গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:13
প্রান্তিক হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে, অনামিকা প্রান্তিককে এমনভাবে হন্তদন্ত করতে দেখে অবাক হয়ে… কাল ওদের বিয়ের ছয়মাস পূর্ণ হলো,সেই উপলক্ষেই দুজন মিলে ঘুরতে বেরিয়েছিলো…তারপর অনামিকাকে ফ্ল্যাটে রেখে কোথাও একটা চলে যায় আর এখন এমনভাবে বাড়ি ফেরে…অনামিকা প্রান্তিককে হাঁফাতে দেখে একগ্লাস জল ঢেলে দেয়…
— “কি হয়েছে ? তুমি এরকম করছো যেনো?”
প্রান্তিক জলের গ্লাস টা টেবিলে রেখে নিজের রুমে যায়…ট্রলি ব্যাগটা আলমারির মাথা থেকে নামিয়ে বিছানায় রাখে,
— “লাগেজ গুছাও,আমাদের ইন্ডিয়া ফিরতে হবে…তিনঘন্টা পর ফ্লাইট…”
অনামিকা বিস্ময়ের সহিত তাকায় প্রান্তিকের দিকে…তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা..
— “কি হয়েছে প্রান্তিক? কোনো সমস্যা? এভাবে তাড়াহুড়ো করে ইন্ডিয়া যেতে হবে কেনো?”
— “ওরা আমাদের প্ল্যান জেনে গেছে, তোমার খোঁজে করতে করতে ওরা এখান অবধি চলে এসেছে…তোমার দাদারও প্রাণ সংশয় আছে…”
আঁতকে উঠলো অনামিকা,এবার পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হলো ওর আছে …তার পরিবার বিপদে আছে…
— “তুমি তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস ,পাসপোর্ট সব গুছিয়ে নাও, আমি একবার আসছি…”
— “কোথায় যাচ্ছো?”
— “আমার কাজের জায়গায়…”
প্রান্তিক রুম থেকে বেরিয়ে নিজের গোপন ঘরে ঢুকলো…রুম থেকে নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলো…তারপর রিভলবারটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে ছয়টা বুলেট ভরে নিলো তাতে…
— “তোমার কাছে বন্দুক কোথা থেকে এলো…”
অনামিকার গলা পেয়ে চমকে ওঠে ও, হটাতই মনে পড়লো ভিতরে ঢুকে ও দরজা লক করতে ভুলে গেছে…অনামিকার দিকে ঘুরে তাকালো ও…অনামিকার চোখে নিজের জন্য ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না…ছুটে গিয়ে অনামিকার বাহু দুটো ধরলো…
— “তুমি ভুল বুঝছো, বিশ্বাস করো অনু আমি খারাপ মানুষ নই…”
অনামিকা প্রান্তিকের দুইহাত ঝিনকে ফেলে দিলো…
— “বন্দুক থাকে দুজন মানুষের কাছে,একজন মাফিয়া আর একজন পুলিশবাহিনী…তুমি তো পুলিশ নও,তাহলে কি আমি ধরে নেবো তুমি একজন মাফিয়া…”
প্রান্তিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো…অনামিকাকে সত্যি বলা ছাড়া আর উপায় নেই…কোনো কিছুর বিনিময়ে ও অনামিকাকে হারাতে পারবেনা…পিছিয়ে গিয়ে একটা ড্রয়ার থেকে আইডেন্টি কার্ড বের করে এনে অনামিকার হাতে দিলো…
— “আমি সরকারি পক্ষের আন্ডারকভার সিআইডি অফিসার, প্রীতমদের পুরো গ্যাং টাকে ধরার দায়িত্ব সরকার আমাকে দিয়েছে…”
অনামিকার পা দুটো খানিকটা টলে যায়,প্রান্তিক ধরার চেষ্টা করলে হাত দেখিয়ে বাঁধা দেয় ও…
— “তাহলে তোমার গোপন ঘরের এই রহস্য?এতদিন তোমার সঙ্গে থেকেও আমি জানতে পারলামনা এটা? ”
— “কেউ জানেনা এটা,এমনকি আমার বাবা মাও না…এই মিশনের শুরুতেই হায়ার ডিপার্টমেন্ট আমাদের বলে দিয়েছিলো এই ব্যাপারটা যেনো তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে…এই গ্যাংটা বিশাল বড়ো…যদি জানে আমার আসল পরিচয় তাহলে আমাকেও হয়তো শেষ করে দেবে…”
— “সরি প্রান্তিক আমার এই ঘরে আসা উচিত হয়নি, তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো…কেনো এমন কাজে নিযুক্ত হলে তুমি?”
— “তোমার মত যারা ওদের চক্রে পড়েছে তাদের বাঁচানোর জন্য, আমাদের কাছে শুধু একটা ইনফর্মেশন আছে এই গ্যাং এর লিডার একজন মেয়ে…এবার কলকাতায় গিয়েই বাকিটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে…”
অনামিকা প্রান্তিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর বুকে মাথা রাখলো,
— “আমাকে তুমি এতটা বিশ্বাস করো যে এই ইনফর্মেশনটাও বলে দিলে? আমি যদি এই কথাটা সবাইকে বলে দিই??”
