“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
পারভীনের সামনেই নাশতা করতে বসেছে শ্রাবণ। থমথমে মুখের দিকে একবারের বেশি তাকায়নি সে। শুরুতেই এসে তাকিয়ে সালাম দিয়েছিলো। গোমড়ামুখে বিড়বিড়িয়ে প্রত্যুত্তর করেছে পারভীন। অথচ ইনি যে বড্ড ভালো মনের মানুষ, তা বেশ ভালো অনুধাবন করে নিয়েছে শ্রাবণ। গত রাতে তার পাশে বসে থেকে কতো খেয়াল রাখলো। মাঝরাতে একবার, ভোর রাতে একবার কপাল ছুঁয়ে জ্বর মেপে গেছে। মায়ের মমতা এই মায়ের মধ্যে আছে বলেই তো ছুঁয়েছেন তাকে। পরীও অবগত করলো, ফ্যালফ্যাল চোখে নাকি তকিয়ে ছিলো তার দিকে। আহা! বড় পুত্রবধূর মায়া শ্বাশুড়ির চোখে না লাগালে চলে? রাগটা ওই যা ছেলের কর্মকাণ্ডের উপরই। শ্রাবণের খাওয়া শেষ পর্যায়ে এলেই মুখে কথা ফুটেছে পারভীনের।
“বাড়ি কই তোমার?”
“আমার বাড়ি নেই।”
“তইলে কি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বড় হইছো?”
একটু ঠমকে উঠে পারভীনের গলা। পরী তাই দরজার পাশে থেকে মুখ ভেঙায় পারভীনের প্রতি। শ্রাবণ ঠোঁটের ধারে হাসি এলিয়ে চোখ তুলে তাকায়।
“আমি নানির কাছে বড় হয়েছিলাম শহরে। এরপর নানি মারা যাওয়ার পর মামাবাড়ি ছেড়ে নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে শিখেছি।”
“মা বাপ কেউই নাই?”
মাথা নত করে হালকা দোলায় সে।
“ওই বাড়িতে আইছো ক্যা? তারা কি লাগে?”
“লাগে না তেমন কিছুই। গ্রামে এসেছি কোনো চাকরির সন্ধানে। মজিদা খালাম্মার কাছে ভাড়া থাকতে চেয়েছিলাম। খালাম্মা বলে ডাকতাম।”
“উনার কি ঘর আছে, তোমারে ভাড়া দিতো?”
“যে ঘরে তিনি থাকেন, সেই ঘরেই আমি থেকেছি।”
“শহর ছাইড়া গ্রামে আইছো। এই গ্রামে কি আর তেমন চাকরি পাইবা? দেখতে তো শিক্ষিতই মনে হয়। কাজটা তো করলা মূর্খের মতো। তোমার তো কিছু গেলো না। সম্মান নিয়া কানাকানি চলতাছে চেয়ারম্যানবাড়ির।”
প্রত্যুত্তর করে না শ্রাবণ। পরীর যেন খুব মনে লাগছে পছন্দের ভাবিটাকে এভাবে বলায়। তাই প্রত্যুত্তর করে বসে সে।
“হইছে, আম্মা। থামেন। ভাবিরে খালি একলা দোষী কইরেন না। ভাইজান না আনলে কি উনি আইতো?”
“তুই চুপ থাক!”
“হো, চুপই তো থাকমু। আপনাগো ভালা কইলেই খালি ভালা।”
বিড়বিড়িয়ে শ্রাবণের প্লেট নিতে আসে।
“আপনের ধুইতে হইবো না, ভাবি। দেন আমার কাছে। আপনে হাত ধুইয়া উঠেন।”
“যেদিন হতে প্লেট ধুতে শিখেছি, কোনো অনুষ্ঠান ব্যাতিত নিজের প্লেট কখনোই অন্যকে ধুতে দেইনি। এখনো দিবো না, পরী।”
নিজের প্লেট হাতে নিয়ে উঠে যায় শ্রাবণ। পরীর যেন মন ছুঁয়ে গেলো ভাবির বাক্য। মনে মনে স্বগতোক্তি করে,
“কত ভালা মানুষ! ওইযে আইতাছে আরেক চেয়ারম্যান কন্যা। পারলে তো হাতটা পর্যন্ত ধোয়াইয়া মুখটা পর্যন্ত মোছায় নেয় অন্যের মাধ্যমে!”
