“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে ঘুম হতে জেগেই দেখে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ঠান্ডা পেয়ে কড়া ঘুমে জমে গিয়েছিলো শ্রাবণ। অর্পাকে পড়ার জন্য ডাকতেই তার ঘুম ভেঙেছে। হাতমুখ ধুয়ে অবসর কাটাচ্ছে বারান্দায় পায়চারি করে। কুয়াশার মতো হালকা বৃষ্টি তাকে টানছে একটু সিক্ততায় মিশে যেতে। তবুও যাচ্ছে না দেহে এখনো অল্পস্বল্প জ্বর অবশিষ্ট থাকায়। আর কত আশপাশের মানুষগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলবে? তাই কুয়াশা অনুরূপ বৃষ্টিকে না ছুঁয়েই অনুভূতিতে উপলব্ধি করা। পাশের ঘরে হালকা চাপানো দরজায় তাকিয়ে ভেতরে মশারি টানানো দেখতে পাচ্ছে। কেউ ঘুমাচ্ছে। ইফতেখার, নাকি বিপুই কে জানে। গতকাল সকালে যে ইফতেখারকে দেখেছিলো, সারাদিন বাড়ি ফিরেনি। রাতেও ফিরেছে কি না দেখেনি। সে ঘুমানো পর্যন্ত ফিরেনি। দূরে কোথাও গেছে নাকি? মনকেই প্রশ্ন করে শ্রাবণ। পরী এসে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি, নাশতা করবেন না?”
“আম্মাকে জিজ্ঞেস করো তো, আমি কবে থেকে রান্নাবান্নায় হাত দিবো।”
“আপনের তুলতুলে হাত এখনই রান্নাবান্নায় লাগাইয়া খসখসে বানাইয়েন না। আম্মা যতদিন রান্না করতাছে, পরী যতদিন সঙ্গে সঙ্গে থাইক্কা সহযোগিতা করাতছে, ততদিন আপনে তুলতুলে থাকেন।”
“তাই, না?”
“হো। রান্নাবান্না শেষ। নাশতা দিমু কি না কন। ওষুধ খাইতে হইবো কিন্তু আপনের।”
“আমি একটু পরে খাবো। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।”
“ঘরে আদা চা সবসময় ডেক ভরা থাকে। আপনে আধা মিনিট খাড়ান। আমি এক মিনিটের মধ্যে আইতাছি।”
স্মিত হেসে পায়চারি করতে থাকে শ্রাবণ। পরী কিছুক্ষণের মধ্যেই চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয়।
“গরম করতে একটু দেরি হইছে, ভাবি।”
“ধন্যবাদ, এক মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে আসার জন্য।”
“আম্মার এই শাড়িটায় আপনারে কত্ত মানাইছে, আপনে কি তা জানেন ভাবি?”
“তুমি এইবার নিয়ে কতবার বললে এই কথা?”
“তা তো জানি না। কিন্তু যতই দেখি, অনেক ভাল্লাগে আপনারে দেখতে। খালি দেখতেই মন চায় চোখের সামনে বসায় রাইক্ষা।”
চুমুক দেওয়া মুখের চা ফিক করে হেসে ফেলে দেয় শ্রাবণ। হেসে নেয় একটু ইচ্ছেমতো।
“এই কথা তোমার ভাইজান বললে না ভালো হতো।”
“ভাইজানের টা ভাইজান কইবো নে। আমারটা আমি কইয়া সারলাম।”
“বেশ ভালো পাম দিতে জানো তুমি।”
“ধুরু ধুরু। সত্যি কথা কইছি। যাই, থালাবাটি গুলা মাজলেই আমার কাজকাম শেষ। আম্মায় আবার রাইজ্ঞা উঠবো নে। চা খাওয়া হইলে ডাক দিয়েন। কাপ নিয়া যামু নে।”
পরী রান্নাঘরে ফিরতেই পারভীন কতক্ষণ শাসালো। বড্ড পাকামো করে সে। তুলতুলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কথা শুনেছে বিধায়ই এই শাসানো। কে বলেছে তাকে আগ বাড়িয়ে মাতব্বরি করতে? শ্রাবণ এদিকে মনযোগ দেয় প্রকৃতির ঘ্রাণে। প্রাণ হারায় কিছু উচ্ছ্বাসে। শ্বশুর বাড়িতে নতুন নতুন সময়, মন্দ যাচ্ছে না তার। এরই মাঝে যুক্ত হয় ইফতেখারের ঘ্রাণ। মোটরসাইকেলে চড়ে খালিদকে পিছু বসিয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। শ্রাবণ তো ভেবেছিলো ঘুমাচ্ছেই বুঝি। ওদিকে খালিদ ও ইফতেখার দুজনেই বারান্দায় ঠাঁই নিতে নিতে দেখেছে তাকে। আবারও সেই সন্ধ্যার কথা মনে হয়ে যায় খালিদের৷ যতবারই মনে হয়, ততবারই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে যেন! বিপুকে নিয়ে খালিদের প্রথম সন্দেহ কান্তার উপর হয়েছিলো যদিও। ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে বিশেষ খেয়াল দিতেই শ্রাবণকে পড়ে যায় চোখে। আর দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে পারে তুলনামূলক বেশি রূপবতী এই শ্রাবণের সাথেই তার ভাব করে দিতে কান্তাকে ঝেকে ধরেছিলো বুঝি বিপু। মাঝপথে বড্ড বেঁকে গেলো পথ! ইফতি এটা কি করলো! তাকে নিয়ে এমন কিছু একদমই অকল্পনীয় ছিলো। এই অকল্পিত কাহিনীর হতবিহ্বলতা নিয়েই মামার ঘরে প্রবেশ করে সে অনুমতি নিয়ে। ইফতেখার দুহাতে মাথার চুলের উপরিভাগ ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে শ্রাবণের দিকে। বাইরের কুয়াশা তুল্য হালকা বৃষ্টি মাথায় বসেছে কুয়াশার মতো করেই। এইযে, হাতে চুলের উপরিভাগ ঝেরে ফেলা কি অপূর্ব লাগছিলো! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তা-ই উপভোগ করছিলো শ্রাবণ। ইফতেখারের দৃষ্টিদ্বয় উপভোগ করছে শাড়ি পরহিত নারী রূপকে। একদম অন্যরকম লাগছে শ্রাবণকে। কপালে হাতের পিঠ ঠেকিয়েই বললো,
“সুস্থ হয়েছো মনে হয়?”
অধরে স্মিত হাসি এলিয়ে শ্রাবণ কাপে দৃষ্টি রেখে চা টুকু কাপের মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে পাক তুলে বলে,
“পরীর কথায় মানহানি হয়েছে বুঝি?”
“ওর কথায় আবার কিসের মানহানি। আমার ইচ্ছে হয়েছে, ডেকেছি।”
চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁট কার্ণিশে হাসি রেখে চোখে চোখ তোলে শ্রাবণ। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“এটা মায়ের শাড়ি?”
“হুম। আপনাকে দেখানোর উদ্দেশ্যে শাড়িটা বাছাই করে পরা অথচ আপনার খোঁজ নেই। কোথায় থাকেন আপনি? মনে হচ্ছে কত বছর হয়, আপনাকে দেখি না।”
পকেট থেকে টাকা, ফোন, চাবি বের করতে করতে ইফতেখার জবাব দেয়,
“আমি তো সকালেও তোমাকে দেখে গেলাম। ঘুমাচ্ছিলে।”
“কিন্তু আমি তো রাতেও আপনাকে দেখলাম না৷”
“রাত এক’টায় ফিরেছি।”
“এতো রাতে কেন?”
“ঘুরতে গিয়েছিলাম ঘোড়াশাল। ফিরতে দেরি।”
“ইশ! কত আনন্দ যাচ্ছে আপনার। আজ কিন্তু শ্রাবণেরই দিন। অথচ শ্রাবণকে রেখেই আপনি শ্রাবণধারায় ভিজে এলেন।”
কথা বুঝতে একটু সময় লাগে ইফতেখারের। বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টির দিকে দেখে আবার তাকে দেখে। জিজ্ঞেস করে,
“আজ হতে শ্রাবণ মাস?”
“বাঙালি মানুষ বাংলা দিনক্ষণের খবর রাখে না।”
হাসিতে ঠোঁট রাঙিয়ে প্রত্যুত্তর করে শ্রাবণ। ইফতেখার আবারও বাইরে দেখে। পুনরায় শ্রাবণকেও দেখে। ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলে,
“কিন্তু উভয় শ্রাবণই আজ নয়নাভিরাম।”
প্রশংসায় মুখের হাসি প্রশস্ত করে শ্রাবণ। খালি কাপটা নিয়ে যায় রান্নাঘরে। নিজ হাতে ধুয়ে রেখে আসে। ইফতেখারও রান্নাঘরের দরজায় এসে পরীকে বলে যায় দ্রুত নাশতা দিতে। পরী থালাবাটি ধুয়ে যাচ্ছিলো। শ্বাশুড়ি গেছে শ্বশুরের নাশতা নিয়ে। পরী উঠতে গেলেই শ্রাবণ বাঁধা দিয়ে বলে,
“আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ধীরে সুস্থে কাজ করো।”
শ্রাবণ নিজ হাতে প্লেটে রুটি সবজি তুলে নিয়ে যায় ইফতেখারের জন্য। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“এই ঘরে খাবেন? নাকি অর্পার ঘরে?”
