গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:19
মাঝখানে দুটো দিন কেটে গেছে,আজ কোর্টে তোলা হবে চামেলীদের…প্রান্তিক ,অনামিকা আর অনীশ এসেছে কোর্টে…প্রান্তিক অনামিকাকে আনতে না চাইলেও একপ্রকার জোড় করে এসেছে অনামিকা…আর অনীশ এর সঙ্গে এসেছে বর্ণীশ… সেও খুব কান্নাকাটি করছিলো তাই আনতে বাধ্য হয়েছে অনীশ সঙ্গে করে ওকে…
— “পাপা পাপা, মাম্মা কখন আসবে?? মাম্মাকে আমরা কখন বাড়ি নিয়ে যাবো..”
বুকে হাজারো কষ্ট চেপে রেখে বর্নিশের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো অনীশ, সে কি করে এই বাচ্চাটাকে বোঝাবে তার মায়ের কীর্তিকলাপের কথা…কিভাবেই বা বোঝাবে তার মাকে এখন সে নিয়ে যেতে পারবেনা…
— “কি হলো পাপা,তুমি কিছু বলছো না কেনো? মাম্মা কখন আসবে…?”
— “আসবে বাবা,তোমার মাম্মা এক্ষুনি চলে আসবে…”
অনামিকারো ভীষণ কষ্ট হলো ওর ভাইপোকে দেখে, অনীশ এর কোলে থাকা ছোট্ট গুব্লুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ও.. গুবলুর মন ঘোরাতে ওকে বললো ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বললো,
–“ এখন তো একজনের পিপির কথা মনেই নেই, শুধু মাম্মা মাম্মা করছে… পিপির কোলেও আসছেনা..”
বর্নিশ খিলখিল করে হেসে উঠলো,
— “পাপা দেখো পিপি কেমন বাচ্চাদের মত নাক ফুলাচ্ছে, পিপি কোলে নে আমাকে…”
বর্নিশ হাত বাড়িয়ে অনামিকার কোলে যেতে গেলে বাঁধা দেয় অনীশ…
— “পিপি এখন তোকে কোলে নিতে পারবেনা… পরে কোলে চাপবি…”
— “কেনো পাপা? পিপিই তো বললো কোলে নেওয়ার কথা…”
— “না বাবু পিপির মধ্যে এখন তোমার ছোট্ট ভাই বা বোন আছে,তুমি কোলে চাপলে লেগে যাবে তো তাকে…”
ওদের কথার মাঝেই পুলিশ চামেলী,সোনিয়া আর মুনিয়াকে নিয়ে কোর্টের সামনে আসে, সোনিয়া ছেলেকে দেখে পুলিশকে রিকোয়েস্ট করে একবার যেনো ওর ছেলের কাছে ওকে নিয়ে যাওয়া হয়…পুলিশ ওদের নিয়ে যায় ওখানে… বর্নিশ মাকে দেখেই মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে ওঠে, সোনিয়া হাত বাড়ায় কিন্তু অনীশ ছাড়েনা বর্নিশ কে…
— “খবরদার বর্ণালী, আমাদের যা ক্ষতি করেছো করেছো,আমার ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা ভুলেও করবেনা…”
বর্ণালীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো,
— “গুব্লু আমারও ছেলে অনীশ,প্লীজ একবার ওকে আমার কাছে দাও,দেখো ও আমার কাছে আসার জন্য ছটফট করছে…”
— “ও ছোটো তো তাই বুঝতে পারছেনা ওর মায়ের আসল রূপটা, অফিসার এদের নিয়ে যান প্লীজ…”
বর্ণালী হাতের উল্টোপীঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিলো, পুলিশ ওদের নিয়ে যেতে গেলে অনামিকা বাঁধা দেয়…
— “দাড়ান অফিসার আমার কিছু কথা আছে ওদের সাথে…”
অনামিকাকে বাঁধা দেয় প্রান্তিক, ও চায়না অনামিকা এই অবস্থায় রিস্ক নিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াক..কিন্তু অনামিকা প্রান্তিকের কোনো কথা শোনেনা… মুনিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ও…চোখের সামনে যেনো আয়নায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখছে দুজনে…দুজন দুজনকে আপাদমস্তক দেখলো ভালোভাবে…তারপর হাসলো অনামিকা…
