প্রেমস্পন্দন #তানিয়া_মাহি(নীরু) #পর্বসংখ্যা_১০( অন্তিমপর্বের প্রথমাংশ)

0
176

#প্রেমস্পন্দন
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_১০( অন্তিমপর্বের প্রথমাংশ)

” আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?”

গাড়ি থামায় আদনান। গাড়ি চলন্ত অবস্থায় কিছু শোনা যাচ্ছিল না। ফোন বেজে ওঠায় স্ক্রিনে নওশীনের নম্বর দেখেই রিসিভ করেছিল সে।

ফোনটা কানে নিয়ে বলে,” কিছু বললে?”

নওশীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,” আমাকে বিয়ে খেতে নিয়ে যাবেন? আমার যেতেই হবে।”
” কার বিয়ে?”
” চলুন আপনি আমার সাথে, গেলেই দেখতে পাবেন।”
” আপনি রেডি?”
” দশ মিনিট লাগবে। আপনি কোথায়?”
” বাড়ি গিয়েছিলাম, এখানেই ফিরছি। আপনাদের বাড়ির ওখানে যে পাঁচ-সাত মিনিট লাগবে।”
” ঠিক আছে বাসায় আসুন।”

নওশীন কল কেটে দিয়ে রেডি হতে শুরু করল। নোয়া বসে বসে নওশীনের কান্ড দেখছে। মনে মনে একটাই ভয় পাচ্ছে বিয়ে বাড়ি গিয়ে কোন ঝামেলা যেন না বাধায়।

নওশীনের তৈরি হওয়া শেষ হলে নোয়া এসে বলে,” তুই কি নুহাশের বাড়িতে যাচ্ছিস?”
” হুম। বুঝতে পারোনি?”
” এটা নিম্ন মানসিকতার পরিচয়। তার ইচ্ছে হয়েছে, বিয়ে করেছে। তুই কেন সেখানে যাবি? তাও আবার আদনান সাহেবকে নিয়ে! উনি একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি।”
” শিক্ষা তো আমি দিবই। চিন্তা করতে হবে না তোমার, আমি সিনক্রিয়েট করব না। ওতটুকু জ্ঞান আমার আছে।”
” তবুও আমার মনে হয় এসব না করাই ভালো। জীবনে অনেককিছুর সম্মুখীন হতে হবে সবকিছুর মোকাবেলা না করে কিছু ছেড়েও দিতে হয় ভালো থাকতে।”
” আমি পারছি না আপু। থাকো আসছি।”

নওশীন রুম থেকে বের হয়ে বাহিরের দিকে আসে৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কিন্তু আদনান বাড়ির ভেতরে নেই তার মানে সে বাড়িতে আসেনি৷ নওশীন সামনের দিকে এগুতে থাকে৷ বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে এসে দেখে তার নানা মুহিব শেখ ছোট বাগানটা পরিষ্কার করছিলেন।
নানাকে বলে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসে সে। বের হতেই দেখে আদনান গাড়ি নিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে। বাড়িতে না প্রবেশ করার বিষয়টা নওশীনের কাছে একটু কেমন যেন লাগে। নওশীনকে এগিয়ে আসতে দেখে আদনান বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

গাড়িতে উঠতে উঠতে নওশীন বলে,” এখানে অপেক্ষা করছিলেন কেন? আমি তো বলেছিলাম ভেতরে যেতে।”
” সমস্যা নেই। বাড়িতে না গেলেও বাড়ির সামনেই তো ছিলাম।”

আদনান গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ধীরে ধীরে চলা শুরু করে। সামনের দিকে মনোযোগ দিয়েই বলে,” কোথায় যেতে হবে? আমাকে কিছু বলোনি তুমি।”

নওশীন জায়গার নাম বলতেই আদনানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সেখানেই তো আদনান নওশীনকে একটা ছেলের সাথে দেখেছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

আদনানকে চুপ থাকতে দেখে নওশীন বলে ওঠে,” চুপ করে আছেন কেন আজ? শরীর ভালো?”
” দেখে কী মনে হচ্ছে?”
” আমি তো সাইকোলজি ভালো পারি না। মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে বলতেও পারি না সে কেমন আছে।”
” ভালো আছি।”
” দেখে মনে হচ্ছে আপনার মন খারাপ।”
” আমরা কার বিয়ে খেতে যাচ্ছি?”
” বিয়ে খেতে যাচ্ছি বলতে বর-বউকে শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছি।”
” একা!”
” নাহ, আপনি যাচ্ছেন আমার সাথে।”
” আমি কোন পরিচয়ে যাচ্ছি?”
” এতসব আপনার ভাবতে হবে না। আপনি ড্রাইভ করুন।”

আদনান আর কিছু বলে না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকে। স্টেশনে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগে না তাদের। স্টেশনে এসে পৌঁছতেই স্টেশনের অপরপাশে এগিয়ে যেতে বলে নওশীন কারণ সে যতটুকু জানে নুহাশের বাড়ি এদিকই হওয়ার কথা। সামনে একটা ব্রিজ পড়লে সেটা পার হয়ে একটা লোককে দেখে নওশীন আদনানকে গাড়ি থামাতে বলে৷ আদনানও দেরি না করে গাড়ি থামায়।

