শ্রাবণধারা” পর্ব- ১৫ (নূর নাফিসা)

0
94

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
চেয়ারম্যান বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষেই উত্তরে কবরস্থান লক্ষ্যনীয়। এটি চেয়ারম্যানেরই সম্পদ। তাদের পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে বাড়ি থেকে আলাদা করেছেন এটিকে। রাস্তায় উত্তরে চলতে গেলেই চোখে পড়ার মতো। শ্রাবণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই স্থানটায় থেমেছে। মনযোগে তাকিয়েছে কবরস্থানের তিন ফুট উচ্চতার বাউন্ডারির ভেতরে। পুরনো দু-তিনটা কবর লক্ষ্যনীয়। বেশিও হতে পারে। ঠিক স্পষ্ট না যদিও। চোখের দেখায় ধারণ করা যায় মাত্র। শ্রাবণ হালকা করে ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে সালাম প্রদান করে কবরবাসীদের। যেখানেই কবর চোখে পড়ুক না কেন, সালাম দেওয়াটা তার অভ্যাসে ধারণ করে নিয়েছে। মনে মনে শান্তিকামী দোয়া করে। যদি তার মৃত্যু এখানে হয়, দেহটা হয়তো এখানেই দাফন হয়ে যাবে। চেয়ারম্যান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানের সদস্য বাড়বে। তখন পথে হাঁটতে গিয়ে কোনো পথিক তার জন্যও দোয়া করবে তো? হৃদমহলে নিরুত্তর প্রশ্ন জাগিয়ে হেঁটে যায় মজিদার কাছে। বেলা হেলে গেছে। সন্ধ্যা নামাতে প্রকৃতির যত আঁধার প্রত্যাশিত আচরণ। একা ঘরের বাসিন্দা মজিদা উঠুন হতে কাপড়চোপড় গুটিয়ে নিচ্ছে। বৃষ্টি বাদলার দিনে কাপড়চোপড়ও শুকায় না ঠিক মতো। সুবিধা দেখলেই ছুটে আসে মেলে দিতে, আবার সেই মেঘের গর্জনে ছুটে নিয়ে যেতে হয় ঘরে। বিনা পারিশ্রমিকের চাকরি যেন কাপড় ঘরে বাইরে মেলা। শ্রাবণকে দেখতেই মজিদা উঠুনে থামে। শ্রাবণ হাসিমুখে এগিয়ে আসে। সালাম দেয়। কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। মজিদা উত্তর দিলেও হাসিটা ঠিক ফুটে উঠেনি তার মুখে। ঘরে যেতে যেতে বললো,
“কি কামডা করলি বুড়ি। তোর কাছে এরুম কিছু আশা করি নাই।”
“আমার ভবিষ্যৎ তো ভাসতে ভাসতে চলছিলো, খালাম্মা। একটা স্থির ব্যবস্থা হওয়াতে কি আপনি খুশি হননি?”
“হেল্লাইগা শেষ মেষ চেয়ারম্যানের পোলার হাত ধরলি!”
“কি জানি, কেন আমার চোখে চেয়ারম্যানের ছেলেটাকেই ভালো লেগে গেলো। আর যা-ই বলেন, খালাম্মা। মানুষটা ভালোই। আমার খুব খেয়াল রাখে। দেখতেও তো সুন্দর। ঠকেছি বলে মনে হয় না। কি বলেন?”
“জানি না, তোগো বয়সের চোখ কিরুম ভালার খোঁজ রাখে। দেখতে সুন্দর হইলেই তো মানুষজন মানুষ হয় না। আমার মাইজ্জা মাইয়াডারে ডকডাক পোলা দেইখ্যা দিলাম বিয়া, হেই জামাই হইলো জুয়াখোর। আল্লাহর রহমতে জুয়াজারি কমছে বছর দুইতিন পরে, কিন্তু সিগারেট খাওয়াডা মাইয়া আমার যুদ্ধ কইরাও ছাড়াইতে পারে নাই।”
“আমার উনি তো এসব কিছুতেই নেই।”
“মারামারি খুব পারে হেই বাড়ির দুই পোলাই। আর তোর কাছে ভালা হইলে ভালাই।”
পরক্ষণে কণ্ঠ ফিসফিসে করে মজিদা জিজ্ঞেস করে,
“হের বাপ মায় তোরে গালিগালাজ করে নাই তো?”
“না তো।”
“এত্তো সোজা কইরাই মাইন্যা লইলো চেয়ারম্যান? আগেই জানাইছিলো নি?”