— “আজ তোর আমাদের সাথেই থাকার কথা ছিলো,কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের দুজনকে আলাদা করে দিয়েছে…”
মুনিয়া হাতকড়া পড়া অবস্থাতেই অনামিকার হাত ধরলো,
— “ আমাকে প্রান্তিকবাবু কাল বলেছেন তুই আমার দিদি, তখন বিশ্বাস না করলেও এখন আমি মানতে বাধ্য…বিশ্বাস কর আমি কিচ্ছু জানিনা এইসবের…আমাকে শুধু দিদি মানে সোনিয়া দিদি যা করতে বলেছে তাই করেছি আমি…”
— “তুই যদি নির্দোষ হোস সেটা ঠিকই প্রমাণ হবে,বিনা অপরাধে আমরাও তোকে শাস্তি পেতে দেবোনা…”
মুনিয়াকে ভরসা দিয়ে অনামিকা চামেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,চামেলী রাগী রাগী চোখ করে তাকালো ওর দিকে, সেটা দেখে ও হাসলো…
— “কেনো আলাদা করেছিলে আমাদের দুই বোনকে,কেনো মুনিয়ার জীবনটা বিশিয়ে দিলে? কেনোই বা নিজের মেয়েকে নকল পরিচয়ে আমাদের বাড়ির বউ করে পাঠিয়েছিলে? কেনো?”
মুখের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব এনে চামেলী বললো,
— “প্রতিশোধ নিতে,প্রতিশোধ..”
উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হলো,অনামিকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো চামেলীকে,
— “কিসের প্রতিশোধ??”
— “তোর দাদুকে খুন করার অপরাধে আমার বাবা আর মামাকে জেলে পাঠিয়েছিলো তোর বাপ তাও আবার বিনা অপরাধে…”
অনীশ অবাক হলো, অনামিকা এইসব বিষয়ে না জানলেও অনীশ জানে এটা…ওর বয়স তখন বছর পাঁচেক হবে…সেইসময় ওর দাদু খুন হয় ছুঁড়ির আঘাতে,ও সেটা নিজের চোখে দেখেছিল,আবছা আবছা মনে থাকলেও পুরোটা মনে নেই ওর,আজ থেকে প্রায় আঠাশ ,ঊনত্রিশ বছর আগের ঘটনা এটা…বড় হয়ে এই বিষয়ে শুনেছিলো ও অতনু বাবুর মুখ থেকে…
— “তুমি তাহলে মদন সান্যালের মেয়ে? তোমার বাবা আর মামা নির্দোষ ছিলোনা, আমার দাদুকে খুব নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো..আমার এখনও আবছা আবছা মনে আছে কতবার ওরা আমার দাদুর পিঠে ছুঁড়ি ঢুকিয়েছিলো…”
— “মিথ্যে সব মিথ্যে, আর এজন্যই আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম…প্রথমে তোকে টার্গেট করি,প্রীতমের মাধ্যমে তুই আমার দলের মধ্যে ঢুকিস…তারপর সোনিকে পাঠাই তোকে মিথ্যে ভালোবাসার জালে ফাঁসিয়ে তোর সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য…আর তারপর তোর বোনকে টার্গেট করি…তোদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম আমি…আমি যেমন চোখের সামনে আমার বাবার ফাঁসি দেখেছি ঠিক তেমনই তোর মা বাপকে আমি চোখের সামনে তাদের মৃতদেহ দেখাতে চেয়েছিলাম…”
প্রান্তিক এতক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার মুখ খুলতে বাধ্য হলো,
— “এত বড় অপরাধ করে সেটা নিজের মুখে বলতে লজ্জা করছেনা একটুও?? আর কোর্ট কখনও নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেয়না,ওরা অপরাধ করেছিলো বলেই শাস্তি পেয়েছে…”
— “আমি তোদের কাউকে ছাড়বোনা প্রান্তিক, একবার বেরোই জেল থেকে তোদের প্রত্যেকটাকে আমি দেখে নেবো…”
— “আগে ছাড়া তো পাও, তারপর দেখে নেবে…তোমার অপরাধের ভাণ্ডার যা,তাতে করে এই জীবনে আর ছাড়া পাওয়া হবেনা তোমার…”
পুলিশ কোর্টের সময় হয়ে যাওয়ার জন্য ওদের তিনজনকে ওখান থেকে নিয়ে চলে যায়…
.
