“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
কিচিরমিচির চড়ুই আর তালগাছে বাবুইপাখির কলতানে জমে আছে ভোর। দুসপ্তাহ কেটে গেছে শ্রাবণের সংসার জীবনের। যদিও সংসারের কাজকর্ম তেমন কিছুই করা হয়ে উঠে না তার। নিজের কাজগুলো যথাযথ করে। আর মাঝে মাঝে একটু গোছগাছ। আজ রুটির খামি তৈরি করেছে শ্রাবণ নিজে। পারভীন সবজি কেটে নিচ্ছিলো। পরী ঝাড়মুছে ব্যস্ত ছিলো। পরে ঘরে বাইরে ঝাড়ু দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে এসে হাত ধুয়ে রুটি বেলতে শুরু করলেই পারভীন সবজি রান্নায় ব্যস্ত হয়েছে। শ্রাবণ অবসর নিরিবিলিতে বাইরে হাঁটছিলো একাকী। দালান ঘরে চোখ পড়তেই যেতে ইচ্ছে হয়। মিস্ত্রিরা এখনো কাজে আসেনি। তবে দালানের কাজ এগিয়ে চলেছে যথাযথ। তাই একটু দেখতে যায় ভেতরটা কেমন বিন্যস্ত করা হয়েছে। খুঁটির ফাঁকে ফাঁকে ভেজা বালিতে হাঁটে সে। বড়সড়ই রাখা হয়েছে একেকটা রুম। শহরের মতো চাপাচাপি নেই একদম। বারান্দাও রাখা হয়েছে প্রশস্ত। শ্রাবণ সিঁড়িতে পা ফেলে ছাদেই যায়। নিরিবিলি আর খোলামেলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়াটা বড্ড উপভোগ করে সে। তারউপর গ্রামের এই শীতল পরশ, পাখিদের গুঞ্জন আর প্রশান্ত নিশ্বাস! সবই তার চমৎকার উপভোগ্য। বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে এক কাপ চা চাইলেন আফজাল হোসেন। পরী চা এনে দিলে চুমুকে চুমুকে ভাবনায় মত্ত হতে লাগলেন। হঠাৎ নজর উঠে বিপরীত প্রান্তের ছাদে। নিরিবিলিতে আপন মনে হাঁটছে তার পুত্রবধূ। শুধু হাঁটছেই না। কানে মুঠোফোন চেপে রাখতেও যেন দেখছেন। ঠোঁট নড়ছে, কথায় মনযোগী হয়ে পায়চারি করছে। ছেলেরা ঘরে ঘুমায়। মেয়েটা সদ্য ঘুম থেকে উঠে হেলে দুলে তার মায়ের কাছে গেলো। পারভীন আর পরী রান্নাঘরে। অর্থাৎ, পুত্রবধূ সেই ছাদ প্রাঙ্গণে একা। ফোনটাই তার সঙ্গী। আফজাল হোসেন বারান্দায় বসে থেকে সেদিকেই দৃষ্টি গেঁথে রাখেন। চুমুকে চুমুকে কাপ খালি করেন। পরীকে ডাকেন, কাপটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। এমনি খালিদ হাজির হয়েছে মামার সামনে। সালাম দিয়েছে। জিজ্ঞেস করছে,
“দিপুর আজ সিমেন্টের অর্ডার দিতে যাওয়ার কথা। যাইবো না?”
“হুম। দশটার পরে ব্যাংকে যাইবো। তারপরে যাইবো।”
“ও, আচ্ছা। ফোন দিতাছিলাম তারে। ধরে না।”
“ঘুমায়।”
“রাস্তার কাজ আজ দুপুরের মধ্যেই শেষ হইবো মামা। সবকিছু খুব পোক্তভাবে করার চেষ্টা আমি করছি। যদ্দুর সাধ্যে কূলায়ছে, করছি। বিকেলে একবার ঘুইরা দেইখ্যা আইসেন?”