“না, না। জানায়নি কিছুই। একটু মন খারাপ তো হয়েছেই, ছেলে না জানিয়ে বিয়ে করেছে। তা-ও আবার একটা অচেনা, অপরিচিত মেয়েকে। অন্যথায় আর কোনো ঝামেলা টামেলা হয়নি।”
শ্রাবণ নিজের কাপড়চোপড় গুছাতে গুছাতে বললো,
“এইতো সেদিন গেলাম, অথচ কত দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছে। ভাবলাম কাপড়চোপড়গুলো নিয়ে যাই, আপনার সাথেও দেখা করে যাই। আপনার রান্নাবান্না ঠিকঠাক চলছে তো?”
“ওই চলে আরকি। তোর কতা না একলাই একলাই কত কই। মাইয়াডা আছিলো, ঘরটা ভরা ভরা লাগছিলো।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“এইতো দূরে নেই, আপনার খুব কাছেই নিজের ঠিকানা হয়েছে। দেখতে ইচ্ছে হলেই যেতে পারবেন।”
“আমরা হেই বাড়িত যাই না।”
“কেন?”
“ঝগড়াঝাটি না, পূবের আমল থাইকাই।”
“কি নিয়ে ঝগড়া?”
“কত্ত কারণ। জমি নিয়া কত্ত কাড়াকাড়ি হইলো। বাড়ির সীমানা নিয়া কত্ত মারামারি হইলো। পোলাপান নিয়া লাঞ্চনা, ঝগড়া হইলো। কিছু কইলেই চেয়ারম্যানে, চেয়ারম্যানের বাপ চাচারা মারতে দৌড়ায় আইতো এই বাড়ি। পোলাগুলাও তো হেরামই হইবো। আর হেরা বড় মানুষ। ছোডগো মাড়াইয়া যাইতে পারলে তাগো ঘাড় সিধা। ক্ষমতার জোরে সবই করে।”
শ্রাবণ চুপ থাকে। আসলেই কিছু ক্ষমতাবান পাষাণ্ডের কাছে অসহায় মানুষগুলো ঠকে যায় প্রতিনিয়ত। তবে পৃথিবীতে এমনও বহু ক্ষমতাবান আছে, যারা অসহায়ের সহায় হয়ে পাশে দাঁড়ায়। হয়তোবা তাদের পরিমাণ পাষাণ্ডদের তুলনায় অতি সীমিত। ব্যাগের ভেতর পোশাকাদি আর বইপত্র নিয়ে শেষ করে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,
“কান্তা বাড়িতে নেই?”
মজিদা কিছুটা হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হো। মাইয়াডার বিয়াডা না ঠিক হই হই কইরাও ভাইঙা গেলো। গত সন্ধ্যা বেলা হেই বাড়িত্তে খবর আইলেই শিরিনের মনডা ভারি হইয়া যায়। একটা মাত্র মাইয়া নিয়া কত্ত আশা। চেহারাডাও তো ডকডাক। গায়ের রঙডা একটু শ্যামলা। ভালাভোলা একটা পোলা যদি আল্লাহ মিলায় দিতো ভদ্র মাইয়াডারে। দোয়া করিস।”
“হুম।”
শ্রাবণ পাঁচশো টাকা চেপে দেয় মজিদার হাতে।
“এটা রাখুন, খালাম্মা। এই মেয়েটাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি বড় কৃতজ্ঞ। আমার যদি অনেকটা সামর্থ্য থাকতো, তবে অনেকটাই দিয়ে যেতাম আপনাকে।”
“আরে, মাইয়া কি করে। কিছু লাগতো না। যা। দিছোত না। আর কত করে মানুষ। ভাঙা ঘরের আশ্রয় আর কি হয়। ধর।”
“না, রাখুন। দোয়া করবেন আমার জন্যও।”
“হো, ভালায় ভালায় সাবধানে থাহিস।”
“যাই তবে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
উঠুনে নেমে কান্তার উদ্দেশ্যে গলা ছাড়ে শ্রাবণ। দৌড়ে বেরিয়ে আসে কান্তা।
“আপু আসছো!”
ভারি উচ্ছ্বাস তার চোখেমুখে। শ্রাবণ ঠোঁটে হাসি রেখে রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। মজিদা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ চলতে চলতে ধীর গলায় বলে,
“কি অবস্থা তোমার?”
“আজকে অনেক খুশি আমি।”
“আচ্ছা?”
