শ্রাবণধারা” পর্ব- ০৭ (নূর নাফিসা)

0
95

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৭
(নূর নাফিসা)
.
.
দুদিন যাবত দেখা কথা হয়নি বিপুর সাথে। শ্রাবণও স্বর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তাই বের হয়নি বাড়ি থেকে। রাস্তায় পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। দূর হতেই বাতাসের ধাক্কায় আলকাতরার গন্ধ এসে শ্রাবণের নাকে ধাক্কাচ্ছে। সকালে খাওয়ার আগে এই গন্ধ পেট পর্যন্ত যেতেই বদ হজম হয়। মজিদা খালাম্মা যথেষ্ট খেয়াল রাখছে। ডিসপেনসারিতে ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছে অসুখ বাঁধার শুরুর দিনই। যদিও টাকা দিয়েছে শ্রাবণই। কিন্তু ছোটাছুটিতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি নিজ দায়িত্বে। আজ দুপুরে যখন খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো মজিদার চৌকিতে মাথা পেতে। মজিদা এসে খবর দেয়,
“চেয়ারম্যানের ছোড ছ্যাড়াডায় তোরে খোঁজতাছে। কোনো কাজ ঠিক করছে মনে হয়।”
শোয়া থেকে বসে যায় শ্রাবণ। খালাম্মার দিকে তাকায় মনে মনে হেসে। খালাম্মা তো তার কাজ পাওয়ার জন্য বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সে তো জানে, কোনো চাকরির ব্যবস্থা বিপু করেনি। নিশ্চুপ চুলগুলো খোপা করে মাথাসহ ওড়না জড়িয়ে নেয় দেহে চাদরের মতো করে। বিপুকে বাড়ির প্রবেশদ্বারের আমগাছ তলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। শ্রাবণ উঠুন ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকে।
“কেমন আছেন?”
“বেশ ভালো। ঘুমাচ্ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“এবার জেগে উঠুন শীঘ্রই। বিয়ে আপনি কবে করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
আকস্মিক এমন প্রশ্নে হেসেই উঠে শ্রাবণ।
“পাত্রের ঠিক নেই, পাত্রীর পছন্দের স্থির নেই, সেখনে বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করে বসি কিভাবে?”
“মনের একটা ইচ্ছে আছে না যে, এখন করবেন না। আরও অনেক পরে।”
“ওটা আসলে বলা যাবে না। আমার প্রচেষ্টা তো চলছে একটা কাজের। দেখি, আগে নিজেকে ফিট করি।”
“বিয়েই যখন করবেন, নিজে ফিট হওয়া তো জরুরী না। হাসব্যান্ড কি ঘরের হাড়ি মাজার জন্য রাখবেন?”
“আপনি দারুণ কথা বলেন তো! পাত্র যেন একেবারে রেডি?”
“রেডিই তো।”
ভাবযোগে একটু নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দেয় বিপু। ভাজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“প্রেমের আগে বিয়েই করবেন তো? এবার প্লিজ কোনো আপত্তি আনবেন না। প্রয়োজনে কোনোরকম অভিভাবক থাকলে আপনার পরিবারের এড্রেস দিন। কথা বলে নিবো।”
“আমিই আমার একমাত্র পরিবার। কাজ কি খুঁজি সাধে? এজন্য তো বিয়েটাও করে ফেলতে পারছি না হুট করে পাত্র পছন্দ করে। নিজেকে নিজে গড়তে হবে।”
“থাক, আর গড়তে হবে না। এটা রাখুন।”
“এটা আবার কি জন্য?”