“যামু নে।”
“মামা, কইছিলাম কি… মাস তো শেষ।”
“হু, মনে আছে। ইফতি টাকা উঠাইলেই বেতন দিয়া দিমু সবার। বিকালে আসিস।”
“আচ্ছা।”
“এর খবরটা আমারে সংগ্রহ কইরা দে।”
শান্ত, গম্ভীর গলার কথাবার্তা চলছে তাদের। কার খবর তা তাৎক্ষণিক বুঝে উঠে না খালিদ। মামার স্থির চোখের অনুসরণ করে ছাদে শ্রাবণকে দেখতে পায় সে। পরক্ষণে গলার স্বর আরও নিচু করে বলে,
“সাত্তারগো বাড়িত থাকতো, মামা। মজিদা মামির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কাজের সন্ধানে আইছিলো। তারপর ক্যামনে জানি দিপুর ঘাড়ে বইসা পড়লো। সবই বয়সের দোষ মামা। কি আর কইবেন। আর মাইনা নিছেনই যখন…”
“তোরে ওই ইতিহাস শুনাইতে বলি নাই। এইসব আমিও জানি। তার পরিবারের খোঁজ কর। ক্যামনে কই বড় হইছে, সেই তথ্য সংগ্রহ কর।”
“আচ্ছা, আমি যামু নে মজিদা মামির সঙ্গে কথা কইতে। উনি ছাড়া তো কেউ খবরাখবর দিতে পারবো বলে মনে হয় না। আসি তাইলে এখন। দিপু বের হওয়ার সময় যাওয়া লাগলে কইয়েন, যামু নে।”
খালিদ চলে যায়। আফজাল হোসেন তাকিয়েই থাকে সেদিকে। ভাবেন অনেক কিছুই। হঠাৎ আসাটাই যেন তার হঠাৎ ভাবনার কারণ। এই হঠাৎ এর পরিধিই না কত বিশাল, তার সন্দেহ। যদিও সন্দেহের নিশ্চয়তা তার নেই। তবে চেষ্টাটুকু আছে৷ তারই যথাযথ প্রয়োগ সে করে ছাড়বে। যদি উদ্দেশ্যহীন হয়, তবে তো ভালোই। আর যদি তা না হয়, তবে এর শেষটা পর্যন্ত পৌঁছানো এবং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন তারও কর্তব্য। হোক তা কোনো চেয়ারম্যান হিসেবে কিংবা পরিবারের কর্তা হিসেবেই। ছাদ থেকেই শ্রাবণ দেখতে পায় মিস্ত্রি লোক আসতে শুরু করেছে গেইট দিয়ে। তাই নেমে আসে সাথে সাথেই। আফজাল হোসেনকেও বারান্দায় বসা অবস্থায় দেখে। ইফতেখার ঘুম থেকে উঠেছে এই মাত্র। শ্রাবণ এগোতে এগোতে বলে,
“দিনের চার ওয়াক্ত নামাজ আপনার আদায় হয়, তাই না?”
“ডেকে দিতে ফজরে।”
“আম্মা ডেকেছিলো। আপনাদের কানে পৌঁছায়নি।”
“ঘুম এখনো ভাঙছিলো না। মশার কামড়ে উঠে গেলাম।”
বড় হাই তুলে ইফতেখার। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“মশারি টানাননি?”
“হ্যাঁ। মশা ঢুকেছে কোনোভাবে।”
হাতের ফোনে চোখ যেতেই জিজ্ঞেস করে,
“এটা কার ফোন?”
“আমারই তো। দেখেননি?”
“উহুম। ফোন নম্বরও তো দাওনি।”
“ফোন দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। তাছাড়া ফোনটায় সমস্যা। অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। আবার কখনো ভাগ্যের মতো খুলে যায়।”
“ফোনে তো তোমার এমনিতেও প্রয়োজন দেখি না। কার সাথে কথা বলো?”
“বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে না? একসাথে পড়াশোনা করেছি। খবরাখবর রাখতে হয়।”
“তুমি এখনো পড়ো? আমি তো ভেবেছি এমনিতেই বই পড়ো।”
“এখন এমনিতেই পড়ছি। সেমিস্টার শেষ হলো। রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। আপনি নাশতা করবেন এখন?”
“হ্যাঁ।”
শ্রাবণ গলার স্বর একটু উঁচিয়ে পিছু ফিরে আফজাল হোসেনের উদ্দেশ্যে বলে,
“আব্বা, আপনাকে নাশতা দিবো?”
“এখন না। আধঘন্টা পরে খাই।”
“ঠিক আছে।”
শ্রাবণ রান্নাঘরে চলে গেছে ইফতেখারের নাশতা নিয়ে আসতে। আফজাল হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে ছেলেকে বললেন,
“খালিদ আইছিলো। মিলে তারে নিয়া যাওয়ার হইলে ডাকতি।”
“মিলে আমি একাই যেতে পারবো। ব্যাংক থেকে একবারে ওদিক দিয়ে সিমেন্ট অর্ডার করে চলে আসবো। চেকটা ঠিক করে রাখছেন, আব্বা?”
