পূর্নতিথি লেখনীতেঃনুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (২৪)

0
182

#পূর্নতিথি
লেখনীতেঃনুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৪)

গোধূলি বিকেল। চারপাশ ধুয়েছে নরম আলোয়।সূর্য মুখ লুকিয়েছে উঁচু পাহাড়ের পিঠে। লাল আভা দিচ্ছে প্রকৃতি। এ যেন এক অনন্য মহিমান্বিত খেলাঘর…..

তিথি মাত্রই সি এন জি থেকে নেমেছে। আরেকটু এগোলেই তন্ময়ের বাসা। গলির ভেতর সি এন জি ওয়ালা ঢুকবেননা। এখানেই নামতে হলো তাই। কাঁধ ব্যাগ টা আরেকটু কাঁধের ওপর দিকে ঠেলে তিথি পা বাড়ালো। দুহাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে রাখা একটা বড় সাইজের টেডিবিয়ার। তুষারের জন্মদিনের উপহার। দেখলে হয়ত ভীষণ খুশি হবে! টেডির টাকা সুচিত্রাই দিয়েছেন। নাদুস-নুদুস বাচ্চাটা তারও মন কেড়েছে একদিনেই। কাজের ব্যাস্ততায় না-ই বা হলো আসা।উপহার পাঠাতে দোষের কি? তিথি এক- দু পা এগোতেই সামনে থেকে দৌড়ে আসতে দেখলো তন্ময়কে। রীতিমতো হুড়মুড়িয়ে আসছে সে। ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পরলো তিথি। এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন ছেলেটা? তন্ময় এসে থামলো ওর সামনে। সু-সাস্থ্যবান লোকটা এতটা দৌড়ে হাপিয়ে গিয়েছে ।প্রথমে দু হাটুতে ভর দিয়ে খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর বুকে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বড্ড বেগ নিয়ে বলল,

‘ এসেছো?

তিথি তখনও ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ছিলো।চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বলল,

” এভাবে এলে কেন?

তন্ময় দম নিয়ে বলল,

‘ ছাদ থেকে দেখলাম তুমি আসছো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি।

তিথি অবাক হয়ে বলল,

‘ আমি তো বাসা চিনি।

তন্ময় একটু হেসে বলল,

‘ চিনলে,অসুবিধে কি? এতটুকু পথ একসাথে চলা তো হবে।

তিথির বিস্ময় আকাশ ছুঁলেও ভাষায় প্রকাশ করলোনা। কিছু চমক অপ্রকাশিত থাকলে ক্ষতি নেই। স্বাভাবিক ভাবে হাটা ধরলো কিছু না বলেই। তন্ময় তখন কৌতুহলে গলা ডুবিয়েছে।তিথির মুখের ভঙ্গি দেখে ওর রাগ,খুশি বোঝা মুশকিল। মেয়েটা এমন কেন? আগের মত হাসেনা,প্রান খুলে কথা বলেনা। কেন বোঝেনা তার জ্বলন -পোড়নের সমাদরে দুলতে থাকা অনুভূতি? ভেবে পায়না তন্ময়। ভাবতে না বসে তিথির পেছনে পা এগোয় সে। আশেপাশের গাছের সবুজ পাতা তখন একটু একটু নড়ছে। শীতকালের ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে এলোমেলো ছোট চুল। সামনে প্রেয়সী,পেছনে সে, মাঝখানে অপ্রতিরোধ্য কিছু দেয়াল। চারদিকে আর কেউ নেই। প্রেম প্রেম অনুভূতির এইতো ক্ষন,এইতো মুহুর্ত। তন্ময়ের কন্ঠনালিতে গানের শব্দ উঁকি দিলো।গলা ফাঁটিয়ে গান ধরতে ইচ্ছে করলো…

‘ এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো।
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো!
হেটে হেটে জীবন, পার হলে বেশ হয়, এক সাথে পা মিলিয়ে চলোতো!

