শ্রাবণধারা” পর্ব- ১৯ (নূর নাফিসা) .

0
124

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
“ফুটন্ত শাপলা আর আমি সবই আছে পাশে। তবে আজ কেমন লাগছে এসে?”
হাতের গড়া শাপলার মালা ইফতেখারের গলায় দিয়ে শ্রাবণ মিষ্টি হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“অপূর্ব।”
গলার মালায় হাত রেখে ইফতেখার বললো,
“মালা পরে মেয়েরা। আমার গলায় কেন?”
“বিয়েতে মালা বদল হয়নি, তাই।”
“আচ্ছা?”
খিলখিলিয়ে হাসে শ্রাবণ। নিজের গলা থেকে মালা খুলে শ্রাবণের গলায় বদল করে নেয় ইফতেখার। পরক্ষণে কোমল স্পর্শ স্থির করে কপালে। শ্রাবণ বাড়ি নিয়ে আসার জন্য এক আঁটি পরিমাণ শাপলা তুলে নিয়েছে। আঁটি বেঁধে দিয়েছে ইফতেখার নিজেই। মেঘেরা গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে। যখন তখন শ্রাবণধারা বইতে পারে। তাই বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাপলা বিল ত্যাগ করে এই যূগল। সময়টা অনন্য ছিলো দুজনের জন্যই। বাড়ি ফিরেই দেখে রক্তাক্ত মাথায় এসে দুয়ারে দাঁড়িয়েছে গ্রামের এক মধ্যবয়সী লোক। জীর্ণশীর্ণ দেহ আর পরনে মলিন লুঙ্গি। এক হাতে মাথা চেপে রেখে দাঁড়িয়েছে চেয়ারম্যানের মুখোমুখি। সঙ্গে আছেন এমনই জীর্ণশীর্ণ দেহের অধিকারী এক মহিলা৷ মাথায় ঘোমটা থাকলেও গলার স্বর যথেষ্ট উঁচু। অশ্রুসিক্ত উভয়ের নয়ন। হামলাকারীর নামে বিচার দিচ্ছে চেয়ারম্যান সমীপে। দূর থেকে দেখেই ইফতেখার ও শ্রাবণের ভ্রু মাঝে কুচকানো ভাব চলে আসে। ইফতেখার এগিয়ে যায় দ্রুত পায়ে। শ্রাবণও চিন্তিত ভঙ্গিতে গলার মালা আর কানের ফুল হাতে নামিয়ে নেয়। দ্রুত কদম ফেলে এগিয়ে যায় ইফতেখারের পিছু পিছু। ইফতেখার লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“খাঁয়ের কাকা, কি হয়েছে?”
লোকটি হামলাকারীর নামের আগে গালি দিয়ে জানায় তার ভাতিজা তাকে মেরেছে। মহিলার কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ঝগড়া শুরু হয়েছে তাদের দুই জায়ের মধ্যে। কথা কাটাকাটি চলার এক পর্যায়ে হুট করে ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই মহিলাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। তার স্বামী অর্থাৎ খাঁয়ের লোকটি তখন এগিয়ে ধমকে কৈফিয়ত চাইতে গেলে তার উপরই খুঁটি হাতে হামলা করে বসেছে। মাথা থেকে রক্ত ঝরিয়েছে। তারা শিগগির এর বিচার চায়। এক্ষুণি চায়। আফজাল হোসেন বারান্দার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থেকে বলছেন যে,
“আচ্ছা, আমি দেখমু নে। তুই গিয়া চিকিৎসা নে।”
“না, আগে বিছার করেন। এক্ষণ হের বিছার চাই। কয়দিন পরে পরেই হেয় দৌড়ায় মারতে আইবো ক্যা? হের আগেও মেম্বার বিছার কইরা দিছে, কোনো মান্যতা হেয় করে না। আপনে কিছু করবেন নাকি, কন।”
“বললাম তো, আমিই দেখমু। তুই যা।”
