তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:5

0
461

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:5

একটা বাইশতলা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা আর প্রান্তিক…গেটে ওদের গাড়িটা ঢুকতেই দুজন মহিলা দেহরক্ষী আর দুজন পুরুষ দেহরক্ষী এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ালো…অনামিকা অবাক হয়ে প্রান্তিকের দিকে তাকালো…প্রান্তিক সেসব পাত্তা না দিয়ে অনামিকাকে নিয়ে লিফটে উঠলো…বডিগার্ড গুলো উঠলো পাশের লিফটে…

— “এখানে আপনি আগেও এসেছেন??”

— “পনেরো বছর বয়স থেকে আমি এখানেই আছি, এটাই আমার শহর…”

— “কিন্তু আপনারা তো সান ফ্রান্সিসকোয় গিয়েছিলেন??”

— “মা,বাবা ওখানেই থাকে…আমি হায়ার স্টাডিজের জন্য অস্ট্রেলিয়া চলে আসি, পড়াশোনার শেষে একটা জব পেয়ে যাই…তাই এখানেই থেকে যাই…এখন এই অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচটা ফ্ল্যাট আমার…তার মধ্যে আমরা থাকবো পনেরো তলায়..”

— “আমাকে আটকে রাখার জন্য সব প্ল্যানই করে ফেলেছেন দেখছি…”

— “আর বেশিদিন তোমাকে আটকে রাখবোনা আমি,তুমি নিজেই থাকতে চাইবে আমার কাছে নইলে…”

প্রান্তিক রহস্যময় একটা হাসি দিলো…অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে…
— “নইলে??”

— “নইলে অবিবাহিত অবস্থায় অন্তঃস্বত্তা হওয়ার জন্য নিজের শহরে তোমাকে অনেক বদনাম কুড়োতে হবে…”

— “মানে আপনি ভেবেই নিয়েছেন আমি প্রেগনেন্ট হয়ে গেছি??”

— “কয়েকমাস পরই হবে…”

পনেরো তলায় লিফট আসতেই দরজা খুলে গেলো…প্রান্তিক বেরিয়ে এলো,পিছন পিছন অনামিকাও বেরোলো…একটা ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা দুজন…নেমপ্লেটে বড়ো বড়ো করে লেখা “মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মজুমদার”

অনামিকার কৌতূহল হলো নেমপ্লেটটা দেখে…
— “আপনি ম্যারেড??”

প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো অনামিকার দিকে…তারপর অনামিকার দৃষ্টি অনুসরণ করে নেমপ্লেটের দিকে তাকাতেই পুরোটা পরিষ্কার হলো ওর কাছে…
— “ইয়েস আই অ্যাম ম্যারেড”

— “আপনার ওয়াইফ কই?? আর ওয়াইফ যদি থেকেই থাকে তাহলে আপনি আমার কাছে বেবি চাইছেন কেনো?? উনিই তো আপনাকে বেবি দিতে পারবেন তাও আবার লিগ্যালী…”

— “এত কৈফিয়ত আমি তোমাকে কেনো দিতে যাবো অনামিকা?? তোমার বিনিময়ে প্রীতম আমার কাছ থেকে টোয়েন্টি ফাইভ ল্যাকস নিয়েছে…এখন তোমাকে দিয়ে কি করবো সেটা আমার ব্যাপার…”

প্রান্তিক দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলো…পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ,পরিপাটি করে গোছানো একটা চার রুমের ফ্ল্যাট এটা… অনামিকাও ঢুকলো প্রান্তিকের পিছন পিছন…

— “আপনি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য প্রান্তিক, নিজেদের স্বামী স্ত্রীর সংসারে নিজের স্ত্রীয়ের অবর্তমানে একটা অন্য মেয়েকে এনে ঘরে তুলছেন,সেটা তো আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি নয়…”

প্রান্তিক অনামিকার দিকে ঘুরে অনামিকার দুটো গাল চেপে ধরলো…ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো অনামিকা…
— “ছাড়ুন আমাকে..”

— “দুটো দিন ভালো ব্যবহার করেছি বলে ভেবে বসোনা আমার লাইফ সম্পর্কে জানার সমস্ত রাইট তোমার আছে…তুমি জাস্ট আমার কেনা একটা খেলনা, যতদিন প্রয়োজন থাকবে নিয়ে খেলবো,তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেবো…”

প্রান্তিকের মুখ থেকে এমন নিম্নরুচির একটা কথা শুনে ঘৃণায় গা টা গুলিয়ে উঠলো অনামিকার…এই কটাদিনে নিজের পজিশনটা কতটা নিচে নেমে এসেছে সেটা ভেবেই কষ্ট হয় ওর …মনে মনে প্রীতমের উদ্দেশ্যে বলে…
— “তোকে আমি ভালবেসেছিলাম প্রীতম, কিন্তু তুই তো আমার ভালবাসার যোগ্যই না…তুই আমার সঙ্গে যেটা করেছিস তার দাম তোকে দিতেই হবে প্রীতম… এখান থেকে একবার মুক্তি পাই শুধু, তারপর তোর জীবন শেষ করে দেবো আমি…”

প্রান্তিক অনামিকার গাল ছেড়ে অনামিকার হাত ধরে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো…একটা বড়ো রুমে ঢুকে লাইট অন করলো প্রান্তিক…
— “এটা তোমার রুম, আগামী দেড় বছরের জন্য…”

— “আপনার স্ত্রী কোথায়?? উনি কিছু বলবেন না??”

