গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:14
আজ কলকাতায় আসার এক সপ্তাহ পর অনামিকার আর প্রান্তিক এসেছে অনামিকার বাবার বাড়িতে, অনামিকাকে দেখে ওর মা জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছে, প্রায় আট মাসেরও বেশি সময় উনি ওনার মেয়ের খবর না পেয়ে চোখের জল ফেলেছেন…আর আজ সব সত্যিটা জেনে উনি খুব খুশি হয়েছেন,ছোটো থেকেই উনি চাইতেন প্রান্তিকের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে,আর আজ ওনার সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ায় বাড়িতে আনন্দের পরিবেশ…
ছোট্ট গুবলু ওরফে বর্নিশ পাল এতদিন পর পিপিকে কাছে পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছেনা,
— “পিপি তুই আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলি?”
অনামিকা বর্নিশকে আদর করলো,
— “পিপি একটু কাজে গিয়েছিলো বাবু…”
— “আর তুই যাবিনা তো আমাকে ছেড়ে?”
ওদের কথার মাঝে অনামিকার বৌদি বর্ণালী ঘরে ঢুকলো চায়ের ট্রে আর কিছু খাবার নিয়ে,
— “তোমাকে জ্বালানো শুরু করে দিয়েছে তো? ব্যাস এবার দেখবে তোমাকে আর ছাড়বেই না…”
অনামিকা ওর ভাইপোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,
–“ ও জ্বালাবেনা তো কে জ্বালাবে,ওর এই জ্বালানোটাকে যে আমি কত মিস করেছি…”
বর্ণালী ট্রেটা রাখলো একটা টেবিলে ওপর,
— “ওকে এবার খাওয়াতে হবে অনু,আমি ওকে নিয়ে গেলাম…তোমরা এগুলো খেয়ে নাও…”
বর্ণালী বর্ণিশকে নিয়ে চলে গেলে প্রান্তিক অনামিকার গা ঘেঁসে বসে, অনামিকা দরজার দিকে দেখে…
— “দরজা খোলা আছে কিন্তু..”
প্রান্তিক অনামিকাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো,
— “তোমার বাবা মা আর দাদা বৌদির এইটুকু বুদ্ধি আছে যে মেয়ে জামাইয়ের ঘরে না নক করে ঢুকবে না…”
— “শ্বশুরবাড়িতে এসেও এই অসভ্যতামি কমবেনা তোমার??”
প্রান্তিক এবার অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো ওর কোলে মাথা রেখে,
— “বউ থাকলে কাছে,প্রেম আসে মনের আনাচে কানাচে..”
প্রান্তিকের কবিতা শুনে অনামিকা না হেসে পারলোনা,
— “এইসব ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে এবার লেখক বা কবি হয়ে যাও..”
— “মন্দ বলোনি, জানো তো ব্যবসায়ী দের থেকে আবার এই লেখক কবিরা বেশি রোমান্টিক হয়,তখন আবার সহ্য করতে পারবে তো এই রোমান্টিক বরের ভালোবাসার অত্যাচার?”
— “তুমি বড্ড ফাজিল হয়েছো,তোমার একটা ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি…”
— “তোমাকে ব্যবস্থা করতে হবেনা,প্রকৃতিই ব্যবস্থা করে দেবে ঠিক..”
প্রান্তিকের কথাটা অনামিকার ঠিক বোধগম্য হলোনা,তাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো…
— “মানে?”
— “ওয়েদার রিপোর্টে দেখলাম আজ সেভেন্টি পার্সেন্ট বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে,আর জানোই তো এই ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে মনটা একটু বেশিই রোমান্টিক হতে চায়…ইউ নো দ্যাট…”
অনামিকা প্রান্তিকের হাতে মারলো,তারপর প্রান্তিককে বিছানায় ফেলে দিয়ে ও বিছানা থেকে নেমে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ায়…
— “আজ কিন্তু আমি বাড়ি যাচ্ছিনা , আমি আজকে মায়ের কাছে থাকবো…”
প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো অনামিকার দিকে,
— “মানেটা কি? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম আগেই যে বিকালে ফিরে আসবো..”