নওশীন আদনানকে জিজ্ঞেস করতে বলে আশেপাশে কোন বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে কি না।
নওশীনের কোথায় আদনান এবার বেশ অবাক হয়। আগে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নওশীনকে বলে,” আশেপাশের কোন বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে কি না সেটা আমি জিজ্ঞেস করতে কেন যাব? তুমি কোন বাড়িতে বিয়ে খেতে আসছ স্যরি বর বউকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছ? আমাকে ক্লিয়ার করে এখনই বলো।”

নওশীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” গতকাল পর্যন্তও যে মানুষটা আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল তার বিয়েতে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। ”

আদনান যেন এবার আকাশ থেকে পড়ে। নওশীনের দিকে সে এতক্ষণ ও ভালোভাবে দেখেনি। এতক্ষণে বুঝতে পারলো নওশীনের চোখ কিছুটা ফুলে গিয়েছে। আদনান বুঝতে পারে নওশীন খুব কান্নাকাটি করেছে।

আদনান বিষয়টা ভালোভাবে জানতে নওশীনকে বলে, ” আপনার প্রেমিক আপনাকে ঠকিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে! একজন নারীর এত গভীর ভালোবাসা ভুলে সেই পুরুষ অন্য কাউকে কীভাবে বিয়ে করে নিতে পারল! ”

নওশীন ঠোঁটে মিথ্যে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলে, ” পারল তো, খুব ভালোভাবেই পারলো। পুরুষের হয়তো জানা নেই, নারী যেমন ভালোবাসতে পারে নারী তেমন ঘৃণাও করতে পারে। কোন পুরুষের প্রতি যখন, তখন সেটা ভালোবাসার চেয়েও বেশি বড় আকার ধারণ করে।”

নওশীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে ওঠে, ” ওই লোক তো চলেই গেল আপনি প্লিজ একটু বের হয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন আশেপাশে কোন বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে কি না? আমি আসলে বাড়ি চিনি না তবে এই এরিয়াতেই যে বাড়ি এটা আমি নিশ্চিত। ”
” এখন বলো তো তুমি বাড়িতে এখন গিয়ে কি করবে তাও তো বিয়ে হয়ে গেছে এমন তো না যে বিয়ে হয়নি তুমি বিয়ের আসরে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিবে। ”
” নাহ। বিয়ে তো ভাঙব না। আমি শুধু তাদের বিয়েতে শুভেচ্ছা জানাবো।”
” কথা দিচ্ছ?”
” জি একদম। পাক্কা প্রমিস।”

আদনান গাড়ি থেকে বের হয়ে বাহিরে যায়। নওশীন গাড়িতে একা একা বসে ব্যাগে থেকে নুহাশের সাথে সম্পর্কের প্রথম মাসে পাওয়া গিফটগুলো বের করে দেখে আবার ব্যাগের ভেতরেই রেখে দেয়।

মিনিট দুয়েক পরেই আদনান ফিরে এসে গাড়ির সিটে বসে। নওশীনকে জানায় সামনে আরেকটা ব্রিজ, ব্রিজের সাথেই নিচের দিকে একটা বাড়ি, ওখানেই বিয়েটা হচ্ছে।

গাড়ি আবার চলা শুরু করে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে নির্দিষ্ট স্থানে থেমেও যায়। আদনান নওশীনকে গাড়ি থেকে নামতে বলে। সে নিজেও বুঝতে পারছে
নওশীনকে তার ইচ্ছেতে এসব করতে দেয়া উচিত হচ্ছে না। তবুও কোনভাবে মনে হচ্ছে কিছু সময় অন্যরকম কিছু করে মানসিক শান্তি পাওয়া গেলে হয়তো সেটা করা উচিৎ।

আদনান গাড়ি থেকে নামার আগে মুখে মাস্ক আর চশমাটা পরে নেয়৷ গাড়ি থেকেই বের হয়ে নওশীনের কাছে এসে দাঁড়ায়। নওশীনের ভেতরে যেতে ভয় লাগছে। প্রিয় মানুষের পাশে আজ সে অন্যকাউকে দেখবে। প্রিয় মানুষের সাথে অন্যকাউকে দেখার মতো দূর্ভাগ্য হয়তো আর কোনকিছুতে নেই। নওশীন আবার ভাবে নুহাশ তো আর প্রিয় মানুষ নেই। সে কঠিনভাবে অপ্রিয় মানুষ হয়ে গিয়েছে। সে একজন প্র*তারক। মিষ্টি কথায় সে তাকে এতদিন ঠকিয়েছে।

নওশীনের ভাবনায় আদনান ছেদ ঘটায়। এপাশে ওপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,” এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

