“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৮
(নূর নাফিসা)
.
.
কলার পাকড়ে ধরা খালিদের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বিপু।
“আরে, হচ্ছে কি! খালিদ ভাই!”
“কই যাস? মেয়েলোক নিয়া কই যাস?”
“কলার ছাড়ো। এইটা কেমন?”
“কলার? তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা বাড়ি নেওয়ার হুকুম পড়ছে।”
ইফতেখার ভ্রু সামান্য কুচকানো রেখে উত্তেজনাহীন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“দুপুর থেকে বাড়ি যাসনি কেন? কাজী বাড়ি নাকি যাস এখন?”
উত্তর দেয় না বিপু। দৃষ্টি নামিয়ে নেয় নিচে। পুনরায় সে বলে,
“বাড়ি যা।”
বিপু মুখ নত রেখে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। খালিদ এক হাতে কলার পাকড়ে রেখেই অন্যহাতে বাহু ধরে টানে তাকে।
“আয়, কাজী বাড়ি যাওয়াই। পালায় বিয়ে করার শখ মামা মেটাইবো নে আজ।”
এক কদম এগিয়েও পিছু ফিরে পরক্ষণে শ্রাবণের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে দেখে। ইফতেখারকে জিজ্ঞেস করে,
“আর এই মেয়ের কি করবি?”
“আমি দেখছি।”
খালিদ টানতে টানতে হাঁটতে থাকে বিপুকে নিয়ে। যেন ভাই নয়, কোনো চোর ধরেছে পাকড়ে। বিপুও চোরের মতোই বিষাদগ্রস্ত হয়ে তার টানে টানে চলছে। সেই খবর দেওয়া ছেলেটাও তাদের থেকে খুব দূরে ছিলো না। খালিদের একা টানতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে অন্য বাহুতে ধরে যোগ দেয়। এতোক্ষণে কলার ছেড়েছে খালিদ ভাই। কিন্তু বিপুর দুই বাহু দুদিকে বাঁধা। মুখাবয়ব ডুবে আছে দুশ্চিন্তায়। বাবার সম্মুখীন হওয়ার দুশ্চিন্তা! ইফতেখার তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তারা বাজার অতিক্রম করতে থাকলেই পরক্ষণে তাকায় পাশে দাঁড়ানো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ এখনো মুখে ওড়না চেপে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেও ভয়ের উপস্থিতি। তাকিয়ে আছে বিপুর অবস্থার দিকেই। এমন কিছু হবে, ভাবেনি সে। ইফতেখার কাগজ দুটো পুনরায় প্যাচিয়ে নেয়। তা প্যান্টের পকেটে রেখেই নিশ্চুপ উঠে বসে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেয়। এতোক্ষণে ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আনে শ্রাবণ। ইফতেখার তার দিকে ফিরে বলে,
“কি হলো? উঠুন।”
মুখে চাপা ওড়না ছেড়ে দেয় শ্রাবণ। চিন্তিত মুখে মোটরসাইকেলে বসে ইফতেখারের পিছু। কিন্তু একদম ছুঁয়ে দেখেনি ইফতেখারকে। মোটরসাইকেলেই শক্ত করে ধরে রেখেছে পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ভর ছাড়া উঠে বসতেও তার সময় লেগেছে। তার কর্মকাণ্ডে খেয়াল রাখে ইফতেখার। তাই চলতে শুরু করার আগে বললো,
“ধরে বসুন। পড়ে যাবেন।”
“পড়বো না।”
“পড়লে আমার দোষ না।”
“ঠিক আছে।”
দুই হাতেই মোটরসাইকেল পাকড়ে ধরেছে শ্রাবণ। তবুও তাকে ধরে না। রাস্তার অনুকূলেই চলতে শুরু করেছে ইফতেখার। গতিও কিছুটা ধীর রেখেছে শ্রাবণের না ধরে বসার জন্য। মোটরসাইকেল এসে যথাযথ থেমেছে কাজী বাড়িতে। শ্রাবণ চুপচাপ নেমে গেছে। মুখাবয়ব হতে দুশ্চিন্তা দূরে হচ্ছে না তার। নেমেই বললো,
“তোতাপাখির জন্য ভয় হচ্ছে।”
ইফতেখারও নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে,
“তোতাপাখি কে?”
