শ্রাবণধারা” পর্ব- ১৩ (নূর নাফিসা

0
112

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
হেলেনা পাগলী চলে যেতেই নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে শ্রাবণ। ইফতেখার আবার তার হাত থেকে ছোলা নিয়ে খেতে মনযোগ দেয়। শ্রাবণ হেসে নেয় ইচ্ছেমতো। মন্দ লাগছে না তার হাসি দেখতে ও শুনতে। শ্রাবণ হাসি থামিয়ে বলে,
“আপনি এটা কোনো কাজ করলেন?”
“কি?”
“কাউকেই দাওয়াত করলেন না। আমাকেও তো দাওয়াত করতে পারতেন।”
“তোমাকে তো দাওয়াত করেই এনেছি।”
“ওটা তো বিপু ভাই করলো। আপনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাওয়াত পত্রে।”
“আমিই লিখেছি।”
“আমি তো দেখিনি লিখতে।”
“তোমার সামনে বসে লেখা উচিত ছিলো?”
“নিজের নামটাও লিখতে পারতেন। সে যাইহোক, পাগল তো মিষ্টি পেলো। আমি তা-ও পাইনি। কেমন বিয়ে করলেন আপনি, বুঝলামই না। কাজী বাড়িতেই মিষ্টি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো আপনার।”
মৃদু হাসির রেখা ভাসে ইফতেখারের ঠোঁটে। শ্রাবণের চোখে এলিয়ে রাখা দৃষ্টিদ্বয়ও যেন হাসতে চায় ঠোঁটের সাথে তাল মিলিয়ে। জিজ্ঞেস করে,
“মিষ্টি খাবে?”
“এখন কেন? সময় চলে গেছে। খবর পুরাতন হয়ে গেছে।”
“তবে ছোলা খাও।”
“খাচ্ছি তো।”
একটু থেমে শ্রাবণ বলে,
“বিপু ভাইয়ের জন্য কিছু করতে হবে আপনাকে।”
“কি?”
“বিপু ভাই আপনার জন্য যা করলো।”
“আমার সামনে তো কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিপুর ব্যাপার দেখতে গেলে অনেক বাঁধা আসবে।”
“তাই বলে কিছু করবেন না?”
“ফাঁকে তালে একদিন নিয়ে চলে আসবে সে-ও, সমস্যা কি?”
খোসা ছাড়ানো হাতের ছোলা ইফতেখারের হাতে দিতে দিতে শ্রবণ প্রত্যুত্তর করে,
“কেমন খাপছাড়া কথা আপনার। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে।”
“ওটা তো আমি হ্যান্ডেল করতে পারবো না। বিপু যখন নিয়ে চলে আসবে, তখন না হয় আমি তার সাপোর্টার হয়ে আব্বা আম্মার সামনে দাঁড়ালাম।”
“বিপু ভাই-ই কিন্তু আমাকে নিয়ে বের হয়েছিলো আপনি পর্যন্ত পৌঁছাতে।”
“তুমি যত সহজে এসে গেছো, কান্তা পারবে না।”
“তাইতো বলছি, আপনি কিছু করুন।”
“আর সব আমার ঘাড়ে কেন চাপাতে চাইছো?”
“আরে, আপনি বড় ভাই। তো আপনি করবেন না তো কে করবে? দুইটা ফ্যামিলিকে আগে থেকেই ম্যানেজ করুন, যাতে পরবর্তীতেও সমস্যা জর্জরিত না থাকে।”
“ফ্যামিলি ম্যানেজ কখনোই হবে না। দুরাশা বাদ দাও।”
“হবে না কেন?”
“বললাম না সেদিনই, সমশ্রেণীর না হলে আব্বা মানবেন না। তুমি দূরের বলে আব্বা চুপ আছে, কান্তা তো বাড়ির মেয়ে। তার সম্পর্কে জানতে আর বাকি থাকবে কে? উঠতে বসতে আব্বাকে মানহানিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।”
“তাহলে?”
