তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:17

0
195

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:17

চারিদিকে একটা নিস্তব্দ পরিবেশ, অতনু বাবু আর সুতপা দেবী সবটা শুনে মাথা নিচু করে বসে আছে…আর অনীশ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে…নিজের ভালবাসার মানুষ,বউ আর সন্তানের মা বর্ণালী…তার সম্পর্কে এগুলো কোনোদিন ধারণাই করতে পারেনি ও…
— “তাহলে বোন এখন কোথায় আছে প্রান্তিক? কোথায় রেখেছে বর্ণালী ওকে?”

— “চিন্তা করোনা অনীশ দা,তোমার বোন ভালোই আছে…ও আমার কাছেই আছে নিরাপদে…”

উপস্থিত সবাই এই কথাটা শুনে অবাক হয় এবং খুশিও হয়ে যায়…সুতপা দেবী এগিয়ে এসে প্রান্তিকের হাত ধরে…
— “তুই ঠিক বলছিস তো আমার মেয়ে ভালো আছে? ”

— “হ্যাঁ কাকিমা অনু একদম ভালো আছে, তুমি চিন্তা করোনা…আমি এখন আসছি, একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আমার…”

প্রান্তিক চলে যায় পাল বাড়ি থেকে, ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় বর্ণালীর কাছে…বর্ণালী টায়ার্ড হয়ে চেয়ারে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো,প্রান্তিকের কত মতো ওর একজন লোক এক বালতি জল নিয়ে বর্ণালীর মুখ ঢাললে বর্ণালী ধীরপিরিয়ে চোখ খুলে ফেলে…

— “তাহলে সোনিয়া মন্ডল কি সিদ্ধান্ত নিলে তুমি??”

ঘুমের ঘোর কাটতেই একটা রহস্যময় হাসি খেলে গেলো সোনিয়ার মুখে…
— “আমার সিদ্ধান্ত তখন যা ছিলো এখনও তাই আছে,তোর তো অনেক ক্ষমতা তাহলে খুঁজে নে অনামিকাকে…”

প্রান্তিক সশব্দে হেসে উঠলো,
— “তুই কি ভাবলি আমি তোর প্ল্যান বুঝতে পারিনি?এমনি এমনি আর সরকার আমাকে তোর,তোর বোনের আর তোর মায়ের এই গ্যাংকে ধরার জন্য এই মিশনে রাখেনি…”

— “হুম তাহলে খুঁজে বের কর অনামিকাকে…”

প্রান্তিক চেয়ারে ঠেল দিয়ে আরাম করে বসলো…
— “অনামিকা তো আমার কাছেই আছে মিস সোনিয়া মন্ডল…”

চমকে ওঠে সোনিয়া…
— “মানে?”

— “মানে আমার সাথে পাল বাড়ি যাওয়া অনামিকা আর আমার সাথে পাল বাড়ি থেকে ফেরা অনামিকা যে এক মানুষ নয়… সেটা আমি কাল রাতেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম ডিয়ার বর্ণালী বৌদি..”

বর্ণালী কৌতূহলী দৃষ্টিতে রাগী রাগী মুখ করে খানিকটা ঝুঁকে পড়লো প্রান্তিকের সামনে…
— “কিন্তু সেটা তো হওয়ার কথা নয়, মুনিকে তো আমি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং দিয়েছি অনামিকা হয়ে ওঠার জন্য…কিভাবে বুঝলে তুমি প্রান্তিক?”

প্রান্তিক ঠোঁট চওড়া করে হা হা করে হেসে উঠলো…
— “সাত জন্মের বউ আমার অনু, তাকে যদি চিনতে না পারি তাহলে কিসের স্বামী হলাম আর আমি… বাই দা ওয়ে মুনি কে??”