শেষের লাইনটি নিজের মত বানালো তন্ময়।গুনগুন সেই গানের সমাপ্তি ঘটলো, তার বাসার গেটের কাছে এসে। তিথি লোহার গেট খুলে ঢুকেছে ভেতরে। তন্ময় দাঁড়িয়ে ঠোঁট কাঁমড়ালো। হঠাৎ নিজের মাকে নিয়ে চিন্তা হলো। মা কি আগের মত কথা বলবে তিথির সাথে? কথাটা ভেবে কিছুক্ষন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে তন্ময়। পরমুহূর্তে নিজেই ভাবলো,

‘ ধুর! যা হবার হোক।

কলিং বেল চাপার প্রয়োজন পরেনি। দরজা হা করে খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলো তিথি। বসার ঘরে বেশ ক’জন অপরিচিত মুখ। সে ঢুকতেই সবাই এক ঝোঁকে তাকালো। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলো তিথি। ঢোক গিলে পেছনে তাকালো ।তন্ময় এখনও এসে পৌছায়নি। কোত্থেকে তুষার দৌড়ে এসে তিথির সরু কোমড় জড়িয়ে ধরতেই একটু কেঁপে উঠলো তিথি। খেয়াল করতেই বুঝলো এটা কে? মুচকি হাসলো তিথি।তুষার খুশি খুশি কন্ঠে বলল,

‘ তুমি এসেছো তিথিদি? এই টেডিটা আমার জন্যে এনেছো তাইনা?

তিথি মাথা নেড়ে” হ্যা “জানাতেই তুষার ছোঁ মেরে নিয়ে এক ছুটে ভেতরে চলে গেলো। তিথি ডাকতে চেয়েও ডাকলোনা।এদিক ওদিক তাকালো। অনেকেই তাকে কৌতুহল নিয়ে দেখছে। তিথি খুঁজছে নির্মলা দেবিকে। কই তিনি? পেছন থেকে তন্ময় বলল,

‘ এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

তিথি ওর দিকে ঘুরলো,বলল

‘ আন্টি কোথায়?

‘ মা হয়ত নিজের ঘরে বা রান্নাঘরে। দেখো গিয়ে।

তিথি মাথা নেঁড়ে বসার ঘর ছেড়ে ভেতরের দিকে যায়। পাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা তন্ময়কে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ কে রে মেয়েটা?

তন্ময় একটু হেসে অকপটে বলল,

‘ আপনাদের বৌমা মামি।

ভদ্রমহিলার চক্ষু চঁড়কগাছ।তন্ময় তাতে ভ্রক্ষেপ না করে নিজের ঘরের দিকে হেটে গেলো। ভদ্রমহিলা চাপা স্বরে পাশের জনকে বললেন,

‘ দেখলেন নির্মলার কান্ড? ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছে অথচ আমাদের বললনা। আর আজকালকার ছেলেমেয়ের কি দশা!বিয়ে ঠিক না হতেই শ্বশুর বাড়ি হাজির এরা।ছ্যাঁছ্যাঁ আমাদের সময় তো নাক সমান লজ্জ্বা ছিলো আর এদের? লজ্জ্বা শরমের বালাইও নেই।

______

তিথি প্রথমে নির্মলা দেবির ঘরে দেখলো।সেখানে নেই দেখে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।মাঝপথে হঠাৎ এসে ওর হাত টেনে ধরলো তুষার। তিথি তাকাতেই দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘ ভয় পেয়েছ?

তিথি মাথা নেঁড়ে বলল

‘ উহু।

‘ এসো আমার সাথে…

সোজা তন্ময়ের ঘরে এসে থামলো তুষার।তিথিকে বসিয়ে গিয়ে দরজা লাগালো । তিথির কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা। তুষার এসে বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসলো। বড়দের মত মুখ করে বলল,

‘ মাকে খুঁজছো?

‘ হ্যা।

‘ মা খুউউব রেগে আছে তিথিদি।

তিথি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ কেন?

‘ কি জানি, কাল রাতে দাভাইয়ের সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে।

তিথি বিস্মিত হয়ে বলল,

‘ ওমা কেন?

তুষার এবারো বলল,

‘ কি জানি!আমাকে তো অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো দাভাই।তবে একটু একটু শুনেছি, মা, দাভাই ওরা বারবার তোমার নাম নিচ্ছিলো।

তিথি স্তব্ধ। কোনো ভাবে তাকে নিয়ে ঝামেলা হয়নি তো? না না, ভগবান আর যাইহোক এরকম যেন না হয়।একটা সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে ফাটলের কারন কস্মিনকালেও যেন সে না হয়। তুষার আরো কিছু বলতে নিলে দরজায় কঁড়াঘাতের প্রবল শব্দ এলো।থেমে গেলো তুষার।স্বর উঁচু করে বলল,

‘ কে?