বিপু ঘুমাচ্ছে তাই অর্পার ঘরেই চলে যায় ইফতেখার। অর্পা স্কুলের জন্য গোছগাছ করছিলো। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“পরীক্ষা?”
“হু। আমাকে দিয়ে আসবা স্কুলে।”
প্রত্যুত্তর করে না ইফতেখার। খাটের এক কোণে বসে প্লেট সামনে নিয়ে খেতে শুরু করে। তার খাওয়ার তাড়া দেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“এতো তাড়াহুড়ো কেন? কোথাও যাবেন নাকি?”
“ঘুমাবো। ভালো ঘুম হয়নি রাতে৷ ভোরেই উঠে দৌড়াতে হয়েছে রাস্তা দেখার জন্য।”
“কাজ হয়ে গেছে?”
“অনেকটা।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ স্টিলের কিছু পাকা মেঝেতে আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে আসে বাইরে থেকে। কানে ঝিম ধরে যায় এই ঘরের প্রত্যেকেরই। পরক্ষণে আরও দুইবার বাজে। প্রথমটা অজ্ঞাত ঘটনাক্রমে মনে হলেও পরের বার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইচ্ছাকৃত আওয়াজ তোলা হচ্ছে। ইফতেখার খেতে বসে বিরক্তিকর শব্দ করতেই শ্রাবণ বেরিয়ে বারান্দায় আসে। দেখে হাতে স্টিলের বাটি নিয়ে ভাইজানদের ঘরে উঁকি দিচ্ছে পরী। যেখানে বিপু ঘুমাচ্ছে। ওদিকে পারভীনের কণ্ঠে ধমকও ভেসে আসছে। শ্রাবণ তাকে জিজ্ঞেস করে,
“কি ব্যাপার? এমন শব্দ করছো কেন?”
পরী এদিকে ফিরে ফিসফিস করে,
“ছোড ভাইজানরে ঘুম থেকে তুলতাছি ভাবি। সেই কোন সন্ধ্যা রাইতে ঘুমাইছে, দশটা বাইজ্জা যাইতাছে। ওঠে না। আম্মায় ডাকতে কইলো। কিন্তু আমি তো জানি, এই বাড়ির নবাবগো ঘুম এমনি এমনি ভাঙে না। তাই এইসব কৌশল আমার ধরতে হয়।”
কথা শেষ করতে দেরি। হাতের বাটিতে টান পড়তে দেরি হয়নি। ঠাস করে মেরে বসেছে পরীর মাথায়। মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার তুলে এক দৌড়ে উঠুনে নেমে গেছে পরী।
“আল্লাহ গো…!”
দরজার সামনে সদ্য ঘুম ভাঙা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাটি হাতে তাকিয়ে আছে বিপু। পরীও মুখটাকে ব্যাঙাচি করে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ দুয়ের কাণ্ডেই হতবাক! বিপু এদিকে ফিরে শ্রাবণকেও দেখতে পায়। পরক্ষণে বাটি হাতে আবার ঘরে চলে যায়। পরী মাথায় হাত ঘঁষতে ঘঁষতে এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। শ্রাবণ তাকে বলে,
“কাজটা তোমার একদম উচিত হয়নি পরী। আমি সজাগ আছি, আমার মাথাটা পর্যন্ত ঝিম ধরে গেছে। আর সেখানে বিপু ভাই তো ঘুমাচ্ছিলোই। তোমার বড় ভাইজানও বিরক্ত হয়েছে। অর্পাও বিরক্ত। এমন তীক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে কতটা ক্ষতি করে, জানো তুমি?”
“আপনি দেখছেন, ক্যামনে মারলো? আমার মাথাটাও ঝিম ধইরা গেছে।”
“তোমার দোষে মেরেছে।”
“হো, দোষ খালি আমারই। উপকার করলেও দোষী হই।”
“এমন উপকার করলে দোষী হতেই হবে। তাই আর এমন করো না।”
ঘরের ভেতর হতে অর্পাও পরীর প্রত্যুত্তরে বলে,
“তুই আমার হাতেও মাইর খাবি এখন। ভাইয়ের দেওয়া মাইরে কম হয়ে গেছে তোর।”
“হো, সবাই মিল্লা মারেন। মারবেনই তো। কিছু কইতাম না।”
শ্রাবণ ফিরে তাকায় ঘরের ভেতর অর্পার দিকে।
“তোমাদের মধ্যে বয়সে কে বড়, অর্পা?”
