গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:7
আকাশে আজ অকালবর্ষণ…শীতের শুরুর দিকে হঠাৎই পরিবেশ আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে…বাইরে প্রচণ্ড গতিতে বৃষ্টিপাত আর ভিতরে অনামিকার মনের মধ্যে উথালপাথাল তোলপাড় শুরু হয়েছে…যখন থেকে শুনেছে একই ছাদের তলায় ও মৃত মানুষদের সাথে বসবাস করছে সেই থেকেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে ও…সামান্য একটু শব্দেও ভয়ে কাহিল হয়ে পড়ছে …ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা…অথচ অনামিকার চোখে ঘুম নেই… হঠাৎই প্রচণ্ড জোড়ে বাজ পড়ার শব্দে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে জ্ঞান হারায় ও…
প্রান্তিক ওর গোপন ঘরের মধ্যেই ছিলো…অনামিকার চিৎকারের শব্দ পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ওর ঘরের সামনে এসে প্রান্তিক…
— “অনামিকা,কি হয়েছে? দরজা খোলো..অনামিকা, এই অনু দরজা খোলো..”
অনেক ডাকার পরও কোনরকম শব্দ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে নিজের রুম থেকে অনামিকার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খুলতেই চমকে ওঠে ও…মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে অনামিকা…প্রান্তিক তাড়াতাড়ি গিয়ে অনামিকাকে কোলে করে বিছানায় শোয়ালো…
— “অনামিকা,চোখ খোলো..এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে কিভাবে..অনামিকা…”
বেডের পাশের টেবিল থেকে গ্লাসে রাখা জল নিয়ে অনামিকার চোখে দিতেই অনামিকার জ্ঞান ফেরে…চোখ খুলেই ও জড়িয়ে ধরে প্রান্তিককে…
— “আমায় মারবেননা প্লীজ, আমি বাঁচতে চাই…আমি আমার মা বাবাকে না দেখে মরতে চাইনা…প্লীজ আমায় মারবেন না…”
প্রান্তিক নিজের ভুল বুঝতে পারলো…অনামিকাকে ভয় দেখানোর জন্য ওই কথাটা বলা ওর উচিত হয়নি…অনামিকা ভয় পেয়েছে তো ঠিকই কিন্তু শকড হয়ে আছে ও…প্রান্তিক অনামিকার মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিলো…
— “শান্ত হও,কেউ তোমাকে মারবেনা…নিজের প্রাণ থাকতে আমি তোমাকে মারবোও না আর মরতেও দেবোনা…”
অনামিকা আরও শক্ত করে জড়িয়ে প্রান্তিকের শার্ট…প্রান্তিক টের পেলো অনামিকার শরীরে উষ্ণতার পরিমাণ…কপালে হাত দিয়ে দেখতেই ও ভয় পেলো…এত রাতে কোনো ডক্টরকেও পাবেনা ও তার ওপর এত ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে…অতিরিক্ত ভয় থেকে জ্বরটা এসেছে…নিজের ওপরে খুব ঘৃনা হয় ওর…তখন যদি ঐ কথাগুলো না বলতো তাহলে এই পরিস্থিতিটা তৈরি হতনা…
— “কিচ্ছু হবেনা তোমার অনামিকা, কিচ্ছু হতে দেবোনা তোমার…”
প্রান্তিক অনামিকাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়..তারপর উঠে কিচেন থেকে একটা বাটিতে করে জল আর নিজের রুম থেকে নিজের রুমালটা এনে অনামিকার পাশে বসে…রুমালটা জলে ভিজিয়ে বারবার জলপট্টি দিতে থাকে… প্রায় আধাঘন্টা পরও যখন জ্বরটা কমলোনা তখন বাধ্য হয়ে প্রান্তিক নিজের চেনা একজন ডাক্তারকে ফোন করলো…ছয় সাতবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হলো…
— “Everything is okay Prantik??”
— “No, nothing is okay doctor, আমার ওয়াইফ অসুস্থ, খুব জ্বর এসেছে..একশো চারে উঠে গেছে বডি টেমপ্যারেচার, নামছেই না..”
