পূর্ন_তিথি নুসরাত সুলতানা সেজুথি সূচনা পর্ব

0
497

(১)

আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা।যত দ্রুত পারো এবোরশন টা করে নিও। তোমার জন্যে এটাই ভালো হবে। টাকা যা দরকার হয় জানিও, পাঠিয়ে দেবো।

,
,

আদিত্যর বলা শেষ কথা গুলো কানে বাজছে বারবার।
ঘরের সমস্ত জিনিস এলোমেলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে।কিছুক্ষন আগেই এক নিরব ধ্বংস যজ্ঞ বয়ে গিয়েছে কক্ষে। এক কোনে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে তিথি।প্রায় মৃতের মতো অবশ হয়ে পরে আছে শরির।রা নেই মুখে।কন্ঠনালি স্তব্ধ, শূন্য। মাঝে মাঝে কাঁপছে চোখের পাতা দুটো।

মৃদূ আওয়াজে গোঙানির শব্দ এলো হঠাৎ। কার্নিশ বেঁয়ে গড়িয়ে পরা জল, ভাঙা ধরা গলায় অস্পষ্ট কিছু উচ্চারন করছে মেয়েটি। হুট করে এক গগন বিদারি চিৎকার দিলো তিথি। উন্মাদের মতোন দুহাতে চুল মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরে, মেতে উঠলো আর্তচিৎকারে।

” ভালোবাসার মানুষ যখন দূরে সরে যায়,তখন সব রঙ ফিকে হয়ে এক মুঠো ছাইয়ে রুপ নেয়। চারপাশের হলুদ আলো পাল্টায় ভয়ানক কুঁচকুঁচে কালোতে।

তিথির ভালোবাসার মানুষের বিয়ে আজ । দীর্ঘ দু বছর ধরে ভালোবেসেছে যাকে,যে ছিলো প্রতিটি চিন্তায় চেতনায় , যাকে নিয়ে প্রতি মুহুর্তে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখলো ,আজ সেই মানুষ টা অন্য কাউকে ঘরের বউ করে তুলতে উদ্যত। এ কষ্ট যে বড্ড অসহনীয়। বড় পীড়াদায়ক। বড় যন্ত্রনার।

ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রনার থেকেও নিজ গর্ভে বেড়ে ওঠা অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে সঙ্কিত তিথি। পরিচয়ের অভাবে শেষ মেষ তার ভালোবাসার চিহ্ন কে কি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে…?? এতোটা নির্দয় হবেন সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি..??

এতক্ষন এক নাঁগাড়ে কাঁদছিলো। গলা এবার জমে আসতে শুরু করলো তিথির। পাশাপাশি চোখের ভেঁজা পাতা গুলোও ভীষণ রকম ভারি অনূভুত হলো।মাথাটা ঝিঁমঝিঁম করে উঠলো ব্যাথায়। একটা সময় ওভাবেই পিছন দিকে ঢলে পরলো তিথি। শূন্য ঘরে তিথির এমন করুন পরিস্থিতি দেখার থাকলোনা কেউ। পুরোপুরি অচেতন হওয়ার আগে একবার অস্পষ্ট আওয়াজে ডাকলো,

— যেওনা আদি…..

___________

ছাই রঙের পীচ ঢালা রাস্তায় দ্রুত গতি নিয়ে ছুটছে দুটো চকচকে গাড়ি। সামনের গাড়িটি ফুলে ফুলে স্বাজানো। গোলাপ,রজনীগন্ধা, সাদা অর্কিডের মিশ্রনে।গাড়ির জানলা ঘেঁষে বসে আছে আদিত্য।চোখে মুখে স্পষ্ট বিষন্নতা,ক্ষুন্নতা।

আজকের বিয়ের বর সে নিজে। যথারীতি আর পাঁচটা বরের মতোই ধূতি আর শেরওয়ানি পড়িয়ে সাজানো হয়েছে তাকে। মাথায় পড়ানো হয়েছে ধবধবে সাদা রঙে কারুকাজ খচিত একটি টোপর।

কিন্তু দূর্ভাগ্য! তার এমন নজরকাড়া সাজস্বজ্জা তার জন্যে নয় যাকে ভালোবেসেছে, বরং অন্য এক মেয়ের জন্যে। ঘন্টা খানেক বাদেই যে হবে তার স্ত্রী।অর্ধাঙ্গিনী। আদিত্যর মনে একটুও উল্লাস নেই।নেই আনন্দ।