“বয়সে বড় যে-ই হোক, অপরাধটা তো দেখবা কার বড়।”
“অবশ্যই এখানে পরীর অপরাধ। কিন্তু বড় কে?”
“পরী বড়।”
“অথচ দেখো, পরী তোমায় আপা বলে ডাকে। ‘আপনি’ সম্বোধনে সম্মান করে। আর সে তোমার থেকে কয়েক বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও তুমি তাকে নাম ধরে ডাকো, তুইতোকারি করো। এটা আদৌও কোনো ভদ্রতার পরিচয় বহন করে না। কাজের জন্য সে এখানে আছে, তাই কাজের ফরমায়েশ দিবে ঠিক আছে। বড় হিসেবে একটা ভালো সম্বোধন তো করতে পারো অন্তত। এই ধরো, তুমি পড়াশোনা করে শিখছো কিছু। সেই প্রেক্ষিতেই।”
কথা বলে না অর্পা। কিন্তু ভ্রু মাঝে বিরক্তি ভাব আনে ঠিকই। মনযোগ দেয় একটু বই রিভিশনে। এই ঢংগী মেয়ে যে ভদ্র হবে না, মনে মনে তা ভেবেই ভেঙচি কেটে চলে যায় পরী। খেতে থাকলেও কথা সবই কানে যাচ্ছিলো ইফতেখারের। শ্রাবণ দরজার পাশ থেকে ইফতেখারের কাছে এগোয়। হাতের রুটিটা খেলেই খাওয়া শেষ। প্লেট খালি দেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“রুটি খাবেন আরও? নিয়ে আসবো?”
“না।”
“ছোট ছোট ভুল থেকেই কিন্তু বড় ভুলের সৃষ্টি হয়। এই ছোটখাটো বিষয়গুলো আপনারা বড়রা ঠিক করে দিতে না পারলে ছোটরা ঠিক হবে কিভাবে? এই যে, অর্পা ভাবছে হয়তো ভাবি তাকে অপমান করলো। কিন্তু আমি যে একটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছি, এটা মানতে তার কষ্ট হবে।”
ইফতেখার রুটি শেষ করে পানি পান করে প্লেটে হাত ধুয়ে নেয়। শ্রাবণ প্লেট হাতে তুলে নিয়েছে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ইফতেখার অর্পাকে তখন বললো,
“চলো, নামিয়ে দিয়ে আসি। পরী কিন্তু তোমায় অনেক আদর করে। ওকে আপু বলে ডাকতেই পারো। সে তো এক হিসেবে আমাদের মামাতো বোনই হয়। তাই না?”
ভাই ভাবি মিলে বললো, অর্পার মুখমণ্ডল থমথমে হয়ে রইলো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে চলে গেছে বারান্দায়। বাবামায়ের কাছে বলে নিচ্ছে যাওয়ার আগে। শ্রাবণ আর ইফতেখার একত্রেই বেরিয়েছে বিপুর ঘর পর্যন্ত। ইফতেখার মোটরসাইকেলের চাবি নিয়েই আবার চলে যাচ্ছে। শ্রাবণ দাঁড়ায় এখানে।
“বিপু ভাই, বাটিটা দিন।”
বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বিপু বাটি এগিয়ে দেওয়ার। ওদিক হতে কানে ভাসে অর্পার গলা। মোটরসাইকেলে উঠতে উঠতেই ভাইকে নিচু গলায় বলছে,
“ভাইয়া, ভাবিকে ফুল ছিঁড়তে নিষেধ করো। অকারণেই ছিঁড়ে ফেলে। একটা ফুলও আমার শান্তিতে ফুটতে পারছে না কারো জন্য।”
“ভাবি ছিঁড়েছে ফুল?”
“কালকেই তো ছিঁড়লো।”
“এতো কিপ্টেমি করতে নেই৷ মাঝে মাঝে কিছু শখ আহ্লাদ পূরণের পিছু ছেড়ে দিতে হয়। সেই তো ঝরে পড়েই যাবে।”
“এহ!”
খুবই অসন্তোষ হলো অর্পা। মোটরসাইকেল চেয়ারম্যান বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শ্রাবণ মৃদু হাসছে অর্পার নালিশ প্রয়োগের উপর। বিপু বাটি হাতে বেরিয়ে বলে,
“খুব খুশি আছেন বুঝি, ভাবি।”
শ্রাবণ বাটি হাতে নিয়ে প্রত্যুত্তর করে,
“সম্বোধনের আগে ক্ষমা চাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু।”
“ওহ্, স্যরি। ভুলে গিয়েছিলাম। আবারও স্যরি।”
“ওকে। অর্পা তার ভাইয়ের কাছে বিচার দিচ্ছে ফুল ছিঁড়েছি বলে। তাই হাসছি।”
“আবার ফুল ছিঁড়েছেন!”
