পূর্ন__তিথি লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (২৩)

0
183

#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৩)

“কোন এক পূর্নিমা কিংবা আমাবস্যায়, নদীতে জোয়ার আনে। ভাটার খবর কে রাখে কোন কালে?
শরীরের ব্যাথা দেখা যায়,
অদৃশ্য শুধু সেই মন,
যা প্রতিনিয়ত জ্বলছে, পুড়ছে, বেঈমানীর অনলে।

বিছানায় আধশোয়া তিথি।পিঠের সাথে নরম বালিশ ঠেস দেয়া। চোখের দৃষ্টি বড়ই শান্ত,স্থির,অপ্রচলিত ।পায়ের কাছে বসে কাঁদছে আদিত্য। চোখের জলে ভিজছে তার পায়ের আঙুল,ছোট ছোট নখ। তিথির মুখের অভিব্যাক্তি বোঝা মুশকিল। তার মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র নঁড়ন চড়ন। এতটুকু হেলদোল ও পরছেনা চোখে ।তবে গলাটা ব্যাথা লাগছে। ঢোক গিলতে গেলেও ব্যাথা পাচ্ছে। আদিত্য তখন কোপের বশে গলা চেঁপে ধরলেও অনুতাপে এখন পুড়ছে সে। তিথি জ্ঞান ফেরার পর থেকেই দেখছে, আদিত্য চোখে জল নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে,ক্ষমা চাচ্ছে।কিন্তু এই কান্না তার মনে হচ্ছে কুমিরের কান্না। এখন কেঁদে কি লাভ! যা খোয়ানোর সেতো খুইয়ে বসে আছে। আর কি ফিরে আসবে সেসব? না, আদিত্য গায়ে হাত তোলায় তার কোনো অভিযোগ নেই, অভিযোগ আদিত্যর মিথ্যে বলে তাকে ঠকানোয়,তার জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দেয়ায়। এই আদিত্য তার বাচ্চার খুনি।কথাটা মনে পড়তেই তিথি দ্রুত পা সরিয়ে আনলো।আদিত্য থেমে গেলো তাৎক্ষণিক। তিথির দিকে তাকালো। তিথি দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল

‘ আর কিছুক্ষন পর মা চলে আসবে,আমি চাইছিনা কোনো সিনক্রিয়েট হোক।

আদিত্য চুপ।তিথি ওর দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ আপনি কি বুঝতে পারছেননা আমি কি বলছি?

আদিত্য ধরা কন্ঠে বলল,
” একটা বার ক্ষমা করা যায়না তিথি?

তিথির বুক ভেঙে এলেও শক্ত কন্ঠে বলল,

” কি হবে ক্ষমা করলে? এই পনের দিনের অশ্রু গুলো ফিরিয়ে দেবেন? আমার বাচ্চাটা ফিরে আসবে? ফিরবে আমার মায়ের বিশ্বাস? নাকি আপনি আপনার বাড়িতে জায়গা দিতে পারবেন আমায়?

আদিত্য চোখ নামিয়ে নিলো।তিথি এক পার্শ্বিক হেসে বলল,

‘ পারবেন না।তাহলে কেন আপনি বারবার ক্ষমা চাওয়ার অজুহাতে আমার কাছে আসছেন আদিত্য? আপনি কি এতটাই অবুঝ? বুঝতে পারছেন না আমি আপনাকে ঘেন্না করি?

আদিত্য চোখ তুলে তাকালো। অসহায় কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো

” এত তাড়াতাড়ি ঘৃনার আসনে বসিয়ে দিলে তিথি?

‘ বসানোর দরকার পরেনি,আপনি নিজেই বসেছেন। প্লিজ এখান থেকে যান।আমার মাথা ব্যাথা করছে, বিশ্রাম নেব আমি।

আদিত্য উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ উদ্বেগ নিয়ে বলল,

” যদি পুতুল কে ডিভোর্স দেই, ফিরবে আমার কাছে?

তিথি ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” দিতে পারবেন?