“এটা ভিন্ন কিছুর জন্য।”
হাতে কাগজ দিয়ে এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে থাকে বিপু। ভ্রুর কার্ণিশে চিন্তার রেশ টেনে কাগজের ভাজ তার সামনেই খুলে শ্রাবন। ঠোঁট কার্ণিশে বেঁধে রাখা হাসিটাও বাঁধা অবস্থাতেই আছে। হাতের লেখা সুন্দর। সুন্দর, লিখে উঠা কথাগুলোও।
❝প্রিয় বর্ষাকালের শ্রাবণ,
প্রেম যখন প্রত্যাখ্যাত, বিয়েই হোক প্রিয় সম্পর্ক। তবুও আপনি আমার। বলুন, কবুল? ❞
ওষ্ঠদ্বয়ে ট্যাপা হাসি প্রস্ফুটিত হয় শ্রাবণের। বিপুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসব কি পাগলামো না? চেয়ারম্যানের ছেলে একটা শিকড়হীনা মেয়েকে…”
“এ-ই নিজেকে বেশ বড় করে তুলছেন ফিট করার কথা বলে। এ-ই আবার শিকড়হীনার কথা তুলে ছোট হয়ে যাচ্ছেন! চেয়ারম্যানের ছেলের যখন আপত্তি ঠেকে না, আপনার আপত্তিটা কিসে? আর কোনো অযুহাত তুলে আমায় আশাহত করবেন না প্লিজ। বারবার প্রত্যাশা নিয়ে আসি।”
দৃষ্টিদ্বয় ভাবুক বেশেই নিচে নামিয়ে রাখে শ্রাবণ। বিপু তার নত দৃষ্টিতে সম্মতি খুঁজে পায়। ঠোঁট প্রাঙ্গণে নিমেষেই হাসি জাগায়। নরম কণ্ঠে বলে,
“কি হলো? ভাবেন পরে। আগে কবুল বলেন। তবেই কাজী পর্যন্ত যেতে পারি।”
দৃষ্টি নত রেখেই লজ্জিত হেসে ঘরে ছুটে যায় শ্রাবণ। নীরব প্রতিক্রিয়াই যেখানে স্পষ্ট সম্মতির লক্ষ্মণ, সেখানে বিপুর মন অতি উল্লাসিত। সে-ও তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে বাড়ির সীমা ছেড়ে রাস্তায় উঠে ব্যবস্থা করতে। আজও খালিদের সামনে। একদম সামনে। মূলত খালিদ তাকে দেখে তার জন্যই এই বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে বিপুর দিকে। হালকা করে কেশে পাশ কাটিয়ে চলে যায় বিপু। সে যে দেখলো, বড় ভাইকে কোনোরকম ভয়ই পেলো না। তবে বিড়ালের মতো পালিয়েছে। কিছুটা দূরত্বে তাদের অবস্থানে বিয়ের কথাবার্তা হালকা করে কানে ভাসতেই শরীরের রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হনহন পায়ে চেয়ারম্যান বাড়ি যায় খালিদ। মামাকে পায়নি। কিন্তু বিচার দিতে কার্পণ্য করেনি। মামীর সাথে বসে বসে গুছানো নালিশটুকু দিয়ে গেছে যথাযথ। শুধু তা-ই না, সে সপ্তাহ যাবতই লোক লাগিয়েছে বিপুর পিছু। প্রতিনিয়ত খবর যাচ্ছে সে সাত্তারের বাড়ি উঁকিঝুঁকি দেয়। কোত্থেকে এক রূপসী মেয়ে এসেছে, রূপে মজে তার পিছু নেয়। পারভীন যথারীতিই চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ইফতেখার ভাত খাচ্ছিলো তখন। চুপচাপ শোনে তাদেরকে। খালিদ বলে,
“তোরে কইছিলাম, ইট্টু বুঝাইছ। তুই বড় ভাই। দুয়েকটা ধমক টমক দিলে মানতেও তো পারে।”
ইফতেখার মুখের খাবার গিলে প্রত্যুত্তরে বলে,
“এসব ব্যাপারে আমায় জড়িয়ো না তো। তুমিও তো বড় ভাই। আমার চেয়েও বড়। দেখোই যখন, দিতে পারো না দুয়েকটা ধমক?”
