#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৬
” আমি তোকে কিছু করেছি? এমন চিৎকার দিয়েছিস কেন? আমি তোকে আদর করেছি, চুমু খেয়েছি নাকি শক্ত হাতে থাপ্পড় মেরেছি, কোনটা?”
রায়া মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়াচ্ছে আর অস্পষ্ট আওয়াজ করে যাচ্ছে। ইহান রায়ার মুখ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। রায়া উঠে বসে হাঁপাতে থাকে। ইহান বিছানার নিচে থেকে আলমারির চাবি নিয়ে রায়াকে দেখিয়ে বলে, ” আমি চাবি নিচ্ছিলাম আর তুই চিৎকার শুরু করে উঠেছিস বেয়াদব মেয়ে।”
” এই রুমে আমার ঘুমের সময় কেউ আসে না। এভাবে চোখ খুলে আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছি। তার ওপর আপনি তো বাড়িতে ছিলেন না।”
” দিন-দুপুরে নিশ্চয়ই ভূত আসবে না তাই না?”
” আসতেও তো পারে কিন্তু আপনি কখন আসলেন?”
” এসব তোর জানতে হবে না।”
” কার জানতে হবে?”
” মানুষ যোগাড় করে নেব।”
” বাড়িতে নিয়ে আইসেন বি*ষ খাইয়ে আগাছা সাফ করে ফেলব।”
” বেশি কথা বললে থাপড়িয়ে চোয়াল বাঁকা করে ফেলব।”
” এই গাল শুধু চুমু দেওয়ার জন্য, একটা চুমু দেন।”
ইহান রায়ার কাছে থেকে উঠে এসে আলমারির লক খুলতে খুলতে রায়ার আড়ালে হাসতে থাকে। মেয়েটা বড্ড পাজি। ইহান নিশ্চিত এই মেয়ের সাথে থাকলে রাগটা আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারবে না। এমনিতেই রাতে কান্না করে মনটা গলিয়ে দিয়েছে। এতগুলো দিন নিজেকে কঠোর করে রেখেছিল কিন্তু পুরো একটা মাস কথা না বলে ভালো না লাগায় মাকে জানিয়ে তাড়াতাড়ি সুদূর ঢাকা থেকে চলে এসেছে।
” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
ইহান আলমারির সিকরেট ড্রয়ার থেকে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাগজ খুঁজছিল এমন সময় রায়ার এমন আবদারজরিত গলা শুনে পিছনে ঘুরে তাকায়। ইহান আবার আলমারির দিকে তাকিয়ে উঁচুস্বরে বলে ওঠে, ” কী চাই এখানে?”
” আপনাকে।”
” মানে?”
” বাংলায় বললাম তো বোঝেন নি?”
” আমি তোর সাথে এখানে প্রেম করতে আসি নি রায়া। আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টাও করবি না। আমাকে আমার মতো থাকতে দে।”
” আপনি আমার জন্য বাসায় আসেন নি?”
” তোর জন্য কেন আসব? এখানে আমার প্রয়োজন ছিল বিধায় এসেছি।”
“আমি জানি আপনি আমার জন্যই এসেছেন।”
” চরিত্রহীন কোন মেয়ের জায়গা নেই আমার জীবনে।”
ইহানের কথায় চোখ ঘোলাটে হয়ে যায় রায়ার। বুকের মধ্যে অদ্ভুত ব্যথা শুরু হয়। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করে। একটা মানুষ যখন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে, একটা মানুষের জন্য শুধুমাত্র একটা মানুষের জন্য নিজেকে তার দিকে এগিয়ে দিবে সেই মানুষটাই বোধ হয় ছেড়ে যাওয়ার সাহস দেখায়! অপ্রিয় থেকে প্রিয় আবার প্রিয় থেকে অচেনা হওয়ার পথ বুঝি এমনই হয়!