পরক্ষণে পারভীনের দিকে তাকিয়ে দেখে পারভীনও শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুশি হয়ে যায় পরীর। মন বলে,
“সৌভাগ্য মনে কইরা মাইন্না লন, আম্মা। এমন বউ পাওয়া সৌভাগ্য।”
এলো চুলে অর্পা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
“আম্মু, আমার চিরুনি কই? স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
“আমি কি জানি তোর চিরুনির খবর!”
পাশ হতে শ্রাবণ বলে দেয়,
“একটা চিরুনি আমি মাথা আঁচড়ে রেখেছিলাম ড্রয়ারে।”
“খালি ভেজাল! সব কিছুতে ভাগ বসায় নিচ্ছে!”
চোখেমুখে বিরক্তি জাগিয়ে অনুচ্চ উক্তি করে চলে যায় অর্পা। পারভীন পিছু বলে,
“ভাত খাবি না?”
“সময় নেই। নিয়ে আসো আসলে।”
শ্রাবণের একটু খারাপ লাগে অর্পার অনুচ্চ উক্তি। মেয়েটা অহংকারী বটে। পারভীন প্লেটে ভাত নিয়ে যায় মেয়েকে খায়িয়ে দিতে। শ্রাবণ বেরিয়েছে পরীর সাথে। নির্ভেজাল বারান্দার পরিবেশটা দারুণ লাগলো শ্রাবণের কাছে। গ্রিল জুড়ে কিছু অপরিজিতার লতা বেয়ে উঠলেই প্রাণবন্ত লাগতো। বারান্দার বেষ্টনী ছেড়ে উঠুনে নামতেই গোলাপ গাছে তাকায়। অসংখ্য ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সেদিনের গোলাপ এই রঙেরই ছিলো। হয়তোবা এই গাছেরই। শ্রাবণ আধফোটা গোলাপে হাত দিতেই পরী বিস্ময়জনক গলায় বলে,
“ছিঁড়েন না কিন্তু ভুলেও। আপায় যেই! আপনার চুলও ছেঁড়া যাইতে পারে।”
যদিও শ্রাবণের ফুল ছেঁড়ার উদ্দেশ্য ছিলো না। একটু স্পর্শই করতো মাত্র। পরীর বিস্ময়কর সাবধানতাজনিত বাক্যের কারণে ঈষৎ হেসে ছিঁড়েই ফেলে। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ টানে নিশ্বাসে। চলতে চলতে বলে,
“তাই? দেখি, আমার চুল স্পর্শ করতে পারে কি না কেউ।”
“আপনের তো মেলা সাহস!”
“একা চলতে গেলে দুর্বল হলে তো চলে না, পরী।”
“নতুন বউদের আবার এতো সাহস ভালাও না।”
“একটা ফুলই তো ছিঁড়েছি। এ-ই দোষ ধরা শুরু করলে?”
“দোষ আর কি? আপনে তো আপারে জানেন না। তাই জানাইতাছি।”
‘তোমার আপা একটা অহংকারী মেয়ে৷ ঠিক বললাম, না ভুল?”
“শতভাগ।”
“তোমার আম্মা, কড়া মানুষ। আদর করলেও হয়তো রেগেই করেন। ঠিক?”