“এখন গায়ে মাখছ না তো। বড়র আগে ছোট বিয়ে কইরা আইলে হেরপর বুঝিছ নে লজ্জা কারে বলে।”
“করুক।”
খালিদ দ্বিতীয় কোনো বাক্য বলে না তার উদ্দেশ্যে। এই ছেলে হচ্ছে আরেক জাতের মানুষ। কোনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবনাটুকু তার মধ্যে নেই। যা ইচ্ছে, করে বসবে। যা ইচ্ছেকে স্পর্শ করবে না, তার ধারেকাছেও যাবে না। দায়দায়িত্ব সব কাঁধেও নিবে না কখনো। একসাথে দুইটা কাজ দিলেও বাছাই করে একটা নিবে। অন্যটায় ফিরেও তাকাবে না আগেরটা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত। মামা যে এসব কি লালন পালন করছে, বুঝে আসে না খালিদের। যা বলার, মামীর কাছেই বলে উঠে যায় সে। মামা ফিরলে যেন ঠিকঠাক বলে। মনে মনে একটা দুঃখও তার। আজকাল সব জায়গায় মামা তাকে নিয়ে যায় না। এইযে এমপির বাড়ি গেলো মেম্বারের সাথে, পারতো না কি ভাগিনাকে সাথে নিতে? আগে তো সবার আগে তাকেই ডাকতো! মন মলিন করে উঠুনে নামতেই বকুল কাকার হুলস্থুল! গোয়াল থেকে বাছুর ছুটে গেছে। লাফিয়ে নেমে এসেছে উঠুনে। বকুল কাকা পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে খালিদের প্রতি।
“তাত্তাড়ি গেইট লাগান। তাত্তাড়ি লাগান। যাইবো গা। ধরতে পারতাম না।”
খালিদ কাদায় পা ফেলে দৌড় দেয়। এক জুতা আটকে যেতেই তা ফেলে রেখে দৌড়ায় গেইট লাগাতে। পরী বারান্দায় এসে বারান্দার গেইট লাগিয়ে দিয়েছে ঘরে ঢুকে পড়বে ভেবে। লাফিয়ে লাফিয়ে অনবরত চিৎকার করছে,
“আল্লাহ গো! আল্লাহ গো! বাছাও!”
পারভীন ও ইফতেখারও এসেছে ততক্ষণে। পরীকে চিৎকার সমেত লাফাতে দেখে ইফতেখার ঠাস করে মারে একটা মাথায়। তাতেই চেঁচানো, লাফানো শেষ তার। বকুল কাকা ছুটে বাছুর ধরতে, বাছুর ছুটেছে খালিদের দৌড় দেখে! যে-ই গেইট লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, তুরন্ত গুঁতো দিলো উরুতে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে খালিদ। পাড়াও দিয়ে বসেছে সাথে সাথে! এবার পারভীনও আৎকে উঠে,
“আয় হায়! বকুল ভাই, ধরেন ধরেন। মাইরা ফেলবো তো!”
খালিদের উপর আক্রমণ করতেই ইফতেখারও বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। বকুল কাকা ধরতে গিয়েও পারেনি। ওপাশ থেকে সরে লাফিয়ে লাফিয়ে সারাবাড়ি দৌড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দালানেই উঠতে যাচ্ছিলো। দালানে লণ্ডভণ্ড করার আগেই ইফতেখার বাছুরের কান টেনে ধরে ফেলে। দুই কান আঁকড়ে ধরতেই লাফালাফি থামে। রশি হাতে ঝটপট বকুল কাকা এগিয়ে এসে গলায় বেঁধে গোয়ালে নিয়ে ফিরে। খালিদ উঠে দাঁড়াতে পারছে না ঠিকমতো। একটা পায়ে কড়া আঘাত বসেছে। ইফতেখার তাকে ধরতে যায় এবার। বারান্দা পর্যন্ত এনে বসায়। দিনের মন্দার উপর খালিদ বিরক্ত হয়ে বসে বসে চাপ লাগা উরুতে মালিশ করতে থাকে অবিরত। তাতেই যদি একটু ব্যাথা কমে আসে। এমনিতে আর ক্ষতের সৃষ্টি হয়নি কোনোরকম। পরী একটু পরপর ফিক করে হেসে উঠে। তখন ভয় পেলেও এখন তার হাসি পাচ্ছে বড্ড। গরু গুতো দিয়েছে বলে কথা! পাঠা দেহের খালিদ ভাই একটা বাছুরের সঙ্গেই পেরে উঠেনি যে। পিছু ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খালিদের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাইজান, পাড়া দেওয়ার সময় আপনে বাছুরের ঠ্যাঙে ধইরা রাখতে পারলেন না? তাইলেই তো ব্যাথাডা পান না।”
