শ্রাবণধারা” পর্ব- ০৪ (নূর নাফিসা) .

0
161

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৪
(নূর নাফিসা)
.
.
বাজারের পাশে ফাঁকা বালুর মাঠে কোনো পার্টি এনে বসাতে হবে। রাস্তার কাজটা সম্পূর্ণ হলেই যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে আসবে। একটা ভালো পার্টিকে ধরতে পারলে মাসে মাসে প্রচুর ভাড়া পাওয়া যাবে। যেহেতু নদীর পাড়, সেহেতু নৌপথেও যোগাযোগ সুস্থির রাখা সহজ হবে। ক্ষমতা আছে এখন, সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না। এখনই দখলের সময়। বালির নিচে যাদের জমিজমা আছে, তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে উপযুক্ত দাম দিয়ে তা কিনে নিতে হবে শীঘ্রই। রাস্তা আর বাড়ির কাজটা সম্পন্ন হলেই যেন এই ব্যাপারে মামাকে জোর দেয় ইফতেখার, সেই ব্যাপারে আলোচনা করতে করতেই খালিদ আর ইফতেখার বাজারের দিক হতে চেয়ারম্যান বাড়ি আসছিলো। রোদে দাঁড়িয়ে থাকায় দুজনের কপালেই ঘাম জমে গেছে। মুখাবয়ব তেল চুকচুকে। কপালের ভাজেও চাপা খানিক বিরক্তি। ইফতেখার নিশ্চুপ শুনতে শুনতেই পা বাড়াচ্ছিলো। ব্যাপার মন্দ বলেনি ভাই। ভালো পার্টি যোগাতে পারলে অনেক লাভবান হওয়া যাবে। খালিদের চোখ হঠাৎ বিপুর উপর পড়ে গেলো পথ ফুরানোর আগে। সাত্তারের বাড়ি হতে বেরিয়েছে বিপু। হনহন পায়ে চলছে সে-ও চেয়ারম্যান বাড়ির রাস্তাতেই। খালিদের মুখখানা যেন আরও থমথমে হয়ে উঠলো মুহুর্তে। ইফতেখারকে বললো,
“দেখছোস, দেখছোস? বিপু সাত্তারের বাড়িত্তে বের হইছে। এই পোলাটায় বেলাইনে যাইতাছে একদম। মেয়েগো পিছে পিছে ঘুরতে লাগছে। কোনো দায় দায়িত্ব নাই। কলেজেও যাইতো কেমন ফুটাঙ্কি করতে করতে। এর হাবভাব আমি ছোডত্তেই ভালা দেখিনা। কয়দিন ধইরা একটা সুন্দর মেয়েলোক দেহি আয়ে যায় সাত্তারের বাড়ি। ওইডার পিছেই বুঝি পড়ছে! কিছু কইছ কইলাম। ঘটনা গাঢ় হওয়ার আগেই সাবধানে টানিস। মামীরে কইছ বুঝাইতো। নইলে মামা কেমন, জানোস ই তো।”
প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না ইফতেখার। কুচকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিপুর ধেইধেই চলার দিকে। মামার কাছেই বলা দরকার ভেবে ফুসতে থাকে খালিদ। চেয়ারম্যান বাড়ি পা দিতেই খালিদের সাত বছর বয়সী মেয়ে ছুটে আসে বাড়ির ভেতর হতে।
“বাবা, তোমারে খুঁজছি আমি! তুমি টাকা দিয়ে আসোনি ক্যা? আমি স্কুলে যাবো না?”
“হো, মনে নাই। যা, স্কুলে যা।”
পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেই মেয়ে চলে যায়। স্কুলে পৌঁছে দিতে অর্পাকে পিছু নিয়ে মোটরসাইকেলে বসেছে বিপু। খালিদ কেবল মটকানো চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বিপুর এদিকে ধ্যান নেই। সে খালিদের মেয়ে তুলিকে ডাকে মোটরসাইকেলে চড়ে বসতে। তাকেও নামিয়ে দিয়ে যাবে। খুশিতে চলে আসে তুলি। তাকে তুলে নিয়েই মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয় বিপু। আফজাল হোসেন নাশতা করে দাত খিলাচ্ছেন বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে। ইফতেখার এসে বললো,
“আব্বা, আলকাতরার টাকা দিয়েন। ইটের গাঁথনি শেষ পর্যায় এসে গেছে।”
“কখন লাগবো?”