“আপনাদের আতা গাছের বিপু।”
মোটরসাইকেল লক করে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় ইফতেখার। নাম বলার ধরনের কারণেই এমন নিরব তাকানো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা সত্ত্বেও এই তাকানোয় লজ্জা অনুভূত হয় শ্রাবণের। গম্ভীরমুখের শান্ত দৃষ্টি অদ্ভুত রকম সুন্দর। এই অদ্ভুত সৌন্দর্য ক্রমশই লজ্জারুণ পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ। চাবি পকেটে রেখে ইফতেখার জবাব দেয়,
“তোতাপাখির কিছু হবে না। ওটা ফুপাতো ভাই হয়। আব্বার আগেপিছে থাকে। নিশ্চিন্তে থাকুন। চলুন।”
মাথার পরে যাওয়া কাপড় পুনরায় তুলে দেয় শ্রাবণ। চলতে থাকে ইফতেখারের পিছু। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। জীবনে বহু সিদ্ধান্তই একা একা নিয়েছে। তবুও এই সিদ্ধান্তটা বড্ড সংকোচের কারণ। হয়তোবা জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় বলেই। মাস খানেক আগেও তো ভাবেনি, এই গম্ভীর লোকটাকে পছন্দ করে বসবে! কেন ভালো লাগে তাকে? লোকটা অল্প সময়ের মায়ায় পড়ে গেছে বলে? নাকি জীবনে প্রথম প্রেম হিসেবে তাকে ডেকেছে বলে? এইতো, নিজেকে বড্ড বিশেষ বিশেষ মনে হচ্ছে। এমন বিশেষ হওয়ার সুযোগ জীবনে আরও এলেও কখনো সুযোগটুকু দেওয়া হয়ে উঠেনি কাউকে। কিন্তু এই মানুষটাকে দিয়ে দিলো। ভেবে ভেবেই দিলো। একদম জোর জবরদস্তি নয়। পছন্দসই দেওয়া হলো। নিজ বাড়ির সদস্য অনুপস্থিত থাকলেও চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে বিয়ে করতে এসেছে জেনে কাজী বাড়ির মেহমানের অভাব হলো না। সাক্ষী ক’জন লাগবে, কাজী যেন ইচ্ছেমতোই নিতে পারে উপস্থিতদের মধ্য হতে। এইযে, আশেপাশে থাকা, পাশের ঘর হতে উঁকি দেওয়া, দুয়ার হতে উঁকি দেওয়া৷ তারউপর মৌলভী আর কাজি সাহেব তো আছেনই! সব আজকের এই বন্ধনের সাক্ষী। যদিও মূল সাক্ষী হওয়ার কথা ছিলো বিপুর। বেচারা ধরা পড়ে গেলো। ইনি কি খালিদ ভাইকে কোনোভাবে তখন ফেলে আসতে পারতেন না?
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পুরুটা সময় শতরঞ্জিত অনুভূতি ঘিরে রেখেছিলো শ্রাবণকে। ভয়, পছন্দের পূর্ণতা, কাজী বাড়ির সমাগমের আনন্দ, অসুস্থতা, লজ্জা, সংশয়, দুশ্চিন্তা! সবই দশদিক হতে ঘিরে ধরেছে তাকে। সর্বক্ষণ চুপ থাকলেও দেনমোহর ধার্যের সময় মুখ ফুটিয়ে ফেললো সে। ইফতেখার দুই লাখ বলেছিলো। শ্রাবণ মুখ খুলে বলে ফেললো,
“মাত্র দুই লাখ? বেশি করা যায় না?”