আদিত্য দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ পারব।

তিথি একটু হেসে বলল,

” এই গলার জোরটা সেদিন প্রয়োজন ছিলো,যেদিন নিজের বাবার সামনে আমার মুখের ওপর বলেছিলেন
“আমি তোমায় চাইনা”
আজ আমিও আপনাকে বলছি আদিত্য,আমি আপনাকে চাইনা,চাইনা, চাইনা।

আদিত্য তিথির কাছে এগিয়ে আসতে নিতেই তিথি আর্তনাদ করে বলল,

‘ খবরদার আমার কাছে আসবেন না আদিত্য। আপনার স্পর্শ বিষের মতন লাগে।

আদিত্য অবাক হয়ে বলল,

‘ আমার স্পর্শ বিষের মতন? এই তুমিই কি একদিন আমায় পাওয়ার আশায় মন্দিরে প্রার্থনা করতে তিথি?

তিথি শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘ পাওয়ার আশা করেছিলাম বলেই হয়ত হারিয়েছি৷ প্রয়োজনের থেকেও বেশি মূল্য দিয়েছি বলেইতো, আমাকে মূল্যহীন ভেবে এক ঝটকায় দূরে ছুড়ে ফেলেছেন আপনি। এতটুকুও বিবেকে বাধেনি আপনার।

আদিত্য অনুরোধ করে বলল,

‘ বিশ্বাস করো তিথি…..

তিথি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এই শব্দটা বলবেন না আদি, আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করাটা আপনার দোষ হলেও আপনাকে নতুন করে বিশ্বাস করলে সে দোষ হবে একান্ত আমার।

আদিত্য চোখ বুজে ঠান্ডা শ্বাস ফেলে আবার তাকালো। নরম কন্ঠে বলল,

‘ তিথি আমার হাতে তখন কিচ্ছু ছিলোনা।বাবা অসুস্থ ছিলেন,তুমিতো দেখেছিলে কিভাবে বুকের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন উনি।ওই অবস্থায় আমি ওনার মুখের ওপর কি করে বলতাম, তোমাকে বিয়ের কথা?

তিথি ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

‘ ওহ তাই? আপনার বাবা অসুস্থ ছিলেন? তারপর আমি যাওয়ার সাথে সাথে আবার সুস্থও হয়ে গেলেন তাইনা? কই আপনার বিয়ের যতগুলো ছবিতে ওনাকে দেখা গেছিলো একদম মনে হয়নি উনি মৃত্যু পথযাত্রী।
তাছাড়া আপনি হয়ত ভুলে গেছেন আদিত্য,কিন্তু আমি ভুলিনি, যেদিন প্রথম আপনাকে ফোনে আমাদের সন্তানের কথা জানালাম আপনি কি বলেছিলেন?
‘ কোন হাসপাতালে যাবে জানিও’
সেদিন আমার কতটা বুকে ব্যাথা করছিলো আপনি জানেন?কয়টা অপরাধের জন্যে ক্ষমা করব আপনাকে? ছোট্ট বেলা থেকে কষ্ট পেয়ে পেয়ে সয়ে নেয়ায় হয়ত বেঁচে আছি।নাহলে কবেই সুইসাইড করতাম।আমার মৃত্যুর জন্যে তখন আপনি দ্বায়ী থাকতেন না? তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন?

আদিত্য অসহায় চোখে তাকালো। তিথি কাঠ গলায় বলল

‘ বিয়ের এতগুলো দিন পরে এসে বলছেন পুতুল কে ডিভোর্স দেবেন? লজ্জ্বাও লাগছেনা? নাকি নতুন শরীরের মোহ দুদিনেই কেটে গেলো?

আদিত্য উদগ্রীব হয়ে বলল,

‘ বিশ্বাস করো আমি পুতুল কে ছুঁইনি।

তিথি চেঁতে বলল,

‘ আর কত মিথ্যে বলবেন? আপনার গলায় নখের কাঁচা দাগ গুলো স্পষ্ট প্রমান দিচ্ছে আদিত্য অাপনি মিথ্যুক।তাহলে কেন নিজেকে ছোট করছেন?