“বিকেলেই যাবো।”
“নিয়া যাইছ।”
পারভীন ছেলের গলা শুনে নাশতা করতে ডাকছে ঘরের ভেতর হতে। পরী এসে বারান্দায় উঁকি দিয়েও ডাকে।
“ভাইজান, নাশতা করতেন হাতমুখ ধুইয়া।”
“শুনছি।”
পরী খালিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই, খালিদ ভাই। ভাবি রানছে তো বাড়িত? নাশতা কইরা বাইর হইছেন তো? নইলে আপনেও আইতেন।”
খালিদ জবাব দেয় না তার। মামার সাথে কথা বলা দরকার বালির মাঠের ব্যাপারে। পরী ঠোঁট উল্টে পারভীনের কাছে যেতেই পারভীন শাসানো চোখে তাকিয়ে বলে,
“তোরে কি আমি বলছিলাম, খালিদের বউ বাড়িত রানছে নাকি তার খবর নিয়ে আইতি? বলছি, খালিদ আইলে তারেও সাধিছ নাশতা করতে। কথাবার্তা ঠিক করিছ। নইলে কপাল মন্দা।”
“জন্মাইছিই মন্দা নিয়া। এহন আর কপালের ভালা তো স্বপ্নেও দেখি না।”
“এতো বেশি কথা আমার একদম পছন্দ না কিন্তু, পরী।”
“আমি মানুষটাই সকলের অপছন্দের। হুহ্!”
জবাব দিয়ে সাথে সাথেই পারভীনের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় সে। কথার পিঠে কোনো কথা না রাখলে যেন তার বাকশক্তির জীবদ্দশা বৃথা যায় বরাবরই। পেছনের দিকের দরজা খুলে দেখে গোয়ালা যাচ্ছে ভারি ওজনের বালতি বহন করে। সে গলা ছাড়ে,
“ও গোয়ালা ভাই, গোয়াল হতে নেন তো খাঁটিডাই। বাজার পর্যন্ত যাইতে যাইতে দুধে পানি মেশান, না পানিতে দুধ মেশান?”
“তুই কোনডা কিনবি, কো দেখি।”
“আমি কিনতাম না। কাকায় কিন্তু চেয়ারম্যান। বুইজ্জা রাইখেন। যদি নালিশ পায়, কোমড়ে দঁড়ি দিবো কিন্তু পুলিশ ডাইক্কা।”
“ধুর বেডি। সক্কালবেলা তোর অলক্ষুণে মুখ না দেখলেই বাঁচি।”
“আমি অলক্ষুণে? তাইলে আপনের কপাল খারাপ। আমি প্রত্যকদিন এনে আইয়া খাঁড়ায় থাকমু আপনে যাওনের সময়। বুইজ্জা রাইক্ষেন।”
গোয়ালা কদম আলী আর পিছু বলে না কিছু। ঘর হতে ইফতেখারের গলা আসে,
“পরী, নাশতা দিবি নাকি!”