ওপাশ থেকে নির্মলা দেবি চেঁচিয়ে বললেন,

‘ দোর বন্ধ করে কি করিস তুই? রেডি হয়েছিস? অতিথিরা চলে এসছে।তোর স্কুলের বন্ধুরাও তো চলে এলো। দরজা খোল।

তুষার জ্বিভ কাটলো।তিথির দিকে ঘুরে ব্যাস্ত কন্ঠে ফিস- ফিসিয়ে বলল,

‘ আমি যাই এখন তিথিদি।তুমি দাভাইকে এগুলো বলে দিওনা হ্যা? আমার কান মলে দেবে তাহলে।

তুষার দরজা খুলে দৌড়ে বের হয়ে গেলো।নির্মলা তখনও তিথিকে দেখেনি।তুষারের যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকাতেই দেখলো ওকে। এই প্রথম তিথির অজান্তেই অস্বস্তি হলো ওনার সামনে। উঠে দাঁড়ালো সে। দুহাতের আঙুল গুলো একে অপরের সাথে কচলাতে শুরু করলো। নির্মলা দেবি বড্ড শান্ত, নিরুদ্বেগ কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি? কখন এসছো?

তিথি আস্তে করে উত্তর দিলো,

‘ এইতো মাত্র।

নির্মলা একটু চুপ থেকে বললেন,

‘ বসো। কিছু লাগলে ডেকো।

নির্মলা চলে গেলেন তারপর। তিথির অবাক লাগলো তার ভাবমূর্তি। বিন্দু পরিমান হেসেও কথা বললেন না নির্মলা। এতক্ষন তুষারের কথায় খুব পাত্তা না দিলেও বিষয়টা ভাবাচ্ছে এখন। কাল রাতে কি এমন হলো তাকে নিয়ে? আর তাকে নিয়ে হওয়ারই বা কি ছিলো? তন্ময়কে প্রশ্ন করবে এ নিয়ে? কোথায় ও? না থাক, এখন বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।ভালো এখানেই বসে থাকা।বাইরে ওদের আত্মীয় স্বজন আছে। ভীষণ অপ্রস্তুত লাগে সবার সামনে।

তন্ময়ের ম্যাগাজিন পরার অভ্যেস। রুমটাও যেহেতু তার,আজকের ম্যাগাজিন থাকবে নিশ্চয়ই? তিথি তন্ময়ের স্টাডি টেবিলের কাছে গিয়ে পেয়েও গেলো পত্রিকা। এখন আর কি? এটা পরেই সময় কাটানো যাক!

____
সন্ধ্যের পর কেক কাটা হলো। সবাইকে পেট পুঁড়ে নিজ হাতে রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়ালেন নির্মলা। সবার সাথে সাথে তিথিও ছিলো৷ কিন্তু অদ্ভূত ভাবে পুরোটা সময় নির্মলা আর কোনো কথাই বললনা ওর সাথে।চোখাচোখি হলেও ভ্রক্ষেপন করেননি। বাকি পাঁচজন অতিথির মত আপ্যায়ন করেছেন তাকে।তন্ময়কে বারবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েও হয়নি। তন্ময়কে তো ধারেকাছে পায়ইনি তিথি।সে ভীষণ ব্যাস্ত।দু সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কথা শোনার সময় নেই।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে আত্মীয়রা চলে যেতে শুরু করেছেন। শহরের বাসায় কেউ দু -দণ্ড সময় নেয়না কারো বাসায় বালিশ পেতে ঘুমোনোর। পুরো বাড়ি যখন আগের মত নির্জীব হলো, তু্ষার তখন ছুটলো পড়নের জামা কাপড় পাল্টাতে।বন্ধুরা দুষ্টুমি করে ডিম লাগিয়ে, গা মেখে দিয়েছে । এই শীতকালে এখন স্নান সাড়তে হবে ভেবেই তুষারের মেদ যুক্ত শরীর ভয়ে দোল খাচ্ছে। তবু গায়ের আঁশটে গন্ধ দূর করা জরুরি। নাহলে বিছানায় মা ঘুমোতে দেবেন না নির্ঘাত।

