তিক্ত_প্রণয়ালাপ কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল পর্ব:10

0
411

গল্পঃ #তিক্ত_প্রণয়ালাপ
কলমে: #পুলকিতা_পোড়েল
পর্ব:10

অনামিকা সবে স্নান করে বেরোলো..প্রান্তিক এখনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছে…অনামিকা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ভিজে তোয়ালেটা ছুঁড়ে দেয় প্রান্তিকের ওপর…প্রান্তিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে বসে…
— “আপনি এখনও এখানে বসে আছেন? দুপুর তিনটে বাজে..স্নান করবেন কখন…?”

প্রান্তিক এক দৃষ্টিতে অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে… ভিজে চুলে কপাল দিয়ে টসটস করে জল পড়ছে গাল বেয়ে…প্রান্তিক উঠে অনামিকার কাছে আসে..অনামিকা একটু পিছিয়ে যায়…প্রান্তিকের অভিব্যক্তি পরিষ্কার তার কাছে..
— “দেখুন একদম অসভ্যতামো করবেন না,আমি এই স্নান করে এলাম..আমাকে রেডী হতে দিন..”

প্রান্তিক অনামিকার কাঁধ নিজের দুহাত দিয়ে ধরলো, তারপর ধরে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো…অনামিকা অবাক হয়ে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে আছে,প্রান্তিক কি করতে চাইছে বুঝে উঠে পারছেনা ও,
— “ঠিক কি করতে চাইছেন আপনি?”

ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনিটা তুলে নিয়ে অনামিকার সামনে ধরলো…
— “আমি আঁচড়ে দিই?”

অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো…
— “আপনি পারবেন?”

— “এতে না পারার কি আছে, একটা সময় তো আমাকেই সব করতে হবে..”

— “কোন সময়??”

— “ঠিক যেই কারণে তোমাকে তুলে এনেছি বলে এতদিন জানতে, সেই সময়টা তো আমাকেই তোমার সব কাজ করতে হবে…”

অনামিকা কটমট করে তাকালো প্রান্তিকের দিকে, প্রান্তিক বুঝে উঠতে পারলোনা এই তাকানোর মানেটা…
— “বাচ্ছা, বাচ্ছা আর বাচ্ছা! বাচ্ছা ছাড়া আপনি কিছু বোঝেননা? আমিও তো কারোর সন্তান, আমাকে ছাড়া আমার মায়ের মনের অবস্থাটা ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে পারছেন? মা তো আর এতকিছু জানেনা..”

অনামিকার হটাৎ এই ব্যবহার পরিবর্তনের মানেটা বুঝলো প্রান্তিক…মাকে ছাড়া প্রায় দুমাস মতো আছে তাও আবার এতদূরে,তাই অনামিকার মনের অবস্থা ঠিক নেই…প্রান্তিক অনামিকার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ওর হাত মুঠো করে ধরলো…
— “মন খারাপ করছে মায়ের জন্য?”

অনামিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে…
— “আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলুননা..”

— “নিয়ে যাবো অনু,তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো তোমার আপনজনদের কাছে…”

— “কবে নিয়ে যাবেন?”

— “অপরাধীদের শাস্তি দিতে আমাদের কলকাতায় ফিরতেই হবে অনু…”

— “সত্যি বলছেন তো??”

অনামিকা বাচ্চাদের মত মুখ করে তাকায় প্রান্তিকের দিকে…প্রান্তিক অনামিকার চোখের জলটা সযত্নে মুছিয়ে দেয়..
— “এবার তো কান্না থামাও, আমাকে আমার কাজ করতে দাও তো…চুপ করে বসো..”

অনামিকা লক্ষী মেয়ের মতো শান্ত হয়ে বসলো…প্রান্তিক অতি যত্নে ধীরে ধীরে অনামিকার চুলের জট ছড়িয়ে ভালো করে চুলটা আঁচড়ে দিলো…
— “একটা আবদার করবো বউ?”

অনামিকা আয়না দিয়ে প্রান্তিকের চেহারা দেখলো,আয়না দিয়ে ওর দিকেই দেখছে প্রান্তিক…
— “আপনি আবদার করতেও পারেন মিস্টার মজুমদার?”

প্রান্তিক চট করে অনামিকার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো…অনামিকা প্রান্তিকের যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো…মিনিট পাঁচেক পর প্রান্তিক আবার ফিরে এসে অনামিকার পিছনে দাঁড়ালো…অনামিকা টুল থেকে উঠে প্রান্তিকের মুখোমুখি দাঁড়ায়…
— “আপনাকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা প্রান্তিক,এখন মাথায় কি ঘুরছে বলুন তো…”

প্রান্তিক নিজের ডানহাত টা অনামিকার সামনে রাখলো…একটা লাল রঙের সিঁদুর কৌটো,যার ওপরে সোনার কাজ করা…অনামিকা অবাক হলো…
— “এটা??”

