প্রেমস্পন্দন #তানিয়া_মাহি(নীরু) #পর্বসংখ্যা_১০( অন্তিমপর্বের শেষাংশ)

0
355

#প্রেমস্পন্দন
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_১০( অন্তিমপর্বের শেষাংশ)

নুহাশ বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই নতুন বউয়ের পাশে নওশীনকে দেখে সেখানেই থেমে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। এখনই যেন চোখদুটো(শ্বেতমন্ডল) কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।

নওশীন ডানপাশে তাকাতেই নুহাশকে দেখতে পায়। বুকের ব্যথাটা যেন প্রকপ আকার ধারণ করে। বুকের ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে নুহাশকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,” আরে নতুন বর যে! অভিনন্দন অভিনেতা।”

নওশীনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় নতুন বউ ঐশি নওশীন তখনও নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নুহাশ ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। আশেপাশে থাকা সব পিচ্চিপাচ্চাকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিল।

সেখানে থাকা পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে দুটোকে বলে ঐশিকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে কিন্তু ঐশিকে বিষয়টাকে নাকচ করে দেয়। জানায় সে এখান থেকে যাবে না। কী হচ্ছে এখানে সেটা তার জানা দরকার।
মেয়ে দুটো এবার নুহাশের ইশারা পেয়ে চলে যায়।

ঐশি এক পর্যায়ে নুহাশকে বলে ওঠে,” আপুটা তোমাকে অভিনেতা কেন বলল? আর এখন উনার সাথে কথা বলতে আমাকে ভেতরে যেতে বলছ কেন? কী চলছে এখানে?”

নুহাশ ঐশির কাছে এসে বলে,” আরে কিচ্ছু হয়নি। ও আমার পরিচিত হয়। ”

নওশীন দাঁড়িয়ে চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল। এমন সময় ফোনে মেসেজের শব্দ আসতে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নেয়৷ আদনান মেসেজ করে জানিয়েছে সে সামনের টেবিলেই আছে। প্রয়োজন হলে যেন কল করে। নওশীন সাথে সাথে রিপ্লাই করে তার ওখানেই মিনিট দুয়েকের মধ্যে আসতে বলে।

ঐশি নওশীনকে জিজ্ঞেস করে,” আপু আপনি কে বলুন তো?”

নওশীন মুচকি হেসে বলে,” আপনার কী মনে হয়?”

নুহাশ দুজনকে থামিয়ে বলে,” আরে কী শুরু করলে তোমরা দুজন?

নওশীন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,” আমি কি কিছু বলেছি নুহাশ? এই যে তুমি আমার সাথে চার পাঁচমাস সম্পর্কে ছিলে, গতকালও দেখা করেছিলে, আমাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলে এসব কিছু কি আমি বলেছি কাউকে? নো, নেভার। আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি নুহাশ।”

ঐশি নওশীনের কথা শুনে চোখ বড় করে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদিক থেকে নুহাশও রাগী চোখে নওশীনের দিকে তাকিয়ে আছে। নওশীন দুজনের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।

দুজনের অবস্থা দেখে নওশীন বলে, ” কী হলো তাকিয়ে আছো কেন? ”

হেসে আবার ঐশিকে বলে,” আর এই যে ভাবি, ছেলেরা কিন্তু বিয়ের আগে কিংবা বিয়ের পরে ভালো ছেলে থাকে না ভালো বানিয়ে নিতে হয়। আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন তাই না। দেখি বুদ্ধিমতী মেয়ে মনে হচ্ছে আমার কথা হয়তো বুঝতে পেরেছেন। ”

আদনান এসে তিনজনের পাশে দাঁড়ায়। সে তখনও মাস্ক সানগ্লাস পরে আছে। নওশীন নুহাশ এবং ঐশীকে উদ্দেশ্য করে আদনানকে দেখিয়ে বলে, ” পরিচয় করিয়ে দেই, উনি আমার হবু বর উনি পেশায় একজন ইউএনও। ”

নুহাশের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” খুব একটা ঠকাতে পারলে না, তোমার চেয়ে শতগুণে একজন ভালো মানুষ পেতে চলেছি আমি। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া উনি তোমার মত ছেলেকে আমার কপালে লিখে রাখেননি। ”

তারা সবাই বিয়ে বাড়ির মানুষদের থেকে একটু দূরে থাকায় কেউ বুঝে উঠতে পারেনি এখানে কী হচ্ছে।

নুহাশের অবস্থা দেখে নওশীনের যেন এবার শান্তি শান্তি লাগছে। সে নিজেই মনে মনে বলতে থাকে – নুহাশ, মেয়েদের তুমি এখনো চিনে উঠতে পারোনি। মেয়েরা যেমন ভালোবাসতে পারে সেরকম ঘৃণাও করতে পারে। মেয়েদের ঘৃণা এতটা তীব্র হয় যে তোমার মত পুরুষরা সেই ঘৃণায় ভ*ষ্ম হয়ে যাবে। আমাকে না ভালবাসলে আমাকে বলেই দিতে পারতে আমি চলে যেতাম। একটাবারের জন্য তোমার দিকে ফিরে তাকাতাম না। এই যে আমি আজ তোমার পাশে অন্য একটা মেয়েকে দেখছি আমার একটুও খারাপ লাগছে না, কষ্ট হচ্ছে না। ওই যে কথায় বলে না, মন থেকে একবার উঠে গেলে কারও পাশে শুয়ে থাকলে যাবে আসবে না সেরকম হয়েছে আমার। আমি এখন খুশি তোমার মতো ছেলেকে আর আমাকে ভালোবাসতে হবে না। তুমিও এখন একটু বোঝো মনের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলে ঠিক কেমন লাগে!

