তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:15

0
333

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:15

প্রান্তিক আর অনামিকা নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছে বিকালে, তারপর প্রান্তিক আর কোথাও বেরোয়নি…অনামিকাকে রান্নার কাজে হেল্প করছে ও…
— “আমি সত্যিই তোমাকে এতদিন অনেক খাটিয়েছি, এবার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেই একজন মেড রাখবো…”

রুটিটা বেলতে বেলতে অনামিকা তাকায় প্রান্তিকের দিকে…প্রান্তিকের মুখে অনুশোচনার ছাপ দেখতে পায় ও…
— “দুজনের সংসারে আবার মেড? তার কোনো দরকার নেই প্রান্তিক…যেমন ছিলাম ভালো ছিলাম…”

— “তুমি কাজ করে করে কেমন পাতলা হয়ে গেছো, অনেক ওয়েট কমে গেছে তোমার…আগে কি সুন্দর গোলুমোলু ছিলে…তবে আজ যেনো তোমাকে একটু বেশিই রোগা লাগছে…”

— “এটা তোমার মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়, আর এটাকে রোগা বলেনা…বলে জিরো ফিগার…”

প্রান্তিক অনামিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে নিজের থুতনিটা রাখে…
— “আমার তো জিরো ফিগার বউ চাইনা, আমার আগের অনামিকাকেই চাই…”

অনামিকা প্রান্তিকের মন খারাপ বুঝতে পেরে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে…
— “প্রীতমদের দলের কি খবর?? মাস্টারমাইন্ডকে ধরতে পারলে??”

প্রান্তিক অনামিকার কাঁধ থেকে মুখটা তুলে একটা আলু নিয়ে কাটতে কাটতে বলে..
— “না এখনও কোনো খবর পাইনি…তবে শুনেছি এই আট মাসে আরও পঁচিশটা মেয়ে ওদের স্বীকার হয়েছে…”

অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রান্তিকের দিকে,
— “এটা কিভাবে জানলে?”

অন্যমনস্ক হয়ে আলু কাটতে কাটতে ছুঁড়িটা বেখেয়ালে প্রান্তিকের আঙুলের ওপর দিয়ে চলে যায়..এর ফলে বেশ খানিকটা কেটে যায় প্রান্তিকের আঙুলটা…অনামিকা তড়িঘড়ি করে এসে একটা জলের পাত্রে প্রান্তিকের হাতটা ডুবিয়ে দেয়…

— “এত অন্যমনস্ক হলে হয়? তোমাকে আগেই বলেছিলাম এইসব মেয়েলি কাজ তুমি পারবেনা…কেনো শুনলে না আমার কথা?”

— “আমি রুমে গিয়ে ফার্স্টএড করে নিচ্ছি, তুমি রুটি গুলো করো..”

প্রান্তিক আবারও কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে নিজের রুমে চলে যায়..রুমে ঢুকতেই দেখে ওর ফোনে তিনটে মিসড কল মিস “মিস সিনহা” নামের নম্বর থেকে…প্রান্তিক ঘুরিয়ে কল ব্যাক করতেই মুহূর্তের মধ্যে ফোন রিসিভ হয়,
— “হ্যাঁ মিস সিনহা বলুন,কোনো নতুন খবর আছে?”

— “ইয়েস স্যার, আপনার কথা মত আমি ওই গ্যাং এর একজন মেম্বার রোহিত বসাককে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছি,ও আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে…এবার ওর মাধ্যমেই আমরা ওদের লিডারের কাছে পৌঁছাবো..”

— “গুড মিস সিনহা, তবে খুব সচেতনতার সঙ্গে কাজটা করবেন, ওরা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন…”

— “বিপদ তো আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী, তাই বলে কি বিপদের সম্মুখীন হবো না?? এই দেশের জন্য যদি আমাকে মরতেও হয় তাহলে আমি আনন্দের সাথে মৃত্যুবরণ করবো…”

প্রান্তিকের খুব ভালো লাগলো রাইমার কথাটা, মুচকি হেসে ও বললো..
— “আপনার মত বীর যোদ্ধাই তো আমাদের ডিপার্টমেন্টে চাই,প্রাউড অফ ইউ মিস সিনহা… অল দ্য বেস্ট ”

দরজার বাইরে একজোড়া পা এর উপস্থিতি টের পেয়ে প্রান্তিক ফোনটা কেটে দেয়..তারপর আচমকা দরজা খুলে দিতেই অনামিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে…প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে…
— “দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করেছিলে? আমার কথা শুনছিলে?”

— “বর যদি দরজা বন্ধ করে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে তাহলে তো বউকে আরি পাততেই হবে..”

অনামিকার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো প্রান্তিক, নিশ্চই ভুল বুঝেছে…অনামিকাকে সঠিক বোঝাতে তাই উদগ্রীব হয়ে উঠলো প্রান্তিক…
— “তুমি যেটা ভাবছো সেটা ঠিক নয় অনু,তুমি আমাকে ভুল বুঝছো…”

— “মিস সিনহাটা কে প্রান্তিক?”