তিথি অনেকক্ষন বসে অাছে সোফায় ,তন্ময়ের অপেক্ষায়। রাত অনেক হয়েছে। এতটা পথ এক একা বাড়ি ফিরতে সমস্যা হবে।তাছাড়া তিন বছর আগের সেই কালো রাতের কথা মনে এলেও ঘাম ছুটে যায়। সাহস হয়না ওই রাস্তা ধরে একা একা ফিরতে। তন্ময় নিঁচে গয়েছে। কোনো এক আত্মীয়দের গাড়িতে তুলে দিতে। নির্মলা ব্যাস্ত খুব,গোছগাছ করতে।তিথি অনেকবার সাহায্য করতে চাইলেও তাকে শুধু ‘না’ বলে নিষেধ করেছেন তিনি।বাড়তি একটা কথাও বলেনি। পাশের বাসার কাজের মেয়েকে টাকা দিয়ে কাজ গুলো করাচ্ছেন। তিথি তখনও অপেক্ষা করছে। সামনে টেলিভিশনে কার্টুন চলছে জোর ভলিউমে। তিথির চোখ গুলো সদর দরজার দিকে।এই বুঝি তন্ময় এলো! একা একা বসে থাকাও যে কষ্টের!

হঠাৎ গলা ঝেঁড়ে কাশি দিলো কেউ। তিথি ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো। নির্মলা দেবিকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। নির্মলা তখন শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছছেন মুখমন্ডলের। তিথি তাকাতেই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ একটু আমার ঘরে এসো। কথা আছে।

বলেই নির্মলা চলে গেলেন।তিথির মুখে ঘাঁবড়ে যাওয়া ছাপ। অপ্রচলিত পা বাড়ালো ঠিকই তবে বারবার পেছনে দেখছিলো। হয়ত তন্ময়কে খুঁজছে। কিংবা না,

ঘরের সামনে এসে বলল

‘ আসবো?

নির্মলা ওয়াড্রবের ড্র‍্য়ার খুলতে খুলতে জবাব দেন,

‘ এসো।

তিথি ভেতরে ঢুকলো। নির্মলা বসতে বললেন।তিথি বসলো। নির্মলা একটা সুতির শাড়ি বের করে হাতে ঝোলালেন,ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,

‘ সারাদিন অনেক কাজ করেছি।ঘেমে গিয়েছি প্রচুর।তুমি অপেক্ষা করো। স্নান সেড়ে আসছি।

তিথি ঘাঁড় কাত করলো। নির্মলা সেটুকু দেখলেনওনা। সোজা ঢুকে পরলেন ওয়াশরুমে। তিথি বসে বসে ভাবছে,

‘ কি হল হঠাৎ? আন্টিকি কোনো কারনে আমার ওপর রেগে আছেন? আমিতো কিছু করিনি। কেউ আমার ওপর রেগে থাকলে আমার একদম ভাল লাগেনা। আন্টি এলে সরাসরি জিজ্ঞেস করব আমি?
তিথির ভাবনা চলতে থাকে। অারো কিছু সময় পর বের হলেন নির্মলা। বারান্দায় গিয়ে প্রথমে ভেজা শাড়ি মেলে দিলেন।রুমে এসে সাদা কালো চুল মুছলেন গামছায়। চুলে গামছা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে গিয়ে বসলেন বিছানার ওপর। তিথি তখন ওনার দিকেই চেয়ে ছিল। নির্মলা চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন ওকে। তিথি উঠে গিয়ে বসলো পাশে।নির্মলা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,

‘ জানো,তন্ময় কখনও আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলেনি।কাল রাতে বলেছে।প্রথম বার,তোমার জন্যে।

তিথি ঠান্ডা চোখে তাকালো।নির্মলা বললেন,

‘ আগে আমি জানতাম আমার ছেলে তোমাকে চায়,এখন বুঝতে পারছি, বিশ্বাস করছি ও তোমাকে কতটা চাইছে।তুমি জানো তন্ময় তোমার অতীতের ব্যাপারে আমাকে সব জানিয়েছে?

তিথি অবাক হলো। নির্মলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ এক মুহুর্তের জন্যে আমি তোমাকে মেনে নিতেই পারছিলাম না।আমি যাকে আমার ছেলের বউ করব ভাবছি, তার জীবনে অন্য পুরুষ ছিলো এ ভাবতেও আমার কেমন কেমন লাগছিলো। সে নিয়েই তন্ময়ের সাথে তর্কাতর্কি হলো। তবে পরে ভাবলাম, একটা কথাতো সত্যি, অতীত কার না থাকে!

এটুকু বলে নির্মলা তিথির দিকে তাকালেন,বললেন,

‘ এসব কেন বলছি নিশ্চয়ই জানো? তোমার মায়ের কাছে আমি তোমাদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।উনি বলেছেন না তোমাকে?

তিথি ঈষৎ মাথা দুলিয়ে ‘হ্যা ‘ জানালো।নির্মলা একটু চুপ থেকে হঠাৎ তিথির হাত দুটো মুঠোয় ধরলেন। নরম কন্ঠে বললেন,

‘ দেখো মা,আমার দুই সন্তান হলেও তন্ময় আমার অনেক সাধের সন্তান। বিয়ের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, অনেক চেয়ে কান্নাকাটির পর ও আমার পেটে আসে। খুব যত্নে,আদরে ওকে আমি মানুষ করেছি। আমি চাইনা, তুমি মনের মধ্যে অন্য কাউকে পুষে ওকে বিয়ে করো। আমার শেষ কথা হলো,তোমার জীবনে যেই থাকুক আমার ছেলেকে বিয়ে করলে ওকে ভালোবেসেই করো। ওকে কোনো অপশন হিসেবে বেছোনা।সারাটাজীবন ওকে তিলে তিলে মরতে দেখতে, মা হিসেবে আমি পারবনা।পারার কথাও নয়।আমি ছেলের সুখ চাই।সে তোমার সাথে সুখি হলে আমার আপত্তি নেই।কিন্তু হ্যা,তন্ময়ের মনের পুরোটা জুড়ে যেমন তুমি আছো, তোমার মনের পুরোটা জুড়েও যেন একিভাবে তন্ময় থাকে।

জবাবে তিথি শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি তন্ময়কে বিয়ে করবনা আন্টি।আপনার এত চিন্তার কিছু নেই।

নির্মলার চোখদুটোতে রাজ্যের বিস্ময়। তিথি আস্তে করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

‘ আমি তন্ময়কে কখনো ভিন্ন চোখে দেখিনি। ভাগ্যে কি লেখা আমি জানিনা,যদি এমন কোনো দিন এসেও থাকে আপনার কথাগুলো আমার মাথায় থাকবে।

পরমুহূর্তে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমার যাওয়া প্রয়োজন আন্টি।রাত অনেক হয়েছে।মা চিন্তা করবে।

তিথি নির্মলার দিকে দেখলোনা।দরজা অব্দি যেতেই নির্মলা পিছু ডাকলেন।তিথি তাকালো।নির্মলা এতক্ষনে শুভ্র হেসে বললেন,

‘ আবার এসো।

তিথি অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ হু।

তিথি ঘর ছেড়ে বের হতেই দেখলো সদর দরজা দিয়ে মাত্র ঢুকেছে তন্ময়। তিথিকে মায়ের ঘরের সামনে দেখে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলো ও। চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

‘ মা কিছু বলেছে তোমায়?

তিথি দুদিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালো।পরমুহূর্তে বলল

‘ আমাকে দিয়ে আসবে বলেছিলে?দিয়ে এসো।

তন্ময় জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল

‘ আগে আমার রুমে চলো।কথা আছে।

তিথির হাত ধরেই দ্রুত পা ফেলল তন্ময়। রুমে এসে দাঁড়াতেই তিথি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ কি হচ্ছে বলবে? একিদিনে তোমাদের সবার কথা আছে? তোমার,আন্টির,তুষারের।

তন্ময় ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

‘ তুষারের আবার কি কথা?

তিথি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,

‘ কোথায় গিয়েছিলে? এত দেরি করলে ফিরতে।অপেক্ষা করছিলাম।

‘ মেজো কাকাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। গোপালগঞ্জ যাবেন উনি।

তিথি ছোট করে বলল, ‘ওহ।কি বলবে?

‘ আগে বলো মা কি বলেছে? তুমি তখন মিথ্যে বলেছো আমি জানি।

তিথি হেসে বলল,

‘ তন্ময়,যখন বুঝতেই পারলে বলতে চাইছিনা তাহলে কেন জিজ্ঞেস করে বিব্রত করছো?

তন্ময় এরপর আর কথা খুঁজে পেলোনা। লম্বা শ্বাস টেনে চেয়ার দেখিয়ে বলল,

‘ বোসো।

তিথি বসলো। কাঁধ ব্যাগটা রাখলো কোলের ওপর। তন্ময় বলল,

‘ কাল কি বলেছিলাম মনে আছে?