— “তোমাকে বউ সাজে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, একটু সিঁদুর পড়বে??”

প্রান্তিকের কাতর অনুরোধের ভঙ্গি দেখে হাসলো অনামিকা…
— “বাঙালি হিন্দু নারীরা প্রথম সিঁদুরটা তার স্বামীর হাতেই পড়ে,আমার বেলায় সেটা হবে না কেনো??”

প্রান্তিকের চোখ ঝলমল করে উঠলো, কৌটের মুখটা খুলে এক চিলতে সিঁদুর তুলে অনামিকার সিঁথিতে দিতে গেলেই অনামিকা ওর হাতটা ধরে…প্রান্তিক করুন মুখে তাকায় অনামিকার দিকে…
— “এভাবে না, অগ্নিকে সাক্ষী রেখে,মন্ত্রচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সাত পাক ঘুরে আপনার হাতে সিঁদুর পড়বো আমি…”

মুহূর্তেই প্রান্তিকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো, খুব শখ হয়েছিলো এই মুহূর্তে অনামিকাকে বউ সাজে দেখার..অনামিকা প্রান্তিকের হাতের ওপর হাত রাখে…
— “এই চার দেওয়ালের মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করুন, আইনি ভাবে বিয়ে হলেও বাঙালিরা সামাজিক বিয়েকেই বেশি প্রাধান্য দেয়…বিয়ে না করে আপনার সঙ্গে আমি থাকতে পারবোনা ”

— “এতদিন তো ছিলে??”

— “এতদিন তো জানতাম আপনি খুব খারাপ একটা লোক,যার মেয়েদের নেশা আছে,বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে…”

— “তাহলে আমার বউয়ের কি ভুল ধারণা ভেঙেছে??”

অনামিকা নিজের হাতে পরিমাপ করে বলে…
— “কিছুটা..”

প্রান্তিক বিরক্ত হয়…
— “এই বাকিটা কি করলে ভাঙবে??”

— “আমাকে আপনার ওই গোপন রুমে নিয়ে গেলে, আমি দেখতে চাই ওখানে কি আছে…”

— “ভূত আছে,দেখবে?”

অনামিকা বিরক্ত হয়ে চিরুনিটা দিয়ে প্রান্তিকের বুকে আঘাত হানলো…
— “শুধু বাজে কথা,যান তো গিয়ে স্নান টা করে আসুন…আপনার অর্ডার দেওয়া খাবার কখন আসবে?”

প্রান্তিক নিজের হাতের ঘড়িতে দেখলো…
— “টেন ফিফটিনস মিনিটের মধ্যে চলে আসবে..”

— “ততক্ষণে স্নান টা করে আসুন”

প্রান্তিক হটাৎ অনামিকার কোমর জড়িয়ে ধরলো..
— “আমার জল বাঁচানোর আইডিয়াটা তো তোমার পছন্দ হলোনা,এই বউ দেওয়ালে কি দেখো..”

অনামিকা প্রান্তিকের হাত অনুস্মরণ করে ওদিকে তাকাতেই নিজের গালে প্রান্তিকের ঠোঁটের পরশ অনুভব করলো অনামিকা,চমকে এদিকে তাকাতেই সামনে প্রান্তিককে দেখতে পেলনা, গালে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো একটু আগে ঠিক কি ঘটেছে…
— “বউ”

প্রান্তিকের গলা শুনে তাকাতেই প্রান্তিককে ওয়াশরুমের দরজা দিয়ে উঁকি মারতে দেখতে পেলো…প্রান্তিক তৎক্ষণাৎ একটা চোখ মারলো…
— “এটা কিন্তু সুগার ফ্রি ছিলো, রাতে সুগার ফ্রি থাকবেনা…”

অনামিকা বিছানা থেকে প্রান্তিকের তোয়ালেটা নিয়ে ছুঁড়ে মারলো প্রান্তিকের ওপর,প্রান্তিক ক্যাচ ধরে মুখ থেকে সরালো…
— “এই বউ তোমার কি ছুঁড়ে মারা লগ্নে জন্ম হয়েছিলো নাকি বলোতো, যখন দেখছি তখনই কিছু না কিছু ছুঁড়েই মারছো,একবার বালিশ, একবার চিরুনি এখন আবার টাওয়েল…”

— “হুম ,এবার ঝাড়ুও ছুঁড়ে মারবো…”

— “এইতো এবার বাঙালি বাড়ির বউ বউ মনে হচ্ছে, এতক্ষন এটাই মিসিং লাগছিলো…বাঙালি বউ হাতে ঝাড়ু না তুললে মানায়!!”