এই সমাগমে ইফতেখার নিজেই যেন একটু বিব্রত হয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ বিস্ময় ধরে রাখা চোখে তাকিয়ে বললো,
“কত?”
“আপনি চেয়ারম্যানের বড় ছেলে। পাঁচ লাখ দিন। সমস্যা নেই, দেনা থাকবে আপনার যতদিন ইচ্ছে।”
কোলে দৃষ্টি রেখে এক হাতের আঙুলের সাথে অন্য হাতে খেলতে খেলতে মতামত ব্যক্ত করে শ্রাবণ। আশপাশের দুয়েকজন হেসেও উঠেছে মৃদুস্বরে। কিন্তু তারা দুজনের কেউই হাসেনি। ইফতেখার দ্বিতীয় কোনো কথাও বলেনি। বাবার অনুপস্থিতিতে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে এমনিতেই মনের ভেতর নিশপিশ ভাব অনুভব করছে। তারউপর এতো মানুষের সামনে কোনো আপত্তি, আলোচনায়ও যেতে চায় না। হলে হোক পাঁচ লাখই। দেনাই তো আছে। উপার্জনে সক্ষম না হলে ধনসম্পত্তিও আছে। তাই কোনোরকম ভাবনায় যেতে চায় না ইফতেখার। পাঁচ লাখই ধার্য হয়। কাজী বাড়ি ছেড়ে পুনরায় ইফতেখারের পিছু মোটরসাইকেলে চড়েছে শ্রাবণ। এবার ইচ্ছে থাকলেও ধরে বসা হলো না মনের সংশয়ে। ইফতেখার ধীর গতিতেই বাজার ছেড়ে তাকে নিয়ে বালির চড়ে এসেছে। একপাশে দোকানগুলো, অন্যপাশে দুয়েকজন মানুষের উপস্থিতি। যারা হাওয়া খেতেই ছাইরঙা আঁধারে ঠাঁই নিয়েছে। আর নদীর কাছাকাছি মাঝামাঝিতে অবস্থানরত আছে এই নব দম্পতি। শ্রাবণ মোটরসাইকেল থেকে নেমে মোটরসাইকেলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসটা ভালো লাগছে। কিন্তু শরীর ও মনের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হচ্ছে। ইফতেখারও একটু চিন্তিত। মনে মনে ভাবছে কিছু। হয়তো নিজেকে উপস্থাপন করার ব্যাপারেই। সে নেমে একটু এগিয়ে গেছে নদীর দিকে। ফোন হাতে নিয়ে সাইলেন্ট অবস্থা সরালো, কল লিস্ট দেখলো। খালিদ ভাইয়ের নম্বর হতে দুইটা কল এসেছে কয়েক মিনিট আগে। আর বিপুর নম্বর হতে অনেকগুলো কলই এসেছিলো ফোন সাইলেন্ট অবস্থায়। যখন সে বাবার সামনে আলোচনায় বসে ছিলো, তখন। এছাড়া আর কোনো নতুন তথ্য নেই। ফোন পকেটে রেখে সে আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে ওদিকেই। শ্রাবণ একটু দূর হতে তাকেই দেখে। তাকে বুঝতে চেষ্টা করে। নিজ মনের দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা তো আছেই! ইফতেখার এগিয়ে আসে আবার তার কাছে। জিজ্ঞেস করে,
“কি ভাবছেন?”
শ্রাবণ প্রশান্ত হাওয়ায় নিশ্বাস ভাসিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
“ভাবছেন তো আপনি।”
“বুঝতে পারছেন তবে? আপনি একটু বেশিই তাড়ায় ফেলে দিলেন আমাকে। বাড়িতে অতিরিক্ত ঘর নেই। ঘরের কাজ বহু বাকি।”
“আপনি কোথায় থাকেন তবে?”