— “বাইরে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে,আমি তো আসতেও পারবোনা…মেডিসিন দিয়েছো??”
— “না ডক্টর,ওর প্যারাসিটামলে অ্যালার্জি..অনেক্ষন থেকে জলপট্টি দিচ্ছি…তবুও কিছু হচ্ছেনা…”
— “তাহলে এক কাজ করো ঠান্ডা জল দিয়ে মাথাটা ধুইয়ে দাও…”
প্রান্তিক কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো…
— “ও ঠিক হয়ে যাবে তো ডক্টর??”
— “তোমার মত স্ট্রং ছেলে যদি এটুকুতেই ভেঙে পড়ে কিভাবে হবে প্রান্তিক? তোমার ওয়াইফ একদম সুস্থ হয়ে যাবে…আমি যা বললাম তাই করো…”
প্রান্তিক ফোনটা রেখে চট করে ওয়াশরুম থেকে এক বালতি জল নিয়ে এসে বিছানার কাছে রাখলো…অনামিকাকে ঘুরিয়ে শোয়ালো প্রান্তিক…
— “আরেকটু ঘোরো…,হুম এবার ঠিক আছে”
প্রান্তিক অনামিকার মাথাতে ধীরে ধীরে জল দিয়ে ধুইয়ে দিলো…তারপর একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছে দেয়…অনামিকা দুর্বলতার জন্য আবার শুয়ে পড়তে চাইলে প্রান্তিক বাঁধা দেয়…
— “চুলগুলো ভিজে, এখন একটু বসো…”
প্রান্তিক ঠেল দিয়ে বিছানার একপ্রান্তে বসলো ,তারপর অনামিকাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে বসালো…অনামিকা কম্পিত কন্ঠে বলে…
— “কেনো আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছেন প্রান্তিক? আপনার বউ আছে, তার সত্ত্বেও কেনো আপনি আমার এত কাছে আসছেন…”
অনামিকাকে কথা বলতে দেখে প্রান্তিক ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো,কপালটা আগের তুলনায় ঠান্ডা…থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর চেক করে দেখলো একশো…একটু নিশ্চিন্ত হলো প্রান্তিক…
— “কি হলো বলুন, আমাকে নিয়ে এত ভাবছেন কেনো আপনি? আপনার বউ আছে..”
প্রান্তিক হাসলো, অবচেতন মনে হলেও তো বলেছে অনামিকা ওর প্রতি দূর্বল হচ্ছে…
— “হুম আমার বউ আছেই তো, আর তুমিই তো হলে আমার বউ…আমার শিশু বউ…”
— “মিথ্যে, শুধুমাত্র নিজের সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে আপনি সবার কাছে আমাকে নিজের বউ হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন…আসলে তো আমি আপনার র…”
অনামিকার মুখটা চেপে ধরলো প্রান্তিক…
— “আমাদের সম্পর্ক পবিত্র অনু, আইন আমাদের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছে…তুমি আমার লিগ্যাল ওয়াইফ,আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার প্রথম এবং শেষ বউ…”
অনামিকা চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করলো প্রান্তিকের বিষয়টা…কিন্তু কতটা ওর বোধগম্য হলো সেটা বোঝা গেলোনা..
— “আমি মায়ের কাছে যাবো…”
প্রান্তিক তারমানে এতক্ষন ভষ্মতে ঘি ঢাললো…অনামিকা ওর কোনো কথাই শোনেনি… ও ভেবেছিলো অনামিকাকে সব সত্যিটা জানিয়ে দেবে…কিন্তু অনামিকা এখন শোনার মতো অবস্থায় নেই…প্রান্তিক অনামিকার কপালে স্নেহচুম্বন দিলো…
— “আমি মায়ের কাছে যাবো প্রান্তিক,আমাকে নিয়ে চলুন…”
— “যাবো তো,আমরা যাবো কলকাতায়…কয়েক সপ্তাহ পরই যাবো…”
— “না আমি এখনই যাবো…”
— “আমরা এখন অস্ট্রেলিয়ায় আছি অনু, বললেই তো আর যাওয়া যাবেনা…”
— “আমি আপনাকে ঘৃনা করি প্রান্তিক, আমি প্রীতমকেও ঘৃনা করি, আপনারা দুজন আমার মানসিক শান্তি শেষ করে দিয়েছেন…আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছেন আপনারা…”
প্রান্তিকের অনুশোচনা হলো, অনেক আগেই অনামিকাকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো ওর…প্রান্তিক অনামিকার কপালে নিজের কপাল ঠেকালো….