রায়ার চোখ টলমল করছিল। রায়ার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ইহান পিছনে ফিরে তাকায়। রায়া চোখের পলক ফেলতেই দুফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
রায়া ইহানের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। ভারী গলায় বলে ওঠে, ” সবকিছু এভাবেই শেষ হয়ে যাবে সত্যি সত্যি? আপনি আমার সাথে এমন করলে আমার বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও যে সলতেহীন মোমবাতির আলোর মতো নিভে যাবে। ”
” রায়া প্লিজ আমার এসব আর শুনতে ইচ্ছে করছে না।”
” মানুষ তো ফাসির আসামীকেও ভালোবাসে, তার জন্য কষ্ট হয়। আমার জন্য আপনার একটুও কষ্ট হয় না? আর একটুও ভালোবাসেন না?”
ইহান কোন জবাব দেয় না। নিজের প্রয়োজনীয় কাগজগুলো নিয়ে বিছানার ওপর চলে যায়। রায়া কিছুক্ষণ স্থির থেকে সেখান থেকে বাহিরে চলে যায়। রায়া চলে যেতেই ইহান দৌঁড়ে এসে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে রায়া চোখ-মুখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। নিজের দুই কোমরে দুই হাত দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মনে মনে ভাবতে থাকে, এভাবে আর কতক্ষণ? নিজের প্রিয় মানুষ, ভালোবাসার মানুষ একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এত আহাজারি করছে আর সে কী না প্রতিশোধ নিচ্ছে! রায়া তো রাতে ঠিকই বলেছিল সে অন্যা*য়ের কথা ভেবেছিল ঠিকই কিন্তু আসল কাহিনী বুঝতে পেরে পিছিয়ে এসেছিল তো। ইহান বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,” এই মেয়ের থেকে কি আর দূরে থাকা সম্ভব হবে? বুকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য বুকটা তো আনচান করছে। মরুভূমিতে একফোঁটা পানির জন্য মানুষ যেমন তৃষ্ণার্ত থাকে আমিও তেমন রায়া নামক পিপাসায় কাতর হয়ে আছি।”
রায়া রান্নাঘরে গিয়ে ইরিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, ” আপনার ছেলে আমাকে সত্যিই আর ভালোবাসে না বড়মা। আমি কী করব এখন?”
ইরিনা বেগম হাতের চামচটা ধুয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ” কে বলেছে তোকে?”
” আপনার ছেলের কথায় বোঝা যায়।”
” ইহান নিজে মুখে বলেছে?”
” না, তা বলে নি।”
” তাহলে তোর এতকিছু ভাবতে হবে না। তুই আবার কান্না করেছিস? আমাকে না কথা দিয়েছিলি?”
” আপনার ছেলে বাজে ব্যবহার করেছে আমার সাথে।”
” ওকে আমি দেখে নেব। তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ সবাই একসাথে খেতে বসব।”
” কালকে আমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে দিও। আজ রাতে ঘুম হয়নি সকালে ঘুমিয়েছি জন্য দেরি হয়ে গেছে।”
” আচ্ছা ডাকব, এখন যা।”
রায়া রান্নাঘর থেকে চলে গেলে ইরিনা বেগম মনে মনে বলেন, ” আমার ছেলেটা যে তোর কান্না আর সহ্য করতে না পেরে চলে এসেছে তোর কাছে এটুকু বুঝলি না!”
খাবার টেবিলে বসে সবাই রায়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। ইহান মায়ের সাথে কথা বলছিল। এশা আর রায়া দুজনই এখনও আসে নি। ইহান গলা উঁচু করে এশার রুমের দিকে তাকিয়ে এশাকে ডাক দিতেই এশা বেরিয়ে এসে খাবার খেতে বসে যায়। ইহান রায়াকে না ডেকে মাকে বলে, ” আম্মি, তুমিই রায়াকে ডাকো।”
এশা পাশে থেকে বলে ওঠে, ” তুমি ডাকছো না কেন? তোমার বউকে তুমি ডাকো। জানো কী পরিমাণ কান্না করেছে বেচারি তোমার জন্য? তুমি তো লাকী।”
” চুপ, বড় ভাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? শিখিয়ে দিতে হবে আবার?”
” আমাকে কিছু শেখাতে হবে না। তুমি বরং গুগলকে জিজ্ঞেস করো, টিউটোরিয়াল দেখে শিখে নাও যে বউয়ের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়।”
ইহান মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে, ” আম্মি তোমার মেয়েকে বলে দাও বেশি কথা বললে কিন্তু আমি ওকে তুলে ছাদে থেকে ফেলে দেব।”
” থামবি তোরা!”