অনামিকা প্রান্তিকের কাছে সরে গিয়ে ওর বুকে হাত রেখে জামাতে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে,
— “শোনো না আজকের দিনটা থাকি প্লীজ? ”
— “না অনামিকা বোঝার চেষ্টা করো আমরা দুজনই কিন্তু নিরাপদে নেই, পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ওই বাড়িটা এই বাড়ির থেকে বেশি নিরাপদ,ওখানে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমার দেহরক্ষীরা আছে…কিন্তু আমি চাইনা আমার জন্য এই বাড়ির কেউ বিপদে পড়ুক, আশা করি তুমিও সেটা চাওনা??”
অনামিকা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো, প্রান্তিক বুঝতে পারলো অনামিকার মন খারাপের কারণ, যে বাড়িতে বাইশ বছর কাটিয়েছে সেখানে মায়া সবথেকে বেশি…অনামিকাকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে নরম স্বরে বললো..
— “আমরা আবার আসবো,আমার মিশনটা ফুলফিল হোক,তখন আবার আসবো আমরা…তখন এসে এক সপ্তাহ থেকে তারপর অস্ট্রেলিয়া ফিরবো…”
— “ তুমি ঠিক বলছো তো??”
— “ হুম, একদম ঠিক, তবে আজ কিন্তু যাওয়ার সময় একদম কান্নাকাটি করা যাবেনা। আমি তোমার কান্না একদম সহ্য করতে পারিনা…”
অনামিকা প্রান্তিকের বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকালো,
— “ আচ্ছা প্রান্তিক,তোমাকে এতদিন জিজ্ঞাসা করিনি কিন্তু আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে একটা কথা..”
— “কি কথা ,বলো”
— “তোমার বাবা মা মানে প্রলয় কাকু আর তনুশ্রী কাকিমা জানেন আমাদের বিয়ের কথা? ওনারা আমাকে মেনে নেবেন তো ওনাদের বৌমা হিসাবে?”
প্রান্তিক অনামিকাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো,
— “তোমার আর আমার বাবা মা তো সেই কোন ছোটো থেকে ভেবেই রেখেছিলো আমাদের বিয়ে দেবে, মাঝখানের কয়েকটা ঘটনার জন্য বিচ্ছেদ হলেও তোমার কথা বলায় মা পাপা দুজনেই খুব খুশি হয়েছে…”
— “তুমি ওনাদেরকে তো আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসতে পারো, আমারও সারাক্ষণ একা একা ভালো লাগেনা…”
— “বলেছিলাম, আসতে চায়নি… ওনারা দুজন এখন আমাদের কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ট করার সুযোগ দিচ্ছেন, যখন আমাদের মধ্যে তৃতীয় কেউ আসবে তখন মা বাবা আমাদের সঙ্গে এসে থাকবে বলেছে…”
অনামিকা চমকে উঠলো তৃতীয় ব্যক্তির কথা শুনে, গাল ফুলিয়ে প্রান্তিকের সামনে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো ও…
— “একবার তৃতীয় কাউকে এনে দেখোনা, তোমার পা ভেঙে বাড়িতে ফেলে রাখবো..”
প্রান্তিক আড়ালে মুচকি হেসে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অনামিকার গলাটা জড়িয়ে ধরে,
— “তৃতীয় ব্যক্তির আগমন তো ঘটবেই,আর সে আমার নয় তোমার হাত ধরেই আমাদের মাঝে আসবে…”
অনামিকার চোখটা ছলছল করে উঠলো, জড়ানো গলায় বললো-
“তুমি এখনও ভাবছো আমি প্রীতমকে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনবো??”