নওশীন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আদনানকে বলে,” চলুন, আমার এখানকার কাজ শেষ। ”
” হুম চলো।”

নওশীন আর আদনান চলে যেতে থাকে। নওশীনের হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই পিছনে ঘুরে তাকায়৷ ঐশি এক পলকে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নুহাশ বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

নওশীন এগিয়ে গিয়ে ঐশিকে উদ্দেশ্য করে বলে,” শুনুন আপু, আমি খুব একটা ভালো মানুষ নই। আমি খুব স্বার্থপর৷ কেউ আমাকে কান্না করাবে আর আমি তার চোখে পানি আনব না এতটা ভালো মানুষ আমি নই। আপনি আপনার বরকে সাবধানে রাখিয়েন। প্লে বয় পড়েছে আপনার ভাগ্যে। নজরে রাখবেন, তার আবার অন্যকোথাও মুখ দেওয়ার অভ্যাস আছে।”

নওশীন আদনানকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। একটাবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকায়নি। সে বুঝতে পারছে আজ সে ভীষণ সেলফিশ হয়ে গিয়েছে তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এটা ভেবে যে মাঝেমধ্যে নিজের মনকে ভালো রাখতে এরকম অন্যজনের মুখোশ খুলে দিতে হয়।

আদনান আর নওশীন গাড়িতে এসে বসে। আদনান খেয়াল করে নওশীনকে নিশ্চিন্ত লাগছে।

আদনান নওশীনকে জিজ্ঞেস করে,” এখন কি ভালো লাগছে? আমার নিজেকে দর্শক মনে হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি এমন একটা দিনে ওসব বলে অন্যা*য় করছ তবে কেন জানি না আটকাতে ইচ্ছে করল না।”

” আমার এখন শান্তি লাগছে। ওরা রিলেশন করে বিয়ে করেছে, সংসার ভাঙবে না কিন্তু মেয়েটা ওকে হাতের পুতুল করে রাখবে। উঠতে বললে উঠতে হবে আর বসতে বললে বসতে হবে। ”

কথাগুলো বলেই সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে নওশীন।

আদনান গাড়ি চালানো শুরু করে। নওশীন সারাটা রাস্তা চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। আদনান গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে নওশীনকে দেখতে থাকে।

এক পর্যায়ে আদনান বলে,” বাড়ি পৌঁছে দেব নাকি কোথাও যাবে ঘুরতে?”

নওশীন চোখ বন্ধ করে বলে,” বাড়ি ছাড়া অন্য যেকোন জায়াগায় নিয়ে যান। আমি একটু শান্তিতে শ্বাস ফেলতে চাই।”

আদনান হাসিমুখে গাড়ি চালাতে থাকে। সামনের দিকে মনোযোগ দিয়েই বলে,” আমাকে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?”
” কীসের জন্য?”
” আমার পাশে বসা মেয়েটার জন্য।”
” অনন্তকাল।”
” কেন?”
” এত সহজে আর কাউকে মন দিতে পারছি না আমি। আমাকে আবার কেউ ছেড়ে গেলে আমি আর নিজেকে সামলে নিতে পারব না।”
” ছেড়ে না যাওয়ার কাজ করি?”
” কী?”
” বিয়ে।”

নওশীন আদনানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, ” আমার সময় লাগবে। আমি এত তাড়াতাড়ি কোনকিছুতে সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।”
” কত সময় লাগবে?”
” আমি কলেজ লাইফটা শেষ করতে চাই।”
” তারপর আপনাকে আর হারাতে হবে না তো?”

আদনানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নওশীন উলটো প্রশ্ন করে,” ভালোবাসেন?”
” যদি বলি ‘ হ্যাঁ ‘?”
” তাহলে বলব ভালোবাসাটা জিইয়ে রাখুন। প্রেমস্পন্দনের দায়িত্ব আমি নিলাম।”
” প্রেমস্পন্দন! সেটা কী?”
” যে প্রেমে হৃদস্পন্দন বাড়ে প্রেমের ভাষায় আমি তাকে প্রেমস্পন্দন বলি। শুধু এটা ভাববেন না যে আমি এক জায়গায় ঠকেছি জন্য আপনাকে হ্যাঁ বলেছি। আমি বড্ড স্বার্থপর, আমি ভালোবাসায় ভালো থাকতে চাই৷ ”

আদনান মুচকি হেসে বলে,” আমি অবুঝ নই নিশু।”
আদনানের মুখে নিশু ডাক শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আদনান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,” নিশু বলতে নিষেধ করেছিলে, স্যরি।”

নওশীন নিচুগলায় বলে,” নিশু বলে ডাকার দায়িত্ব দিলাম, হেরফের হলে কঠিন শা*স্তি ভোগ করতে হবে বলে দিলাম।”
” কী শা*স্তি?”
” বিয়ের পর রাতে রুমে নিব না।”

উচ্চস্বরে হেসে ওঠে আদনান। আদনানের হাসি দেখে নওশীনও মুচকি হাসে। আদনান সেটা খেয়াল করে বকে ওঠে,” এই হাসি হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। ”

নওশীন হেসে বলে,” প্রেমস্পন্দন! ”

আদনান নওশীনের দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।

নওশীন নড়েচড়ে বসে। বলে ওঠে,” আপনার গাড়িতে গান চলছে না কেন?”
” দেওয়া হয়নি তাই।”
” গান চালান জলদি।”
” কোন গান বলো তুমি?”
” এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো….”
” তোমার গান গাওয়া মন্দ হচ্ছিল না কিন্তু।” বলেই গান জুড়ে দেয় আদনান। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে ফেলে।

নওশীনও গানের সাথে তাল মিলিয়ে গেয়ে ওঠে,” এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!

~ সমাপ্ত🌼

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here