“আইতাছি ভাইজান।”
পরবর্তী দিন দুপুরের দিকে পুনরায় সাত্তারের বাড়ি আসে বিপু। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে বাড়ি হতে বের হওয়ার পর। ছাতাটাও নিয়ে এলো না, ঝপাঝপ নামলেই দৌড়াতে হবে। যে কাজে এসেছে তা না করে গেলেই নয়। বড্ড সংশয় পুষে দাঁড়িয়ে আছে এই বেলা। গতকাল উঁকিঝুঁকি দিতে গিয়ে সাত্তার কাকার সামনে পড়ে গিয়েছিলো সকাল বেলা। দুপুরে তো তিনি কর্মস্থলে থাকেন, তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে আসা এই সময়ে। কিন্তু কাঙ্খিত মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে না দৃষ্টির সীমায়। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেও ভয় ভয় হয়। এমনি কান্তার দেখা পায় বারান্দায় কাপড় মেলে দিতে এসেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বাড়ির প্রবেশদ্বার হতে ফিসফিসিয়ে ডাকে বিপু।
“কান্তা…”
কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই ওদিকে দৃষ্টি গাঁথে কান্তা। বিপুকে দেখেই বিরক্তিকরভাবে ভ্রু কুচকে যায় তার। বিপু হাতে ইশারা করে ডাকে এগিয়ে যেতে। কান্তা মেজাজী গলায় বলে,
“না।”
“আয় না একটু। কথা আছে।”
“পারতাম না আইতে। আমার পায়ে ব্যাথা।”
চেহারায় বিরক্তি ও হতাশা বাঁধে বিপু। পরক্ষণে বলে,
“শ্রাবণ যে, উনি বাড়িতে আছেন?”
“ক্যা?”
“একটু কথা আছে। ডেকে দে।”
“পারতাম না।”
ঠমক যোগে উত্তর করে ঘরে চলে যায় কান্তা। তার ঠমকানোর কারণে বিপুর রাগ হয়। ইচ্ছে করে এক্ষুণি একটা ঠুসি মেরে আসতে মাথায়। বেয়াদব মেয়ে একটা! কিভাবে যে শ্রাবণের কাছে পৌঁছাবে! চাচিরা কেউ দেখলে কি না কি জিজ্ঞাসা করতে থাকে, কি না কি মনে করে আবার গালমন্দ শুরু করে। যতই হোক, উদ্দেশ্যটা তো উনাদের ধারণায় গালমন্দ করার মতোই। তাই যেন আরও সাহস পাচ্ছে না। চলেই যাবে নাকি? মিনিটখানেক পরেই হনহন পায়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে কান্তা। সোজা চলে গেছে তার জেঠির ঘরে। পুনরায় বেরিয়ে আবার হনহন পায়ে গেছে নিজেদের ঘরে। যাওয়ার আগে ক্রুদ্ধ চোখে একবার বিপুকেও দেখে গেছে। বিপু যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। ফিরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। যার অবসান কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হয়েছে। পেট ভরে মাত্রই ভাত খেয়ে সেরেছে শ্রাবণ। মাথায় ওড়না তুলে ঢেকুর তুলতে তুলতে এগিয়ে আসে রাস্তার কাছাকাছি। আকাশে তাকিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির অবস্থাও বুঝে নেয় চলতে চলতে।
“ও, আপনি। ডেকেছেন নাকি?”
“হ্যাঁ। কেমন আছেন?”
“এইতো, আলহামদুলিল্লাহ।”
“আচ্ছা, মজিদা কাকি আপনার কি হয়?”
“খালাম্মা।”
“কেমন খালাম্মা?”
“খালাম্মা আবার কেমন হয়?”
“না, মানে আপন? নাকি অন্য কোনো আত্মীয়?”
“খালাম্মার বোন খালাম্মা।”
“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। দূর সম্পর্কের।”
“কিভাবে বুঝলেন?”
“আপন হলে বলতেন মায়ের বোন।”
অধরের বাঁকে মৃদু হাসিয়ে এলিয়ে দেয় শ্রাবণ।
“জ্বি। এজন্যই ডেকেছেন?”
“উহুম। আপনার জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”
“তাই? কিসের প্রস্তাব?”
“প্রেমের প্রস্তাব।”
“বাব্বাহ! কিন্তু আমি তো প্রেমের প্রত্যাশা করছিলাম না।”
“প্রেম অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে।”
“হুম, হয়তোবা।”
“প্রেম করবেন কি না, সেটা বলুন।”
“আগে থেকে তো ভাবিনি। তবে…”
“কি?”
“ভাবলে, বলা যায়।”
“ইচ্ছে আছে মনে হচ্ছে।”
“ইচ্ছে রাখাই যায়।”
ঠাট্টা জুড়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে শ্রাবণ। পরক্ষণেই বলে,
“তবে, আমি ভেবেছিলাম আপনি কোনো কাজের অফার নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। প্রেমের চেয়ে এখন একটা চাকরির বেশি প্রয়োজন ছিলো আমার।”
“কি চাকরি লাগবে আপনার?”