প্রান্তিক শব্দ করে হেসে অনামিকার নাকটা টেনে দিলো,
— “তুমি সত্যিই পাগলী,আমি তো আমাদের বেবির কথা বলছিলাম…”
মুহূর্তেই অনামিকা স্বাভাবিক হয়ে গেলো,নিজের বোকামোর কথা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলো,
— “তুমি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে, আরেকটু হলেই আমি কেঁদে দিতাম…”
— “হুম জানি তো,তোমার মাথা পুরোটাই ফাঁকা ,যেমন বুদ্ধি নেই আর তেমনই কাঁদুনে..”
— “বাজে না বলে বৌদি কি কি দিয়ে গেলো খেতে শুরু করুন তো, সকালে তো ব্রেকফাস্ট করার টাইম পাওনি, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে…?”
— “হুম পেয়েছে তো, চলো খেয়ে নিই..”
.
.
অনীশ বর্ণালী,প্রান্তিক আর অনামিকা বসে আছে ড্রয়িং রুমে,সাধারণ গল্পগুজবই করছিলো তখন অনামিকার বাবা অতনু বাবু আসেন ওখানে,
— “তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো প্রান্তিক,আজ এতগুলো মাস পর মেয়েটাকে দেখলাম…সময় করে এখানে আসার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ..”
— “তোমার সঙ্গে কি আমার থ্যাঙ্ক ইউর সম্পর্ক অতনু কাকু?”
অনামিকা পাশ থেকে প্রান্তিকের পেটে গুঁতো মারে…কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে…
— “অতনু কাকু আবার কি? শ্বশুরমশাইকে কেউ নাম ধরে কাকু বলে ডাকে? বাবা বলো..”
অনামিকা আস্তে আস্তে কথাটা বললেও ওখানে উপস্থিত সবাই কথাটা শুনতে পেয়ে যায় আর শুনে হেসে ফেলে…অতনু বাবু অনামিকার উদ্দেশ্যে বলে…
— “আহ অনু এরকম কেউ করে? ওর যা ইচ্ছে সেটা বলেই ডাকুক আমাকে, আমার কোনো আপত্তি নেই..”
প্রান্তিক বোকা বোকা চাওনিতে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে…
— “আসলে এতদিনের অভ্যাস তো? তাই আর কি…”
— “কোনো সমস্যা নেই প্রান্তিক,তোর যা ইচ্ছে হয় তাই বলেই ডাকবি আমাকে…”
ওদের কথার মাঝে অনামিকার বৌদি বর্ণালী উঠে পড়ে, তাই দেখে অনামিকা বলে..
— “কি হলো বৌদি , কোথায় যাচ্ছো??”
— “মা রান্নাঘরে একাই কাজ করছেন,আমি গিয়ে একটু হেল্প করি…”
— “আমিও যাই?”
অনামিকা উঠতে গেলে বাঁধ সাধলো বর্ণালী,
— “বাব্বাহ ননদিনী আমার দেখছি ভালোই সংসারী হয়ে উঠেছে, জল গড়িয়ে না খাওয়া মেয়েটাও রান্নাঘরে যেতে চাইছে…তোমাকে কি রান্নাবান্না করতে হয় নাকি ওখানে?? নন্দাই তোমাকে রাজরানী করার বদলে চাকরানী করে রেখেছে নাকি?”
কথাটা প্রান্তিকের ঠিক হজম হলোনা, একমুহুর্তের জন্য ওর মনে হলো ও যেনো কোনো বাড়ির রাজকন্যাকে চাকরানীর মত খাটিয়েছে এতদিন…অনুশোচনা হলো ওর, অনামিকা প্রান্তিকের চোখের অভিব্যক্তি পড়তে সক্ষম হয়…চোখের ইশারায় বেশি ভাবতে বারণ করে প্রান্তিককে…তারপর বৌদির উদ্দেশ্যে বলে…
— “কি বলোতো বৌদি নিজের সংসার হয়ে গেলে নিজেকেও পাল্টাতে হয়, সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়…এই দেখোনা তুমি বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছো ছয় বছরেরও বেশি হয়ে গেলো…কিন্তু আমার মা এখনও সংসারের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলো না..এখনও একা একা আমাদের জন্য রান্না করে যাচ্ছে…আমি তাই বিয়ের পর থেকেই সংসারের কাজ শিখছি…”
অনামিকার কথাটা গিয়ে লাগলো ঠিক বর্ণালীর বুকে, মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে অনামিকার কাছে এগিয়ে এলো কিছুটা…
— “তুমি কি বলতে চাইছো অনু আমি বাড়ির কোনো কাজ করিনা?”