“আসতে হলে পালিয়েই আসতে হবে। তাতেও খুব একটা লাভ হবে কি না, কোনো নিশ্চয়তা নেই। একে তো আব্বার মানহানির ব্যাপার। অন্যথায় কান্তার বাবাচাচাও চেয়ারম্যান বাড়িকে দেখতে পারেন না। বাড়ি এসেই দেখা যাবে হট্টগোল শুরু করবে।”
“দেখতে পারে না কেন?”
“কি আর। জমিজমা নিয়েই বিরোধ আছে। পাশাপাশি বাড়ি যখন।”
“পাশাপাশি কোথায় হলো? আপনাদের দুই বাড়ির মাঝখানেও তো আরো দুইটা বাড়ি আছে।”
“অন্যদিকের জমিজমা থাকতে পারে না? আর আমি সঠিক জানি না। সবসময় এমনই দেখে আসছি। হতে পারে এই দাদা, পাশের বাড়ির দাদা, তারপর ওই দাদা এমন করেই কোনো বিরোধ ছিল। যা ছেলেদের মধ্যেও জেগে আছে।”
“তারপর আবার উনাদের ছেলেদের মধ্যেও আছে। তাই না?”
“কই, না তো। বরং আরও যোগসূত্র দেখা গেলো বিপুর আর কান্তার।”
“কান্তার ভাইকে নাকি মেরেছেন খুব, শুনলাম।”
“ওইটা বিপুর সাথে চলতে ফিরতে লাগালাগি হয়েছে। তেমন কিছু না।”
“ইচ্ছেমতোই নাকি মেরেছেন।”
শ্রাবণ যেন জোরপূর্বকই একটু মন্দাকর দিকে ঠেলতে চাইছে চেয়ারম্যান পুত্রদ্বয়কে। ইফতেখার তার ভাবভঙ্গিতে লক্ষ্য করে বলে,
“কে বলেছে? কান্তা?”
“কান্তা বলতে যাবে কোন দুঃখে! আমি এসে খবরাখবর পেয়েছি না কিছু।”
“এখন তো তোমাকেই আমার রহস্যময়ী কিছু মনে হচ্ছে।”
“আমি আবার রহস্যময়ী হয়ে উঠার কি করলাম?”
“এই যে, খবরাখবর খুব রাখা হয়েছে।”
“বা রে! একটা জায়গায় থাকবো, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে থাকবো না?”
“হুট করে বিয়ে করাটাও তো একটা রহস্য হতে পারে।”
“আপনিও তো করেছেন তা-ই।”
“আমি তো এতো ভেবে কোনো কাজ করি না। ইচ্ছে করলে করে ফেলি যে কোনো কিছুই।”
“আমাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করলে তা-ও করে ফেলবেন?”
মুখের নড়চড় এবং দৃষ্টির হাতড়ানো উভয়ই থেমে যায় ইফতেখারের। অল্পক্ষণের একটা মুহুর্ত জবাব পাওয়ার প্রত্যাশায় তার মুখাবয়বে তাকিয়ে থেকে হাসির মাধ্যমে কথার রেশটা সরিয়ে দেয় শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“কঠিন প্রশ্ন করে ফেললাম? আচ্ছা থাক। তবে আমার ক্ষেত্রেও তো তেমনটাই ভাবতে পারেন। হুট করেই ইচ্ছে হলো বিয়ে করতে, তাই বেরিয়ে পড়েছি।”
“তুমি এমন নও।”
“কেন?”
“তুমি ভেবে ভেবে কাজ করো।”
“কেমন?”
“এই যেমন আমার ইচ্ছে হলো হঠাৎ প্রেম করতে, প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু তুমি ভেবে তা প্রত্যাখ্যান করলে।”
“তা-ও ঠিক।”
“ঠিক যদি হয়, তবে বিয়ে কেন করলে?”
“আপনি ভালো মানুষ যে, তাই।”
“তুমি তো আমায় কাছ থেকে দেখোনি কখনো। দূর থেকে ভালো মন্দ বিবেচনা করা যায় না।”
“আপনি যদি এক পলকে দেখে নিজের জিনিস চিনতে পারেন, তবে আমি কেন ভালো মন্দ দেখতে পারবো না?”
