তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:16

0
332

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:16

চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার , বৃষ্টিমুখর পরিবেশে মাঝেমধ্যেই আকাশের গর্জন ভেসে আসছে…দুর থেকে ব্যাং আর ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ শব্দ প্রান্তিকের কথার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে…প্রায় দশজনের একটা মিটিংয়ের মধ্যমণি প্রান্তিক মজুমদার…
— “আমি মনে হয় এই কেসের একদম কিনারায় চলে গেছি, নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট সল্ভ করে ফেলেছি ,এবার বাকিটা ক্রিমিনালদের স্বীকারোক্তিতে…”

প্রান্তিকের কথা শুনে উপস্থিত বাকি সবাই খুব অবাক হয়…এত গভীর রহস্য কিভাবে প্রান্তিক জেনেছে সেটা শুনতে সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে…
— “কি বলছেন মিস্টার মজুমদার? এত কঠিন কেস টা আপনি এত সহজে সল্ভ করলেন কিভাবে?”

— “আমি অনেক বড় একটা প্রমান পেয়েছি, আর এই গ্যাংএর সেই লিডারকেও ধরে ফেলেছি হয়তো, সে যদি লিডার নাও হয় তাহলেও তার মাধ্যমেই আমি আসল মাস্টারমাইন্ড এর কাছে পৌঁছাবো…”

— “কে সেই লিডার মিস্টার মজুমদার?”

— “সব বলবো,তার আগে মিস সিনহাকে বলবো আপনি আপনার কাজ টা বন্ধ করুন…যেহেতু মাথার কাছে পৌঁছে গেছি সেহেতু আর ওই চুনোপুটিকে ফাঁদে ফেলার দরকার নেই..”

অন্ধকারে কাউকে দেখা না গেলেও রাইমা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়…
— “আপনি তো এই কয়েকঘন্টা আগে অবধি বললেন কাজটা করতে,তাহলে এই কয়েকঘন্টায় এমন কি প্রমাণ পেলেন স্যার?”

প্রান্তিক বাঁকাভাবে হাসলো,
— “অনেক বড়ো প্রমাণ পেয়েছি…যেটা আমাদের এই কেসটা সল্ভ করে দেবে…”

— “তাহলে আমরা অপেক্ষা কেনো করছি? এখনই তাকে গিয়ে অ্যারেস্ট করে নিই?”

— “না আমাদের কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে অ্যারেস্ট করার জন্য, মাছকে এমনভাবে বর্শীতে আটকাতে হবে যাতে সে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায়…”

.

.
— “এই শুনছো ,বৌদিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছেনা..”

সকালবেলা প্রান্তিক বাড়ি ফিরতেই কথাটি বলে অনামিকা…প্রান্তিক গাড়ির চাবিটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বিছানায় আরাম করে বসলো…
— “খুব টায়ার্ড লাগছে,একটু জল দেবে অনামিকা?”

অনামিকা করুন মুখে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিতে গেলে দেখে গ্লাস ফাঁকা…
— “একটু বসো,আমি এক্ষুনি জল নিয়ে আসছি…”

অনামিকা চলে যেতেই প্রান্তিক ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, একটা চেনা নাম্বার ফোনে ডায়াল করার কিছুক্ষনের মধ্যেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা রিসিভ হয়…
— “বর্ণালী ম্যাডাম কিছু স্বীকার করেছেন?”

— “না স্যার, উনি জেদ ধরে বসেই আছেন…বলছেন মরে যাবেন তবুও কিচ্ছু বলবেননা..”

— “ভয় দেখাও,চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি পজিটিভ কিছু শুনতে চাই…”

— “উনি কিচ্ছু খেতে চাইছেন না স্যার…”

— “তোমরা আছো কি করতে?? এতগুলো টাকা দিয়ে তোমাদের রেখে আমার লাভটা কি? আমি বেলার দিকে আসবো..তখন আমি ওনার মুখ থেকে যেনো সব জানতে পারি..”

— “ঠিকাছে স্যার..”

প্রান্তিক ফোনটা কেটে দরজাটা খোলে,কিছুক্ষনের মধ্যেই অনামিকা আসে…
— “তুমি দরজা বন্ধ করে কি করছিলে? একবার এসে ফিরে গেলাম…!”

— “চেঞ্জ করছিলাম,দাও জল দাও..”

অনামিকা প্রান্তিকের সামনে খাবারের প্লেটটা রাখলো,
— “বেলা তো হয়েই আসছে, ব্রেকফাস্টটা করেই নাও..”

প্রান্তিক বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে প্লেটটা তুলে নিলো, পাউরুটিতে একটা কামড় দিয়ে বললো..
— “কি যেনো বলছিলে? কাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা!!”

অনামিকা চিন্তিত মুখে প্রান্তিকের সামনে বসলো…
— “বৌদিকে, কাল রাত থেকে নাকি বৌদি মিসিং…”

প্রান্তিক কিছুই না জানার ভান করে বললো…
— “হঠাৎ কিভাবে মিসিং হলো?? বাড়ির বউ রাতদুপুরে মিসিং হয়ে যাচ্ছে?”

অনামিকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “তুমি ঠিক কি মিন করতে চাইছো প্রান্তিক?”

— “আমি বলতে চাইছি কাল রাতে অত বৃষ্টির মধ্যে তোমার বৌদি মিসিং হলো কি করে? আচ্ছা অনামিকা তোমার বৌদির বিয়ের আগে কি কোনো অ্যাফেয়ার….”

কথাটা শেষ করার আগেই অনামিকা বলে উঠলো,
— “না না বিয়ের আগে বৌদির কোনো অ্যাফেয়ার ছিলো না, দাদা আর বৌদির তো লাভ ম্যারেজ…”

— “তুমি চিন্তা করোনা,আমি খোঁজ নিচ্ছি…”

— “আমি তাহলে আজ একবার ওই বাড়ি যাবো?”

— “বললাম তো আমি দেখছি বিষয়টা,তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা…”

— “আমার খুব চিন্তা হচ্ছে, একবার যাই? লুকিয়ে লুকিয়ে যাবো…আমার কোনো বিপদ হবেনা…”

প্রান্তিক অবাক হলো,
— “তুমি একা যেতে পারবে?”

— “পারবো…”

— “সিওর? ”

— “হুম”

— “ঠিকাছে ”

— “এখনই বেরিয়ে পড়ছি তাহলে,তুমি আজকের দিনটা একটু হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে নিও..”

প্রান্তিক সম্মতি জানায় অনামিকার কথায়,অনামিকা বিছানা থেকে উঠে আলমারি থেকে একটা চুড়িদার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়…

অনামিকা প্রান্তিকের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো…তাই প্রান্তিক একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনীশকে ফোন করে…
— “হ্যাঁ প্রান্তিক বল…”

— “অনামিকা পৌঁছেছে?”

— “অনু?? কই না তো? অনু তো এখানে আসেনি…”

প্রান্তিক চিন্তিত হয়ে পড়ে…
— “একঘন্টা আগে বেরিয়েছে ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে, এখনও যায়নি?”

— “তুই ওকে একা ছাড়লি কেনো বল তো? এদিকে বর্ণালী মিসিং … এখন আবার অনু,কোনদিকে যাবো আমি?”

প্রান্তিক কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে দিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে…
নিজের গোপন ডেরায় পৌঁছে বর্ণালীর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে প্রান্তিক…
— “অনামিকা কোথায় মিসেস বর্ণালী পাল?”

খানিকটা নিয়ন আলোয় প্রান্তিকের মুখটা স্পষ্ট হতেই চমকে ওঠে বর্ণালী…
— “প্রান্তিক তুমি??তুমি আমায় ধরে এনেছো এখানে??”

— “হ্যাঁ বর্ণালী ম্যাডাম ওরফে সোনিয়া মন্ডল…”

চমকে উঠলো বর্ণালী,ওর পরিচয় প্রান্তিক জেনে গেছে ভেবেই আঁতকে ওঠে ও…
— “তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে প্রান্তিক, আমি বর্ণালী..বর্ণালী পাল..তোমার অনীশ দার বউ, প্লীজ ভাই আমাকে ছেড়ে দাও…বাড়িতে আমার ছেলেটা অস্থির হয়ে যাবে আমাকে ছাড়া..”

প্রান্তিক চেয়ারের হ্যান্ডেলে একটা জোড়ে ঘুষি মারতেই চেয়ারটা ভেঙে পড়ে…বর্ণালী সেটা দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়…
— “বেশি অভিনয় করার চেষ্টা করো না বৌদি…তোমাদের সব রহস্য আমি জেনে গেছি…অনামিকাকে কোথায় রেখেছো? বলো…তোমাদের লিডার কে??”

এবার নকল মুখোশ সরিয়ে নিজের আসল চেহারায় ফিরে এলো বর্ণালী… হো হো করে হেসে উঠলো ও,
— “অনামিকাকে তুমি কোনোদিনও খুঁজে পাবেনা প্রান্তিক,আর না পাবে আমাদের লিডারকে…আমাকে মেরে ফেললেও আমি তোমাদের কিচ্ছু বলবোনা…”

প্রান্তিক রিভলবারটা বের করে বর্ণালীর কপালের মাঝখানে ধরে,
— “তাহলে মরার জন্য রেডি হও, এই প্রান্তিক মজুমদারের কলিজায় হাত দিয়েছো তুমি…আমাকে তুমি চেনোনা…এখন মৃত্যু ছাড়া তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা…নয় মুখ খোলো নয় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করো…তোমাকে ভাবার জন্য ষাট মিনিট সময় দিলাম…”

প্রান্তিক চেয়ার ছেড়ে উঠে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়…সোজা চলে যায় নিজের বাড়ি…ফাঁকা রুমে বড্ড একা লাগে ওর…তাই ছাদে চলে যায়…
— “তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে ওই সোনিয়া মন্ডল…আমি ওকে ছাড়বোনা… তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে দিয়ে আমি ওকে মারবো…তুমি আমার শক্তি অনু, ফিরে এসো তাড়াতাড়ি আমার কাছে…”

বিকালের ঝোড়ো হাওয়ায় অনামিকার কথা মনে পড়ে ওর, অনামিকা বৃষ্টি, ঠান্ডা হাওয়ার ঝড় খুব ভালোবাসে…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রান্তিক নিচে নেমে আসে…গাড়ি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে অনামিকার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে…

অতনু বাবুর বাড়িতে ঢুকতেই ছোট্ট বর্ণিশ এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে থাকে, ওকে এরকম করতে দেখে প্রান্তিক হাঁটু মুড়ে ওর সামনে বসে…
— “তুমি কাকে খুঁজছো বাবা?”