আচ্ছা, নিজের ভালোবাসার মানুষ কে ঠকিয়ে কোনও দিন কি সে পারবে সুখে ঘর বাধতে? পারবে ভালো থাকতে। পারবে না তো…!তবে এমন নিদারুন খেলায় মেতে উঠলো কেন ভাগ্য..?বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান হতে গেলে বুঝি এতটাই সেক্রিফাইজ করতে হয়.? একেই বলে আত্মত্যাগ..?নাকি ভালোবাসা ত্যাগ?তাই বলে নিজের সন্তানের জীবন কেও..? আদিত্যর বুক হুহু করে উঠলো,

— নাহ আমি পারিনি তিথি,পারিনি একজন ভালো প্রেমিক হতে।আর না পারলাম আমার অনাগত সন্তানের ভালো বাবা হতে! অন্তত নিজের বাবা মায়ের আদর্শ সন্তান হই এবার? ক্ষমা করে দিও তিথি! পারলে তুমি আমার এই অন্যায় ক্ষমা করে দিও।

আদিত্য চোখ বুঁজে ঢোক গিললো। হঠাৎ ভাবলো,

‘কিন্তু আমার সন্তান..? ওর জীবনের স্পন্দন কি ওখানেই থেমে যাবে..? সব জেনেও নিজের সন্তানের পরিচয় দিতে আমি পারবোনা? এতোটাই অসহায় আমি?

আদিত্যের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।চিনচিনে ব্যাথা হয়। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তিথির কাছে।কিন্তু কিছু সম্পর্কের টান বেড়ির মতোন পা জাপটে ধরে । যাওয়া হয়ে ওঠেনা। হয়না পালানো।চুপচাপ নিস্তব্ধতা নিয়ে একভাবে বসে থাকে আদিত্য।

আদিত্যের পাশেই বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন তার বাবা।নাম সমীরন পাল। বয়স ষাটের কোঠায় ছুঁই ছুঁই লোকটার । কিন্তু রাগ তেজ তরুন বয়সের মতোই টগবগে।

পড়নে ভাঙ্গি রঙের পাঞ্জাবি। মুখে পান গুঁজে জানলা থেকে একটু পরপর পিক ফেলছেন । চকচকে চেহারা।
আজ তার আনন্দের দিন। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!তার থেকেও অধিক আনন্দ হচ্ছে নিজের পছন্দ করা মেয়ের সাথে আদিত্যের বিয়ে দিতে পেরে। অবশেষে এতদিনে তিথি নামক ঝামেলার অন্ত মিললো। এ যে মহা খুশির ব্যাপার! অতি উত্তম তার পরিবারের জন্যে, তার ছেলের জন্যে। আর এমন খুশিতে ঝলমল করছে তার মুখমণ্ডল।

আড়চোখে আদিত্যর দিকে তাকালেন সমিরন। আদিত্যর কালো মুখ, উদাস দৃষ্টি, তার চোখ এড়ালোনা। সমিরন ভাবান্তর দেখালেন না। সামনের রাস্তার দিকে চোখ ফেরালেন। মনে মনে ভাবলেন,

” বিয়ে করে একবার বউ পেলে সব পাগলামি দূর হয়ে যাবে।শত হলেও পুরুষ মানুষ, কতক্ষন আর ঠিক রাখতে পারবে নিজেকে? তাও একেবারে হাটুর বয়সী মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে যেখানে।
আজ বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক,তিথির নাম সারাজীবনের মত ঘুঁচে যাবে। এ নাম ছেলে আর তুলবেইনা।

ঠোঁট জোঁড়া বাঁকালো সমীরন। বাইরের ফুরফুরে বাতাসের স্পর্শে তার মন মেজাজ আরো ফুরফুরে হয়ে আসছে।

কিন্তু গাড়ির মিনমিনে গতি তার পছন্দ হলোনা।মুখ কুঁচকে চালকের উদ্দেশ্যে বেশ শক্ত ভাবে বললেন,