“আমি তো নিজের পছন্দটাকে চিনেছি। তুমি ভালো, না মন্দ তা তো বিবেচনা করিনি।”
“তাই? ঠিক আছে। তবে মানছি, আমারও বিয়েতে হুট করে রাজি হয়ে যাওয়ার কারণ আছে।”
“কি?”
“গায়ে থুতু পড়ার পরও যে লোক অপরিচিতের কাছে কৈফিয়ত পর্যন্ত চায় না, ফিরে তাকায় না পর্যন্ত। তাকে অনায়াসেই বিয়ে করা যায়। ওয়ান অফ পারফেক্ট ম্যান।”
ভ্রু হালকা কুচকে আসে ইফতেখারের। মনে পড়ে কিছুদিন আগের বাজারের ঘটনা। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না, তাই মনে পড়তেও দেরি হয়নি সেই একদিনকে। জিজ্ঞেস করে,
“রিকশায় বসে তুমি থুতু ফেলেছো?”
ছোলা মুখে এঁটে নিঃশব্দে হেসে উঠে শ্রাবণ। জবাব পাওয়া হয়ে যায় ইফতেখারের। কিন্তু চোখ ফেরাতে দেরি হয়। অক্ষিগোলকের প্রেমের বর্ষন কাটে না তার। যেন বেড়েই উঠছে দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে। রূপ নাকি মায়া ছন্দ, কোনটা তাকে বেশি টানে বুঝতে পারে না ঠিক। কিন্তু মুগ্ধতার পরশ থৈথৈ করতে থাকে ঠিকবেঠিক। দেখতেই থাকে শ্রাবণের হাসি এবং হাসির ছন্দাকে। শ্রাবণ দিনের শ্রাবণ ছন্দা। অবশিষ্ট ছোলার প্যাকেট ইফতেখারের পকেটে রেখে দেয় শ্রাবণ। অনেক্ক্ষণ হয়েছে এসেছে, বাড়ি যেতে চায় এবার। যাওয়ার সময় আরেকদিন ফুসকা খাওয়াতে নিয়ে আসতে বললো ইফতেখারকে। পরী এবং অর্পাকে সহ। তখন খাওয়ার সময় অর্পা আর পরীকে মনে পড়ছিলো তার। তারা এলেও হয়তো আরও ভালো জমতো খাওয়ার আসরটা।
তবে পরবর্তী দুপুরটা ভালো জমে গেছে। সকালে নাশতা করে বিপু বাইরে ঘুরাঘুরি করে এলো। প্রাক দুপুরে বাড়ি ফিরতেই দেখে তার অপেক্ষায় বসে আছে অর্পা, পরী। সকালে বকুল কাকা গরুর ঘাস কেটে আনলে শাপলা ফুল এসেছিলো ঘাসের সাথে। পরী তা নিয়ে অর্পার সামনে আসতেই তার আগ্রহ বেড়ে যায় শাপলা কুড়াতে। বিপু ভাইকে ধরে বসবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাজেই, বাড়ি ফিরতে না ফিরতে তাকে ঘিরে ধরেছে। বিপু মুক্তি নেওয়ার উদ্দেশ্যে বারবার বলছিলো বকুল কাকাকে নিয়ে যেতে। তাদের এক কথা, বিপুর সাথেই যাবে। পারভীন ক্রমশই বিরক্ত হচ্ছিলো তাদের কর্মকাণ্ডে। কিছুক্ষণ বকলো নিজের মেয়েকে, যে কি না পড়াশোনা বাদ দিয়ে শাপলা বিল নিয়ে পড়ে আছে! কিছুক্ষণ বকলো পরীকে। মাথায় উস্কানি দেওয়ার মূল এই পরী। শ্রাবণ তাদের সমর্থন করে বিপুকে বললো,
“এতো করে বলছে যখন নিয়ে গেলেই তো হয়, বিপু ভাই। বোনেরা এমন আবদার কি সবসময় করে? শখের সময়ও সবসময় থাকে না।”
“আপনিও যাবেন?”
“উহুম। তারা শখ করছে, তাদেরকে নিয়ে যান।”
“এই, আয়। আয়!”