“হু, নিয়া যাইছ।”
বারান্দা ছেড়ে দালানের দিকে হাঁটে আফজাল হোসেন। মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলবেন কাজকর্মের ব্যাপারে। ইফতেখার বারান্দায় দাঁড়িয়েই আড়মোড়া ভাঙে। হাতের আঙুল জড়ো করে মটকায়। শ্রাবণ প্লেটে রুটি সবজি নিয়ে এগিয়েছে অর্পার ঘরে। মন্তব্য রাখে,
“আপনার ভুঁড়ি বেড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখি। আরও সকালে উঠে হাঁটা দরকার। আগে থেকেই ফিটনেস ধরে রাখা ভালো।”
মৃদু হাসি স্পষ্ট হয় ইফতেখারের মুখে। পিছু পিছু এসে অর্পাকে দেখতে পায় না ঘরে। তাই জিজ্ঞেস করে,
“অর্পা কোথায়?”
“রান্নাঘরে। নাশতা করছে আম্মার হাতে।”
“তুমি করেছো?”
“পরে।”
“এখনই খাও। আমার সাথে।”
“আপনি খেতে থাকুন।”
পাশে বসে গ্লাসে পানি ঢেলে দেয় শ্রাবণ। ইফতেখার এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে নিজের মুখে দেওয়ার আগে শ্রাবণের মুখের সামনে ধরে। শ্রাবণ উপেক্ষা না করে হাসিমুখে নিয়ে নেয় খাবার। কিছু বলবে ভাবছিলো। এখনই বলবে কি না, তা-ও ভাবছিলো। ইফতেখার নিজের মুখে খাবার তুলে দ্বিতীয়বারের মতো আবার সামনে ধরে রুটির টুকরো। শ্রাবণ হেসে উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথেই।
“আরে! আপনি খান। আমি আমার প্লেট নিয়ে আসছি এখনই।”
হাসিমুখে চলে যায় সে। নিজের নাশতা নিয়ে এই ঘরে হাজির হয় পুনরায়। একসাথেই নাশতা করে নিবে। খেতে খেতেই বলে,
“কিছু বলতে চাইছিলাম।”
“হুম?”
“আব্বা বলেছিলো সেদিন, কাজের সন্ধান যেন না করি। কিন্তু আমার তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করি। আপনি কি বলেন? আমি কি চাকরি করবো না?”
“উহুম।”
“টুকটাক প্রয়োজন তো আমারও হতে পারে।”
“যখন যা প্রয়োজন, আমায় বলো।”
“আমার দশ হাজার টাকা লাগবে।”
শুরুতেই দশ হাজার এবং সাথে সাথেই টাকা চাওয়াতে কিঞ্চিৎ বিস্ময় যেন উপস্থিত হলো ইফতেখারের মধ্যে। খাবারের প্লেটের মনযোগ শ্রাবণের চেহারাতে বসালো। তবে স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলো,
“কেন?”
“আমার ইউনিভার্সিটির ফি বকেয়া আছে। কিছু মওকুফ করে আর কিছু পরিশোধ করে এডমিট কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু সব তো আর হয়ে উঠেনি। সময় নিয়েছিলাম। পরিশোধ করা দরকার। দুদিন ফোন দিয়ে ফেললো।”
ইফতেখার দৃষ্টি নামিয়ে আনে প্লেটে। খাওয়ায় মনযোগ দেওয়ার আগে বলে,
“আচ্ছা।”
শ্রাবণও চুপচাপ খেতে থাকে এবার। ইফতেখার খাওয়া শেষে উঠে যাওয়ার আগে বলে,
“আবার শহরে যেতে হবে তবে?”
“যেতে তো হবেই। না গেলে কিভাবে?”
“ব্যাংকিংয়ে হয় না?”
“উহুম। আমাকে গিয়ে রিসিট দেখাতে হবে না? সমস্যা নেই, হাতে সময় নিয়ে চলে যাবো। সকাল সকাল রওনা হলে বিকেলের মধ্যেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ।”
“আচ্ছা, আমি নিয়ে যাবো। সমস্যা নেই।”
মাথা হালকা নেড়ে সম্মতি প্রদান করে খেতে থাকে শ্রাবণ। ইফতেখার বেরিয়ে গেছে। শ্রাবণ খাওয়া শেষে প্লেট রেখে আসে। বারান্দায় বিপুর সাথে দেখা। শ্রাবণকে দেখেই বিড়বিড় করে বললো,
“ভাবি, ব্যাপারটা মাকে জানানো দরকার।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“তো জানান।”
“আপনি আছেন কোন কাজের জন্য?”