প্রান্তিক দুহাত দিয়ে আগলে নিলো অনামিকাকে,
— “এমনি এমনি তোমাকে বিয়ে করিনি বউ, প্রান্তিক মজুমদারের বউ হওয়ার যোগ্যতা শুধু তুমিই রাখো।আমি জানি তুমি কখনও আমার পিঠে ছুঁড়ি মারবেনা…”
অনামিকা মাথা তুলে প্রান্তিকের মুখের দিকে তাকালো…
— “একটু নিচু হও..”
প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে হাঁটু বাঁকিয়ে খানিকটা নিচু হলো, অনামিকা বিদ্যুৎ গতিতে প্রান্তিকের দুই গালে দুটো চুমু খেলো…প্রান্তিক তার লজ্জাবতী বউয়ের এমন কাণ্ড দেখে খুব অবাক হলো..
— “তুমি আমার সেই লজ্জাবতী বউই তো?”
অনামিকা বেজার মুখ করে প্রান্তিকের বুকে দুটো ঘুষি মারলো..
— “আমাকে এতটা বিশ্বাস করার জন্য একটা গিফট আর দ্বিতীয়টা বোনাস…”
প্রান্তিক অনামিকার কোমর ধরে ওকে আরও কাছে নিয়ে এলো..
— “কপাল আর ঠোঁট টা বাকি থাকে কেনো? আর দুটো এক্সট্রা বোনাস দিয়ে দাও..”
অনামিকা প্রান্তিককে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরায়…
— “মিস্টার পতিদেবতা, এতো লোভ করলে তো হবেনা…যখন যতটা পাবেন সেটা নিয়েই যে খুশি থাকতে হবে আপনাকে…, এবার চলো নাহলে যে ফ্লাইট মিস করবে…”
— “তুমি যাও আমি দু মিনিটে আসছি…”
অনামিকা প্রান্তিকের কথা শুনলো,দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এলো…
— “বরবাবু, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ…”
.
.
মাত্র ঘন্টাখানেক হয়েছে অনামিকা আর প্রান্তিক কলকাতায় এসেছে..এসে ওরা প্রান্তিকের সেই পুরোনো বাড়িতেই উঠেছে…একেবারে নববধূর মত আলতা পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছে ও…সেই চেনা বাড়ি যেখানে ওকে জোড় করে তুলে আনা হয়েছিলো সেখানে আজ ও নিজের ইচ্ছায় একেবারে পরিপাটি করে প্রবেশ করেছে…প্রান্তিক নিজেই সব ব্যবস্থা করেছে অনামিকাকে খানিকক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে…প্রান্তিকের ঘরে বসে আছে এখন ওরা দুজন…
— “তোমাকে একদিন বলেছিলাম তুমি নিজেই আমার কাছে থাকতে চাইবে, আজ কিন্তু সেটাই হচ্ছে বউ…”
অনামিকা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রাত্রির পরিবেশ দেখতে দেখতে বলে,
— “কম অত্যাচার করেছো? আমার গাল দুটো তোমার ওই শক্ত হাত দিয়ে একদম চ্যাপ্টা করে দিয়েছো..”
প্রান্তিক অনামিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর ডান গালে একটা চুম্বন এঁকে দিলো,
— “সুদে আসলে এভাবে পুষিয়ে দেবো, কদিনেই দেখবে ওই চ্যাপ্টা গালদুটো পুরো রাউন্ড হয়ে গেছে, আর লালও হয়ে গেছে…”
অনামিকা সত্যি সত্যিই এবার লজ্জায় লাল হয়ে গেলো…মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে এলো…
— “ইস ”
প্রান্তিক হাসলো,অনামিকাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে একটা স্নেহচুম্বন আঁকলো…পকেট থেকে একটা রিমোর্ট বার করে অনামিকার হাতে দিলো ও…
— “আমাকে বেরোতে হবে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই…বাইরে গার্ডরা আছে…যদি কোনো বিপদের আঁচ পাও এই লাল বোতামটা তিনবার টিপবে…”
অনামিকা খানিকটা চিন্তিত হলো,কলকাতা শহর এখন ওদের দুজনের কারোর জন্যই সেফ নয়…
— “কখন ফিরবে?”
— “রাত হবে, আমি খাবার অর্ডার করে দিয়েছি….দিয়ে যাবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে…”
— “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে, আর শোনোনা আমার কিছু জিনিস লাগবে…”
প্রান্তিক হাসলো,কারণ অনামিকার থেকে ও বেশি জানে অনামিকাকে…
— “আমার এইদিকে খেয়াল আছে ম্যাডাম, লাগেজে সব আছে…তোমার এ টু জেড আমার নখদর্পণে…”
অনামিকা মুগ্ধ হলো,সত্যিই ভাগ্য করে ও পেয়েছে প্রান্তিককে…
— “এতটা ভালবাসো কেনো আমায়?”