“এক্কেবারে।”
“তোমার বড় ভাইজানের মনটা স্বচ্ছ, মাথাটা গরম। কাজকর্ম করে ধীরেসুস্থে এবং অলসতার মাঝেও।”
“একদম।”
“তোমার ছোট ভাইজান দুষ্টু, হাসিখুশি স্বভাবের। আবার উত্তেজিত হতেও সময় নেয় না। আর আমার শ্বশুর আব্বাকে কি ডাকো?”
“কাকা।”
“তোমার কাকা গম্ভীর ও পোক্ত মানুষ। অপ্রকাশ্যে ভেবে হয়তো কাজ করেন বেশি।”
“আপনি তো সবই জানেন তাইলে। ভাইজান আগেই জানাইছে সব?”
“তোমার ভাইজান কিছুই জানায়নি। ওই নিজেকেই যতটুকু প্রকাশ করার, করেছে। বাকিদের ভাবভঙ্গি দেখে আমার ধারণা আরকি। আরও কেউ বাকি আছে পরিবারে?”
“ওইযে, ওইযে। খালিদ ভাইটা। ওইটারে নিয়াও কিছু কইতে পারেন। আঠার মতোই এই পরিবারে লাইজ্ঞা থাকে।”
“কি কারণে লাগে, তা তো জানি না। তবে উনাকে দেখে মনে হলো উনি তদন্তকারক। কে কোথায় কি করলো, ওইদিকে ওনার লক্ষ্য বেশি থাকে। উম্ম… মূলত দোষ খুঁজে বেড়ায় বেশি।”
“হো। এক্কেরে এমনই। আর খালি কাকার কানে কানে খোঁচায়। ওই কাকার আগে পিছে ঘুরে ঘুরে বেতন বোনাস পায়, এইডাই লাইজ্ঞা থাকার উদ্দেশ্য। যেকোনোভাবে কাকার কাছে তার ভালা সাজন চাই!”
মৃদু হেসে শ্রাবণ পশ্চিমে এগোতে থাকে ধীর পায়ে। পরী বলে উঠে,
“আরও একজন আছে তো। তার সম্পর্কেও কিছু বলেন।”
“কে?”
“ওইযে, আমাগো বকুল কাকা।”
পরীর নির্দেশিত দিকে গোয়ালে তাকিয়ে দেখতে পায় একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। বড় বাজানের বউ দেখছিলো আড়ালে থেকে। পরী বলতেই সে দেখা বাদ দিয়ে ঝটপট কাজে লেগে পড়লো যেন। শ্রাবণ মৃদু হাসলো। গোয়ালের সামনের দিকে মোটামুটিরকম একটা জায়গা ফাঁকা বিস্তর মাঠে নামার জন্য। এপাশেও লোহার গেইট। গোয়ালের মুখোমুখি বিপরীত পাশে পাড় বাঁধাই করা পুকুর। পানি স্বচ্ছ হলেও নিচে শ্যাওলা জমায় সবুজাভ দেখাচ্ছে দূর হতে। বাড়ির বাউন্ডারি পুকুর পর্যন্ত ঘিরে রাখা। সারি সারি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে পাড়ের ছায়া হয়ে। স্যাঁতসেঁতে আবাদি মাঠে না নেমে পুকুরের পাশটা ঘেঁষেই দাঁড়ায় শ্রাবণ। পরীকে তখনকার জিজ্ঞাসায় এখন বলে,
“বকুল কাকা বোধহয় লাজুক স্বভাবের।”
“আরে না। আস্ত কাইজ্জাখোর।”
“এই পুকুরে মাছ আছে?”