তার ফিকফিকে হাসিতেই বড্ড রাগ হচ্ছিলো। এখন বিরূপ মন্তব্যের কারণে আরও ক্ষেপে গেলো। কটকটে চোখে তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় খালিদ। পরী মুখে হাত চেপে ধরে হাসতে হাসতে ঘরের ভেতরে চলে গেছে। তার মন্তব্যে যে খালিদের পাশে দাঁড়ানো ইফতেখারের মুখেও হাসি এনে দিয়েছে তাতেই আরও হাসার সাহস পেয়ে বসেছে পরী। বড় ভাইজানের হাসি চোখে মুগ্ধতা লাগার মতোই ঠেকে তার কাছে। কিন্তু এই মানুষটা হাসে কম। কাকার মতো মুখ গোমড়া করে রাখে যেন! তার আম্মাও তো কম হাসে। হাসার মধ্যে বিপু ভাইজানই এট্টু বেশি হে হে করে! আরেক তো আছেই ঢংগী আপা! যেন পৃথিবীতে বাপের একমাত্র মেয়ে সে-ই। সবাইকে নিয়ে মনে মনে ভাবতে ভাবতে আসবাব মোছামুছির কাজে হাত লাগিয়েছে পরী। গোয়ালে বাছুর বেঁধে বকুল কাকা এসেছে খালিদের পাশে। মালিশ করতে করতে ব্যাথা একটু কমেছে। সামান্য মেজাজ বকুল কাকার উপরও দেখালো। কি দায়িত্বে থাকে সে যে, গরু গোয়াল ছেড়ে পালায়! নিজের উপর দোষ চাপানো মনোভাবে নিশ্চুপ থাকেন তিনি। বকুল কাকার কাঁধে ভর করেই বাড়ি পর্যন্ত গেছে খালিদ।
মেম্বারের সাথে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন। এমপির সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছে গ্রামের রাস্তা বড় করার ব্যাপারে এবং সরকারি হাসপাতালটা আরও প্রশস্ত করার ব্যাপারে। বাড়ি এসে মেম্বারকে বিদায় দিয়ে আগে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। খেতে খেতেই বিপুর নালিশ সম্পর্কে জানায় পারভীন। মনে মনে ক্ষিপ্ত হয় আফজাল হোসেন। ছেলেটা মান ইজ্জত নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে নাকি! এদিকে পারভীন জানায়, সেই যে দুপুরের আগে বেরিয়েছে। এখনো ফেরার নাম নেই। একটু যেন শাসন করে ছেলেটাকে। কেমন অগোছালো জীবন যাপন করে যাচ্ছে। তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আফজাল হোসেন চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। দালানঘরের পাশে গিয়ে একটু কাজকর্মে লক্ষ্য গাঁথে। সুবিধা পেয়ে বাইরের দিকের গাঁথুনির কাজ কিছুটা ধরেছিলো মিস্ত্রি। বড় ছেলেটা পাশে থেকে থেকে ভালোই এগিয়ে নিচ্ছে সব। ছোটটার বেহাল দশাই তো তার দুশ্চিন্তার কারণ। ওটা এমন বাঁদর হলো কেন? মাগরিবের আজান পড়তেই নামাজ আদায় করতে যায়। ইফতেখারকে বলে দেয় তার সাথে কথা আছে। নামাজের পর ঘরে যেন বসে। তিনি যেতেই ইফতেখারের ভেতর হতে বিরক্তি নেমে আসে নিশ্বাসে। আজ বলতে গেলে