প্রান্তিক হেসে উত্তর দিলো,
— “আই ডোন্ট নো বাট…. বাট…”
— “বাট??”
প্রান্তিকের একটু ঝুঁকে অনামিকার কানের কাছে নিজের মুখ টা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,
— “বাট তোমার কোমড়ের ওই কালো তিলটা আমায় বেশ আকৃষ্ট করে…”
লজ্জায় চোখ বুজিয়ে মুচকি হাসলো অনামিকা,
— “তুমি না দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো..”
প্রান্তিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জামার কলার ঠিক করতে করতে বললো,
— “নিজের বউয়ের কাছে অসভ্য হবো না তো কার কাছে হবো? তুমি আমার ,তোমার সবকিছুও আমার…আর ওই তিলটার অধিকার শুধু আমারই…নিজের জিনিস নিয়ে মন্তব্য করাই যায়…”
.
.
প্রান্তিক আর ওর সাথে আরও তিনজন বসে আছে একটা অন্ধকার গোডাউনের মধ্যে, শুধু কটা নিয়ন আলো জ্বলছে যাতে কেউ একে অপরের মুখ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেনা…ওরা কেউ কাউকে চেনেনা,মুখ পর্যন্ত দেখেনি…পর্দার আড়ালে থেকেই চারজন কাজ করে চলেছে এই মিশনের ওপর,
— “মিস্টার প্রান্তিক তাহলে আপনি বলতে চাইছেন এই গ্যাং এর মাস্টারমাইন্ড একজন মহিলা?”
— “ইয়েস মিস্টার গুপ্ত,এবং সে এই কলকাতাতেই নিজের ঘাঁটি করেছে গত তিন চার বছর যাবত, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে আছে যে আমরা তাকে আইডেন্টিফাই করতে পারছিনা…”
— “তাহলে এখন কি করার? কিভাবে ওই ক্রিমিনালটাকে আমরা ধরবো??”
ওদের মধ্যে আরও একজন বলে ওঠে,
— “আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে, এক্ষেত্রে আমাদের লাগবে মিসেস মজুমদারকে, যেহেতু উনি একজন ভিকটিম তাই ওনাকে দিয়েই আমাদেরকে ওই ক্রিমিনালটাকে চিনতে হবে…”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রান্তিক, কেউ দেখতে না পেলেও প্রান্তিকের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছে…
— “মিস্টার সিং, একটা কথা শুনে রাখুন আমি এই মিশনের জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে দিতে পারি কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে কখনোই এই বিষয়ে ইনভলভড করবোনা, তাকে আমি যে জায়গা থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি সেখানে আবার পা রাখতে দেবোনা…”
মিস্টার গুপ্ত সহমত হলো প্রান্তিকের কথায়…
— “আমারও তাই মনে হয় মিস্টার মজুমদার, এইভাবে ইনোসেন্ট মানুষদের গান পয়েন্টে রেখে আমরা নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে পারিনা,আমাদের অন্যকিছু ভাবতে হবে…”
লোকটা অনুতপ্ত হলো নিজের কথায়,সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো…প্রান্তিক একটু শান্ত হলো…
— “এক্ষেত্রে মিস সিনহা আমাদের হেল্প করতে পারেন,পরের মিটিংয়ে ওনাকে রাখতে হবে…”
*
রাত প্রায় দুটো বেজে গেছে, প্রান্তিক ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে নিজের বেডরুমে যায়, অনামিকা গভীর ঘুমে নিমগ্ন, প্রান্তিক আলমারি থেকে একটা টিশার্ট আর টাউজার বের করে চেঞ্জ করে চুপিচুপি এসে অনামিকার পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে….
— “এতক্ষনে তোমার আসার সময় হলো?”
প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনামিকার দিকে, অনামিকা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে…
— “তুমি ঘুমাওনি? এতক্ষন নাটক করছিলে তাহলে!”
অনামিকা প্রান্তিকের দিকে ঘুরে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো,
— “তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় ,যতক্ষণ তুমি বাড়ির বাইরে থাকো আমি আতঙ্কে থাকি…”
প্রান্তিক অনামিকার মাথায় হাত বুলালো,
— “তোমার আতঙ্কের দিন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে বউ, আমি তোমাকে আর তোমার সিঁথির সিঁদুরকে অক্ষত রাখবো,কথা দিলাম..”
— “খেয়েছো?”
— “আমি তো জানি আমার বউও না খেয়ে আছে,আমি কি করে একা খেয়ে নিই বলো?”
অনামিকা উঠে বসলো,
— “আমি এক্ষুনি খাবার গরম করে আনছি,খেয়ে তারপর ঘুমাবে…”
প্রান্তিক বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো…
— “তোমার শরীর অসুস্থ,বিশ্রামের প্রয়োজন তোমার…আমি খাবার আনছি,একসঙ্গে খাবো…”