“আছিলো। শখে চাষ করছিলো বিপু ভাইজান। গতবার খাড়া ঢলকে পুকুর ভইরা সব মাছ গেছে ক্ষেতে নাইম্মা। পাড়ার লোকে চিলের লাহান পড়ছে আইয়া।”
“বৃষ্টির বহু তেজ।”
“হো। দেখেন না, ভরো ভরো হইয়া রইছে এহনই। আরে! আপনে তো ওষুধ খান নাই, ভাবি। তাত্তাড়ি যান।”
হাতে গোলাপটা দোলাতে দোলাতেই পরীর সাথে ঘরে উঠতে যায় শ্রাবণ। ব্যাগ কাঁধে মাত্রই বের হচ্ছে অর্পা। গোলাপ দেখেই রাগ হয় তার। থমথমে চোখে তাকায় শ্রাবণের মুখে। মুখোমুখি হওয়ায় শ্রাবণ মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“স্কুলে যাচ্ছো?”
জিজ্ঞাসার জবাব আর কি দিবে। রাগে হনহনিয়ে যেতে থাকে গেইটের দিকে। পারভীন পরীকে পাঠায় রিকশায় তুলে দিয়ে আসতে। শ্রাবণ একা একাই ঘরে আসে। ওষুধ হাতে নিয়ে দেখে সেবন করে। প্রতিবেশী এক দাদী এসেছে ইফতেখারের। চেয়ারম্যানের চাচী হয় সম্পর্কে। পারভীনকে বাইরে থেকে বারান্দায় দেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কি গো বউ, তোর পোলায় নাকি বিয়া করছে? দাওয়াতও যেনে করলি না।”
“দাওয়াত দেওয়ার কপাল থাকলে তো দিমু।”
“কামডা করলো কি বুইড়ায়!”
পরীর সাথে তুরতুরিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হোন তিনি।
“কই, নাতবউ? কই লুকাইছে?”
পারভীন বলে না কিছুই। পরীই আহ্লাদে টেনে নিয়ে যায় দাদীকে দেখাতে। শ্রাবণকে ওষুধ খেতে দেখে বলে,
“এই বয়সেই ওষুধ খাওয়া ধরছোস গো বুড়ি? বাকি দিন ক্যামনে যাইবো? রোগা বউ আনলো নি নাতি!”
কথার প্রতুত্তর না করে অপরিচিতকে সালাম দেয় শ্রাবণ। দাদী সালামের জবাব দিতেই কথার প্রত্যুত্তর করে পরী।
“বেশি কথা কইয়ো না, দাদী। তুমি যেনে এক্কেরে ওষুধ ছাড়া থাকো!”
”আমি তো বুড়া। নানান রোগে ধরে বুড়াগো। ওষুধ থাকবো বুড়া মাইনষের লাইগা। যোয়ানের এই দশা ক্যা?”
“এহ! যেনে যোয়ানে এক্কেরে বীরকন্যা ছিলা! ভাবির জ্বর হইছে। তাই ওষুধ লাগছে। তোমার লাহান উঠতে বইতে ওষুধ লাগে না।”
“নাতবউয়ের বাড়ি কই?”
“জ্বি, ঢাকায়।”
“ওমাগো! শহরতে ধইরা লইয়া আইছে? সাত্তারগো বাড়িত্তে না আইছে হুনছি? তাগো আবার শহরে আত্মীয় কইত্তে আইলো!”
পরী ঠমকে উঠে,
“ওই, এত্তো কথা তোমার জানা লাগতো না। শহরে হোক আর গ্রামে। নাতবউ পছন্দ হইছে কি না, হেইডা কও।”
“তুই এমন ঠমকাছ ক্যা?”
“তোমার সঙ্গে আমার জন্মান্তরের শত্রুতা যে।”
“খাড়া! তোরে বিদায় করতাছি নাগর ধইরা।”
“নাগরের লগে বাইন্ধা তোমারেই দিয়া দিমু, শালী!”
বুড়ি হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দেয় পরীর পিঠে। সরে যায় পরী। শ্রাবণ মৃদু হাসে। বুড়ি শ্রাবণকে দেখে আবার বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পারভীনকে বলে,
“নাতি তো এক্কেরে চান্দের পরী আনছে গো, বউ।”
পাশ থেকে এখানেও পরীর আপত্তি!