“আমি? আমার কাজের জন্য আছি।”
মৃদুস্বরে একটু হেসে নেয় শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“সুযোগ বুঝে জানাবো৷ তবে জানাজানিটা তার দিক থেকে আগে হওয়া ভালো ভাবছি। পরিস্থিতি যে কূলেই যাক না কেন, ওদিক থেকেই যাওয়া দরকার।”
শ্রাবণ চলে যায়। বিপুর মুখাবয়বে ঘিরে দুশ্চিন্তা। কি করবে, বুঝেই আসে না যেন। প্রেম এতো না ধরি আর না ছাড়ির মতো পীড়াদায়ক হয়ে যাবে জানলে হয়তো জীবনে প্রেমে জড়াতোই না। এই যে এখন মন চাইছে আবার কান্তার দেখা পেতে, ঘরের খবরাখবর জানতে। কি না কি হলো? নতুন কিছুই না আবার ঘটলো? দুদিন যাবত কলেজেও যেতে দেখা যায় না তাকে। বিপু ডানে বামে দেখতে দেখতে এসে থামে কান্তাদের বাড়ি সম্মুখে। জড়তা-সংকোচে বাঁধা পা দুটো এগিয়ে এনে দাঁড়ায় মোটা আম গাছটায় হাত ভর করে। জনশূন্য লাগছে বাড়ি। অথচ ঘরের দুয়ার খোলা। কিন্তু কোনো মানব ছায়ার উপস্থিতি নেই। শ্রাবণ এই বাড়ি থাকতে এতোটা জড়তায় জড়াতে হয়নি তাকে। কিন্তু নিজ প্রয়োজনে এগোতে মন থেকে হাজারটা বাঁধা আসে৷ একবার মনে হয়, ডেকে উঠুক। আবার মনে হয় ট্যাপট্যাপ পায়ে দুয়ার পর্যন্তই যাক। অবশেষে সিদ্ধান্ত এলো ফিরেই যাক। ঘুরেও দাঁড়ালো। এক পা বাড়াতে না বাড়াতেই সামনে পলিতে শাকসবজি হাতে সাত্তার হাজির। চলতে চলতেই তার ভ্রু কুচকে গেছে একটু দূর হতে। নিকটবর্তী হয়েই সন্দেহভাজন গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুই এনে কি করছ?”
“কিছু না।”
মাথা চুলকাতে চুলকাতে দ্রুত প্রস্থান করে বিপু। খানিক এগিয়ে আবার পিছু ফিরে ফিরে দেখে। ঘনঘন পা ফেলতে ফেলতে অগোচরে দাঁতে দাঁত চেপে হাসে এই ভেবে যে, বলে দেওয়াই বুঝি উচিত ছিলো ‘আপনার মেয়েকে দেখি উঁকিঝুঁকি মেরে।’ সাত্তার এক মুহুর্তই দাঁড়িয়ে ছিলো বিপুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণে ঘরে এসে মা মেয়েকে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখে। ভ্যান নিয়ে বের হবে, তাই শিরিন চটজলদি তার খাবারটা সামনে হাজির করে। বাইরে পানি ছিটা দিয়ে হাতটা ধুয়ে নেয় সাত্তার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে খেতে। শিরিন তাল পাখায় বাতাস করছে গরম ভাতে। সাত্তার জিজ্ঞেস করে,
“এই ছ্যাড়াডায় একধারা উঁকি মারে ক্যা এই বাড়ি?”
“কোন ছ্যাড়া?”
“চেয়ারম্যানের পোলা। ছোটডায়।”
“আমিও দেখছি। শ্রাবণ থাকতে একাধারে আসাযাওয়া করতো।”
“হেই মাইয়া তো বাড়ি নাই এহন। আমি আরও অনেক আগেই দেখছি। আজকাও দেখছি। মতলব কি হের? হাতেনাতে ধইরা কান তলায় দুই তিন ঘা মাইরা জিগামু একদিন?”
“এইসব কি কথা কন। আন্দাজে মান্দাজে মারতে যাইবেন ক্যা?”
“কোনো মতলব ছাড়া তো আইয়া খাঁড়ায় না। আমরা কয়দিন যাই চেয়ারম্যানের বাড়ি উঁকি মারতে? হের পোলায় আয়ে ক্যা তবে? নাকি কান ধইরা টাইনা চেয়ারম্যানের সামনেই খাড়ামু? কি কছ?”