“আমি তো একবারই ছিঁড়লাম।”
“সেদিন অর্পার গাছের প্রথম ফুলটাই ভাই আপনার জন্য পাঠিয়েছিলো। আর সব হাত করতে হয়েছে আমাকে। এই মেয়ে ফুল পাগল। একটা ধরতে দিবে না কাউকে।”
“তা-ও ভালো। ফুলকে পছন্দ করা মানুষদের আমিও পছন্দ করি। কিন্তু আপনি বড় অপছন্দের কাজ করলেন, ভাই।”
“আমি আবার কি করলাম?”
“পরীর মাথায় যেই আঘাতটা দিয়েছেন, এতে তার সাথে মন্দ কিছুও ঘটে যেতে পারতো।”
“আমি তো এতো জোরে আঘাত করিনি। এইটা বড্ড শয়তান। কোনো ভালো উপায়ে তাকে কাজ করতে দেখবেন না। যত শয়তানি চিন্তাভাবনা নিয়ে ঘুরঘুর করে।”
“আপনি তো ভালো। তাই আপনার জন্য এটা অনুচিত হয়েছে। একটা হালকা আঘাতেও অনেক সময় মানুষের স্ট্রোক হয়ে যায়। আপনি যথেষ্ট জোরে আঘাত করেছেন। ব্যাথা অবশ্যই পেয়েছে। আল্লাহ না করুক, সে যদি এখন কোনোভাবে তেমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে যেতো, আপনি কি করতেন তখন? এই ছোটখাটো দুর্ঘটনাই যদি বড় কিছুর সৃষ্টি করে ফেলে, আপনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? এজন্য করতে হলে সাধারণ কিছুও গভীরে ভেবে করা উচিত আমাদের। আর নয়তো ছেড়ে দেওয়াই ভালো।”
শ্রাবণ থালাবাটি নিয়ে পা বাড়িয়েছে রান্নাঘরের দিকে। বিপু চুপ রয়েছে অতিরিক্ত কথা না বলে। কথার যৌক্তিকতা নিজের অপরাধ স্পষ্ট করতে চাইছে যেন। শ্রাবণ পরীকে পাঠিয়েছে বিপুর খাবার দিয়ে যেতে। পরী অনিচ্ছুক হলেও শ্রাবণকে মানতে বাধ্য হয়েছে। নাশতা করেই ওষুধ সেবন করেছে শ্রাবণ। বারবার বাইরে দেখছে। বারান্দায় হাঁটছে। একটু মজিদা খালাম্মার বাড়ি যাওয়া দরকার। তার সাথে বহন করা সম্পদ উনার ঘরে পড়ে আছে সব। ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বেগ কিছুটা বেড়ে এসেছে। এমনি ইফতেখার ফিরেছে। পিছু রাখা একটা চারাগাছ। মোটরসাইকেল বাইরে রেখে চারাগাছটি বারান্দায় এনে রেখেছে সে। শ্রাবণ কিছুটা দূর হতেই দেখতে পায় তিনটি শ্রভ্র বেলী ফুটে আছে ছোট্ট গাছটাতে। ইফতেখার এগিয়ে এলেই বলে,
“আপনি তো ভিজে গেছেন পুরো। রেইনকোট ব্যবহার করতে পারেন না?”
“কিনতে হবে।”
আধ ভেজা শার্ট খুলে বারান্দায় নেড়ে দেয় ইফতেখার। ঘরে যেতে যেতে বলে,
“অর্পার গাছের ফুল ছিঁড়ো না। তার কষ্ট হয়। এটা তোমার বেলী গাছ। ফুল ফুটলেই ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে নিয়ো। নিজের বাড়ি হওয়ার পর কিনবে ঠিক করেছিলে না? ভালো একটা দেখতেই নিয়ে এলাম। যেখানে ইচ্ছে, লাগিয়ে দিয়ো।”
ঠোঁটে হাসি রাঙিয়ে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ। মন বলে,
“আমার তো এখন ইচ্ছে করছে আপনার মন জমিনে এই গাছটি রোপন করতে। শখ রাখতে না জানলেও শখের খেয়াল আপনি খুব রাখেন, আমার শখপ্রাণ মহাশয়! কিন্তু, এটা কি আমার বাড়ি?”