“ওই বুড়ি, পরী তো আমি।”
“এই যাহ! তুই ওদিগ যাহ! কতা কইয়ে শান্তি নাই এইডার লাগি!”
পরী চলে আসে শ্রাবণের কাছে। পারভীনের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় দাদী। ওদিকে একটু পরেই পরীকে দিয়ে শ্রাবণকে ডাকায় আফজাল হোসেন। শ্রাবণ তার ঘরের দরজার সামনে এসে সালাম দেয়। আফজাল হোসেন তাকে সোফায় বসতে বলে। ছড়ানো পা গুটিয়ে খাটে বসে আছেন তিনি। দৃষ্টি নত রেখে বসে থাকে শ্রাবণ সামনে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পরীও। আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করে,
“জ্বর কমছে?”
“জ্বি।”
“বাড়ি কই?”
“আমার বাড়ি নেই। জন্মস্থান ঢাকায়। নানা ভাড়া থাকতো সেখানে। নানীর কাছেই বড় হয়েছি।”
“আব্বা আম্মা নেই?”
মাথা দুদিকে নাড়ে শ্রাবণ।
“ঢাকার কোন জায়গায় বড় হইছো?”
“কোনাপাড়া।”
“বাপের জেলা?”
“বাবাও ঢাকাতেই থাকতো।”
“সাত্তারের বাড়ি কি?”
“আমার সাথে উনাদের কোনো পরিচয় নেই। মজিদা খালাম্মার কাছে আশ্রয় পেয়েছি গ্রামে কাজের সন্ধানে এসে।”
“এতোদিন ক্যামনে চলতা?”
“একটা এনজিও তে চাকরি করতাম। এখন আরেকটু ভালো অবস্থায় যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
“আমি আমার পোলার কাছে এমনটা কোনোদিন আশা করি নাই। মানসম্মান নিয়া টানাটানির ব্যাপার। বউ যখন হইয়া আইছোই, চাকরি বাকরির জন্য আর দৌড়াইয়ো না। আমার পোলাগোও আমি অন্যের গোলামী খাটতে দেওয়ার ইচ্ছা রাখি না। করলে ব্যাবসা করবো৷ নিজের জমিজমা দিয়া আয় কইরা চলবো। আর তুমি তো বাড়ির বউ পরিচয়েই থাকবা। চাকরি বাকরির দরকার নাই।”
“তবে কি আমারও ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া উচিত?”
দৃষ্টি তুলে চাঞ্চল্যকর জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয় শ্রাবণ। মুখের উপর পাল্টা জিজ্ঞাসা বোধহয় প্রত্যাশা করেননি আফজাল হোসেন। থমথমে মুখখানা গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুরের মতো স্থির করে রাখেন। শ্রাবণ পুনরায় দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। আফজাল হোসেন বলেন,
“কোনোটাই করবা না। সংসার দেখবা। এইডাই মেয়েলোকের কাজ। নিরাপদ কাজ। ঘরের ঘরনি হওয়া সম্মানের কাজ। পুরুষ থাকতে ঘরের বাইরে নারীর পরিশ্রম দিয়া অতিরিক্ত আয়ের কোনো দরকার পড়ে নাই।”
শ্রাবণ নিরব থাকে। তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয় আফজাল হোসেন। যাওয়ার সময় বলেও দেন,
“কারো কাছে পরিচয় বর্ননা দেওয়ার দরকার নাই। কেউ জিগাইলে বাড়ি ঢাকা কইয়া দিবা। এ-ই শেষ।”
শহুরে পুত্রবধূ পেয়ে যে শ্বশুরেরও মন গলা ভাব ব্যক্ত হয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়না উপস্থিত দুয়ের। শ্রাবণ উঠে চলে যায়। পরীর সাথে আবার এসে আশ্রিত হয় অর্পার ঘরে। পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“একমুঠ কালোজিরে এনে দিতে পারবে?”