“বললেই পাবো?”
“পাবেন কি না জানি না। চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“আমার ইচ্ছে ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু আমি মেডিকেলে পড়তে পারিনি। আমাকে কি ডাক্তার বানানো যাবে কোনো হসপিটালের?”
“ডাক্তারি পড়ার ডিগ্রি নেই, আবার ডাক্তার! ফালতু কথা রাখেন। আসল কিছু বলেন।”
“আপনি আমায় ফালতু বলতে পারলেন?”
“সম্পর্ক স্থির হলে ক্ষমা চেয়ে অন্যকিছু বলবো। আপাতত আমাকে এটা জানান যে, আপনি তো এমনিতেই বেশ রূপবতী। আবারও শিক্ষিত একটা মেয়ে। কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কি?”
“থাকলে?”
“দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার যাত্রী নিতে দ্বিধা। এক নৌকার জন্য সৎ যাত্রী চাই।”
কপালে আঙুল চেপে হেসে উঠে শ্রাবণ।
“আপনি কথা বেশ ভালো বলতে পারেন। আপনার কথার কারণেই প্রেমে পড়ে যাবে মানুষ।”
“তা-ও, একটা গুণ নিজের আছে বলে গর্ববোধ করছি। এখন আপনার মনের খবরটা বললেই বড় ধন্য হই।”
“দুই নৌকায় পা রেখে চলার যাত্রীও আমি নই। ওকে?”
“আর প্রস্তাবের ব্যাপারটা?”
“বলেছি না, ভাবতে হবে?”
“প্রস্তাব পত্র।”
ভাজ করা একটা কাগজ সামনে এগিয়ে দেয় বিপু। মুখে চাপা হাসি নিয়ে একবার বিপুর দিকে তাকায় শ্রাবণ। আবার কাগজটার দিকেও তাকায় পরপর দুইবার।
“সত্যি সত্যিই প্রস্তাব!”
“মিথ্যে কেন বলতে যাবো?”
“তা-ও তো কথা। নিতেই হবে?”
“নেওয়ার জন্যই তো দিলাম।”
একটু ভেবেই যেন পত্রটা গ্রহণ করলো শ্রাবণ। সন্তুষ্টচিত্তে বিপু প্রস্থান করতে চায় এবার,
“শীঘ্রই জানাবেন কিন্তু।”
হাতের মুঠোয় কাগজ চেপে চলে যায় শ্রাবণও। কাগজটা নিয়ে ঠিক করলো না ভুল করলো, দ্বিধা কাজ করছে মনে। তবুও পড়ে দেখতে ইচ্ছুক। ঘরে পা রাখতেই মজিদা খালাম্মা জিজ্ঞেস করেন,
“কেডা ডাকছিলো রে, শ্রাবণ?”
“চেয়ারম্যানের ছেলে, বিপু।”
“ক্যা, গো? ক্যা?”
“ওইযে, চাকরি খুঁজছিলাম৷ হয়তো উনি কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।”
“দিবো কইছে? দেইখ্যা হুইন্না যাইছ।”
ফিসফিস করে মজিদা। স্মিত হেসে সম্মতিতে পলক ফেলে শ্রাবণ। পাশের রুমে গিয়ে কাগজ মেলে পড়ে। কিছু সরল বাক্যে প্রেমে পড়ার আহ্বান। শ্রাবণকে প্রথমবার দেখতেই তার চোখে লেগে গেছে। মন যে কখন ছুঁয়ে নিলো চোখের লাগাটুকু, তা বুঝতেই পারেনি। প্রেমটেম জীবনে হয়ে উঠেনি। এবার নাকি মন বলছে ‘প্রেম কর’। খোলা ও বন্ধ চোখের পর্দায় লেগে থাকা ছবিটার সাথেই প্রেম কর। মানুষ ছবির মতো কিভাবে হতে পারে?
শ্রাবণের মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু মনে ভর করে এক ফালি সংশয়। পত্র যে নিলো, এবার কি দিবে তার উত্তর?