মুখ দিয়ে চ সূচক একটা শব্দ বের হয়ে এলো সোনিয়ার, এখানে ও এই নামটা মুখ ফসকে বলে ফেলে খুব বড়ো ব্ল্যান্ডার করে ফেলেছে…ভয়েতে শুকনো একটা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করলো সোনিয়া…প্রান্তিক ওকে ভয় পেতে দেখে মুচকি হাসলো,
— “কি ব্যাপার বৌদি ভয় পেয়ে গেলে? তাহলে যখন শুনবে তোমার মুনি ওরফে মুনিয়া মন্ডল ,তোমার বোন এখন আমাদের হেফাজতে আছে…তখন তুমি কি করবে??”

চমকে উঠে চোখের পাতা খুললো সোনিয়া…কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো…
— “ম..মু..মুনি তো..তোমার কাছে?”

— “হ্যাঁ বৌদি আজ সকালে যখন ও আমার বাড়ি থেকে তোমার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোয় তখনই সাদা শার্টের পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করে আমাদের হাতে ট্রান্সফার করে…”

— “প্লীজ প্রান্তিক আমার বোনকে ছেড়ে দাও…ওকে এইসবের মধ্যে জড়িয়ো না..”

— “জড়িয়ে তো তুমিই ওকে ফেলেছো বৌদি, আমার আছে ওকে পাঠিয়েছিলে খবর জানার জন্য…আমার অনুর আমার কাজের বিষয়ে কোনো কৌতূহল ছিলোনা,কিন্তু অনামিকা রুপি মুনিয়া আমার কাজের বিষয়ে খুব কৌতূহল দেখিয়েছিলো, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শোনা থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করা…বড্ড বেশিই কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলো ও… যার দরুন ধরা পড়ে যায়..”

— “ও এইসবের কিছুই জানেনা বিশ্বাস করো,ওকে শুধু আমি বলেছিলাম তোমার বাড়িতে থেকে আমাকে সব খবর দেওয়ার জন্য…ওকে ছেড়ে দাও…”

প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে সোনিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো…
— “ছেড়ে দেবো? কিন্তু আমার যে কটা শর্ত আছে..”

— “শর্ত??”

— “হ্যাঁ শর্ত, তুমি যদি সেগুলো মানতে রাজি থাকো…তাহলে আমি ভেবে দেখবো মুনিয়াকে ছাড়বো কিনা…”

— “ক..কি শর্ত?”

প্রান্তিকের মুখের ভাব বদলে গেলো….
— “তোমার মাকে ফোন করে বলবে তুমি দেখা করতে চাও…”

— “আমি পারবোনা, মাকে আমি কিছুতেই এক্সপোজ করতে পারবোনা…কিছুতেই না…”

নিজের রিভলবারটা বের করে তাতে হাত বুলালো প্রান্তিক…
— “তাহলে চোখের সামনে নিজের বোনের মৃত্যু দেখার জন্য রেডি হও…”

গলা ফাটানো চিৎকার ভেসে আসে সোনিয়ার মুখ থেকে…
— “নাআআআআআ ”

প্রান্তিক নিজের একটা লোককে ডাকলো..
— “নিয়ে এসো ওকে…”

লোকটা চলে গেলো ,কিছুক্ষনের মধ্যেই মুনিয়াকে নিয়ে এলো সোনিয়ার সামনে…মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে ও…
— “দিদি আমাকে কোন ঝামেলার মধ্যে ফেললি তুই?? আমাকে প্লীজ বাঁচা…আমি মরতে চাইনা..”

বোনের কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে অস্থির হয়ে ওঠে সোনিয়া…
— “প্লীজ ওকে ছেড়ে দাও…আমাকে মেরে ফেলো তোমরা, কিন্তু ওকে ছেড়ে দাও..ওর কোনো দোষ নেই…”

— “আমি তোমাদের গ্যাং এর মেন লিডার চামেলী মণ্ডলকে চাই, মুনিয়াকে আমি ছাড়তে পারি এই শর্তেই…আমি পাঁচ গুনবো তার মধ্যে তোমার মতামত শুনতে চাই আমি…”

প্রান্তিক কাউন্ট করতে থাকে, সোনিয়ার চোখের সামনে শুধু ভেসে ওঠে মুনিয়ার কান্না ভেজা চোখ, বাঁচার আকুতি..শেষমেশ নিজের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সোনিয়া…
— “বেশ,আমি তোমার শর্তে রাজি…ফোন দাও..”