.
দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরও তিনমাস…সেদিন কোর্টের বিচারক চামেলীকে ফাঁসির রায় শুনিয়েছিলো…আর সোনিয়া ওরফে বর্ণালীকে চোদ্দো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডিত করেছে…মুনিয়াকে কোর্ট বেকসুর খালাস করে দিয়েছিলো কারণ মুনিয়ার কোনো অপরাধ প্রমাণ হয়নি….মুনিয়া এখন ওর নিজের বাবা মার কাছেই থাকে তবে নতুন পরিচয়ে…. মুনিয়ার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে অনিন্দিতা…অনামিকার বোন অনিন্দিতা…
এখন অনামিকার পাঁচ মাস চলছে…অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যায়নি ওরা…অনামিকার সাধ ছিলো প্রথম কয়েকটা মাস ও ওর মায়ের কাছে থাকবে…তাই প্রান্তিক থেকে গেছে ওকে নিয়ে কলকাতায়..আজ ওকে পঞ্চামৃত খাওয়ানো হবে…এরপরই ওরা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে…
— “পিপি পিপি আমরা চলে এসেছি…”
ছোট্ট বর্নিশ অনিন্দিতার হাত ধরে ঢুকলো প্রান্তিকের অট্টালিকায়…ছোটখাটো অনুষ্ঠান হলেও বাড়িটাকে ভালোভাবে সাজিয়েছে প্রান্তিক…অনামিকা বর্নিশকে দেখে বর্নিশের কাছে এলো… বর্নিশ কয়েক সেকেন্ড অনামিকাকে পর্যবেক্ষণ করে বললো…
— “এই পিপি তোর পেটটা এরকম ফুলে গেছে কেনো?? তুই কি গোটা মুরগি গিলে খেয়েছিস?”
উপস্থিত সবাই বর্নিশ এর কথা শুনে হেসে ফেললো…অনিন্দিতা ওকে ভালোভাবে বোঝালো সবটা…
— “অনামিকা!!!”
প্রান্তিকের গলার আওয়াজ শুনে সারা দিলো অনামিকা…প্রান্তিক আবার চিৎকার করলো,
— “একবার রুমে আসবে??”
অনামিকা একবার সবার দিকে তাকালো,খানিকটা লজ্জা পেয়ে চলে গেলো রুমের দিকে,ওর প্রেগন্যান্সির কথা ভেবে নিচের একটা রুমেই ওরা থাকছে কয়েকদিন ধরে…বাকিটা সময় ও পাল বাড়িতেই ছিলো…অনামিকা রুমে ঢুকলে প্রান্তিক দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দেয়…অনামিকা মৃদু হাসে…
— “আবার দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেলো তো? বাইরে সবাই আছে কিন্তু…”
প্রান্তিক অনামিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পেটে হাত রাখলো,তৎক্ষণাৎ ওদের জুনিয়র নিজের উপস্থিতি জানান দেয়…
— “এই জুনিয়র কিক করলো…”
প্রান্তিকের উচ্ছ্বাস দেখে অনামিকা হাসলো,
— “ভাবা যায় আমাকে কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে করা বরের সন্তান আমার মধ্যে বড়ো হচ্ছে, এটা কোনোদিনও ভেবেছিলাম আমি?”