‘ আছে।কিছু কথা বলবে?

‘ হু।

এটুকু বলে এক অদ্ভূত কাজ করলো তন্ময়।তিথির পায়ের কাছে হাটুমুড়ে বসলো। এক প্রকার চমকালো তিথি।উদ্বেগ নিয়ে বলল,

‘ এখানে বসলে যে..

তন্ময় প্রস্বস্থ হেসে তিথির হাত দুটো ধরলো। তিথি আরো চমকালো।তন্ময়ের চোখে মুখে তখন অন্য ভাষা।তিথি পড়ার চেষ্টা চালিয়েও ব্যার্থ হলো।তন্ময় একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ আজ তোমাকে আমার জীবনের কিছু সত্যি জানাব।অপ্রকাশিত সত্যি।

তিথি চোখ সরু করলো।তন্ময় এক হাতে তিথির হাত দুটো ধরে,অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো।একটু বাদে একটা মেয়ের ছবি বের করে তিথির সামনে ধরলো।

‘ ওর নাম অবনী। আমার ব্যাচমেট?

তিথি ছবিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তন্ময়ের দিকে ফিরলো।ভ্রু নাঁচিয়ে বলল
‘ তো?

তন্ময় শুকনো ঢোক গিললো। ফোনটা আবার পকেটে রেখে তাকালো।বলল,

‘ আমি যখন কলেজে পড়ি? তখন আমাদের আলাপ হয়।তারপর হয় বন্ধুত্ব।একটা সময় আমিই ওকে প্রপোজ করি।একবারেই রাজি হয়ে যায় অবনী। বলে, আমাকেও ওর পছন্দ। তারপর শুরু হয় আমাদের সম্পর্ক। ও অনেক ফ্রি ছিলো।আর পাঁচটা মিডল ক্লাশ মেয়েদের মত ফ্যামিলিগত বাঁধা হয়ত ছিলোনা।কোথাও যাওয়া,থাকা নিয়ে হয়ত সমস্যা পোহাতে হতোনা।তাই ইচ্ছেমতো দেখা করতাম।চুটিয়ে প্রেম চালিয়েছি দুজন। একটা সময় সম্পর্ক আরো গভীর হলো।ইন্টিমেট হলাম দুজন। আমার এক বন্ধুর বাসা ফাঁকা থাকায় ওটাই ছিলো প্রথম জায়গা। অবনীরই স্বায় ছিলো বেশি। এরপর অনেক বার ইন্টিমেট হয়েছি আমরা।

এটুকু বলে তন্ময় শ্বাস নিলো।তিথির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও কেমন অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছে।তন্ময় আবার বলতে শুরু করলো,

‘ দিন পার হলো।মাকে জানালাম ওর কথা। মা রাজি হলেন।অবনীর কথার জাদুতে মা ঘায়েল হলো একবারেই। সব ভালোই যাচ্ছিলো।হঠাৎ অবনী একদিন আমাকে ফোন করলো।জানালো ও প্রেগন্যান্ট। আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম,মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই? ও উত্তরে বলল,
‘ না তার দরকার নেই।আমি এবোরশন করাব।তুমি টাকা পাঠাও।

