরবো?”
— “আমি জানিনা ,আপনাকে চোখ বন্ধ রাখতেই হবে…”
প্রান্তিক অনামিকার দিকে ঘুরে তাকালো, তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো ওর কাছে…
— “বউটা যখন আমার তখন বউয়ের সবকিছুই আমার। তাই নিজের জিনিস দেখার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার…”
অনামিকার গালদুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, মাথা নিচু করে গোপনে হাসলো অনামিকা। প্রান্তিক অনামিকার লুটিয়ে পড়া শাড়িটা হাতে তুলে সুন্দরভাবে ভাঁজ করলো…
— “ধরো ”
কুঁচির ওপরের প্রান্তটুকু অনামিকার হাতে ধরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো প্রান্তিক…তারপর নিচের অংশটুকু সমান করে উঠে দাঁড়ালো…
— “এতটা যখন করলাম তখন গুঁজেও দিই?”
— “নাআআআআআ ”
প্রান্তিক শব্দ করে হেসে উঠলো, মূলত অনামিকাকে রাগানোর জন্যই কথাটি বলেছিলো প্রান্তিক…অনামিকা প্রান্তিকের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে নিজেই কুঁচিটা কোমড়ে গুঁজে নিলো ও…
— “ম্যাডাম আঁচলটাও ধরে দেবো নাকি??”
কথাটা বলেই চোখ মারলো প্রান্তিক,অনামিকা বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে ছুঁড়লো প্রান্তিকের দিকে…
— “এবার যান তো আপনি..”
প্রান্তিক বালিশটা ধরলো,
— “হ্যাঁ হ্যাঁ প্রয়োজন ফুরালে তো মানুষ এভাবেই ছুঁড়ে ফেলে দেবে…”
— “যাবেন আপনি?”
প্রান্তিক রুম থেকে বেরিয়ে গেলো…অনামিকা আয়না দেখে দেখে আঁচলটা ভাঁজ করলো,তারপর একটা সেফটিপিন নিয়ে আটকে দিলো আঁচলটা…
— “প্রান্তিক এবার আসুন”
প্রান্তিক মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অনামিকার রুমে এলো…
— “এত দেরি হলো কেনো??”
প্রান্তিক লাল রঙের পাঞ্জাবি পড়ে অনামিকার সামনে দাঁড়ায়…
— “বউ তো রেডী হয়ে গেছে, বর কি একটুও সাজবে না নাকি?কেমন লাগছে বউ আমাকে?”
অনামিকা প্রান্তিককে আপাদমস্তক দেখলো, এই প্রথম শার্ট প্যান্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি পড়েছে ও…
— “এতদিনে আপনাকে বরবর মনে হচ্ছে…”
— “হোয়াট বর্বর??”
অনামিকা হো হো করে হেসে উঠলো…
— “বর্বর নয় বর অ্যান্ড বর, আসুন তো আমাকে গয়না গুলো পড়িয়ে দিন…”
অনামিকা আয়নার সামনে রাখা টুলটায় বসলো…প্রান্তিক একে একে সব গয়না পড়িয়ে দিলো অনামিকাকে… শাঁখা পলা , নোয়া সব একে একে পড়িয়ে দিলো…অনামিকা নিজের হাতদুটো দেখলো….
— “কত স্বপ্ন ছিলো আমার ধুমধাম করে বিয়ে করার,কিন্তু দেখুন কিভাবে বিয়ে করতে হচ্ছে…”
প্রান্তিক অনামিকার দুই কাঁধে হাত রাখলো…
— “আমার বউয়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করবোনা তাই কখনো হয় নাকি? প্রয়োজন হলে দশবার বিয়ে করবো…যতক্ষণ না তোমার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে ততোবার বিয়ে করেই যাবো…”
— “আপনি সত্যিই পাগল, তিন চার বছর পর ছেলেপুলে হয়ে গেলেও কি বিয়ে করবেন নাকি?”
হতাশ সুরে টেনে টেনে বললো প্রান্তিক…
— “তিন চার বছর? এতগুলো দিন ওয়েট করতে হবে ছেলেপুলে জন্য??”
অনামিকা বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লো…ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা চার বাজে…
— “এই চলুন এবার,নাহলে যে লগ্ন পেরিয়ে যাবে…”
— “হুম চলো.., এই একমিনিট…”
অনামিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে, প্রান্তিক কাপড়ের ব্যাগটা থেকে একটা লাল ওড়না বার করলো…তারপর অনামিকার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে ভালো করে ক্লিপ আটকে দিলো…
— “এবার পারফেক্ট,শুধু ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে তুমি মুকুট আর আমি টোপর পড়ে ফেললেই পুরো নবদম্পতি…”
প্রান্তিক নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো,অনামিকা প্রান্তিকের বাহুটা ধরলো…তারপর এগিয়ে চললো নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে…