“শ্রাবণধারা”
পর্ব-৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে নাশতার পর এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেছেন আফজাল হোসেন। দৃষ্টি সম্মুখেই একটা পাকা ঘরের কাজ চলছে। যেহেতু সন্তানদের কেন্দ্র করে সকল সম্পত্তির সঞ্চয়, সেহেতু ঘরের নকশার ভার ছেলেদের উপরই ছেড়েছেন। কোথায় কি দরকার হিসেব জমা করে বাবার অনুমতিতে টাকা খরচ করছে। পছন্দানুযায়ী ঘর নির্মাণে মিস্ত্রিদের পাশে থেকে থেকে দুই ছেলেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফরমায়েশ প্রদান করছে। সব মিলে ভালোই লাগছে আফজাল হোসেনের। ছেলে দুয়ের মধ্যে কখনো কোনোরকম দ্বন্দ্ব না এলেই হয়। এক ঘরে সর্বদা একত্রে থাকবে, তা-ই প্রত্যাশা। সম্পত্তি আর ক্ষমতা এক সময় বন্টন হয়ে গেলেও মনটা যেন কখনো পৃথক না হয়। বাবাকে বারান্দায় বসতে দেখে ছোট ছেলে আতাহার বিপু এসে হাজির হয় নির্মাণাধীন ঘর হতে।
“আব্বা, কিছু কথা ছিলো।”
“কি?”
“কিছু টাকা দরকার।”
“কিসের?”
“একটা খেলার আয়োজনের জন্য। ফুটবল লীগ ছাড়বো ভাবছি। অনেকদিন যাবত খেলা হয় না।”
“তুই তো প্রত্যেকদিনই খেলছ।”
“খেলছি, ঠিক আছে। মানে, আয়োজন হয় না। আগামী শুক্রবার একটা আয়োজন রাখতে চাই।”
“এক, রাস্তার কাজ ধরছি। আরেক, বাড়ির কাজ ধরছি। টাকা উড়তাছে না। দুই দিন পরপর এতো খেলাধুলার লীগ লাগাইছ না। এইগুলা সাইরা উঠি। মাস তিনেক পরে খেলার আয়োজন নিয়া হাজির হইছ।”
“কত আর লাগবো একটা খেলার আয়োজনে? এতো বড় কাজ হয় আর এইটুকুতে কি আটকে থাকবো কিছু?”
“যেইটা বুঝোস না, ওইটা নিয়া কথা বাড়াইছ না। কইলাম তো, মাস তিন পরে যোগাযোগ করিস। রাস্তার কাজ কতদূর আগাইছে, দেইখ্যা আয়। তোগো নজর রাখতে কইছিলাম ওইদিকে। এক কুড়ি ইটও যেনে চুরি না হয়। আগেরবার রাস্তার ইট নিয়া জামশেদ মেম্বার বাড়ির বাউন্ডারি দিয়া বইছিলো, মনে আছে? অথচ আমি চেয়ারম্যান বাড়ি তখন বাউন্ডারি ছিলো না। এমন কত জামশেদ যে খাপ পেতে থাকে রাস্তায়, ধরা মুশকিল। যা, ওদিক গিয়া ঘুরে আয়।”
হুকুম মোতাবেক চলে যায় বিপু। তবে মুখমন্ডলে পোষা চরম বিরক্তি। বাবা টাকা দিলো না আয়োজনের। অথচ কত প্রত্যাশা ছিলো শুক্রবারই আয়োজনটা করবে! মাস যাবত খেলে নাকি এই পরিণতি শেষে? হনহনিয়ে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ইটের উপর হোচট খায়। সামনের দিকে দুই তিন কদম হেলে গেলেও পড়েনি নাকেমুখে উপচে। পিছু হতে কেউ বলে,
“আরে, আরে! আস্তে। এখনই তো পড়ে যেতেন!”