— “আমি তোমার মানসিক শান্তি নষ্ট করিনি অনু, বরং তোমাকে মানসিক অশান্তি থেকে দূরে রাখার জন্য সবার থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি তোমাকে…সুস্থ হও,সব বলবো তোমাকে…আমি খারাপ মানুষ নই…”
— “আমি এখনই সব শুনবো…”
— “এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন অনু, ঘুমাও…”
— “আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন না তো?? আপনি আপনার কাছ থেকে কোথাও যাবনা, আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছেন আপনি…”
অনামিকার সোজাসুজি স্বীকারোক্তি শুনে হাসলো প্রান্তিক, সুস্থ অবস্থায় কখনও এমন কথা বলতো না…
— “বউ, ইউ লাভস মি?”
অনামিকা পিটপিট করে তাকালো প্রান্তিকের দিকে, চোখ জ্বালা করছে ওর….
— “নট শিওর, বাট আই ওয়া…”
প্রান্তিকের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজালো অনামিকা, অতিরিক্ত জ্বরের জন্য এতক্ষন ঘুমাতে পারছিলো না, জ্বরটা একটু ছাড়তেই আর চোখ চেয়ে থাকতে পারলোনা ও…প্রান্তিক আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিলো অনামিকাকে…তারপর পাশে বসেই অনামিকার চুলে বিলি কাটতে থাকে…
.
.
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গলো অনামিকার…চোখ খুলতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো…শরীরটা ভারী হয়ে আছে ওর…উঠে বসে চোখ রগড়ে ভালো করে তাকালো…পাশে ঘুরতেই প্রান্তিককে বিছানায় বসে ঘুমাতে দেখে অবাক হলো ও…কাল রাতের কথাগুলো আবছা মনে পড়তে লাগলো ওর… প্রান্তিককে দেখে অনামিকার মায়া হলো, বেচারা ওর জন্য সারারাত জেগে আছে… আস্তে করে নাড়া দিলো প্রান্তিককে…
— “প্রান্তিক, প্রান্তিক…”
— “উমমম ,আরেকটু ঘুমাতে দাও বউ…”
বউ শব্দটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো অনামিকা, তারপর ঘুমের ঘোরে ভুল বকছে ভেবে পাত্তা দিলোনা…
— “হ্যাঁ ঘুমাবেন তো,কিন্তু সোজা হয়ে শোন, নাহলে ঘাড় ব্যাথা করবে…”
প্রান্তিক লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো, অনামিকা ওর গায়ে চাদরটা টেনে নামতে গেলেই প্রান্তিক অনামিকাকে নিজের পাশে শুইয়ে চেপে ধরলো…
— “কি করছেন ,ছাড়ুন..”
প্রান্তিক ধীরে ধীরে চোখ খুললো…অনামিকার চোখের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো যত্ন করে কানে গুঁজে দিলো…অনামিকার নাকে থাকা লাল তিলতার ওপর নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো…অনামিকা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে…
— “আই লাভ ইউ ,বউ”
অনামিকা চোখ খুললো বউ ডাকটা শুনে…প্রান্তিক সজ্ঞানেও কেনো তাকে বউ বলছে এটা ভেবে অবাক হয়ে ও…
— “আপনি বারবার আমাকে বউ বলছেন কেনো বলুন তো?বউকে মিস করছেন বুঝি? তাহলে তাকে নিজের কাছে আনছেন না কেনো??”
প্রান্তিক অনামিকাকে জড়িয়ে ধরলো আরও শক্ত করে, দুজনের মধ্যে বায়ু চলাচলকে নিষিদ্ধ করলো প্রান্তিক..