— “এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই…”

অনামিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তিক ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়…অনামিকা হো হো করে হেসে ওঠে…
— “এই লোকটা সত্যিই আমার বর? প্রথম দিনের সেই রাগী,আমাকে আঘাত দেওয়া মানুষটাই ইনি, অথচ আজ কত পরিবর্তন…সে বউ ছাড়া কিছু বোঝেনা…আজ সারাদিনে কতবার বউ বলে ডেকেছে কাউন্ট করে রাখলে ভালো হতো…থ্যাঙ্ক ইউ গড,ওই কাপুরুষটার হাত থেকে বাঁচিয়ে প্রান্তিকের মত একজন জীবনসঙ্গীকে দেওয়ার জন্য…”

….
আজ অনেকদিন পর বিরিয়ানি খাচ্ছে অনামিকা, সেই কলকাতায় প্রান্তিকের বাড়িতে প্রথম দিন খেয়েছিলো, আর তারপর আবার আজকে…একটা শসার টুকরো নিয়ে মুখে ভরতে গেলে প্রান্তিক অনামিকার হাতটা ধরে…
— “শসায় অ্যালার্জি তোমার, ওটা সাইডে রাখো…”

অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রান্তিকের দিকে..
— “আপনি কি করে জানলেন আমার শসায় অ্যালার্জি?”

— “প্রীতমের কিসে অ্যালার্জি অনামিকা??”

— “চিংড়ি মা… এই আবার আপনি প্রীতমের প্রসঙ্গ টানছেন কেনো??”

— “তুমি যেমন প্রীতমের সব খবর রাখতে আমিও ঠিক তেমনই তোমার সব খবর রেখেছি…”

অনামিকার আফসোস হলো, এবং নিজের প্রতি করুণাও হলো এটা ভেবে যে তিনটে বছর সে ভুল মানুষের পিছনের নষ্ট করেছে…
— “আপনি আগে কেনো এলেননা আমার জীবনে?আগে কেনো বললেননা ভালোবাসার কথা?”

প্রান্তিক অনামিকার কথা শুনে মৃদু হাসে..
— “আমার বউটা যে তখন খুবই ছোটো ছিলো, ক্লাস নাইনে স্টুডেন্টকে কিভাবে আমি জানাতাম ভালোবাসার কথা?”

— “আপনি ভুল করেছেন প্রান্তিক, আপনি যদি আমার জীবনে থাকতেন তাহলে প্রীতমকে ভালোবেসে জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা আমি করতামনা…”

প্রান্তিক অনামিকার কাঁধে হাত রাখলো,
— “এখন তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো, প্রীতমকে ভোলা তোমার জন্য কঠিন হলেও ওকে তোমায় ভুলতেই হবে অনামিকা, তোমার ভবিষ্যৎ জুড়ে শুধুই যেনো আমার অস্তিত্ব থাকে, এমনভাবে নিজেকে গুছিয়ে নাও…”

— “আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেননা তো?”

— “আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, তোমার অতীত তো পাল্টাতে পারবোনা কিন্তু তোমার বর্তমানটাকে এমনভাবে সাজিয়ে দেবো যে ওই বিষাক্ত অতীতটা তোমার জীবন থেকে মুছে যাবে…”

ফোনটা জোড়ে শব্দ করে বেজে উঠলো প্রান্তিকের, প্রান্তিক একঝলক অনামিকার দিকে তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো…
— “হ্যালো..”

“__________________”

— “আমি আসছি.”

প্রান্তিক ফোনটা রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠলো…অনামিকা অবাক হলো..
— “খাবারটা শেষ করে যান..”

— “সময় নেই,জরুরি কাজ এসে পড়েছে…আমাকে যেতে হবে..”

অনামিকাও চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রান্তিকের সামনে দাঁড়ালো…
— “কখন আসবেন??”

— “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করবো বউ, জানোই তো তোমাকে বাড়িতে একা রেখে আমি বাইরে মন বসাতে পারিনা..”

— “একটা অনুরোধ করবো??”

— “বলো..”

— “একা একা আমার খুব বোরিং লাগে, আমার ফোনটা আমাকে দেবেন?”

প্রান্তিক অনামিকার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো…
“মেয়েটা কি সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে? ফোন দেওয়াটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?”– মনে মনে ভাবে প্রান্তিক…

অনামিকা করুন চোখে তাকালো প্রান্তিকের দিকে…
— “প্রান্তিক?”

— “আচ্ছা দেবো”

প্রান্তিক কিচেনে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে গেলো…অনামিকা আবার বসে খাওয়া শুরু করলো…মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রেডী হয়ে ফিরে এলো প্রান্তিক…অনামিকার হাতে ওর ফোনটা দেয়…
— “আমার বিশ্বাসের মান রেখো, আবারও বলছি আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই, নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনোনা…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here