সারাদিনই তার বাড়িতে কেটেছে। একটু বাইরের আলোবাতাস যে গায়ে লাগাবে, তার সুযোগ হয়নি এই ঘরের কাজ মিস্ত্রিদের বুঝিয়ে দিতে দিতে। এখন মিস্ত্রি গেলো, কোথায় সে একটু ছুটি নিবে। তা-ও হলো না বাবার কাজ পড়ে যায় যত তারই সাথে! পিছু হতে মা বলে দেয় নামাজ পড়তে যেতে। ইফতেখার নামাজ আদায় করে বাবার সাথেই বাড়ি এসে বসে আলাপে। প্রথমে ঘরের কাজকর্মের বিবৃতি, পরক্ষণে রাস্তার কাজের আলোচনাও। তারপর এমপির সাথে করে আসা সাক্ষাতের বিস্তারিত বর্ণনা! ক্রমে ক্রমে বিরক্তি নেমে এসেছে ঘন্টাযাবত এই আলোচনায় বসে বসে। এশার আজান পড়বে বুঝি এবার! আজকাল সকল কাজেই বড় ছেলেকে নিয়ে পরামর্শে বসেন তিনি। দায়িত্বের গুরুভার যেন পুরোটাই তার উপর অর্পণ করবেন নিজের অবনত কালে। কিন্তু গুচ্ছ গুচ্ছ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়াটা পছন্দের না ইফতেখারের। যে কাজটা নেয়, তা নিখুঁতভাবে করে বলেই হয়তো বাবা ভাবে সে সব সামাল দিতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু বিরক্তি ভাবটা দেখে না কেন? বাবাকে থামাতে ইফতেখার কথার মাঝে বলে,
“হাসপাতালের কাজটা নিয়ে আপনি আপাতত একদমই ভাবতে বসবেন না, আব্বা। রাস্তার কাজ ধরেছেন, এটা আগে শেষ করুন। মেম্বারগোষ্ঠী লাফালেই শুধু চলবে না। টাকার লালসায় তারা বিরতি নিতে চাইছে না কিছুতে। একটার পর একটা লেগে থাকবে, আর তারা টাকা হাতাবে। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে আমি দেখি না। রাস্তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বালুর মাঠে প্রজেক্ট করার কাজও ধরবেন না। খালিদ ভাই খুব পড়ে আছে এটা নিয়ে। তার চাচার সাথে জমি নিয়ে কিছু বিরোধ আছে না, সেই জন্যই এতো ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সেখানে তার চাচারও তো জমি আছে। আপনি নিলেই তার জমির পরিমাণ কমে আসবে। এতে আপনার ভাগ্নে খুশি। কিন্তু আপনি চতুর্দিকের কাজ না করে একটা একটা সুষ্ঠুভাবে ধরেন। আর যদি সব একত্রেই ধরতে হয়, তবে আমার উপর দায়িত্ব চাপাবেন না। দশ কাজ একত্রে চালানোর দায়িত্ব আমি নিবোই না। কাকে দিবেন, তা আপনিই ভালো জানেন।”
“খালিদ তো ভুল কিছু কয় নাই। তারে আবার মন্দদিকে টানোছ ক্যা?”
“মন্দ দিকে টানিনি। চাচার পরাজয়ের নিমিত্তে প্রতিহিংসা আছে তার। সেসব বাদ দেন। তাদের ব্যাপার। আমি যেটা বলছি, আপনি এতো কাজ একসাথে নিবেন না। রাস্তা বড় করছেন, বাজারটাও বড় দরকার। মানুষের সমাগম বাড়বে। বাজারের দোকানপাট ভেঙে তো এমনিতেই ছোট হয়ে গেছে। বালুর চড়ের আরও কিছু অংশ ছাড়েন বাজারের জন্য। বড় না হলে চলবেই না। প্রজেক্ট করার পরে দেখবেন সমস্যা হয়ে গেছে। রাস্তা শেষ করেই বাজারের সীমা নির্ধারণ করেন আগে। তারপর প্রজেক্টের পার্টি ডাকবেন।”
কথা মন্দ বলেনি ছেলে। যেন একটু ভাবতেই বসে গেলো আফজাল হোসেন। ইফতেখার বললো,
“আরো কিছু বলবেন? নয়তো আমি উঠতাম।”
“বিপু ফিরে নাই। না?”