“ধন্যবাদ তোমাকে।”
“এতো খুশি হওয়ার দরকার নেই। ছোট ছোট বিষয়ে কম খুশি হওয়া ভালো।”
“আরে, বিষয় ছোট না৷ বড়। বড়। জানো? বিয়েটা শেষ।”
দাত চেপে নিচু স্বরে হাসে কান্তা। যেন পিছু না কেউ আন্দাজ করে। শ্রাবণের ঠোঁটের ধারে হাসির রেশ থাকলেও সে তাল মেলায় না তার হাসিতে। উপদেশমূলক বলে,
“এইটা শেষ মানেই শেষ নয়। যদি একান্তই ইচ্ছেটা ও বাড়ি পর্যন্ত গাঁথা থাকে, তবে তা-ই হবে বিয়ের শেষ। ঠিকাছে? পড়াশোনা করছো, মনযোগে করতে থাকো। ভাগ্যে কি আছে, কারোই তো জানা নেই। কিন্তু যত জানতে চাইছি, ব্যাপারটা যেন তত কঠিন হয়ে আসছে সামনে।”
“ইনশাআল্লাহ, তুমিই কিছু করতে পারবে। আমি জানি।”
“এতো নির্ভরশীল মানুষ আমি হতে চাই না, কান্তা। কারো মন ভাঙার কারণ হওয়াটা আমার জন্য নিতান্তই বড্ড কষ্টের। তবে আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করবো। দেখি, কিছু করতে পারি কি না। আসি, আমি। হুম?”
“আসবে তো মাঝে মাঝে?”
“ইনশাআল্লাহ, সুযোগ পেলেই আসবো দেখা করতে। কথা বলতে। আর হ্যাঁ, বিয়েটা ভাঙার ক্ষেত্রে আমার চেয়ে তোতাপাখির অবদান বেশি। আবার আমার জন্যও তো কতকিছু করলো সে। কিন্তু তোমার নামে নালিশ দিলো। সব দোষ নাকি তার উপর চাপাতে চাইছো।”
“দেক নালিশ।”
মিটিমিটি হাসে ভাবযোগে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি ভালো আছো তো ওই বাড়িতে?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আসি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি কম করো। বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো। পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, উল্টাপাল্টা কোনো ভাবনা যেন মাথায়ও না আসে।”
উপদেশ প্রদান করে চলে আসে শ্রাবণ। চেয়ারম্যান বাড়ির গেইট ছুঁতে না ছুঁতেই মাগরিবের আজান পড়ে। আফজাল হোসেন টুপি মাথায় মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন। শ্রাবণ তার সামনে পড়তেই মাথার ঘোমটাটা আরেকটু সামনে টেনে সালাম দেয়। তিনি সালামের জবাব দিয়ে মুখে এবং হাতের ব্যাগে দৃষ্টি স্থির করেন। পরক্ষণে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান। উঠুন হতে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে পরী। জিজ্ঞেস করে,
“ভাবিজান, কই গেছিলেন?”
“এইতো, পোশাকাশাক নিয়ে এলাম।”
“আমারে কইতেন, লগে যাইতাম।”
“তুমি গিয়ে কি করতে?”
“ইট্টু ঘুইরাও আইতাম, লগে কাপড়চোপড় নিয়া আইতাম।”
“থাক, এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি বেশি দূরে যাইনি।”
“সাত্তার কাকাগো বাড়িত গেলেন না? চিনি।”
“আচ্ছা।”
ঘরে এসে ব্যাগ রাখে শ্রাবণ। মাগরিবের নামাজটাও আদায় করে নেয়। কিছুক্ষণ খাটে বসে থাকে এমনি এমনি। পাশেই অর্পা পড়ছে চেয়ার টেবিলে। তার দিকেও একটু নজর রাখছে। মেয়েটা পড়ে কম, ঝিমায় বেশি। পড়তে বসে একশো একটা হাই তুলে যাচ্ছে। পরীক্ষার প্যারায় যেন ঠেলে ধাক্কিয়ে পড়ছে। পরী এসে চা দিয়ে গেলো দুজনকেই। পারভীন একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছে মেয়ে পড়ে কি না। শিক্ষক এসে প্রত্যেক দিনই কেবল নালিশ দিতে থাকে। তার পড়া হচ্ছে না। একদিনও পরিপূর্ণ পড়া দিতে পারছে না। তিনি শ্রাবণের দিকেও তাকিয়েছেন। শ্রাবণ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আম্মা, কিছু করতে হবে?”