রায়াকে দেখেই এশা বলে ওঠে, ” ওরে নীল পরী যে! তা কোত্থেকে পরীর দেশ থেকে আসলে নাকি আকাশ থেকে পড়লে?”
এশার কথা শুনে সবাই বামপাশে তাকায়। রায়া নীল শাড়ি পরে লজ্জামাখা মুখে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। ইহানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ইরিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কেমন লাগছে আমাকে, বড়মা?”
ইরিনা বেগম মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলেন, ” খুব সুন্দর লাগছে, তাই না রে ইহান? শর্ট হেয়ারে শাড়িতে কী সুন্দর মানিয়েছে তোকে! কারো নজর না লাগুক। ”
রায়া ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে নিজের প্রশংসা শুনতে। পৃথিবীর সব নারীর অধিকার আছে শাড়ি পরলেই ব্যক্তিগত মানুষের কাছে থেকে প্রশংসা পাওয়ার৷ পৃথিবীর সব পুরুষের উচিৎ নারী শাড়ি পরলে পরিমাণগতভাবে বেশি বেশি ভালোবাসা, অন্যা*য় করলে ক্ষমা করে দেওয়া।
রায়ার অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা দেখে ইহান বলে ওঠে, ” মা, মেয়েদের বড় চুলেই ভালো লাগে। ছোট চুল ছেলেদের জন্য। আর হ্যাঁ শাড়িতে একটু ভালোই লাগছে। বাড়িতে যেসব টিশার্ট পরে থাকে ওসব দিয়ে তো তুমি রান্নাঘরের পাতিল ধরো।”
রায়া রাগী চোখে ইরিনা বেগমের দিকে তাকালে ইরিনা বেগম রায়াকে ইশারায় ইহানের পাশে বসতে বলেন। রায়া একটা বড় শ্বাস টেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ইহানের পাশে ধপ করে বসে পড়ে।
সবাই খাওয়া শুরু করেছে। ইহান ভাতের এক লোকমা মুখে নিতেই নিজের পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব করে৷ ভাত মুখে দিয়ে টেবিলের নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে রায়া তার পা ইহানের পায়ের ওপর রেখে সুড়সুড়ি দিয়েই যাচ্ছে। ইহান পা সরিয়ে রায়ার দিকে তাকাতেই রায়া ঠোঁট দিয়ে চুমুর ইশারা করতেই ইহানের হেঁচকি উঠে যায়।
ইরিনা বেগম তাড়াতাড়ি করে পানির গ্লাসটা ইহানের দিকে বাড়িয়ে দেন। ইহান ঢকঢক করে গ্লাসের সম্পূর্ণ পানিটুকু খেয়ে নেয়। রায়া পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে। রায়ার হাসি দেখে ইহান চোখ বড় বড় করে রায়ার দিকে তাকাতেই রায়া হাসি বন্ধ করে খাবার প্লেটে মন দেয়।
খাবার খাওয়া শেষ হতেই একে একে সবাই গিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে এশা দরজা খুলতে যাবে ইহান তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে ওপাশে অপরিচিত এক লোককে দেখে ইহান জিজ্ঞেস করে, ” জি বলুন?”
দরজার ওপাশ থেকে লোকটা বলে,” ইহান শেখ-এর নামে পার্সেল এসেছে।”
” আমিই ইহান শেখ৷ কে পাঠিয়েছে?”
” সেটা লেখা নেই স্যার।”
” ঠিক আছে আমাকে দিন।”
ফরমালিটিজ পূরণ করে ইহান পার্সেলটা রিসিভ করে নেয়। হঠাৎ কে পার্সেল পাঠালো? বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে ইহানকে। পার্সেলটা উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে আর ভাবতে থাকে- কী আছে এখানে আর পাঠালোই বা কে?
#চলবে…..
[পেজে কি যেনো সমস্যা হচ্ছে তার জন্য পেজে গল্প পোস্ট হচ্ছে না ]