ইফতেখার তার কাঁধ স্পর্শ করে বলে,
“কাকা, আপনে ডাক্তারের কাছে যান। আব্বা বলছে তো দেখবে। চিন্তা করবেন না। অপরাধ যখন করেছে, বিচার হবে। কাকী, আপনি নিয়ে যান তো। রক্ত ঝরা বন্ধ করুন আগে।”
তারা বাড়ির বাইরে গেলেই আফজাল হোসেন ইফতেখারকে বলেন,
“ঘুরে দেখে আয় তো, কি হইছে বিষয়াশয়।”
ইফতেখার মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায় সাথে সাথেই। শ্রাবণ পিছু বলে দেয়,
“আপনি আবার উল্টাপাল্টা করতে যেয়েন না যেন। মাথা গরম হতে সময় নেয় না তো আবার।”
ইফতেখার এক পলকের জন্য পিছু ফিরে তার দিকে তাকায়। আফজাল হোসেনও শ্রাবণের কথার সুর ধরে বলে,
“হু, তুই কিছু করিস না। জেনে আয় শুধু।”
ইফতেখার চলে যেতেই শ্রাবণ শাপলার আঁটি হাতে বারান্দায় আসে। তার বড্ড খারাপ লাগছে তাদের দেখে। রাগ হচ্ছে ছেলেটার উপর। একটা ছেলে কিভাবে একটা মাতুল্য নারীর গায়ে লাথি মারতে পারে। বাবাতুল্য চাচার মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে! পারভীনের সাথে দাঁড়িয়ে অর্পা আর পরীও দেখছিলো এতোক্ষণ তাদের। শ্রাবণ পরীর হাতে শাপলার আঁটি ধরিয়ে দিতেই পরী জানতে চায়,
“আপনেরা নৌকা দিয়া ঘুইরা আইলেন?”
শ্রাবণ চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে পরীর জবাব দিয়ে আবার পিছু এগিয়ে দাঁড়ায় আফজাল হোসেনের সামনে।
“উনাদের একটা জিডি করলে ভালো হতো না, আব্বা?”
“বিচার যখন আমিই বসামু, জিডির কি দরকার?”
“আইনও তো বসে থাকার জন্য সৃষ্টি হয়নি। আপনি পুলিশ ডেকে দিলেই হয়তো বেশি ভালো হতো। যেহেতু ক’দিন পরপরই ছেলেটা তেড়ে মারতে যায় বললো। ভয়ের জন্য হলেও আইনী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”
“আমি যা বুঝি, তুমি তা বুঝো না।”
“তা হয়তো বুঝি না। কিন্তু স্পর্ধাটুকু পরিমাপ করতে পারি। কতটা জঘন্য স্পর্ধা নিয়ে সে কোনো মাকে লাথিতে ফেলে দেয়! তার শাস্তিটাও তো সেইরকমই হওয়া দরকার।”
“এক বাড়ির এক মানুষ। আজ ঝগড়া লাগলে, কালকেই আবার একত্রে চলবো। এইসব ব্যাপার আইনী ঝামেলায় না টানাই ভালো।”
দুঃখের সাথে ঠোঁটের কোণে সামান্য তাচ্ছিল্যকর একটা হাসি স্পষ্ট করে শ্রাবণ বলে,
“আজ মাথা থেকে কয়েক ফোটা রক্ত ঝরিয়েছে, কাল যে প্রাণটাকেই দেহ থেকে ঝরিয়ে দিবে না তারও নিশ্চয়তা নেই।”
কথাটা বলেই হাতমুখ ধুয়ে নিতে চলে যায় সে। আফজাল হোসেন তাকিয়ে থাকেন তার যাওয়ার পানে৷ বড়দের কথার উপর ছোটদের দখল দেওয়াটা তিনি ঠিক পছন্দ করেন না। কিন্তু যুক্তি ও স্পষ্টবাদিতায় আকৃষ্ট হোন বটে। এই মেয়েটা ভাষ্যের দিক থেকে ভীষণ সুস্পষ্টবাদী। কিন্তু কথাগুলো বলে বিদ্ধ ভাবার্থে। সরল বাক্যে জটিলতার ভাব স্পষ্ট না করলেই যেন চলে না তার। উপস্থিত পারভীনের কাছেও ভালো লাগলো না শ্রাবণের আচরণ। শ্রাবণ যখন রান্নাঘরে আসে, পারভীন তখন আফজাল হোসেনের নাশতা গুছায় প্লেটে। শ্রাবণকে দেখতেই গম্ভীরমুখে বলে,
“পাঁচ-ছয় বছর যাবত চেয়ারম্যান তিনি, এমনে এমনেই দায়িত্ব পালন করতাছে না। ছোট মানুষ, ছোটর মতো থাকবা। মুরব্বিগো কথাকাজের উপর পাকনামি করা ছাড়ো। এইসব তোমারে সাজে না। বউ না খালি, আমার একটা মাইয়াও আছে ঘরে। তোমারেও ভিন্ন চোখে দেখি না। হয়তো শ্বাশুড়ির কথা গায়ে লাগবো বেশি। কিন্তু এইসব বেয়াদবি। উচ্চ ডিগ্রি পাইছো, কিন্তু আদবকায়দা তেমন পাও নাই দেখতাছি।”
শ্রাবণ কোনো কথা রাখে না তার বিপরীতে। পারভীন প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে যায়,
“ঢাকনার নিচে রুটি আছে। হাড়িতে ভাতও আছে। যেইটা ভাল্লাগে, খাও।”
শ্রাবণ প্লেট নিয়ে দুই মুঠো ভাতই তুলে নিলো। রান্নাঘরের জানালার পাশে মোড়া পেতে বসে এখানেই খেতে লাগলো। এক লোকমা মুখে তুলে বাইরে তাকিয়ে থাকে ভাবুক ভঙ্গিতে। পরবর্তী লোকমায় এভাবে পড়ে যায় অস্বাভাবিক বিরতি। পরী অর্পার জন্য খাবার নিতে এসে তাকে এভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
“ভাতে মাছি পরবো তো, ভাবি৷ কি এতো ভাবতাছেন?”
মুখে মৃদু হাসি এনে ডানেবামে মাথা নেড়ে খাওয়ায় মনযোগ দেয় পুনরায়। বাইরে এসে ইফতেখারের দেখা পায়। বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে ফোটা ফোটা। ইফতেখার উঠুন ভেদ করে দৌড়ে আশ্রিত হয় বারান্দায়। মাথার চুল ঝারতে ঝারতে যায় বাবার ঘরে। শ্রাবণ বারান্দায় দাঁড়িয়েই শোনে তাদের কিছু কথপোকথন। শফিক ছেলেটাকে বাড়ি গিয়ে পায়নি সে। তার মায়ের কাছে শুনে এলো কিছু। তিনি জানালেন উল্টো তারাই স্বামী-স্ত্রী মিলে আগে হামলা করেছে তাদের মা, ছেলে আর বাবার উপর। তাই তারাও পাল্টা দিয়েছে। বাবামাকে অক্ষত অবস্থায় দেখা গেছে। ছেলেকেও যে খুব মেরেছে, বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইফতেখার তাদের তিনজনকেই বিকেলে আসতে বলে এসেছে চেয়ারম্যান বাড়িতে।
মলিন মুখে কলেজের জন্য তৈরি হয়েছে কান্তা। এরই মধ্যে নামতে শুরু করেছে টুপটাপ ফোটা ফোটা বৃষ্টি। ছাতাটা কোথায় রেখেছে, খুঁজে পাচ্ছে না। ছাতা বিহীন বের হলেই না মাঝ রাস্তা ছুঁতে ছুঁতে ভিজে যাবে পোশাকাদি! কিছুক্ষণ খুঁজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মায়ের অপেক্ষায়। পুকুরে হাড়িপাতিল মাজতে গিয়েছিলো শিরিন। বৃষ্টি পড়তে দেখেই ঝটপট কাজ সেরে বাড়ি ছুটে এসেছে। বারান্দায় বোরকা পরে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তার কপাল কুচকে আসে। হাড়িগুলো চটের বস্তায় উপুর করে রেখে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কই যাছ তুই?”
“কলেজে।”
“কোনো কলেজ ফলেজ লাগতো না। ঘরে যা। বোরকা খোল গিয়া কইতাছি।”
“পরীক্ষা। আমার যাইতে হইবো।”
“কোনো পরীক্ষাও লাগতো না আমার। বহুত করছত পড়াশোনা।”
“আম্মা, এমন কইরো না তো। সময় চলে যাইতাছে। ছাতা কই রাখছো?”