“দুই ভাইয়ের এক ঘর। আপনি গেলে ভাইকে বাইরে ফেলে দিতে হবে।”
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ঠাঁই দিতে চায় যেন শ্রাবণ। শান্ত স্বরেই প্রত্যুত্তর করে,
“বিয়ের প্রস্তাব তো আমি দেইনি। আপনিই দিলেন।”
“ওইযে, ছুটে যেতে চাইছিলেন।”
“চাইলে যেতেই পারতাম, এখনো।”
“আজ চাননি বলে কাল কিংবা পরশুও যে চাইবেন না, তা তো বলা যায় না।”
“আপনি ভয় পান, আমি জানতাম না।”
“নিজের জিনিস হারানোর ভয় সবারই থাকে।”
“এতো অল্পতে নিজের জিনিস চিনে উঠা যায়?”
“এক পলকেও যায়।”
“কেমন সন্দেহ লাগছে আপনাকে। আপনার উদ্দেশ্য কি, সত্যি করে বলুন তো?”
“কিসের উদ্দেশ্য?”
“এইযে, স্বল্পতায় এক শিকড়হীনাকে বেঁধে রাখার উদ্দেশ্য।”
এবার ঠোঁট কার্ণিশে স্পষ্ট মৃদু হাসি ভেসে উঠে ইফতেখারের।
“পরিবারের বাইরে মোটরসাইকেল আমার অতি প্রিয় এখন পর্যন্ত। যার আয়নায় আপনি নিজের ছবি এঁকে দিয়েছেন। তাই দিনরাত এক করে আপনাকেই দেখতে হচ্ছে। মানুষ এভাবেই বুঝি প্রেমে পড়ে যায়? আমি জানতাম না। কিন্তু মনে হলো তা-ই।”
“ছবি এঁকে দিয়েছি! কখন? কোথায়?”
আরও কাছে এগিয়ে আসে ইফতেখার। শ্রাবণের পিছু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলের আয়নায় দুজনকেই ভাসিয়ে তোলে।
“ওইতো।”
লজ্জায় আয়নায় তাকিয়েও দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে শ্রাবণ। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“সে তো এখনকার দৃশ্য।”
“সেদিনের দৃশ্য বাজারে ছিলো। ভুলে গেলেন?”
একই অবস্থায় থেকে শ্রাবণ বিড়বিড় করে,
“কানে ফুলটা ঠিকমতো গুজে দিতে একটু আয়নাই তো দেখছিলাম।”
“এটাই তো চরম অপরাধ করে বসেছেন। নিজের না করা পর্যন্ত কেমন হারিয়ে যাওয়ার সংশয়ে ডুবে ছিলাম।”
“এভাবে না পালালেও তো হতো।”
“হতো না।”
“কেন?”
“সম যোগ্যতাহীন আত্মীয় করার লোক আমার আব্বা না।”
“এখন জায়গা দিবে?”
“কি জানি। তাইতো বিয়ে করলাম। দেখি, কি হয়। এখানে থাকবেন আরও কিছুক্ষণ? না যাবেন?”
“আমার ইচ্ছে করছে না যেতে।”
ইফতেখার কাছ ছেড়ে পুনরায় সামনে এগোয় আরেকটু সময় অতিবাহিত হওয়ার জন্য। মৃদু বাতাসে মনের সংশয়ও যেন হালকা হচ্ছে অনুভব হয়। শ্রাবণেরও হয়তো বা। তাই চাইছে আরও কিছুক্ষণ থাকতে। একটু নিরব থেকে সে জিজ্ঞেস করে,
“মজিদা কাকি তো আপনার নিকট কোনো আত্মীয় নয়, তাই না?”
“উহুম।”
“তবে আপনি উনার পরিচয়ও উল্লেখ করবেন না। পরিচয় হীন আছেন, একদম হীনই থাকেন।”
“কেন?”