অনামিকার সরাসরি প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় প্রান্তিক, সবটা কি অনামিকা শুনেছে? কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা…সত্যিটা বলে নিজের কাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবেনা ও…তাই ওকে মিথ্যেটাই বলতে হবে… প্রান্তিককে চুপ করে থাকতে দেখে অনামিকা আবারও বলে…
— “চুপ করে কেনো আছো প্রান্তিক? তুমি কি আমাকে চিট করছো?”

— “না অনু,আমি তোমাকে ভালোবাসি…আমি তোমার সাথে প্রতারণা করতে পারিনা…”

— “তাহলে এই মিস সিনহাটা কে??”

— “আমার অস্ট্রেলিয়ার অফিসের একজন কলিগ, আমি যখন এই কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই তখন উনিই আমার অবর্তমানে অফিসটা সামলান…”

অনামিকার ঠিক বিশ্বাস হলোনা প্রান্তিকের কথাটা,কোথাও গিয়ে একটা খটকা লাগছে ওর…
— “অস্ট্রেলিয়ার মেয়ের সাথে বাংলায় কথা বলছো?”

— “উনি কলকাতারই মেয়ে, কলকাতার অফিস বন্ধ করায় উনি অস্ট্রেলিয়ার অফিসে শিফট করেছেন…”

কথাটা অনামিকা কতটা বিশ্বাস করলো সেটা বুঝতে পারলনা প্রান্তিক,তবে অনামিকা আর কিছু বললো না… প্রান্তিককে পাশ কাটিয়ে রুমের মধ্যে চলে গেলো…
— “ওয়েদার খারাপ হচ্ছে, আকাশে মেঘ আছে…মনে হয় এক্ষুনি ঝড় উঠবে, তুমি বাড়ির সব জানালাগুলো বন্ধ করে দাও..আমি রান্নাটা শেষ করি গিয়ে…”

— “ম্যাডাম হটাৎ রান্না ছেড়ে আমার কাছে এলেন কেনো?? মনে হচ্ছে সামথিং সামথিং…”

অনামিকা প্রান্তিককে বিছানায় বসিয়ে ফার্স্টএড বক্স টা নিয়ে প্রান্তিকের পাশে বসলো,
— “নিজের যত্ন তো কোনোদিনও নেবেনা, এবার আঙুলটায় ইনফেকশন হয়ে গেলে রিভলবার ধরবে কি করে??রুমে এসেই শুরু করে দিয়েছেন ওনার মিস সিনহার সাথে কথা…”

প্রান্তিক বুঝলো এবার প্রত্যেকবার এরকম খোঁটা দেওয়া কথা শুনতে হবে…মেয়েরা বড্ড অদ্ভুদ জিনিস…মনে মনে ভাবে প্রান্তিক…
— “আজকে কিন্তু ওয়েদারটা বেশ মনোরম,তাহলে হয়ে যাবে নাকি আজ একবার… বউউউউউউ..”

অনামিকা রাগী চোখ করে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “হাতটা দাও,এসব ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই…”

প্রান্তিক অনামিকা পাশে একটু ঘেঁসে বসলো…
— “কেনো এরকম করছো বউ? বিশ্বাস করো রাইমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই..উনি জাস্ট আমার কলিগ…”

— “আমি কিছু বলেছি??”

— “না তুমি অভিমান করছো, আমার সাথে ভালো করে কথা বলছো না…”

অনামিকা আর কোনো কথা বললো না,প্রান্তিকের হাতটা ভালো করে ব্যান্ডেজ করে ফার্স্টএড বক্সটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে এসে প্রান্তিকের পাশে বসলো…আলতো করে মাথা এলিয়ে দিল প্রান্তিকের ডান কাঁধে…
— “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি প্রান্তিক… আই লাভ ইউ…”

প্রান্তিক ডানহাত দিয়ে আগলে নিলো অনামিকাকে…
— “আই লাভ ইউ টু বউ, একটা আবদার করবো?”

— “কি?”

— “আমাদের বিয়ের তো প্রায় নয়মাস হতে চললো, চলোনা এবার আমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করি…”

অনামিকা অবাক হয়ে তাকালো প্রান্তিকের দিকে,
— “এই যা চিকেন টা বসিয়ে এসেছি ওভেনে, মনে হয় পুড়েই গেলো…”

অনামিকা তড়িঘড়ি করে ছুটলো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে…প্রান্তিক অনামিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো…
— “এখনও তোমার এই লজ্জাটা কাটাতে পারলামনা আমি, পাগলী বউ আমার…”

.
.
রাত্রি নেমেছে,সঙ্গে বাইরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে…গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এই বৃষ্টি… অনামিকা এইমাত্র সব এঁটো বাসন ধুয়ে রুমের মধ্যে এলো.. প্রান্তিককে কোথাও খুঁজে পেলো না…
— “প্রান্তিক , কোথায় তুমি??”