— “পিপি কই? মাম্মা কই…? কেউ নেই …আমি মাম্মার কাছে যাবো..”

বর্নিশকে দেখে খুব মায়া হয় ওর, নিজের বুকে চেপে ধরে বর্ণিশের মাথাটা…
— “সবাই চলে আসবে বাবা, তুমি কেঁদোনা…”

অতনু বাবু নিজের চশমাটা পড়তে পড়তে ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ায়…
— “তুই এসেছিস বাবা? বৌমা আর অনু কোথায় গেলো বলতো? ওদেরকে খুঁজে আননা প্রান্তিক…”

প্রান্তিক বর্নীশকে ছেড়ে অতনু বাবুর সামনে আসে,
— “কাকু আমি তোমাদের একটা কথা বলতে চাই, কাকিমা আর অনীশদাকে ডাকো…”

অতনু বাবু ডাকলেন সবাইকে, রুম থেকে বেরিয়ে এলো অনীশ আর সুতপা দেবী…অনীশ বর্নিশকে কোলে তুলে নিলো…
— “কি বলবি প্রান্তিক?”

— “বৌদির সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?”

অনীশ অবাক হলো এমন সময় প্রান্তিকের এই প্রশ্নে..
— “হঠাৎ এই কথা কেনো জিজ্ঞাসা করছিস প্রান্তিক?”

— “বলোনা ”

অনীশ একবার অতনু বাবু আর সুতপা দেবীর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
— “ফেসবুকে”

প্রান্তিক জোর গলায় চিৎকার করে বললো,
— “মিথ্যে কথা,বৌদির সাথে তোমার আলাপ হয়েছে আজ থেকে সাত বছর আগে রেড এরিয়ার একটা আবাসিক হোটেলে… যেখানে তোমার অবাধ যাতায়াত ছিলো…”

লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে অনীশ, ওর মা বাবাও ওর দিকে ঘৃণার সহিত তাকায়…
— “ছি অনি, ছি…আমাদের ছেলে হয়ে তুই এমনটা করলি?? তুই এতটা খারাপ!!”

কোনো কথা বলার অবস্থাতে নেই অনীশ, অতনু বাবু ছুটে গিয়ে বর্নীশকে অনিসের কোল থেকে নিয়ে নেয়…
— “তোদের কাছে থাকলে আমার নাতি তোদের মতোই তৈরি হবে, নিজেকে শুধরে তারপর আমার নাতির কাছে আসবি…”

প্রান্তিক অতনু বাবুকে শান্ত করতে এগিয়ে আসে ওনার কাছে,
— “অনীশ দা পাল্টে গেছে কাকু, বিয়ের পরপরই, প্রণতির মৃত্যুর পরপরই ও পাল্টে গেছে…শুধু পাল্টায়নি বৌদি মানে বর্ণালী পাল…”

অনীশ মাথা তুলে প্রান্তিকের দিকে অবাক নয়নে তাকায়…
— “বর্ণালী পাল্টায়নি? কিন্তু ও তো বলেছিলো বিয়ের পর ও আর ওইসব কাজ করবেনা…”

— “সাত বছর ধরে তোমার বউ তোমার চোখে ধুলো দিচ্ছে আর তুমি এক রুমে থেকেও জানতে পারোনি অনীশদা?”

— “মানে ,কি করেছে বর্ণালী?”

— “তুমি জানো বর্ণালী পাল আসলে কে?? এতগুলো বছরেও তোমাদের কারোর সন্দেহ হয়নি?”

সুতপা দেবী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রান্তিককে বললো…
— “বো..বৌমা ক..কে??”

প্রান্তিক অতনু বাবুর কোল থেকে বর্নীশকে নিচে নামালো,তারপর হাঁটু মুড়ে বসলো ওর সামনে…
— “বাবা তুমি ঘরে গিয়ে খেলা করো, তোমার পিপি এক্ষুনি চলে আসবে…”

বর্নীশ লক্ষ্য ছেলের মতো ওখান থেকে চলে যায় রুমে…প্রান্তিক উঠে দাঁড়ায়…
— “বর্ণালী মিত্র ওরফে বর্ণালী পাল নামের কোনো মানুষ কোনোদিন এক্সিস্টই করেনি…দিনের পর দিন তোমাদের বোকা বানিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে গেছে ও…”

অনীশ ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞাসা করলো…
— “তাহলে কে ও?”

— “ ওই গ্যাং এর বাম হাত ও, সোনিয়া মন্ডল…কুখ্যাত অপরাধী। যার সব অপরাধই এখনও গভীরেই রয়ে গেছে…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here