নিরুত্তর চলে গেছেন পারভীন। আবার ফিরেছেন মিনিট দুই পরেই। শ্রাবণের কাছে এসে বসেছেন। হাতে এক জোড়া নতুন সিটি গোল্ডের চুরি। শ্রাবণ হাতের কাপ রেখে দিয়েছে তিনি পাশে বসার পরপরই। তাকিয়েছে চুরির দিকে। হাত টেনে এনে পারভীন চুরি দুটো দুই হাতে ঠেলে দিতে দিতে বললো,
“বউবেডি গো হাত খালি রাখলে সুন্দর দেখায় না। চুড়ি আর নাকের ফুল না থাকলে বেরাইম্মা লাগে। নাকই তো ফুডাও নাই। ফুল দেই ক্যামনে? চুড়ি হাতে রাইখো সবসময়।”
“জ্বি।”
চুড়ি মাপমতোই হয়েছে। হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা দেখে যেন সন্তুষ্ট হলো পারভীন। মাঝে মাঝে বাড়িতে এক মহিলা আসে মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী আর গহনাগাঁটি নিয়ে। পারভীন বাজারে খুব একটা যায় না তাই, চুড়ি কিনতে হলে কিছুদিন পরপর তার কাছ থেকে কিনে নেয়। আরেক পরী তো আছেই৷ মহিলাকে দেখলেই পারভীনের আঁচল ধরে, “আম্মা, কানের দুল কিন্না দেন।”, “আম্মা, একটা কাজল কিন্না দেন।”, ” আম্মা, একটা আতর কিন্না দেন”। পারভীন মুখটা গম্ভীর রাখলেও এই ছোটখাটো আবদার মেটাতে কার্পন্য করে না। মাঝে মাঝে অর্পাও চায় টুকটাক। তার কানে সোনার দুল থাকায় তা চায় না ঠিক, তবে প্রায়ই লিপস্টিক আর ব্রেসলেট নেয় সে। আজ বিকেলে মহিলাটি এলেই আবার ঝেকে ধরেছিলো পরী। মনে করে শ্রাবণের জন্য চুড়ি জোড়াও নিয়ে নিলেন তিনি। পারভীন উঠে যাওয়ার আগে আরও বললেন,
“তোমার শ্বশুর তোমারে বাইরে যাইতে নিষেধ করছে। নামাজের পরে ঘরে আইসাই বলতাছে, বউ বাইরে যায় ক্যা? আমি তো তোমারে পাঠাই নাই কোনো কাজে। আগের জীবন ভুলে এইসব ঘুরাঘুরি বাদ দেও। এখন তুমি বাড়ির বউ। আর এইডা চেয়ারম্যান বাড়ি।”
“আমি জামাকাপড়গুলোই আনতে গিয়েছিলাম, আম্মা। আপনার ছেলের কাছে বলেই গিয়েছিলাম।”
“আর যাইয়ো না।”
চলে গেছে পারভীন। হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি শ্রাবণ। তাকে আরও যেতে হবে হয়তো কত প্রয়োজনেই। সে আপাতত মনযোগ দেয় সিটি গোল্ডের চুড়িতে। ভালোই দেখাচ্ছে। একটু বেশিই ম্যাচুরিটি এনে দিয়েছে যেন এই অলংকার। বাড়ির বড় বউ! ঠোঁট কার্ণিশে হাসি ফুটে শ্রাবণের। চুড়ির নকশায় হাত বুলায়। এরইমধ্যে বাইরে কর্কশ পরীর গলা। সঙ্গে ভাসছে বকুল কাকার গলার আওয়াজও। লেগে গেছে দুজন কথা কাটাকাটির তুমুল ঝগড়া৷ শ্রাবণ বেরিয়ে ছিলো বারান্দায়। অর্পা মাথা চেপে জিদ্দি গর্জন তুলেছে মায়ের উদ্দেশ্যে। এই ক্যাটক্যাট একদম ভালো লাগে না তার। পারভীন আগে থেকেই ধমকাচ্ছিলো তাদের উভয়কেই। কে ছাড়ে কাকে? সে-ও জবাব দেয়। সে-ও জবাব দিতেই থাকে। শ্রাবণ পরীর হাত টেনে নিয়ে এলো অর্পার ঘরে। অর্পা কটমটে চোখ করে তাকায় পরীর দিকে। শ্রাবণকে বলে,
“এরে তুমি আপু ডাকতে বলছো? ছোট হইলে গলা টিপে মারতাম আমি তারে।”
“এহ, আপা! খালি আমারে কইয়েন না। হেই বেডারে গিয়া কইতে পারেন না কিছু?”