“আবারও কেন! আমি তো আপনার পরিচয় নিয়ে পড়ে নেই। আমার আব্বার মান যেন না যায় ছোটখাটো পরিচয়ে। তাই আপনি দূরের মানুষ, পরিচয়ও দূরেই থাকুক। আচ্ছা, বাদ দেন। বাড়ি চলুন আগে। দেখি কি হয়। রাত বাড়ছে। আমার ক্ষুধা লেগেছে। দোকান থেকে কিছু নিয়ে আসবো আপনার জন্য?”
“পানি দরকার এখন।”
“নদী পাশেই।”
বলেই দোকানের দিকে এগিয়ে যায় ইফতেখার। শ্রাবণ তার কথায় মৃদু হাসতে গিয়েও হাসতে পারে না। বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বিয়েটা কি হওয়ারই ছিলো? সিদ্ধান্ত ভুল নিলো না তো? ওবাড়িতে কি হবে? এতো অস্বস্তি লাগছে কেন? মোটরসাইকেলে ভর করে দাঁড়ায় শ্রাবণ। শরীর ও মনের অস্থিরতা সমতালে বেড়ে যাচ্ছে। ইফতেখার পানি নিয়ে আসতেই বলে,
“একটু হেলান দিয়ে কোথাও বসতে পারলে ভালো হতো। আমার খারাপ লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে।”
“এখানে বসবেন কোথায়? বালিতে? হেলান দেওয়ারও তো জায়গা নেই।”
জবাব দেয় না শ্রাবণ। দুহাতের ভরই মোটরসাইকেলে ফেলে। চোখেমুখে ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছে ইফতেখার। তাই বললো,
“চলুন, বাসাতেই ফিরি।”
“হুম।”
ক্যাপ খুলে দিতেই পানির বোতলটা হাতে নেয় শ্রাবণ। এক ঢোক পানি গিলেই বোতল ফিরিয়ে দেয়। ছোট কেকের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলে নিলো না শ্রাবণ।
“আমি কিছু খাবো না। চলুন।”
“অযথা আনলাম!”
এক প্যাকেট ছিঁড়ে একটা কেক সে খেয়ে নেয় গপাগপ। শ্রাবণ ক্লান্ত চোখেও তাকিয়ে দেখে তার গলদ করণের ব্যস্ততা। খাওয়ার বেগ দেখে মনে হচ্ছে, পালিয়ে বিয়ে করেও কোনো দুশ্চিন্তা নেই তার মুখে। কি মানুষ! ভেবেছে দুটোই খেয়ে নিবে। তবে তা করেনি। একটা শ্রাবণের কাঁধের ব্যাগটা টেনে রেখে দেয়। পকেট থেকে তার এবং শ্রাবণের জন্ম সনদও ব্যাগে রাখে। মোটরসাইকেলে চড়ে বসে পরক্ষণে। মোটরসাইকেলে উঠে বসতেও দুর্বলতা অনুভব করছে শ্রাবণ। তখনকার অর্ধেক শক্তিও যেন নেই দেহে। এবার ইফতেখারের কাঁধে ভর করেই উঠে বসে। মোটরসাইকেল চলতে শুরু করলেও কাঁধ থেকে হাত সরায়নি। আর তখন সংশয়ে স্পর্শই করছিলো না তাকে। কিন্তু ইফতেখার বালির মাঠ ছাড়ার আগেই পুনরায় থেমে যায়। তার কাঁধটা পুরো গরম হয়ে গেছে এইটুকু আসতেই। শার্টের উপরে তাপমাত্রাটা সাথে সাথেই বুঝে উঠতে পারেনি তখন। এখন উপলব্ধি করতেই থেমে শ্রাবণের হাতের উপর হাত রেখে মুখাবয়বে বিস্ময়ের ঠাঁই দেয়। পিছু ফিরে কপাল ছুঁয়ে বলে,
“আপনার তো খুব জ্বর! বলেননি কেন এতোক্ষণ? ডাক্তার দেখাবেন?”