— কি দাদা,এত আস্তে চালালে হবে?একটু গতি বাড়ান। ঘরের লক্ষী তুলতে যেতে হবে আমার।

এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন বাবাকে দেখে নিয়ে চোখ সরিয়ে আবারো বাইরের দিকে তাকালো আদিত্য। মৃদূ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
বিয়ে নিয়ে সবার মধ্যে কত উল্লাস!অথচ যার বিয়ে সে একটা পুতুলের মত চালিত হচ্ছে।সে খবর কি কেউ জানে?জানেনা।
আদিত্যর বুক হাহাকারে মেতে উঠলো৷ বুকের বা পাশে কাঁপা হাত রাখলো, ভাবতে বসলো তার শ্রেয়সীর কথা,

‘ আচ্ছা তিথি এখন কি করছে?? কি অবস্থায় আছে ও, আমার বিয়ের খবর ওর কাছে পৌছে গিয়েছে নিশ্চয়ই?? ও ঠিক আছে তো..??

দুই প্রান্তে থাকা দুটো মানুষের ,ভালোবাসা ময় দিনগুলো পার হয়ে এলো এক কঠিন সময়। কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে তাদের জীবন? কি ছিলো এদের এক হওয়ার পাশাপাশি তাদের আলাদা হওয়ার গল্প..? বিবর্ন ফ্যাকাশে সেই অতীত টাই বা কেমন?

_____

দুই বছর আগে……

সকালের কুসুম রঙের আলো চোখে পড়তেই ঘুম থেকে নঁড়ে উঠলো তিথি। চোখ কঁচলে উঠে বসলো। লম্বা করে হাই তুলে বাম দিকে তাকালো। পাশে হাত পা মেলে ঘুমিয়ে আছে স্বপ্ন। বয়স দশ বছরে পরলেও মুখে খই ফোটে খুব।

স্বপ্নর গভীর ঘুম তিথির পছন্দ হলোনা। দুষ্টি বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়।
হাত এগোলো ভাইকে সুড়সুড়ি দিতে । এর আগেই নড়েচড়ে উঠলো স্বপ্ন। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলল,

— সোনু,,,ঘুমের মধ্যে বিরক্ত করলে খবর আছে। মাথার সব চুল ছিড়ে নেবো কিন্ত।

তিথি ভঁড়কালো, স্বপ্ন বুঝে গেলো তার উদ্দেশ্য? এত্ত চালাক! ক্ষেপে বলল,

— কি?আমার চুল ছিড়বি,,,দেখি তো কেমন পারিস। দাড়া মজা দেখাচ্ছি।

কিন্তু মজা দেখানো আর হয়ে উঠলোনা। সব উদ্যোগে জল ঢেলে দিয়ে মাত্রই তার মা সুচিত্রা এসে দাড়িয়েছেন দরজার সামনে। মাকে দেখেই থেমে গেলো তিথি।হাত গুছিয়ে এনে ভদ্র মেয়ে সাজলো। তাকালো মায়ের দিকে। জাম রঙের থ্রি পিস পরেছেন। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপের সাথে লম্বা সিঁথি ভর্তি সিদুর। কি সুন্দর লাগছে! তিথি মুগ্ধ চোখে মায়ের দিকে চেয়ে থাকলো।বয়স অনুযায়ী একটু বেশিই সুন্দরী তার মা। বোঝাই যায়না তার তিনটে সন্তান।তিথিকে দেখা মাত্রই এক মিষ্টি হাসি উপহার দেন সুচিত্রা। আদুরে কন্ঠে বললেন,

— সোনু… উঠে পরেছিস,আমি আরো ডাকতে এলাম।

তিথি মৃদূ হাসলো। সুচিত্রা আবার বললেন,

‘ আচ্ছা শোন,আমার রান্না বান্না শেষ। আমি বেরোচ্ছি। ভাই উঠলে ভাইকে খাইয়ে রেডি করিয়ে স্কুলে পাঠাস। আর নিজেও খেয়ে নিবি। কেমন..??