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রান্তিক বৃষ্টির যমযম শব্দের কারণে অনামিকার আওয়াজ শুনতে পেলনা ও…অনামিকার কি মনে হতে বারান্দার দরজা ঠেলতেই দেখে প্রান্তিক দাঁড়িয়ে আছে…
— “এখানে কি করছো তুমি??”

প্রান্তিক অনামিকার দিকে ঘুরে ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো,অনামিকাকে সামনে রেখে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে অনামিকার ঘাড়ে মুখ ডোবালো প্রান্তিক…অনামিকা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়…প্রান্তিক নেশালো কন্ঠে বলে…
— “উঁহু, ছাড়া পাওয়ার একদম চেষ্টা করো না বউ, আজকে তোমাকে ছাড়ছিনা…”

— “আজকের দিনটা ছেড়ে দাও,আমার ভালো লাগছেনা…”

প্রান্তিকের হাতের বাঁধন আলগা হতেই অনামিকা একটু সরে দাঁড়ায়..কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না… শাড়ির ভাঁজ সরিয়ে সরাসরি অনামিকার শ্যামলা মেদহীন কোমড় ধরে আবারও নিজের কাছে ওকে টেনে আনে প্রান্তিক…অনামিকা বিরক্ত হয়..
— “বললাম তো আজকে ভালো লাগছেনা…”

— “তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করবোনা,তবে কিছুক্ষন থাকো এরকমভাবে… বৃষ্টিটাকে উপভোগ করো…”

অনামিকা চুপ হয়ে যায়, দুজন মিলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকে…বৃষ্টির একটু একটু ঝাপটা এসে মাঝেমধ্যে দুজনকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে…
— “আচ্ছা অনামিকা ,তোমার ফেভারিট ডেস্টিনেশন কোনটা?”

অনামিকা প্রান্তিকের দিকে ঘুরে তাকায়,
— “হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

— “বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেলো,হানিমুনে যাওয়া হয়নি…এবার ভাবছি কলকাতা থেকে একেবারে হানিমুনে যাবো..বলো না..”

— “প্যারিস..”

— “তাহলে দুটো টিকিট বুক করে ফেলি?”

অনামিকা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়…প্রান্তিক এবার অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে রুমে এসে ল্যাপটপ খুলে বসে…অনামিকা বেশ কিছুটা অবাক হয়…প্রান্তিকের পিছন পিছন ও নিজেও রুমে আসে,
— “হঠাৎ চলে এলে যে? এই যে বললে বৃষ্টি উপভোগ করবে!”

প্রান্তিক ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে অনামিকার দিকে তাকায়…
— “বউ আমার প্যারিস ভালোবাসে, সেই ইচ্ছে পূরণ করার জন্য তো এক্ষুনি আমাকে ফ্লাইটের দুটো টিকিট কেটে ফেলতে হবে…”

অনামিকা অবাক হলো প্রান্তিকের কথা শুনে,
— “এত তাড়াহুড়ো করছো কেনো? তোমার এইদিকের ঝামেলাটা মিটুক তারপর না হয় যাওয়া যাবে…”

— “এখন ফ্লাইটের অবস্থা খুব খারাপ, তাই আগে থেকেই করে রাখছি বুকিংটা…”

প্রান্তিক ল্যাপটপটা বন্ধ করে বিছানা থেকে উঠলো,তারপর বিছানা থেকে গাড়ির চাবিটা তুলে নিলো…সেটা দেখে ভীষণ অবাক হলো অনামিকা…
— “তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?? বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে আর কত রাত হয়েছে দেখেছো?”

— “ইম্পর্ট্যান্ট মেল এসেছিলো, এখনই যেতে হবে…তুমি রুম লক করে শুয়ে পরো, আমার আসতে দেরি হবে…”

প্রান্তিক যেতে গেলে অনামিকা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়…
— “তুমি আমার ওপর রাগ করে চলে যাচ্ছো তাইনা??”

অনামিকার ছলছল করা চোখ দেখে প্রান্তিক চমকে ওঠে,অনামিকাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে…
— “ তুমি ভুল বুঝছো বউ, আমি তোমার ওপর রাগ করিনি…আমার সত্যিই কাজ আছে…”

— “তুমি মিথ্যে বলছো, প্লীজ যেওনা…”

প্রান্তিক অনামিকার কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দিলো,
— “আমাকে সত্যি যেতেই হবে গো, এটা আমার প্রফেশন…পার্সোনাল লাইফের সাথে গুলিয়ে ফেললে তো হবেনা..”

— “তুমি সত্যিই রাগ করে নেই তো?”

— “তুমি আমাকে এতদিনেও চিনলে না? আমি এইসব কারণে রাগ করবো এমন ছেলে আমি নই…”

অনামিকা মাথা নিচু করে ফেললো..
— “সরি ”

— “আসছি, সাবধানে থেকো…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here