মাথাটা ভারি লাগছে, তাই সে মাথার ভারও হেলিয়ে দেয় ইফতেখারের পিঠে।
“আমার জ্বর আজ দুদিন ধরেই। আপনি বাসায় চলুন আগে।”
ইফতেখার বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ কাটে। শ্রাবণ এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠেই মাথা পেতে রেখেছে। ইনিই বিপুকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর লোক। ইনিই সেদিনের বৃষ্টিতে দূর হতে বৃষ্টিবিলাসীকে ভিজতে দেখে মাথা হতে ছাতা ফেলে দেওয়ার লোক। শ্রাবণ আড়ালে তাকে দেখতে পেয়েছিলো তাই বিপুকে ফেরত পাঠিয়েছে। বিপু সেই পাঠানো সামগ্রী ফেরত এনে টাকার কথা প্রকাশ করলে কোনোরকম না বলেই ইফতেখার পকেট থেকে টাকা বের করে চাপিয়ে দেয় বিপুর হাতে। ভাইয়ের হঠাৎ বদলে যাওয়া নবরূপ দেখে আনন্দ চিত্তে নিজের মাথার ছাতাও ফেলে দেয় বিপু। সে তো ভাবতেই পারেনি, ভাইও কারো প্রেমে পড়ে যাবে এভাবে! দুয়ের মধ্যস্থ বাহক হওয়াটা যেন দায়িত্বস্বরূপ নিয়ে নিয়েছে কাঁধে। তার বিশ্বাস ছিলো, কান্তা আর তার ব্যাপারটা পরিবারে একমাত্র ভাইই পাকাপাকি করতে পারবে। তাই ভাইয়ের চিঠির ডাকবাহক হওয়াটাও চরম সৌভাগ্যের মনে করে ছুটে যেতো কিঞ্চিৎ আহ্বান পড়তেই। ভাই ভাবির পুরো যোগাযোগটাই যেন তার মাধ্যমে পৌঁছায়। আর বারবারই বেকুব খালিদ ভাইয়ের কড়া নজরে শুধু সে-ই ফাঁসে!
চলন্ত মোটরসাইকেলে ঠান্ডা বাতাসটা ভালোই লাগছিলো উত্তপ্ত দেহে। যেন বাতাসের বেগে উত্তপ্ততা অনেকটা ছুটে গেছে এতোক্ষণে। যদিও তা নয়। মোটরসাইকেল চেয়ারম্যান বাড়ির গেইটে প্রবেশ করতেই মাথা তুলে নেয় শ্রাবণ। ইফতেখার ঘরের সামনে এসেই থামে। শ্রাবণ নেমে যায়। ঘরের ভেতরের সদস্যদের চোখ পড়ে এদিকে! মেয়েটাকে পিছু বসিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে ইফতেখার! এতোক্ষণ যাবত বিপুর উপরই ধাওয়া যাচ্ছিলো। ভাইয়ের বিয়েটা যেন সম্পন্ন হয়ে উঠে, সেজন্য চুপ ছিলো। মায়ের থাপ্পড়, বাবার বকাঝকা সব সহ্য করছিলো নিশ্চুপে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থেকে। প্রকাশ করলেই বিয়ে ভাঙার ভয়! খালিদ ভাই তাকে বাড়ি আসার জন্য ফোন করার সময় মনটা বলছিলো ভাই যেন ফোন রিসিভ না করে। যদি বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে বলেই দেয় সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তবে না তখনই আবার খালিদ ভাই ছুটে যায় ভাইকেও আটকে দিতে! এখন দুজনকে একত্রে ফিরতে দেখে কিছুটা শান্তি লাগছে। বাকিটা অশান্তির স্রোতে ভাসছে। কি যেন হয়! কি যেন হয়!