বিকেল থেকে আবারও নেমেছে আষাঢ়ে ঢল! আগামীকাল হতেই পিচ ঢালাইয়ের কাজ ধরা হতো রাস্তায়। এরই মধ্যে আবার কাজের স্থগিতের ঘোষণা আকাশ কর্তৃক। ওদিকে চেয়ারম্যানের ঘরের কাজও সাময়িক স্থগিত। প্রথম তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজটা এই সুবিধার দিনে সেরে উঠা গেছে। এরপর ভেতরের কাজ বৃষ্টিতে করতেও সমস্যা হবে না। ইটের গাঁথুনি চলবে ছাদের কারণে একটু বিরতি নিয়ে। ঝড় হলেই সমস্যা। বাতাসের বেগে যদি কাঁচা গাঁথুনিতে পানি এসে যায়, এইটুকু সংশয় মাত্র। অন্যথায় সমস্যার কিছু দেখা দিবে না বলে আশাবাদী। বারান্দায় হেঁটে হেঁটে খাড়া ঢল দেখছেন আফজাল হোসেন। বালির মাঠের ব্যাপারটা নিয়ে শীঘ্রই আলোচনা সভায় বসতে হবে। খোলা মাঠেই খোলা সভা করবে অত্র জমিজমার মালিকদের সাথে। কারোই তেমন বেশি অংশ নেই। অল্পস্বল্প জমির সমন্বয়ে বড় চড় ছিলো। নদী ভাঙনের কারণে অনেকের জমি হারানোর পথে ছিলো। নির্বাচনের পরপরই তিনি পাড় তৈরি করে দিলেন। জনগণ খুশি হলো। এরপর আরও দুর্দশার শিকার হলো। বৃষ্টির পানি জমে এটা এক বিলের মতো তৈরি হলো। এখন কি ফসল করা বাদ দিয়ে মাছ চাষ করবে তবে? এই বিল যখন ভরে গিয়ে পানি চারদিকে নামতে থাকবে, তখন মাছ কোত্থেকে পাবে? একদিকে রাস্তায় পানি উঠে তা ঘরবাড়ির দিকে নামতে শুরু করবে। অন্যদিকে মাছসহ নদীতে গড়িয়ে যাবে। তারউপর এতো গভীরতায় গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়েও সমস্যা। পানি দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ার বদভ্যাস আছে। নাগালহীন বিলে পড়ে তখন প্রাণ হারানোর দশাও বড্ড ভয়ংকর রূপ হবে। তাই সকল সমস্যা নিরসনে সুযোগের বড় সদ্ব্যবহার করে ফেললো চেয়ারম্যান। বালিতে ভরাট করে দিলো জমি। এবার বাচ্চারা খেলে, বাজারের পরিধিও কিঞ্চিৎ বাড়ানো যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো কিছু করার চিন্তাও করা যায়। এই ভালো কিছু নিয়ে তিনি আগে থেকেই ভাবছেন। খালিদ মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দেয়। আজ সকালে ব্যাপারটা বলতেই তিনি সভা নিয়ে ভাবছেন৷ এমনি ভাবনার ছেদ ঘটে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে অর্পা। তিনি শান্ত গলায় বলেন,
“পানি ধইরো না, আম্মা। সর্দি লাগবো।”
“আমি তো মাথা ভেজাচ্ছি না, আব্বু।”
“তবুও লাগবো। তোমার এলার্জি আছে পানিতে।”
“এলার্জির ওষুধও আছে আমার আব্বুর হাতে।”
ঠোঁটের কোণে হাসি স্পষ্ট করেন আফজাল হোসেন। মেয়ে তার বড়ই আদুরে। এমনসব কথাবার্তা দিয়েই যেন আদর কেড়ে নেয় সর্বদা। এই অসময়ে ভিজে বাড়ি আসে বিপু। বৃষ্টির শুরু হয়েছে, বেশিক্ষণ হয়নি। কিন্তু ছেলে ভেটকিমাছের মতো সাদা হয়ে এসেছে। চামড়াও কুচকে যাচ্ছে যেন। অনেক্ক্ষণ যাবত ভিজেছে, বুঝাই যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাকে ডাকে বিপু। গামছা আর পোশাক দিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্পাকে শুরুতে বলেছিলো যেতে। অলস মেয়ে পরীকে ডাকতে শুরু করেছে এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে। পরী কখন আকাশ থেকে নেমে আসবে আর কখন তার পোশাক পৌঁছাবে, তাই মাকেই ডাকে বিপু। আফজাল হোসেন থমথমে চোখে দেখেন ছেলেকে। বাবার এমন নিরব তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করা ক্রমশই অস্বস্তি তুলে মনে। তবুও দাঁড়িয়ে মৃদুবেগে কাঁপতে থাকে। পারভীন চোখ গরম করে এসে প্যান্ট আর গামছা ছুঁড়ে দেয়।
“কোত্থেকে আইছোস?”