প্রান্তিক নিজের থুতনীতে ঠেকালো অনামিকার কাঁধে,
— “এই এক বছরে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো বলো?
–“সেই অচেনা,খারাপ লোকটাকে ছাড়া আমি এখন আমার জীবন কল্পনাও করতে পারিনা…”
— “হুম আর দুদিকে চুল বিনিয়ে স্কুল যাওয়া সেই পুচকি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো অনার্স পড়ুয়া একজন যুবক,সাত বছরের ছোট সেই মেয়েটাই তার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছিলো আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে…”
— “হুম আর কদিন পর সেই কুড়ি বছরের অনার্স পড়ুয়া যুবকটাই বাবা হতে চলেছে , আর…”
অনামিকাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রান্তিক নিজেই বলে উঠলো,
— “আর তেরো বছরের সেই মেয়েটা মা হবে,সেই পুচকি মেয়েটারও একটা পুচকি হবে…”
অনামিকা প্রান্তিকের দিকে ঘুরে কোমড়ে হাত দিয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়ালো…
— “পুচকি কেনো? পুচকুও তো হতে পারে…”
প্রান্তিক হাঁটু মুড়ে বসে অনামিকার পেটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো তার সন্তানের উদ্দেশ্যে…
— “পুচকিই হোস বা পুচকু, তুই সুস্থ ভাবে আমাদের কাছে আয়,এটাই চাই আমরা…বাবা অপেক্ষা করছে সোনা…”
অনামিকা প্রান্তিকের এলোমেলো চুলগুলো ঘেঁটে আরও এলোমেলো করে দিলো…
— “শুনছিস সোনা,তোর বাবা কিন্তু আমার আগে তোকে চেয়েছিলো আমার কাছে…খুব অসভ্য লোক তোর বাবা…”
প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো অনামিকার সামনে,ব্যাঙ্গ করে ওকে বললো..
— “হ্যাঁ আমি অসভ্য , আমার একার প্রচেষ্টায় তো তুমি আজ মা হচ্ছো…তাইনা?”
প্রান্তিকের ঠোঁটকাটা জবাবে অনামিকা লজ্জা পেয়ে গেলো…
— “তুমি আর সুধরাবেনা? দুদিন পর যে বাবা হবে তার মুখে এরকম অসভ্য অসভ্য কথা…”
প্রান্তিক অনামিকার কোমড় ধরে সাবধানে নিজের কাছে নিয়ে এলো, অনামিকার কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে ওর চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো…
— “আমার জীবনের সবথেকে বড়ো উপহারটা তুমি দিতে চলেছো বউ, আমি এই পৃথিবীতে প্রথম বাবা হচ্ছিনা কিন্তু বিশ্বাস করো একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার…মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এই প্রথম আমিই বাবা হচ্ছি…এই অনুভূতিটা কাউকে বলে বোঝাতে পারবোনা আমি…”
অনামিকা প্রান্তিকের বুকে হালকা করে মাথা রাখলো,
— “তুমি আমার জীবনে না আসলে কোথায় যে ভেসে যেতাম আমি, আমার জীবনকে আলোকিত করে নতুন ভাবে বাঁচতে সাহায্য করেছো তুমি আমায়…আমাদের ভালোবাসার বয়স দশমাস হলেও যেনো আমার মনে হয় আমি তোমাকে কতযুগ আগে থেকে ভালোবাসি…আর দেখো আমাদের দুজনের ভালোবাসা কটা মাস পরই আমাদের কাছে চলে আসবে…”
— “আমরা ওকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা মা হবো আমরা,তুমি দেখে নিও..”