নওশীন আদনানের দিকে তাকায়,” আপনি বরং গাড়িতেই থাকুন। আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে এখানে কেউ চিনলে সমস্যা হয়ে যাবে। ”
” হয়তো তোমার খুশির জন্য সব করতে পারব।”
” মানুষ সবসময় ভুল মানুষেই আটকে যায়, আমিও কেমন বাজেভাবে আটকে গিয়েছি৷ আমি আটকেছিলাম তার মাঝে আর আপনি আমার মাঝে। আমরা দুজনই পরিস্থিতির স্বীকার।”
” হয়তো। তবে আমার ভাগ্য হয়তো আপনার মতো হবে না। আপনি নিশ্চয়ই আপনার প্রাক্তনের মতো অন্যকাউকে বিয়ে করে নিবেন না।”
” আমার এখন কাউকে ভালোবাসতে ভয় লাগবে।”

” সেটা দেখা যাবে। এখন চলো।”

নওশীন সেখানেই দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। আদনান নওশীনের অবস্থা বুঝতে পারে। মুচকি হেসে বলে,” ভেতরে যেতে ভয় লাগছে? আরে আমরা তো জাস্ট নতুন বর-বউকে দেখতে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে মন খারাপ করা একদম চলবে না। হুম?”

নওশীন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। আদনান এবার নিজেই নওশীনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত পথটা একটু ঢালু বিধায় নওশীনকে সাহায্য করতেই হাত বাড়ায় আদনান।

নওশীন আদনানকে বলে,” জীবনের কত খারাপ সময় পার করছি আর এটুকু রাস্তা শেষ করতে পারব না? চলুন তো।”

আদনানও আর কিছু না বলে নওশীনকেই আগে আগে যেতে বলে। নওশীন রওয়ানা দিলে সেও পিছন পিছন যায়।

বাড়িতে জমজমাট আয়োজন। বাড়িটাও বিশাল আকারের। গ্রামের বড় বাড়ি যেমন হয় এই বাড়িটাও তার অন্যথা নয়। বাড়ির আনাচে কানাচেও লোকে লোকারণ্য। বিয়েতে যাদের দাওয়াত করা হয়েছে তারা খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হচ্ছে। একপাশেই ছোট একটা জায়গা সাজানো। সেখানে ফাঁকফোকর দিয়ে নতুন বউকে কিছুটা দেখা যাচ্ছে কিন্তু পাশে বর নেই। বউয়ের আশেপাশে কিছু পিচ্চি আর দুইটা পনেরো-ষোলো বছর বয়সী মেয়ে বসে আছে বউকে সঙ্গ দিতে। আশেপাশে তেমন কাউকে না দেখে নওশীন বউয়ের দিকেই এগুতে থাকে। মাঝপথে আদনানের কল এলে আদনান ফোনটা বের করে দেখে তার মা কল দিয়েছে। নওশীন আদনানের দিকে তাকাতেই আদনানও নওশীনের দিকে তাকায়। নওশীন কথা বলে আসতে বলে। আদনান তাকে জানায় সে দুই মিনিটের মধ্যেই আসছে। নওশীনও মুচকি হেসে সম্মতি দেয়।

নওশীন বউয়ের কাছাকাছি যেতেই যেন তার বুকটা ভারী হয়ে আসতে শুরু করে। নিজের ভরটাও যেন বেড়েছে। পা ঠিকমতো চলছে না। নিজের মন শক্ত করে একটা শ্বাস ফেলে বউয়ের দিকে এগিয়ে যায়। নওশীন নতুন বউয়ের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসেই সালাম দেয়।

নতুন বউ সালামের জবাব দিতেই নওশীন বলে ওঠে,” কেমন আছেন?”

নতুন বউ মুচকি হেসে জবাব দেয়,” জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?”
” জি ভালো। আমাকে চিনলেন না তাই না?”
” ন না, আসলে চিনতে পারিনি।”
” আমি নুহাশের বান্ধবী।”
” ওহ আচ্ছা। ”
” হুম। তা সে কোথায়? দেখছি না যে?”
” ও একটু ভেতরে গেল, বলল কী যেন দরকার। আপনি এখন এসেছেন? খাওয়া দাওয়া হয়েছে?”
” ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ”

নওশীন ব্যাগ থেকে গিফটগুলো বের করে নতুন বউয়ের হাতে দেয়। জানায় এগুলো তার জন্যই আনা হয়েছে। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে। নওশীন কথার মাঝে নতুন বউয়ের দিকে এক পলকে চেয়ে থাকে আর ভাবে ওই মানুষটা না ঠকালে হয়তো এই জায়গায় সে থাকতে পারত।

নুহাশ বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই নতুন বউয়ের পাশে নওশীনকে দেখে সেখানেই থেমে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। এখনই যেন চোখদুটো(শ্বেতমন্ডল) কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।

নওশীন ডানপাশে তাকাতেই নুহাশকে দেখতে পায়। বুকের ব্যথাটা যেন প্রকপ আকার ধারণ করে। বুকের ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে নুহাশকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,” আরে নতুন বর যে! অভিনন্দন অভিনেতা।”

#চলবে…..

আজ লিখে শেষ করতে পারলাম না। এই গল্পের অন্তিমপর্বের শেষাংশ আসবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here