“বেশি কথা কইয়েন না তো। চুপচাপ খান৷ এইসব কোনো ঝামেলা টামেলা কইরেন না কইলাম। হেয় উঁকি মারছে, তাতে আমগো কার কি উইড়া গেছে? যার যার রাস্তা হেয় দেখেন। ঝামেলা যত্ত এড়াইয়া চলা যায়।”
“মাইয়ারে সাবধান করিস।”
আর কথা বলে না শিরিন। ক্রমশই চুপ হয়ে যায়। কিছু উত্তেজনার ভারও পড়ে মস্তক পাড়ায়। মেয়েকে সাবধান! তবে কি মেয়ের দিকে বিপু ছেলেটার চোখ যায়? এমনটা তো ভাবেনি সেভাবে। হতেও তো পারে। আবার না-ও হতে পারে। অযথা অন্যের উপর দোষ তোলাও দায়। তবে সাবধান থাকাটা মন্দ নয়। অবশ্যই থাকতে হয়। আশপাশের পরিস্থিতিও তো কত কিছু বুঝিয়ে যায়, শিখিয়ে যায়। এই যেমন নিকটতম ঘটনা শ্রাবণ আর ইফতিকেই ধরা যায়! না, না। এ হয় না। গরীবের মানসম্মান এমনিতেই তুলোধুনোর পর্যায়। তারা বড় ঘরের মানুষ। তাদের সম্মান অর্থের অংকে পরিমাপ করা হয়। গরীবের অর্থ ও সম্মান উভয়ই বহু পরিশ্রমে উপার্জন হয়। এতো সহজে ক্ষুন্ন হতে দেওয়া যায় না উপার্জন তথা অর্জন। সাত্তার প্লেট খালি করে তাতে হাত ধুয়ে নেয়। বেরিয়ে যায় ভ্যান টেনে। শিরিন প্লেট ধুয়ে ঘরে যায়। কান্তাকে মনযোগে শাক বেছে নিতে দেখে। প্লেট রেখে পাশেই পিড়িতে বসে শিরিন। একটু সাবধানতাজনিত বাক্যের প্রয়োগ করতে চায়। শাকে হাত দিয়েই জিজ্ঞেস করে,
“বিপু কি কোনো কারণে তোরে খোঁজে রে?”
কান্তা বাবার কথা সবই শুনছিলো এপাশে বসে। তাই মায়ের মুখে বিপুর কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের কম্পন উঠে না তার মাঝে। তবে হৃদস্পন্দনটা ঢিপঢিপ তান ধরেছে। মুখটা নিশ্চুপ থাকে তার৷ শিরিন পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“রাস্তাঘাটে কোনো সময় কথা কইতে চেষ্টা করছে তোর লগে?”
তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনা কান্তার মুখে। বিপুর দেওয়া পরামর্শ বেশ মনে পড়ে। ইচ্ছে করে, এখনই বলে দেক। বিপু বলেছিলো তো, ইনিয়েবিনিয়ে না গিয়ে যেন সরাসরি বলেই দেয়। কিন্তু এর পর কি হবে, তা ভেবেই আর বলার সাহসটুকু মনে আসে না। শিরিন মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে যেন আরও চিন্তিত হয়ে যায়। সত্যিই তবে সাত্তারের ধারণা ঠিক কি না ভেবেই গম্ভীর হয়ে উঠে। গম্ভীরমুখে এবার বলে,
“কথা কছ না ক্যা?”
“কি?”
“কি জিগাইলাম, কানে যায় নাই?”
চোখ দুটো ভিজে আসে কান্তার। মাথা আরও নিম্নমুখী করে মিনমিনিয়ে বলে,
“উনি পছন্দ করে আমাকে।”
“পছন্দ করে মানে!”
কন্ঠ এবং দৃষ্টি উভয়ই ধারালো হয়ে উঠে। মননশক্তির দিক থেকেও ক্রোধান্বিত হতে সময় নেয়নি শিরিন। কান্তার মাঝে এক প্রকার ভয় জন্মে। নিজেকে লুকানোর ভয়। কিন্তু পেরে উঠে না ঠিক। শিরিন যেন লুকানো ভয়ের মুখোশটা ছিনিয়ে নিয়ে উন্মোচন করে তাকে।
“কবেত্তে পছন্দ করে? জানাস নাই ক্যা? হেয় পছন্দ করে আর তুইও করোছ? এইজন্যই বাড়ির বাইরে দাঁড়াইয়া উঁকিঝুঁকি মারে?”
টপ টপ করে দুই চোখ হতে দুই ফোঁটা অশ্রু বাধাহীন মাটিতে পড়ে। শিরিন মাথায় ঠুকে জবাব চায়,
“কথা কছ না ক্যা?”
“আমিও পছন্দ করি তারে। আমার বিয়া দেওয়ার হইলে তার সাথেই দিবা।”