একটু অবাক হলাম।যেখানে আজকাল মেয়েরা এমন কাজের পর মাথা ঠুকেও ছেলেদের বিয়ের জন্যে কনভেন্স করতে পারেনা,সেখানে আমি নিজে থেকে বলেও…
তারপর ভাবলাম,হয়ত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছেনা,বা অপেক্ষা করছে বয়স টা পরিপক্ক হওয়ার। টাকা পাঠাই ওকে।ও এবোরশন করায়। তারপর আবার সব কিছু আগের মত।দুজনের ইন্টিমেট হওয়া তখনও বহাল ছিলো। হঠাৎ সিচুয়েশন পাল্টে যেতে লাগলো।বদলাতে থাকলো অবনী। আমার বন্ধুরা প্রায়ই ফোন করত আমায়,বলত,আজ এই ছেলের সাথে ওকে দেখেছে কাল আরেক ছেলের সাথে।এমন বহু ফোন,বহু। আমি প্রথম প্রথম পাত্তা দেইনি। কিন্তু ব্যাপারটা বাড়তে থাকলো।অবনীর ফোনও বিজি পেতে থাকি প্রায়সই।একটু খটকা লাগলো। ওকে ফলো করা শুরু করলাম। একদিন একটা পার্কে হাতে নাতে পেলাম অন্য ছেলের সাথে। যথেষ্ট গা ঘেঁষে ছিলো।অন্তরঙ্গতার একটু নিঁচে?হ্যা ওমনই হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার অবস্থা। কাছে যেতেই ও থতমত খেয়ে যায়,ভয় পেয়েছিলো কিনা জানিনা।আমি প্রচণ্ড রাগারাগি করি ওখানে। একটা সময় ও যেটা বলল সেটা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না আমি।বলল,
আমি ওর টাইমপাস ছিলাম। ও আমাকে ভালোবাসেনি।
আমি বাকরুদ্ধ।টাইম পাস করতে মানুষ এত তলিয়ে যায় একটা সম্পর্কে? আমার আর কিচ্ছু বলার ছিলোনা।চলে এলাম ওখান থেকে।টানা দুই বছর ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি।কিশোর মন তখন ভেঙে চুরমার হলো। তবুও পুরুষ মানুষ, মেয়েদের মত ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে তো পারবনা।কষ্ট গুলো কাগজের মত উড়িয়ে দিলাম। অবনী আমাকে অনেক কল মেসেজ করেছে।যেখানেই মেসেজ পাঠাতো ব্লক করেছি।তারপর একটা সময় হয়ত ও ক্লান্ত হয়ে পরলো। ততদিনে ভার্সিটি উঠি,ওর সাথে আর যোগাযোগ বা দেখা হয়নি।কিন্তু ভালোবাসার প্রতি বিষাদ এসে গেছিলো। তাই কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবতে চাইতাম না। ঘরকূনো হচ্ছিলাম। হঠাৎ বাবা মারা যান।মা, ছোট ভাইকে সামলাতে ব্যাবসার হাল ধরি। আগের মত চটপটে হয়ে যেতে থাকি। কাজ ডুবে যেতে চাই। একদিন তুমি সামনে এলে।ব্যাস্ততম জীবনের কাঠফাঁটা রোদে আমার এক পশলা বৃষ্টি। কোনো এক #পূর্নতিথিতে তোমায় বউ করার স্বপ্ন বুনলাম। কিন্তু সেটা আর হয়নি,জানলাম আদিত্য নামের একজন অনেক আগেই তোমার জীবনে এসে গিয়েছে,সেখানে আমার জায়গা নেই। সরে আসি আস্তে আস্তে।কিন্তু একেবারে দূরে যেতে পারছিলাম না। তাই বন্ধু হয়েই থেকে গেলাম। কিন্তু আজ আবার চাইছি তোমায় নিজের করে পেতে। বিশ্বাস করো তিথি এখানে মোহ- মায়া কিচ্ছু নেই,শুধুই ভালোবাসা আছে।তৃষ্ণার্ত গলায় একটু জলের আস্বাদন পাওয়ার লোভ আছে।

কথায় বলে, স্বামী -স্ত্রীর একে অপরের কাছে দূর্বলতা রাখতে নেই। আমি জানি,যদি ভাগ্যক্রমে আমাদের বিয়ে হত, তুমি আমার কাছে আদিত্য নামক দূর্বলতার জন্যে নিজেকে ছোট ভাবতে।আমার শত বারন সত্ত্বেও। তাই আজ আর ধোয়াসা রাখলাম না,নিজের সব অতীত তোমাকে বলে দিলাম।কাটিয়ে দিলাম সব কুয়াশা। আমার ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ভেবে নিও। এটুকু অনুরোধ। আজ ভালোবাসোনা,কাল বাসবেনা তেমন তো নয়।
জানো তো একটা কথা, প্রথম ভালোবাসা ভুল সময়ে ভুল মানুষের সাথে আসে। দ্বিতীয় ভালোবাসা অাসে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সাথে ।মানুষ দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে পারে।চাইলেই পারে।

তন্ময় থামলো। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলো তিথি কাঁপছে। অস্থির লাগছে, ঢোক গিলছে বারবার। তন্ময় উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ আর ইউ অলরাইট তিথি?

তিথি কাঁপা গলায় বলল,

‘ আআ…আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসো।প্লিজ!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here