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু দেখতে পায় শ্রাবণকে। এই মেয়েটাকে আগেও একবার দেখেছে কাইয়ুমদের বাড়িতে। শ্রাবণ তার পাশাপাশি হাঁটতে ইচ্ছুক হয়ে এগিয়ে আসে।
“এতো তাড়াহুড়ো কেন করছেন? আস্তেধীরে চললেও পথ শেষ হবে। সাথে আপনিও সুরক্ষিত থাকবেন।”
পাশাপাশি একটা মেয়ের চলা স্বস্তিতে কেমন বিঘ্নতা তুলে দেয় বিপুর। গলাটা হালকা খাঁকারি দেয় সে। মুখের বিরক্তিটুকু একদম উপস্থিত নেই। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“এদিকেই। রাস্তার নির্মাণ কাজে ইট চুরি যায় কি না, তা দেখার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ হয়েছে। দায়িত্ব পালনে যাচ্ছি।”
“তাই? চেয়ারম্যান বাড়ির দিকেও নজর রাখবেন।”
ভ্রুর মাঝে হালকা ভাজ পড়ে যায় বিপুর।
“কেন?”
“চেয়ারম্যান বাড়িতে নাকি পাকা দালান উঠছে রাস্তা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে। যদি কোনোভাবে রাস্তার নাম করে আনা ইট ওই দালানে গেঁথে যায় তো!”
“মানে! আপনি কি বলতে চাইছেন?”
“আরে, ক্ষেপে যাচ্ছেন নাকি? আমি তো কিছু বলতে চাইছি না। আমি হচ্ছি দুদিনের জন্য আসা এই গ্রামের অতিথি। লোকমুখের সন্দেহ আপনার সাথে শেয়ার করলাম আরকি। দায়িত্বে যখন আছেন আপনি। যাইহোক, আমাকে একটা হেল্প করতে পারবেন কি?”
“কোন ব্যাপারে?”
“কবিরাজ বাড়িটা দেখিয়ে দিতে পারবেন একটু?”
“আমার এখন সময় নেই।”
“আমরা মানুষেরা এই কথাটা একদম ভুল বলি। সময় আমাদের ঠিকই থাকে। কিন্তু ব্যবহার করতে ইচ্ছাবোধ করি না। এই যেমন আপনি এখন চাইলেই একটু হেল্প করতে পারেন। প্লিজ।”
“আপনাকে হেল্প করে আমার কি লাভ?”
শ্রাবণ কিঞ্চিৎ ভাবুক হয়ে পড়ে।
“লাভ? উম্ম… সব ক্ষেত্রে লাভ কেন খুঁজতে হবে? আমিও তো আমার লাভে আসিনি। একজনের উপকার করতেই এসেছি। আপনিও কি এখানে লাভলস না খুঁজে পারেন না?”
“না।”
“করবেন না হেল্প?”
“উহুম।”
“আমি আসলে একজনের বিয়ে ভাঙতে চাইছি।”
হঠাৎ চমকে উঠে যেন বিপু। শ্রাবণ তার এভাবে তাকানো দেখে জিজ্ঞেস করে,
“ভয় পেলেন?”
শ্রাবণের চোখে দৃষ্টি রেখেই বিপু জবাব দেয়,
“না।”
“মেয়েটা বিয়েতে রাজি না। জোর করে বিয়ে দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না, বলুন?”
“কবিরাজি করে বিয়ে ভাঙাবেন?”
খানিক হেসে উঠে শ্রাবণ।
“আরে না। এতো কঠিন পাপে আমি যাবো না। কবিরাজ বাড়ি নাকি ওই পাত্রের ঠিকানা। একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে দেখবো আরকি। যদি পাত্রের সদয় হয় তাতে।”
ঠোঁট কার্ণিশে মৃদু হাসি রেখে নিশ্চুপ চলতে থাকে বিপু। হঠাৎই যেন ফুপাতো ভাই খালিদের সামনে পড়ে গেলো। দিকবিক না তাকিয়ে খালিদের সন্দেহভাজন চোখকে উপেক্ষার চেষ্টায় মত্ত হয় সে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয় নিমেষে। যেন সে একা পথের পথিক। মেয়ে তো দূর, কারো সাথেই হাঁটছে না ভুলেও। এদিকে তার হাঁটার গতিতে শ্রাবণও নিজ পায়ের গতি বাড়িয়ে তার সমতালে পথ চলতে প্রস্তুত হয় কবিরাজ বাড়ি চিনে উঠার প্রত্যাশায়। মহা মুশকিল! ভাইয়ের সন্দেহের বুঝি এবার আরও গভীর সৃষ্টি! কি করে বলবে, আপনি একটু পিছু হাঁটুন। আমার ভাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে! তবুও বিড়বিড়িয়ে বলার চেষ্টা করে,
“আপনি একটু আস্তে হাঁটুন।”
শ্রাবণ বুঝতে না পেরে তার মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি বললেন?”