— “ She is pregnent.. এখানে দেখাশোনা করার কেউ নেই, তাই ওকে মা বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি আমেরিকায়…”

অনামিকার এই বিস্ময়ের হয়তো শেষ নেই…প্রান্তিক মানুষটাকে এবার বড্ড গোলমেলে লাগছে তার…অনেক রহস্য আছে এই মানুষটার মধ্যে নাহলে কদিন পর যার নিজের বেবি হবে সে কিভাবে অন্য একটা মেয়ের কাছ থেকে বেবি চায়…

— “আই থিংক আপনার বেবি চাইনা, আপনার চাই নারী শরীর…ওয়াইফ প্রেগনেন্ট হওয়ার জন্য যেটা আপনি পাচ্ছেননা সেটাই চাইছেন আপনি আমার কাছ থেকে…আপনি তো আপনার ওয়াইফকেও ঠকাচ্ছেন মিস্টার মজুমদার…”

— “আমার লাইফ নিয়ে এত কিউরিসিটি কেনো তোমার??তুমি এখন আমার গোলাম…আমি তোমার কাছে বেবি চেয়েছি মানে তুমি আমাকে সেটাই দেবে…”

— “হ্যাঁ আমি তো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ,আপনি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বাচ্চা চাইলেন আর আমি দিয়ে দিলাম…”

— “এই নিয়ে আমি আর একটাও কথা বলবোনা, তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে কিচেনে যাও…আজ থেকে এই বাড়ির সমস্ত কাজ তুমি করবে…”

অনামিকা খুব বিরক্ত হলো,নিজের বাড়িতে রাজকন্যার মত লাইফ লিড করা মেয়েটাকে নাকি আজকে কাজের লোকের কাজ করতে হবে…এটা ভেবেই নিজের ওপর খুব করুনা হয় ওর…
— “এত বড়লোক মানুষ, বাড়িতে একটা কাজের লোক রাখতে পারেননা??”

প্রান্তিক হাসলো…
— “তো তোমাকে পঁচিশ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি কিসের জন্য?? শোপিস করে সাজিয়ে রাখার জন্য? যা বলেছি তাই করবে…”

প্রান্তিক রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অনামিকা রাগে জোড়ে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়…প্রান্তিক এই শব্দটা শুনে বড্ড রেগে যায়…
— “খুব বার বেড়েছে তোমার, দুদিন ভালো করে কথা বলেছি বলে খুব উড়ছো, এবার তোমার ডানাগুলো ছাঁটার সময় এসে গেছে…”

.

.
অনামিকা সবজি কাটছে আর মুখে বিড়বিড় করে কিছু বলছে…একটু আগেই স্নান করে সাথে সাথে রান্নাঘরে চলে এসেছে নাহলে প্রান্তিক তাকে হাজারো কথা শোনাবে…চুলটা ভালো করে মোছারও সময় পায়নি ও…
— “জীবনটাই আমার শেষ হয়ে গেলো, মায়ের কথা শুনে স্কুলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে না গেলেই ভালো হতো…তাহলে আমি আজ কলকাতায় পায়ের ওপর পো তুলে চিকেন লেগপিস খেতে পারতাম, আর তা না করে এখন আমাকে রান্না করতে হচ্ছে…তোর এই সর্বনাশের জন্য তুইই দায়ী অনামিকা পাল…”

— “কি বিড়বিড় করছো??”

প্রান্তিককে কিচেনে ঢুকতে দেখে আরও রেগে গেলো অনামিকা, রাগটা গিয়ে পড়লো ওর কাটতে থাকা গাজরের ওপর…
— “গাজরের ওপর রাগটা না দেখিয়ে যদি প্রীতমের ওপর দেখাতে তাহলে আজকে তোমাকে এখানে থাকতে হতনা….”

কথাটা বলতে বলতে প্রান্তিক এগিয়ে গেলো অনামিকার কাছে…অনামিকার চুলের জলে ওর জামার অনেকখানি অংশ ভিজে গেছে…তাতে বেশ মোহময়ী লাগছে ওকে…প্রান্তিক অনামিকার চোখের কাছে নড়তে থাকা চুলগুলোকে ওর কানের কাছে গুঁজে দিলো…অনামিকা প্রান্তিকের দিকে ঘুরে তাকালো…
— “সরে যান”