— “আমি তো আমার বউয়ের কাছেই আছি, তাকে জড়িয়ে তার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছি…”
অনামিকা প্রান্তিককে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও সেটা করে উঠতে পারেনা…
— “সরুন প্রান্তিক, জ্বর হয়েছিলো আমার আর ভুলভাল বকছেন আপনি…?”
— “তোমার জ্বর হলো বলেই তো আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারলাম, তোমাকে আর অন্ধকারে রাখবোনা আমি…”
— “কিসের অন্ধকার??আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়ে বলছেন আমাকে অন্ধকারে রাখবেননা?”
প্রান্তিক অনামিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো…
— “না বউ আমি তোমার জীবন তছনছ করিনি, বরং তোমার জীবন তছনছ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি,কয়েকটা শয়তানের দৃষ্টি থেকে তোমাকে সরিয়ে এনেছি…”
— “মানে?এই আপনি ঘুমের ঘোরে কি উল্টোপাল্টা বকছেন? নাকি কাল রাতে কিছু উল্টোপাল্টা খেয়েছেন?”
প্রান্তিক অনামিকার কথা শুনে হাসলো, অনামিকার কাঁপতে থাকা ঠোঁটটা আজ খুব আকর্ষণ করছে ওকে…নিজের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে বারবার দমিয়ে রাখতে চেয়েও ব্যর্থ হয় ও…অনামিকা ঠোঁটটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজের দখলে নিয়ে নেয়…অনামিকা উত্তেজনায় প্রান্তিকের চুল খামচে ধরে…কয়েক সেকেন্ড পর ছাড়া পেতেই অনামিকা খুব জোড়ে জোড়ে স্বাস নেয়…
— “এটা কি হলো??
— “চুমুটা বেশ মিষ্টি, এখন থেকে সকালবেলা ভাবছি কফি না খেয়ে এটাই টেস্ট করবো…”
— “বউ থাকতে অন্য মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা”
— “তুমিই তো আমার বউ,আমার লিগ্যাল ওয়াইফ,তোমাকে চুমু খাওয়ায় লাইসেন্স আমি চল্লিশ দিন আগেই পেয়ে গেছি…”
লিগ্যাল ওয়াইফ কথাটা শুনে অবাক হলো অনামিকা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…প্রান্তিক অনামিকার কৌতূহল সম্পর্কে বুঝতে পারলো…
— “কলকাতায় যেদিন তোমাকে এনেছিলাম আমার কাছে, মনে আছে কয়েকটা পেপারে সাইন করিয়েছিলাম তোমায়??”
অনামিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললো…
— “হুম মনে আছে, কন্ট্রাক্ট পেপার ছিলো”
প্রান্তিক মৃদু হাসলো অনামিকার দিকে তাকিয়ে…
— “না,ওপরের পেজ গুলো সব ফলস ছিলো যেগুলো তুমি পড়েছিলে, ভিতরের পেজ গুলো আসল ছিলো যেগুলো তুমি পড়নি,আর যেটা ছিলো আমার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপার…আমার কোনো বউ নেই,তুমিই আমার একমাত্র বউ..আর বাইরের নেমপ্লেটে লেখা মিসেস মজুমদার হলো তুমি,মিসেস অনামিকা মজুমদার, ওয়াইফ অফ প্রান্তিক মজুমদার…”
( আজকের পর্ব তুলনামূলকভাবে অনেকটা বড়ো লিখেছি,তোমরাও কিন্তু বড় বড় কমেন্ট করবে, আজ থেকে শুরু হলো রহস্য উদঘাটন পর্ব…
Shampa Mistri ম্যাম বিবাহ রহস্যটা আগেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলো দেখে খুশি হয়েছি আমি….আসলে গল্পটা মন দিয়ে পড়লে সবাই বুঝতে পারবে দুইয়ে দুইয়ে চারই হয়…ধন্যবাদ সকলকে…সবার মতামত জানাও,তোমরা কি ভেবেছিলে??)