“আস্তে হাঁটুন।”
“আস্তে হাঁটবো? কেন?”
আপদ! যেখানে অপরিচিত মনে করানোটা জরুরি সেখানে আরও মুখের উপর তাকিয়ে যেন ভাব জমানো! কিন্তু শ্রাবণ তো জানে না তার কোনো ভাই যে তাকিয়ে আছে! নিরুপায় বিপু নিজেই পায়ের গতি কমিয়ে দেয়। শ্রাবণও তার অনুরূপ! বিপু এবার স্পষ্টই বলে,
“আপনি হাঁটতে থাকুন সামনে, আমি একটু আসছি।”
“আচ্ছা।”
ততক্ষণে তারা বাজারে চলে এসেছে৷ রাস্তার বিপরীত পাশে বিপু যায় নির্মাণ কাজের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা লোকদের সাথে কথা বলতে। কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করেই আবার শ্রাবণকে পাঠানো পথে যায়। সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর এই খালিদ ভাই। তুই এসেছিস কাজে নজর রাখতে, সেখানে ভাইয়ের উপর নজর রাখা কি দরকার! অদ্ভুত! এতোক্ষণে বাজারের সীমা অতিক্রম করে যায় শ্রাবণ। বিপু পিছু ডাকে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। শ্রাবণ ফিরে আসতেই বলে,
“আর যেতে হবে না। এইযে, এইটা কবিরাজ বাড়ি।”
“ওহ্, ওকে। ভীষণ ধন্যবাদ।”
“হুম।”
বাড়ি দেখিয়েই পিছু পথে ফিরতে শুরু করে বিপু। শ্রাবণও তার সাথেই চলতে শুরু করেছে এবারও!
“আরেহ! আপনি ফিরে আসছেন কেন?”
“দেখলাম তো। এইটাই না?”
“হ্যাঁ, এইটা। কিন্তু যে কাজে এসেছেন, তা করতে যাচ্ছেন না কেন?”
“কাজ তো আমি এখনই করবো না। চিনতে এসেছি। চেনা হয়েছে, ব্যাস। তাই চলে যাচ্ছি আবার।”
“ওহ্!”
“আর আপনি এই এই করে পিছু ডাকছিলেন, এটা কোন ধরনের অভ্যাস? কাউকে ডাকতে হলে, নাম জানলে নাম ধরে ডাকবেন। নয়তো পুরুষ মহিলা ভেদে, বয়সের তারতম্যর ভিত্তিতে আপু, ভাইয়া, আঙ্কেল, আন্টি কিছু তো একটা সম্বোধন করতে পারেন।”
আসলেই বোধহয় রাস্তায় এভাবে পিছু ডাকাটা ঠিক হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ হলো। শ্রাবণকে প্রত্যুত্তরে বললো,
“স্যরি।”
“ইট’স ওকে। পরেরবার খেয়াল রাখবেন।”
“আপনি তো আমার বয়সে বড় বলে মনে হচ্ছে না। নাম কি আপনার?”
“আমি? বর্ষাকালের শ্রাবণ। ঋতুভেদেই আসি, আবার চলে যাই।”
বিপু ঈষৎ হাসির ঠাঁই দেয় মুখে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“আপনার নাম?”
“আতাহার বিপু।”
“বাড়ি এদিকেই?”
“চেয়ারম্যান বাড়ি।”
“ও, তবে তো চেয়ারম্যান সাহেব আপনারই প্রতিবেশি। যাক, দায়িত্ব দিয়ে প্রতিবেশীর হাক ভালোই বরাদ্দ করছেন তিনি। সম্পর্কে কি ডাকেন? চাচা? দাদা?”