খানিক বিরক্তি নিয়ে বের হয় বিপু। শর্ত একটাই। দশ মিনিটের বেশি রাখবে না। বকুল কাকার কাছ থেকে বৈঠা নেয় তাদের ছোট নৌকার। নেমে যায় বাড়ি হতে ঢালুতে। দুইটা ক্ষেতের পর থেকে বর্ষার পানি। এখানেই বেঁধে রাখা নৌকাটি। ঘাস কাটা হয় বিধায় ছড়ানো ছিটানো ঘাসে লেপ্টে আছে নৌকার পুরোটাই। পরীর কাছে দাঁড়িয়ে সে বৈঠা দেখিয়ে হুমকি দিয়ে বলে,
“পরিষ্কার কর। একটা ঘাসও যেন না থাকে।”
“আইয়া তো গোসলই করবেন। এত্ত পরিষ্কার গিরির কি দরকার?”
“চোখে দেখোছ না, কি অবস্থা? এই অপরিষ্কার নৌকায় আমি যাবোই না। যেতে হলে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কর।”
অর্পাও ঠেলে দেয় পরীকে।
“ওফ্ফ! যা তো। আমিও বসতে পারবো না এভাবে।”
“সুন্দর কইরা কন। ভাবি কি শিখায় দিছে, মনে নাই?”
“হু, যাও যাও। আসছে ভাবিওয়ালী!”
পরী উঠে ঝটপট পরিষ্কার করতে লেগে যায়। বিপু বৈঠায় ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। হুকুম করে একটা পর্যন্ত ঘাস উপচে ফেলার। কাজ অনেকটা হয়ে এলে অর্পাকে বলে,
“ভাবিকেও ডেকে নিয়ে আয়, অর্পা।”
“ভাবি যাবে না।”
“তুই ডাকতে কি সমস্যা?”
“আবার এতোখানি হেঁটে বাড়ি যাবো!”
“হাঁটবি না যখন, উড়ে যা।”
বিপু বিরক্তিকর গলায় প্রত্যুত্তর করলে অর্পা হনহন পায়ে আবার বাড়ি আসে৷ শ্রাবণ হাতের মুঠোয় গম ছিটাচ্ছিলো উঠুনে। মুরগি, কবুতর একত্রে লেগে পড়েছে। অল্প অল্প ছিটিয়ে ফেলতে ভালোই লাগছিলো তার। অর্পা এসে বলে,
“ভাবি, চলো ঘুরতে গেলে।”
“এখনো যাওনি?”
“হ্যাঁ। যাবো। আসো, মজা হবে।”
“তোমরা যাও।”
“আরে আসো তো। এখন না গেলে আবার পাঠাবে বিপু ভাইয়া।”
“আম্মা রাগ করবে শুনলে।”
“চুপিচুপি চলে আসো।”
ঘর থেকে পারভীনের গলা আসে অর্পার জন্য।
“বেশি টইটই করতাছোস। পড়তে বইলে জ্বর ধরে, ঘুরতে গেলে ধরে না। সাঁতার কিন্তু জানোস না ঠিকমতো।”
“তাইতো ভাইয়ার সাথে যাই। ও ভাবি, তাড়াতাড়ি আসো।”
শ্রাবণের উদ্দেশ্যে কিছু বললো না, তাই শ্রাবণও আর দমে রইলো না। যাওয়া যাক শাপলা বিল দেখতে। যাওয়া হয়নি এদিকে কখনো। ছোট নৌকা। চারজনে পরিপূর্ণ। বৈঠা হাতে বিপু বসেছে এক পাশে। তাদের তিনজনকে বলেছে মাঝখানে বসতে। পড়ে টরে গেলে সে একদম ধরবে না। পাটাতনে দুজন আরাম করে বসে গেলেও শ্রাবণ বিপরীত প্রান্তের কোণে বসেছে। তার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। সাঁতার জানা আছে। পরীও ভালো সাঁতার জানে। নৌকার কোণে বসা তার অভ্যাসও বটে। তবে ভাবির জন্য ছেড়ে দিয়েছে জায়গাটা। স্থল হতে সামনের দিকটা উঁচু হওয়ায় পানি কম। লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে বিপুকে যেতে হয়েছে কিছুক্ষণ। পানির গভীরতা ছুঁয়ে নিলেই আরামে বৈঠা চালাতে বসতে পেরেছে। এদিকে লতাঘাসের যানজটও কম। স্বচ্ছ পানিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ভাসছে। পরী আর অর্পা ঝুঁকে