“শুরু তো তুই করছ। উনার বিচার আব্বু করবো। তোকে তো বিচারে পাওয়া যায় না। তখন লুকাস।”
“অর্পা, তুমি পড়ো।”
শ্রাবণ অর্পাকে পড়তে বলে পরীর হাত ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কেন লেগেছো ঝগড়া?”
“আরে হুদাত্তে। ভাতের মার দিতে গেছিলাম গরুরে। কইছি খালি, কাকা বালতিডা নেন। কয়, গামলায় রাইখ্যা আইতাম। কন খালি, হাতটা বাড়াইয়া খালি বালতিডা লইয়া যাইবো। হেইডা হেয় পারতো না। আমি কি গোয়ালে গোবরে গিয়া হাটমু এই অবেলায়? হেয় কি মশারিডা পরে টানাইতে পারতো না? ঘর থেইকা এতোখানি টাইন্না নিয়া যে দিয়া আইছি, ওইডাই তো হের সাত কপালের ভাগ্য। তিনবার কইছি, নিতে। নিলোই না। হেয় হের কাজ করেই। আলা দিছি দরজার সামনেই ঢাইল্লা। যা, আলা। গোয়াল পরিষ্কার কর গিয়া।”
“তুমি পারবে না যখন, বালতি রেখে চলে আসতে। অহেতুক ঝগড়া বাঁধিয়ে লাভটা কি হলো?”
“হুনেন, ভাবি। যত ভালা কাজই করি না ক্যা, দোষ ঘুরাইতে ঘুরাইতে সবাই আমার উপ্রেই দিবেন। জানি।”
“ঝগড়া একদিক থেকে লাগে না। দুইদিক থেকেই লাগে। বুঝতে পারছো? আমি যেন আর একদিনও না দেখি। নয়তো, আর দোষাদোষি করবো না। একদম বকুল কাকার ছেলের কাছে তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো।”
অর্পা আর শ্রাবণ সমানতালে হাসে। পরী যায় ক্ষেপে। একবার অর্পার দিকে তাকায়। আরেকবার তাকায় শ্রাবণের মুখে। শ্রাবণ কথার পরপর ফিক করে হেসেও বলে,
“বকুল কাকার ছেলে আছে কি না, তা-ও তো জানি না।”
হাসতেই থাকে শ্রাবণ। অর্পা জানতে সাহায্য করে ভাবিকে।
“আছে, আছে। তিনটা।”
“বিয়ে করেনি?”
“একটা মনে হয় করছে। আরও দুইটা বাকি।”
“বড়?”
“হ্যাঁ।”
শ্রাবণ হাত ছেড়ে দিয়ে অর্পার থেকে পরীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলে,
“তো পরী, সাবধান।”
“এহ! যাইবো নে এই পরী কাইল্লা বেডার ঘরে।”
“তো কেমন ছেলে চাও?”
“আপনে আর বড় ভাইজান যেই রকম।”
“তোমার ভাইজান তো আমার মতো না। তাই তোমার লোককেও তোমার মতো হওয়া যাবে না। একটু কম থাকাই ভালো।”
“তা-ও যাইতাম না। মইরা গেলেও ওই বকুল মিয়ারে আব্বা ডাকতাম না।”
রাগে হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় সে। হাসে উপস্থিত দুজনেই। পরক্ষণে অর্পাও পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য হাসি কমিয়ে নিয়েছে। শ্রাবণও খাটে ফিরে নিজের একটা বই নিয়ে বসেছে। একটু পরেই ইফতেখার আসে বাড়িতে। দুজনকেই পড়ায় মনযোগী বেশে দেখতে পায়। কিছু শিঙারা নিয়ে এসেছে। দরজার সামনে থেকেই হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা অর্পার টেবিলে রেখে বলে,
“খেয়ে নে সবাই মিলে।”
শ্রাবণ চোখ তুলে তাকাতেই আবার চলে যেতে দেখেছে তাকে। অর্পা বই বন্ধ করে প্যাকেট খুলে এগিয়েছে ভাবির কাছে। শ্রাবণ পারভীনকে প্লেটে দিয়ে এসে পরীকেও ডেকে নিয়ে এলো। ইফতেখারকেও ডাকতো খাওয়ার জন্য, কিন্তু তাকে পাওয়া গেলো না। মহারাজ চলে গেছে তখন সাথে সাথেই। গরম গরম শিঙারায় ভালো একটা সময় কেটেছে ভাবি ও ননদিনীদের। গল্পস্বল্প চলেছে। এইতো, অর্পা ধীরে ধীরে কাছে আসছে শ্রাবণের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here