“আব্বা।”
“মানে!”
বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে যায় যেন শ্রাবণ! বিপু চলতে চলতে তার বিস্মিত মুখে তাকিয়ে বলে,
“আমি চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে।”
“ইন্না-লিল্লাহ! তখন আমি কার সামনে কি বলছিলাম!”
স্বগতোক্তি করতে করতে পায়ের গতি দিগুণ বাড়িয়ে নেয় শ্রাবণ।
“আরেহ! কি আর তেমন বললেন? এতো জোরেইবা হাঁটছেন কেন? পড়ে যাবেন তো আবার আমার মতো।”
শ্রাবণ থামে না। বিপু হাসে। শ্রাবণ যথা পথে ফিরে গেলেও সে বাজার পর্যন্তই আটকে থাকে। নির্মাণ কাজ দেখতে। রোদের আড়াল হতে মসজিদের সামনে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে বিপু। ইটের গাঁথুনি যথাযথ হচ্ছে। খালিদ কোত্থেকে হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়ালো। বিপুর মন বলছে কি না কি বলে এক্ষুণি! কিভাবে বা কি উদ্দেশ্যে ভাইকে উপেক্ষা করা যায় তাও ভাবতে শুরু করেছিলো মাত্র। পর্যাপ্ত সময় দিলো না খালিদ। সন্দেহভাজন চোখে তাকিয়ে বিপুকে জিজ্ঞেস করে,
“মেয়েটা কে রে?”
“কোন মেয়ে?”
“যার সঙ্গে গেলি।”
“আমি চিনি না।”
“কথাও বললি, আবার বলস চিনোছ না?”
“আসলেই চিনি না। কবিরাজ বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলো, তাই দেখিয়ে দিলাম।”
“মামায় কিন্তু খুব কঠিন লোক। আউল ফাউল কিছু পছন্দ করে না জানোস। এইসব ধান্ধা ছাইড়া কাজের কাজে মন দে। বড় ভাই হয়ে এইটুকু পরামর্শ দিলাম আগ থেকেই।”
“কি মুশকিল! আমি কি ধান্ধা নিয়ে ঘুরলাম?”
“ওই ছ্যাড়া! ট্যাকা দে। ওই ছ্যাড়া! ট্যাকা দে কইলাম।”
হঠাৎ গ্রামের এক মহিলা পাগল এসে ঠমকে টাকা চাইলো বিপুর সামনে হাত বাড়িয়ে। হালকা ভয় পেয়ে গেছে বিপু। বললো,
“আমার কাছে টাকা নেই।”
“ও…ই, মিছা কতা কবি না! আমি জানি তুই চেয়ারম্যানের পোলা। তোগো পকেট ভরা ট্যাকা থাকে। দে কইতাছি। নইলে রাস্তার সব ইট তুইলা নিয়া গাঙ্গে ডুবায় দিমু।”
বিপু প্যান্টের এক পকেট টেনে বের করে বলে,
“এইযে দেখেন, আমার পকেট ফাঁকা। আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে নেন।”
খালিদকে দেখিয়ে দিয়ে বিপু ছুটি নেয় ঝটপট। হেলেনা পাগলী বিপুর পথ ছেড়ে এসে খালিদকে ঘিরে ধরে। খালিদও নেই নেই বলে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু শার্ট টেনে ধরে রাখে হেলেনা। খালিদ বিশ টাকা দিয়ে মুক্তি পেতে চায়। তবুও সফল হয় না। বিশ টাকা নিবে না সে। একশো টাকার দাবি তার। নয়তো ছাড়বেই না। খালিদ ধমকে ধমকে ছাড়াতে চাইছে। পাগলীর চোখ গলা যেন সমান ক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। টাকা না দিলে ইট দিয়েই মাথা ফাটাবে হুমকি। বিপু দূরে গিয়ে হাসছে তাকে ফাসিয়ে দিয়ে। পাগল, তাই রেগে কিছু করতেও পারে না খালিদ। পুরো একশো টাকাই আদায় করে ছেড়েছে হেলেনা।