তিথি ঘাড় কাত করে বলল,

— আচ্ছা।

সূচিত্রা যেতে যেতে বললেন,
— দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে যা…

বিছানা ছেড়ে নেমে মায়ের পিছু পিছু হাটা ধরলো তিথি। সূচিত্রা বের হওয়ার আগে সচেতন কন্ঠে বললেন,

— সাবধানে থাকবি কিন্তু। আর কেউ এলে জানলা দিয়ে কথা বলবি,,দরজা খুলবি না।

তিথি কপাল কুঁচকে বলল,
— উফ মা! প্রত্যেক দিন একই কথা। এটা মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।

সূচিত্রা হেসে বললেন।
— হলেই ভালো…আসছি…

দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমে এলো তিথি। স্বপ্ন তখনও ঘুমে। তিথি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বেসিনের আয়নার দিকে তাকালো। কিছুক্ষন গভীর মনোযোগে দেখলো নিজেকে। গালে হাত দিয়ে আফসোস করে বলল,

— ইশ! আমার গালে যদি এই গর্তর মতো টোল টা না থাকতো,আরো সুন্দর লাগতো আমাকে।ঠিক মায়ের মত লাগতো। একে তো এই কোঁকড়া চুল,সাথে এই টোল। তোদের দুটোর জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ রে অতিষ্ঠ।

_____

মায়ের নির্দেশ মোতাবেক সব কাজ সেড়ে একেবারে
ভাইকে স্কুলে পাঠিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো তিথি। সামনে তার এডমিশন।এবার মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পা বাড়ানোর পালা। ছাত্রী হিসেবে ভালো উত্তম মধ্যম। তিথি খাতায় কিছু লিখছে ।
লেখার সময় দ্রুত হাতে বই টানতে গিয়ে বাড়ি
লেগে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা কাঁচের
ফটোফ্রেম টা শব্দ করে মেঝেতে পরলো।.হকচকালো তিথি।গোল চোখে সেদিক তাকালো। ফ্রেম একেবারে তিন টুকরো তে পরিনত হয়েছে। তিথি কপালে হাত দিয়ে বলল,

— এইরে,,,সারা বাড়িতে বাবার সাথে মায়ের এই একটাই ছবি আছে। এটা নষ্ট হলে মা আমাকে শেষ করে দেবে।
ধড়ফড় করে উঠে দৌড়ে মায়ের ঘরে গেলো তিথি। টেবিলের ড্রয়ার থেকে গ্লু নিয়ে আবার ছুটে নিজের রুমে এলো।হাটু ভেঙে বসে পরলো মেঝেতে। লেগে পরলো ভাঙা ফ্রেম জুড়তে।

প্রায় অনেক চেষ্টার পর ফ্রেমটা জোড়া হয়। কিন্তু আঠা লেগে চিপচিপে হয়ে আছে। ফ্রেমের ওপরেও দাগ রয়ে গিয়েছে হালকা। তিথি ফ্রেম উল্টে পাল্টে দেখে আগের জায়গায় রাখলো। ঠোঁট কামড়ে খুঁটিনাটি পরীক্ষা করলো, খুব ভালো করে না দেখলে বোঝা যাচ্ছেনা। তিথি হাফ ছেড়ে বলল,

— যাক বাঁচলাম।

হঠাৎ কিছু একটা ভেবে মুখের হাসি উবে গেলো তার। ভর করলো এক গুচ্ছ মেঘ। মলিন কন্ঠে বলল,
—- এমন ভাবে যদি বাবা মায়ের ভাঙা সম্পর্ক টাকেও জোড়া লাগাতে পারতাম….?

#পূর্ন_তিথি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
সূচনা পর্ব

গল্পটা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যাদের পড়তে অসুবিধে হবে তারা প্লিজ ইগনোর করবেন।কথাটা বলার একটাই কারন,আগের বার যখন পর্বটা পোস্ট করি দুজন আপু আমায় নক দিয়ে বলে ইসলাম অনুসরন করে লিখতে।কিন্তু প্লট অনুযায়ী আমাকে এই ভাবেই লিখতে হবে। কারন এটা অনেকাংশে সত্যি ঘটনা অবলম্বন করে। কারোর জীবনের করুন পরিনতি৷ কিছু অংশ তার জীবনের বাকি কিছু আমার মস্তিষ্কের। তাই যাদের ভালো না লাগবে তারা প্লিজ এড়িয়ে যাবেন।অহেতুক এসব ধর্ম টেনে বিব্রত করবেন না আমাকে😊গল্পকে গল্পের মত নিতে শিখবেন আশা করি।হ্যাপি রিডিং!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here