প্রান্তিক বাঁকা হেসে সোনিয়ার দিকে তাকালো…
— “মুনিয়া কিন্তু আমার গান পয়েন্টে থাকবে,তাই বলছি বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবেনা..”

প্রান্তিকের কাছে থাকা সোনিয়ার ফোনটা প্রান্তিক ওকে দেয়…সোনিয়া ওর মায়ের নম্বর ডায়াল করার কিছুক্ষনের মধ্যেই ওপর প্রান্ত থেকে ফোনটা রিসিভ হয়…প্রান্তিক ইশারায় বলে স্পিকারে দিতে…
— “হ্যালো তুই কোথায় সোনি, কাল রাত থেকে তোকে ট্রাই করছি,ফোন বন্ধ আসছিলো কেনো? আর কোনো খবর পেলি মুনির থেকে??”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো অপরপ্রান্তে থাকা মহিলাটি…সোনিয়া একবার মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো…
— “মা তুমি তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে দেখা করো,আমি মুনীর থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি…”

— “সাব্বাস বেটি,কি তথ্য রে?”

— “ফোনে বলা যাবেনা,তুমি আমার শ্বশুরবাড়ির কাছে যে পার্কটা আছে ওখানে দেখা করো…”

— “ঠিকাছে কাল সকালেই দেখা করছি…”

— “না মা আজ রাতেই দেখা করো…”

— “তুই শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোতে পারবি রাত্রে?”

— “পারবো…”

— “ঠিকাছে, আর ওই অনামিকার কি খবর রে?? একবার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে…এবার যেনো না বেরোয়, আমি খদ্দের দেখে ফেলেছি…ওকে সামলে রাখ তুই…”

কথাটা শোনামাত্রই প্রান্তিকের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায়…অনেক কষ্টে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ফোনটা কেটে সোনিয়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় ও…

— “এবার আমার বোনকে ছেড়ে দাও…”

— “আগে ওই চামেলী মণ্ডলকে কাস্টেডিতে নিই,তারপর তো তোমাদের ছাড়বো নাকি ভেবে দেখবো…আর একটা কথা শুনে রেখো…আমি থাকতে আমার কলিজা আমার অনুর গায়ে ফুলের টোকাও আমি মেনে নেবনা…আমার অনুকে তুমি কিডন্যাপ করেছিলে এবার তোমার ব্যবস্থা তো আমিই করবো..”

— “আমাকে তুমি যা ইচ্ছে তাই করো,কিন্তু আমার বোনটাকে ছেড়ে দাও…”

প্রান্তিক চেয়ার ছেড়ে উঠে মুনিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়…
— “আমার বউ সাজার খুব সখ জেগেছিলো না,এবার দেখো এই প্রান্তিক কি জিনিস…”

— “বিশ্বাস করুন আমি নিজে থেকে এগুলো করিনি,আমাকে দিদি যা বলেছিলো আমি তাই করেছি…”

প্রান্তিক মুনিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়…

.

.
প্রান্তিক হসপিটালে আসতেই অনামিকা বেড থেকে নেমে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে…যার দরুন কিছুটা টলে যায় প্রান্তিক…
— “এখন কেমন আছো বউ?”

অনামিকা প্রান্তিকের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে…
— “বৌদি এতটা খারাপ কেনো প্রান্তিক? কেনো বৌদি আমার সাথে এরকম করলো?”