প্রান্তিক সরলোনা ,বরং উল্টে আরও অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো ওর…দুহাত দিয়ে অনামিকার গালগুলো আলতো ভাবে ধরলো প্রান্তিক…অনামিকা শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়তে থাকলো…শিহরণে চোখ বুজলো অনামিকা…প্রান্তিকের হাত অনামিকার চুলে বিচরণ করতে শুরু করলো…পকেট থেকে ক্লিপটা বের করে অনামিকার চুল আটকে দিলো ও…তখনও অনামিকাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে হো হো করে হেসে উঠলো প্রান্তিক…
— “এখনই ফিলিংস জাগলে হবে?? এই তো সবে সন্ধ্যে,রাত পর্যন্ত তো ওয়েট করতে হবে মিস পাল…”

অনামিকা তড়িৎ গতিতে চোখ খুললো নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত সে…হঠাৎ প্রান্তিকের ছোঁয়ায় ওর অসস্তি হচ্ছেনা এটা ভাবায় অনামিকাকে….তারপর ও কোনো উত্তর না দিয়ে আবার গাজর কাটায় মনোযোগ দেয়…

— “তোমাকে কেনো এখানে নিয়ে এলাম জানো??”

অনামিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…প্রান্তিক বলতে শুরু করলো…
— “কলকাতার বাড়িতে এত সিকিউরিটি গার্ড, হেলপিং হ্যান্ডের মধ্যে থেকে রোমান্স করার সুযোগ পেতাম না,এখানে কেউ নেই,কাজের লোক পর্যন্ত রাখিনি…তাই আমার বেবিকে পৃথিবীতে আনার প্রসিডিউরটা তো শুরু করতে হবে…”

— “আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ প্রান্তিক”

— “I know that ”

— “আমাকে ছেড়ে দিননা,এভাবে একটা অবিবাহিত মেয়ের বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা আমাদের সোসাইটি কি চোখে দেখেন জানেন??এই সোসাইটির কাছে আমার পরিচয় হবে প*তি*তা”

— “তাতে আমার কি??”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনামিকা, প্রান্তিকের মন গলাতে পারবেনা ও…তাই অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে ওকে…
— “আপনি এখন এখান থেকে যান,রান্না হয়ে গেলে ডাকবো আপনাকে…”

প্রান্তিক চলে গেলো কিচেন থেকে…নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফোন লাগালো কাউকে…
— “ওখানের কাজ কতদূর?? ওকে নজরে রাখো, কোথায় যায়, কার সাথে দেখা করে সব ইনফর্মেশন চাই আমার…”

— “হ্যাঁ স্যার আমাদের লোক সারাক্ষণ নজর রেখেছে ওর ওপর,ওর সাহায্যেই আমরা আসল মাস্টারমাইন্ডকে খুঁজে পাবো….”

— “একদমই তাই,ওর ওপর থেকে নজর সরানো যাবেনা, ওদের গ্যাংটা কিন্তু খুবই চালাক,তাই আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে…”

প্রান্তিক ফোনটা রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো…অফিসের কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল চেক করে মেল করলো…দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনে ল্যাপটপ বন্ধ করে দরজা খুললো ও…

— “কি চাই ?? এত তাড়াতাড়ি তো রান্না হওয়া সম্ভব নয়…”

— “আপনাকে কেউ খুঁজছেন…”

— “কে??”

— “একজন মধ্যবয়সী মহিলা…”

প্রান্তিকের আর বুঝতে বাকি থাকেনা কে তাকে খুঁজছে…গত পাঁচ বছর হলো অপরের ফ্ল্যাটে এসেছেন এই মহিলারা…বাঙালি হওয়ার সুবাদে প্রায়শই প্রান্তিকের কাছে আসেন উনি…প্রান্তিক কিছুটা বিরক্তও হয়…

— “তুমি আমাকে না জিজ্ঞাসা করে দরজা খুলেছো কেনো??”

— “অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছিলেন,আপনি আসছেন না দেখে খুলে দিয়েছিলাম…”

— “এর শাস্তি পরে দিচ্ছি তোমাকে, সরো…বাইরে আসবেনা এখন একদম…”

প্রান্তিক অনামিকাকে সরিয়ে বেরিয়ে এলো,দরজার কাছে আসতেই দেখে ওই মহিলাটি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে…
— “কিছু বলবেন কাকিমা???”

— “না আসলে বিকালের দিকে দেখলাম একটা মেয়েকে নিয়ে তুমি ঘরে ঢুকছো, তাই জানতে এলাম,মেয়েটা কে গো??এখনও দরজা খুলে দিলো.. বউ নাকি?”

প্রান্তিক মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলোনা…
— “হ্যাঁ কাকিমা বউ হয় আমার…”

— “বাহ খুব ভালো,বৌমা খুব ভালো হয়েছে…তবে হিন্দু বাঙালি বাড়ির বউ হয়ে শাঁখা সিঁদুর কিছুই নেই…অন্তত নোয়াটা তো রাখতে পারতো হাতে…”

— “কাকিমা ও অবাঙালি, এই যা কাকিমা আমার অফিসের কিছু কাজ পড়ে আছে… পরে কথা হবে আপনার সাথে…”

— “ঠিকাছে…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here