“কালোজিরা দিয়া কি করবেন?”
“মুখটা তেতো হয়ে আছে। চিবাতাম।”
“তিতা মুখে তিতা চাবাইবেন?”
“তাইতো কালোজিরে দিয়ে এই তেতোকে ঢাকবো।”
পরী ছুটে যায় কালোজিরে নিয়ে আসতে। খাটে বসে পা ঝুলাতে থাকে শ্রাবণ। ভাবনা চেপে আছে মুখাবয়বে। পরী এসে তার হাতে কালোজিরে দিয়ে নিজের মুখেও এক চিমটি পুরে দেয়। শ্রাবণ দাতের চিপে কালোজিরে পিষতে পিষতে বলে,
“পরী, শ্বশুর আব্বার হাতের কনিষ্ঠা আঙুল বোধহয় অর্ধেক কাটা। নাহয় ছোট। আমি কি ভুল দেখলাম?”
“না। ঠিকই দেখছেন। কাইট্টা গেছে।”
“আল্লাহ! কিভাবে হলো এমন? কেউ কেটে দিয়েছে ঝগড়া করে?”
“আরে না। ভাবি যে কি কন! কাকায় যাইবো মারামারি করতো?”
“না, মানে উনি তো রাজনীতিতে জড়িত। পত্রিকায় তো কত হানাহানির ঘটনাতেই এমন দেখা যায়। এজন্য যেন মনে হচ্ছিলো এমন কিছু কি না।”
“নাহ। কাকায় তো মাত্র ছয় বছর ধইরা চেয়ারম্যান পদে হাক দিতে নামছে। এইডা বহু আগে কাইট্টা গেছে আপনাগো শহরের দিকে গিয়াই। রোড এক্সিডেন্ট নাকি হইছিলো একবার, কাকায় যখন ইয়াং বয়সের আছিলো৷ মাত্র নাকি নতুন বিয়া করছে তখন। পরিবারের মাইনষে তো ভাবছে, মইরাই বুঝি গেছে। আল্লাহ বাছাইয়া আনছে।”
“ওহ্! আঙুলটাই কাটা যাওয়ার ছিলো!”
দুঃখ প্রকাশ হলো শ্রাবণের গলায়। পরী জানায়,
“আঙুল খালি? কাকার পায়ে দেহি এত্তোবড় সিলি। পিঠে সিলি।”
“ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়েছে তবে!”
“হো।”
আরেকটু নিরব থেকে কালোজিরে চিবাতে থাকে শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“আমি তো কাপড়চোপড় কিছু আনিনি। গোসল করে পরবো কি!”
“হেইডা আমি ক্যামনে কই? ভাইজান বাড়ি থাকতে কইলেন না ব্যবস্থা কইরা যাইতো? আমার তো আর অতিরিক্ত কাপড়চোপড় নাই। আমারটা কি আর আপনে পরবেন? ওয়ারড্রব খুইল্লা দেখেন আপার কোনোটা লাগে কি না আপনের। এই বেডির এত্তো জামাকাপড়।”
“না, না। তোমার আপার সবকিছুতেই নাকি ভাগ বসিয়ে ফেলছি! তারটা আমার হবেও না। তুমি বরং তোমার আম্মার কাছ থেকেই একটা শাড়ি চেয়ে নিয়ো আমার জন্য।”
“ঠিক আছে। দেখমুনে। এট্টু জাম্মুরা খাইবেন? গাছে আছে। নিয়া আসি। শুকনা মরিচ টাইল্লা ভর্তা খাইলে ভাল্লাগবো নে জ্বরমুখে।”
“কত খেয়াল রাখো তুমি আমার। ধন্যবাদ দিতেও কম মনে হয়।”
“কি যে কন, ভাবি। আপনে বসেন৷ আমি ঝটপট নিয়া আইতাছি।”