— “তোমার বৌদি তোমাকে লুকিয়ে রেখে তোমার মতোই দেখতে একজনকে আমার সাথে পাঠিয়েছিলো আমার কাজের সব খবর জানার জন্য…”

অনামিকা প্রান্তিকের বুক থেকে মুখ তুলে অবাক নয়নে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “আমার মতই দেখতে মানে??”

— “হুম হুবহু তোমার মত দেখতে আর একজন মানুষ আছে…”

অনামিকা ঠোঁট ফুলিয়ে প্রান্তিককে বলে…
— “কাল রাতে সে তোমার সাথে এক ঘরে ছিলো?”

প্রান্তিক অনামিকার এমন বাচ্চা বাচ্চা মুখ দেখে মুচকি হাসলো…
— “আমি আমার বউকে চিনতে না পারলে কিভাবে হবে বলোতো? আমি ওকে কাল রাতেই চিনে ফেলেছিলাম..”

— “কিভাবে চিনলে? তুমি তো বললে হুবহু আমার মত দেখতে…”

প্রান্তিক অনামিকার কোমড় ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে আনলো…তারপর কোমড় থেকে শাড়িটা খানিকটা সরিয়ে অনামিকাকে ইশারা করলো ওর কোমড়ে থাকা তিলটার দিকে…
— “শারীরিক দিক থেকে এটাই পার্থক্য তার আর তোমার…”

অনামিকা শব্দ করে হাসলো,
— “তারপর তুমি কি করলে??”

— “তখনই মেয়েটাকে কিছু বলিনি,কাজের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম…তখন তোমাকে খোঁজাটা আমার মূল লক্ষ্য হয়ে গিয়েছিলো…রাত তখন সাড়ে বারোটা কি একটা…দেখলাম তোমার বৌদিকে…মুখ চাপা দিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে…ফলো করতে করতে একটা গোডাউনের সামনে পৌছালাম…বাইরে থেকে দেখতে পেলাম তোমাকে…তখন পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হলো আমার কাছে…”

অনামিকার চোখে অনেক কৌতূহল…
— “তারপর কি করলে? বৌদি কোথায় এখন?”

— “আমার হেফাজতে , বৌদি যখন ওই গোডাউন থেকে বেরোলো তখন বৌদিকে তুলে নিলাম…তারপর একটা জায়গায় বৌদিকে রেখে এসে তোমাকে উদ্ধার করলাম যখন তোমার কোনো সেন্স ছিলোনা…সঙ্গে সঙ্গে এখানে নিয়ে এলাম তোমাকে…”

— “তাহলে সেই মেয়েটা কোথায় ? আর ওই মেয়েটাই বা কে যে হুবহু আমার মত দেখতে?”

— “ওই মেয়েটা হলো তোমার বৌদির বোন, আর তোমার বৌদির নাম বর্ণালী নয় ওর নাম সোনিয়া মন্ডল আর ওর বোনের নাম মুনিয়া…ওরা হলো এই মেয়ে পাচারকারী দলের একেকটা অংশ…”

— “কি বলছো? বৌদি এইসবের সাথে যুক্ত?”

— “হ্যাঁ সোনিয়ার মা এই গ্রুপের মেন লিডার, মায়ের কথামতই ও তোমার দাদাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে তোমাদের বাড়িতে ঢোকে…”

— “কিন্তু আমাদের বাড়িতে ঢুকে কি লাভ বৌদির? ”

প্রান্তিক অনামিকাকে ছেড়ে খানিকটা দূরত্বে সরে গেলো…
— “এই রহস্যটা চামেলী মণ্ডলকে পেলেই জানা যাবে, মুনিয়া আর তোমাকে কেনো একই দেখতে সেটাও জানতে হবে আমাকে…”

অনামিকা প্রান্তিক সামনে গিয়ে করুন চোখে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “তুমি কি বলতে চাইছো ওই মুনিয়া আর আমি যমজ দুই বোন?”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here