“ছাতা পাতার খবর জানি না। তোরে ঘরে যাইতে কইছি।”
“লাগবো না তোমার ছাতা।”
ঠমক দিয়ে উঠুনে নেমে যায় কান্তা। শিরিন পিছু হতে গলা উঁচিয়ে বলে,
“এই যে, যাইতাছোস। যা। আর আয়িছ না।”
বিপরীতমুখী দুয়ার হতে মজিদা বলে,
“যাক না। এমন করছ ক্যা? পরীক্ষা যহন, কলেজ যাইতো না?”
“আরে, ভালা না তো। ভালা না। ভালা হইলে ঠিকই পড়ালেখা করাইতাম।”
“ক্যা, কি করছে?”
“করে নাই, করতে কতক্ষণ? বন্ধুবান্ধব লইয়া চলার হইলে লাগতো না এমন পড়ালেখা। বিয়া দিমু, জামাইর বাড়ি গিয়া সংসার করবো। পড়াশোনা দিয়া কি হইবো?”
ঠমকে ঠমকে ঘরে চলে যায় শিরিন। বলতে গিয়েও যেন বলতে পারে না কারণ। কানাঘুঁষায় জানাজানি হবে। গরীব এমনিতেই মূল্যহীন। কোনো অসম্মানজনক কথা জুড়লে কন্যা প্রদানের জন্য একটা ভালো ঘরও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনিতেই তো পাত্র মিলে না। পাত্রীর দুর্নাম রটলে এই মেয়ের কি করবে? বুক ভরা কষ্ট একা একাই পুষে যায় বুকের মাঝে। মনযোগ দেয় আসবাব গুছানোর কাজে৷ হাড়ির ঢাকনা খুলে দেখে ভাতও খেয়ে যায়নি মেয়ে। না খেয়ে, না খেয়ে মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে একদম। মায়ের কষ্ট লাগে না বুঝি এই চেহারা দেখে? কিন্তু রাগও তো কমানো যায় না। কত স্পর্ধা নিয়ে বলে দিলো, বিয়ে দিতে হলে ওই ছেলের সাথেই দিতে। দুয়ের যে কোনোদিক হতেই মিলবে না, এটা কি একবার ভেবেছে?
বাজারে ছাত্রলীগের ক্লাবে বসে ছিলো বিপু। চোখের পলকে একবার মনে হলো রিকশায় কান্তাকে দেখলো। কিন্তু কান্তা তো হেঁটে যাওয়া আসা করে। মনের সন্দেহ বলে ছেড়েও যেন ছাড়তে পারলো না। দুপুরে মন টেনে আনলো তাকে কলেজের দিকে। কলেজ ছুটির সময় এসে দাঁড়িয়ে রইলো কলেজের পাশেই। যদি এসে থাকে, অবশ্যই দেখা হবে। হলোও তা-ই। কান্তা বের হওয়ার সময়ই তাকে দেখেছে রাস্তার বিপরীতে। এড়িয়ে যেতে দুই পা এগিয়েও থেমে গেলো। পুনরায় তাকিয়ে রাস্তা পেরিয়ে বিপুর কাছেই গেলো।
“এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
বিপু জবাব না দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে ভীড় কাটিয়ে উঠার নিমিত্তে। সাথে কান্তাও হাঁটে সমতালে। ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি অংশ কাটিয়ে এলেই পায়ের গতি ধীর করে হাঁটতে থাকে দুজনেই। কান্তাকে জিজ্ঞেস করে,
“তোকে দেখা যায় না কেন আজকাল?”
“কি দরকার?”
“দেখাটাই দরকার।”
দৃষ্টি ফিরিয়ে বিপুর চোখে তাকায় সে একবার। বিপু তার বাম পাশ থেকে ডান পাশে এসে হাঁটে। তা লক্ষ্য করে কান্তা বলে,
“ঘরে থাকতেই তো আমার ভয় করে। রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কি হবে? একটা গাড়ি এসে মেরে দিয়ে গেলেও ভালোই হবে।”
“একটা চড় দিবো কষিয়ে।”
“এক চড়ে যদি মেরে ফেলতে পারেন, তো দেন।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here