“না।”
“যা। দেহিস কই কই ঘুরে। কান ধইরা বাড়িত পাঠাইস।”
ইফতেখার বসা হতে উঠতে দেরি, আঘাতপ্রাপ্ত পায়ে হালকা ভরে হাঁটতে হাঁটতে খালিদ এসে দরজায় হাজির। ছুটে এসে হাঁপিয়ে গেছে যেন। ইফতেখার দাঁড়িয়ে গেছে আর সামনে না এগিয়ে। তার অবস্থা দেখছে নিশ্চুপে। আফজাল হোসেন বলে,
“কি রে? তুই এম্নে হাঁটোছ ক্যা?”
“পায়ে গরু গুতা দিছে দুপুরে। আমার কথা বাদ রাখেন। আপনারে ফোন দিতাছি, ধরতাছেন না।”
“মসজিদে যাওয়ার সময় বন্ধ করছিলাম।”
“বিপুর পিছনে লোক লাগাইছিলাম, মামা। এইমাত্র ফোন দিলো, হেয় মেয়েটারে নিয়া ভাইজ্ঞা যাইতাছে নাকি!”
“কি কছ!”
“হো। সাত্তারগো বাড়িত এক মেয়েলোক আইছে। তারে নিয়া ভাগছে। দূরে যায় নাই। দিপু, জলদি আয়। হাতে নাতে ধরতে হইবো।”
ইফতেখারের ঠোঁটের চাপে আর নিশ্বাসে সমানতালে বিরক্তি ভাসে আবারও। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে! তার যেন রেহাই নেই! আফজাল হোসেনের আদেশে খালিদকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে মোটরসাইকেলে। পা ভেঙে হলেও যেন এই মুহুর্তে ধরে নিয়ে আসে ক্রুদ্ধ আফজাল হোসেনের নির্দেশ। কাজের মধ্যে কোনো বিরতি না থাকায় বিরক্ত হলেও ইফতেখারের মধ্যে এতো উত্তেজনা নেই। আদেশ মোতাবেক মোটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে মাত্র। খালিদ পিছু বসে বসে বিপুর পিছু লাগানো ছেলেটাকে ফোন করছে, তারা কোন পর্যন্ত গেছে তা ঠিকঠাক বলতে। বাজারের কাজী অফিসে যায়নি। অফিস থেকে কাজীর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এইমাত্র হাঁটতে শুরু করেছে মেয়েটাকে সাথে নিয়ে। পিছু বসে বসে উত্তেজিত গলায় বারবার ইফতেখারকে বলছে,
“জলদি যা, জলদি যা। বেশি দূর যায় নাই। রাস্তায়ই ধরমু। আজকা খবর আছে তাগো। কত্তবড় সাহস! চেয়ারম্যানের পোলা নিয়া ভাগে ওই মেয়ে!”
ইফতেখারের বিরক্ত লাগছে তার ঘ্যানঘ্যান। তবুও সহ্য করছে বড় ভাই বিধায়। ছোট হলে বোধহয় নামিয়েই দিতো হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য। বাজার অতিক্রম করে একটু এগোতেই তাদের ধরে ফেলে দুজনে। সত্যিই পালিয়েছে বিপু শ্রাবণকে নিয়ে। হুট করে এসে মোটরসাইকেল থামতেই চমকে উঠে দুজনে! ক্রুদ্ধ খালিদ ভাই নেমেই কলার মুঠোয় ধরে বিপুর৷ শ্রাবণ বড্ড ভয় পেয়ে যায়! বিপুর চোখেমুখেও ভয়। ইফতেখারও নেমেছে মোটরসাইকেল ছেড়ে। বিপুর হাতের কাগজ টেনে নেয় সে। দুটি জন্ম সনদ কার্ড প্যাচিয়ে নেওয়া হাতে। তা খুলেই থমথমে চোখে একবার বিপুর দিকে আরেকবার শ্রাবণের দিকে তাকায় ইফতেখার। ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে ওড়নায় মুখ চেপে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ। এ কি হলো!

[পোস্টের রিচ তো মাশাআল্লাহ। কিন্তু একটা রিয়েক্টেও সাইলেন্ট রিডার্সদের এতো কৃপণতা কেন? আমিও কিন্তু গল্প দিতে তবে কার্পণ্য করতে শুরু করবো…😒]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here