মাঝে মাঝে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছে। কথা বলছে, হাসছে। শাপলা ছুঁয়ে দেখার প্রত্যাশায় উত্তেজিত হয়ে আছে। মেঘ না ডাকলেও আকাশ গুমোট হয়ে আছে। রোদের দেখা না পাওয়া গেলেও দিনটা ঝরঝরে লাগছে। মোটকথা এই দুপুরে বাইরে বের হওয়ার মতোই একটা মনোরম পরিবেশ। বাতাস বইছে মাঝারি বেগে। অনুকূল যাত্রা হওয়ায় বিপুর কষ্ট লাঘব হচ্ছে। একটু বৈঠার বেগে চললে নৌকা আরেকটু এগিয়ে যাচ্ছে বাতাসের বেগে। ফেরার সময় কষ্ট বাড়বে নিশ্চিত। বিপু আবারও সাবধান করে দিচ্ছে অর্পা ও পরীকে।
“এই যে বারবার নড়ছিস, যদি খালি পড়বি। এই আমি বিপু একটাকেও ধরবো না। এই জায়গায় দুই পুরুষের দাঁড়ানো সম্ভব না।”
পরী পাজি সাথে সাথে তর্ক জুড়ে,
“এহ! ভাইজানের কথা! ওইযে, পানির নিচে মাটি দেহা যায়। এত্ত বলদ ভাইব্বেন না।”
“নাম দেখি।”
“এহন নামমু ক্যা অহেতুক?”
“কথাটা বাড়াস ক্যা অহেতুক!”
মাইর দেওয়ার ভঙ্গিতে বৈঠা তুলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নেয় বিপু। শ্রাবণ দুহাত দুইদিকে বাড়িয়ে পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে চলন্ত নৌকায়। তাদের কথাবার্তা শুনে হাসছেও। বাতাস এসে বারবার মাথার আঁচল ফেলে দিচ্ছে। আবার তুলছে সে। বিপু বৈঠার হাল ধরতে ধরতে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি সাঁতার জানেন?”
“হুম।”
“এখান থেকে বাড়ি ফিরতে পারবেন?”
বাড়ির দিকে দূরত্ব দেখে শ্রাবণ। পরক্ষণে প্রত্যুত্তর করে,
“পারবো। কিছু দূর গেলেই তো হাঁটতে নাগাল পাওয়া যাবে।”
“ঠিক আছে। যাওয়ার সময় নৌকা ডুবিয়ে দেখবো কার দম কতদূর।”
অর্পা চেঁচিয়ে উঠে,
“না…! আমি মরেই যাবো!”
“তুই মরবি জানলে এলি কেন?”
“আমি তো নৌকায় এসেছি। সাঁতার কাটতে আসিনি।”
“শখ যখন, ডুবে ডুবে শাপলা তুলবি।”
“না ভাই, না।”
শ্রাবণ হাসিমুখে প্রত্যুত্তর করে,
“তাইতো আপনাকে সাথে নিয়ে এলো।”
অর্পা সহমত হয়।
“ঠিক, ঠিক। তাইতো তোমাকে নিয়ে এসেছি। তুমিই তুলবে ডুবে ডুবে। ভাইয়া, শাপলা! শাপলা! ওইদিকে যাও।”
শ্রাবণ পিছু ঘাড় ঘুরিয়ে অর্পার ইশারা করা দিকে তাকায়। মুগ্ধ হয় শাপলা বিলের প্রতি! যতদূর চোখ যাচ্ছে, বড় বড় গোল পাতায় আচ্ছন্ন বিল দেখা যাচ্ছে। এ যেন শাপলা পাতার চাদর বিছিয়ে আছে জলবিছানার উপর। যদি ফুলগুলো ফুটে থাকতো, নির্ঘাত এই বিলকে পুষ্পরাজ্য মনে হতো। কিন্তু দুপুরের সময় তাদের লজ্জাবরণের সময়। এই প্রহরে তারা নিজের সৌন্দর্যের কপাট গুটিয়ে বিশ্রাম নেয়। সৌন্দর্য বর্ধন করতে ফুটে থাকে সকাল, সন্ধ্যা। শ্রাবণ ঘুরে বসে যায় নৌকার কোণে। এইতো, নৌকাটা একটু এগিয়ে গেলেই শাপলা ছোঁয়া যাবে। অর্পার আফসোস হয়, শ্রাবণের জায়গায় সে নেই বলে। কোণে থেকে ভাবি আগে ছুঁতে পারবে শাপলা। মনের উত্তেজনা বেড়ে আসছে তার। উঠার জন্য হালকা নড়েও উঠে,
“ভাবি, আমি তোমার কাছে আসি?”