মুখে হাসি জাগিয়ে সে উত্তর করে,
“নদীতে নামছিলাম একটু।”
“একটু না বেশি নামছোস, চেহারাই জানায় সব। নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধুইয়া দিবি। এক্ষুনি দিবি। বুঝছোস?”
“পরী আছে, মা। তোমার চিন্তা করতে হবে না।”
“পরী তোগো চৌদ্দ পোশাক ধোয়ার জন্য নাই। তারে এক পোশাক ধোয়ার জন্য রাখা হইছে। ধামরা হয়েও যখন বারবার পোশাক পাল্টাছ, নিজের কাজ নিজে কর।”
ভেতরে চলে যায় পারভীন। বিপু চুপচাপ শরীর মুছে নিতে মনযোগ দেয়। বারান্দার এক কোণে চেপে থাকে বাবার আড়াল হতে। পোশাক পাল্টানোর পর আফজাল হোসেন ডেকেই বসেন ছেলেকে। পিছু হাত রেখে লম্বা বারান্দার মাঝামাঝিতে অবস্থান করে বলে,
“খেলাধুলা তো আছেই। ঘুরাফেরাডাও বড্ড বেশি করতাছোস। খালিদ কি কয় এগুলা?”
“কি, আব্বা?”
“আজকাল মেয়েগো পিছন ঘুরতে দেখা যায় তোরে।”
বিপু একদমই অপ্রস্তুত ছিলো বাবার কাছে এখন এমন কিছু শোনার। কি বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। ব্যাপার জানাজানির দরকারও, আবার জানতে দেওয়াও যেন ভয়। তাই চুপই আছে বিপু। আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে বলেন,
“সাত্তারগো বাড়ি উঁকিঝুঁকি মারার নালিশ আয়ে আমার কাছে। আর যেনে না হুনি।”
চুপচাপ ঘরে চলে যায় বিপু। এই খালিদ ভাইটা মহা ঝামেলার একটা মানুষ। এই বয়সটা কি সে পাড় করে আসেনি কখনো? যদি সময়টাকে দেখতে পারতো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করতো জীবনে কখনো মেয়েদের পিছু লেগেছিলো কি না। নাকি ছ্যাকা খেয়েছে বলেই অন্যের ব্যাপার স্যাপার সহ্য হচ্ছে না? বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে ঝামেলাময় লোকটা। সাত্তার বাড়ি যাওয়া সে আটকাবে, না? আরও বেশি বেশি যাবে৷ একশোবার যাবে। খালিদ ভাই পারলে আটকে ধরুক, কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে! ঘরের ভেতর থেকে পারভীনের গলা শুনেছিলো পরী। সে-ই মাথায় চড়ে বসেছে একদম। বিপু এসে বলার পরও সে কাপড়চোপড় ধুয়ে দিলো না। “নিজের কাজ নিজে করেন” বলেই ছুটিতে গেলো। তার ভাব দেখলে শরীর কিড়মিড় করে উঠে বিপুরও। এই মায়ের আস্কারাতেই বুঝি এমন হয়ে উঠছে দিনদিন! মায়ের পিতৃদেশের মানুষ তো! দূর সম্পর্কের ভাইঝি বলে কথা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here