অনামিকা হাসলো…
— “আমি সেটা বলিনি বৌদি,আমি শুধু বলছি আমার মায়ের তো বয়স হচ্ছে…এবার মাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও…”
বর্ণালী ব্যাঙ্গ করে হাসলো,
— “খুব তো সংসার সংসার করছো, সংসার কাকে বলে জানো?? শ্বশুর ,শ্বাশুড়ি ,ননদ দেওর ,ভাসুর , জা নিয়ে একটা সংসার গড়ে ওঠে…তুমি তো বরকে নিয়ে একা থাকো, শ্বশুর ,শ্বাশুড়ির ঝামেলা বুঝবে কি করে?”
বর্ণালীর কথা শুনে গর্জিয়ে উঠে দাঁড়ালো অনীশ,
— “তুমি অনেক বেশি বলে ফেলেছো বর্ণালী, ঘরে যাও…আমার বোনকে আর একটাও বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাবো তুমি বর্নিশের মা… এখান থেকে যাও…”
— “আর তোমার বোন কি বললো শুনতে পাওনি তুমি?”
— “তোমাকে যেতে বলেছি..”
বর্ণালী রাগে, অপমানে চলে গেলো ওখান থেকে…অতনু বাবু সবার অলক্ষে চোখের জলটা মুছলেন…অনীশ অতনু বাবুর সামনে বসে ওনার হাত টা ধরলো…
— “বর্ণালীর হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি বাবা…”
অতনু বাবু হাত রাখলেন অনীশের মাথার ওপর,
— “ধুর পাগল, ও তো আমার মেয়ের মতোই…মেয়ের কথায় আমি কিছু মনে করতে পারি…জানিস অনু তোর বৌদিটা না একদম পাগল…যা বলে মনে থেকে বলেনা, ওর কথায় কিছু মনে করিসনা..”
— “এই নাহয় কটা মাস তোমাদের ছাড়া আছি, এর আগে গত পাঁচ বছর ধরে তো বৌদিকে দেখেছি…আমি জানি বৌদি কেমন…আমি কাজ করলেও বৌদির চোখে কোনোদিন সেটা পড়তোনা…এতদিন কিছু বলিনি কিন্তু আমার হাসবেন্ডের নামে খারাপ কথা আমি সহ্য করবোনা বাবা..”
প্রান্তিক অনামিকার হাতটা চেপে ধরলো,
— “আহ্ অনামিকা,বড্ড বেশি কথা বলছো তুমি…বৌদি তোমার গুরুজন,এভাবে কেনো কথা বললে? বৌদি কষ্ট পেয়েছে..বৌদির কাছে ক্ষমা চেয়ে আসো..”
— “প্রান্তিক!!! তুমি বলছো এটা? তুমি তো আমাকে সবসময় শিখিয়েছো অন্যায় মুখ বুজে সহ্য না করতে…”
— “সেটা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় অনু,কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুখ বুজে সহ্য করতে হয়..”
— “তাই বলে বৌদি বাবা মাকে খাটাবে, তোমাকে অপমান করবে সেটা আমি সহ্য করবো??”
— “হ্যাঁ করবে, প্রয়োজন হলে কাকু কাকিমাকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে যাবো…কিন্তু তুমি বৌদির সাথে এভাবে কথা বলে ঠিক করোনি…এক্ষুনি সরি বলবে তুমি বৌদিকে…”
অনামিকা মাথা নিচু করে মুখ ভার করে ফেললো…
— “ঠিকাছে”