“আসবে?”
বিপু সাথে সাথেই নিষেধাজ্ঞা অর্পন করে,
“একদম না। একদিকে ভার হলে নৌকা ডুবে যাবে।”
“এইপাশে তুমি আছো না!”
“আমি হ্যাংলা পাতলা একজন মানুষ তোদের দু-তিন জনের ব্যালেন্স ক্যামনে ধরি একা! চুপ করে বস।”
গলায় আফসোসের কান্না ভঙ্গি ঠাঁই পায় অর্পার।
“আ… আহা…। আমি শাপলা নিতে পারবো না তবে।”
“নৌকা ভেতরে গেলে সবাই-ই নিতে পারবি। চুপ করে বস।”
পরী চেঁচায়,
“ভাইজান, ওদিক দিয়া যান। ওদিক দিয়া অনেকগুলা।”
“পরী, দেখতো এইবার মাটি দেখা যায় কি না?”
পরী উঁকিঝুঁকি দেয়। পানিতে ভাসমান আকাশ ব্যতীত কিছুই দেখা যায় না। বিপুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায় তাই। বিপু বলে,
“এই জায়গায় তোর সাত পুরুষের নাগাল আসবে না।”
“এতো গভীর?”
বিপুর বিরুদ্ধে মুখে প্রশ্ন জুড়লেও শ্রাবণের দৃষ্টি মনযোগে গেঁথে থাকে প্রথম ছুঁয়ে যাওয়া শাপলাটার দিকে। নাগাল পেতেই প্রশ্ন করতে করতে বাহারি কপাট বন্ধ রাখা শাপলা মুঠোয় ধরে ফেলে সে। বিপু তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে,
“শাপলা উঠিয়ে দেখেন কতটা গভীরতা।”
বৈঠার জোরেশোরে ধাক্কায় পানির স্বচ্ছতা কাটিয়ে বিস্তৃত শাপলা বনে ঠাঁই নেয় তাদের নৌকা। শ্রাবণের হাতের শাপলা নীড় ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। সে পুরোটা শাপলা নৌকায় তুলে আনে। সাত পুরুষের সমান না হলেও দুই পুরুষের উপরে হবে তার দৈর্ঘ্য! শ্রাবণ নৌকায় এলিয়ে দেয় শাপলার পুরো অস্তিত্ব। তরতাজা পুরুত্বের টসটসে শাপলা। এর রুপে মুগ্ধ হয় শ্রাবণ। চোখ রাখে পরবর্তী একটা ধরার। এদিকে নৌকা হেলেদুলে উঠছে মধ্যস্থানের দুইয়ের কর্মকাণ্ডে। দুদিকে দুজন ঝুঁকে যাচ্ছে আপ্লুত হয়ে। শাপলা টেনে তোলা চাই তাদের। বিপুর ধমক কোনো কাজেই আসছে না। শ্রাবণ ধীরেসুস্থেই একটা দুইটা তুলছে আর তাদের দেখে হাসছে। বিপু সাবধান করে,
“সাবধানে। শাপলা মনে করে আবার সাপের মাথা টেনে তুলিস না।”

[প্রতিটি পর্বের কমেন্ট বক্সে আগের পর্বের লিংক দেওয়া থাকে। পেজেও ধারাবাহিকভাবে পোস্ট করা। তবুও খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগ!😒]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here