আদিত্য তাৎক্ষণিক গলায় হাত দিলো।তিথি হেসে ফেলল তাতে। এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ থেকে গড়িয়ে গাল অব্দি এলো।বলল,

‘ ধরা পরে গেলেন তাইনা? দেখুন আমার সাথে যা করার করেছেন, স্ত্রীকে ঠকাচ্ছেন কেন? বউ নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করুন।ফিরে যান প্লিজ ফিরে যান।
বের হন আমার বাড়ি থেকে ।

আদিত্য আর শব্দ খুঁজে পেলোনা।এই মুহুর্তে তিথির অভিমানের আগুনে তার সব দৃঢ়তা দাউদাউ করে জ্বলছে। আদিত্য এক পা এক পা পেছাতে পেছাতে দরজা অব্দি গেলো। তিথি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। তিথিকে খানিকক্ষণ স্পষ্ট চোখে দেখে নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো আদিত্য। তিথি মাথা উঁচিয়ে দেখলো আদিত্যর প্রস্থান।বাইক সমেত আদিত্য উধাও হতেই তিথি লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়।বালিশটা বুকে চেঁপে হুহু করে কেঁদে ফেলল তারপর। কেন এই লোকটা তার ঢাকা পরা ক্ষতকে তাঁজা করতে আসে,কেন আসে? যত গুলো সেকেন্ড চেষ্টা চালায় তাকে ভুলতে, ততবার মনে করিয়ে দেয়। কেন ভালোবাসার মত নিষ্ঠুর পারাবারে পা ডোবালো সে? এখন যে তলানো ছাড়া উপায় নেই!

‘ তিথি..?

ডাক শুনে বালিশ থেকে মুখ তুললো তিথি। গলার স্বর চেনা পরিচিত। তিথি ধড়ফড় করে চোখের জল মুছলো। দরজার দিকে ফিরতেই জলমাখা চোখের পাতার সামনে তন্ময়ের মুখটা স্পষ্ট হয়। শোয়া থেকে উঠে বসলো তিথি। তন্ময়ের হাতে কালো শপিং ব্যাগ।তিথি বোঝার চেষ্টা করলো তন্ময় আদিত্যকে দেখেছে কিনা! যদি দেখে নিশ্চয়ই আঘাত পাবে! নিজের মতন অনেক কিছু ভাববেও।তাতে তিথির মাথা ব্যাথা নেই।কিন্তু সে অজান্তেই চায়না এত ভালো মনের মানুষটা কষ্ট পাক কিছু নিয়ে।অন্তত তার সাধ্যে যতটুকু থাকবে ততটুকু দিয়েই তন্ময়ের কষ্ট পাওয়া লাঘব করবে। তন্ময়ের কাছে তার অস্তিত্ব অন্য কিছু হলেও, তার কাছে যে তন্ময় বন্ধু।খুব, খুব ভালো বন্ধু। তিথি ভাঙা কন্ঠে বলল ,

‘ তুমি এখন?

তন্ময় এগিয়ে আসতে আসতে মৃদূ স্বরে বলল,

‘ সন্ধ্যে বেলায় দরজা এমন হা করে খুলে রেখেছো কেন? যে কোন সময়,যে কোনো কিছু হতে পারে।

তন্ময়ের স্বর স্বাভাবিক। তিথি বুঝলো তন্ময় আদিত্যকে দেখেনি। তন্ময় এসে বসলো সেইখানটায় যেখানে এতক্ষন আদিত্য বসে ছিলো। কালো প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ গাড়িতে ফেলে এসেছিলে। কিছু দূর যেতেই চোখে পরলো, তাই নিয়ে এলাম।

তিথি শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এত কষ্ট করে নিয়ে আসার কি প্রয়োজন? পরে নিতাম না হয়!

তন্ময় স্মিত হেসে বলল,

‘ পরে আবার দেখা করতে কিনা সন্দেহ ছিলো।

তিথি উত্তর দিলোনা।শপিং ব্যাগ থেকে বের করলো মোটা মলাটে আবৃত বইটা। সামান্য হেসে বলল,

‘ এটা ফেরত দিয়ে অবশ্য উপকার করলে, না হলে পড়া মিস করতাম।

তন্ময় পাল্টা হেসে উঠে দাঁড়ালো। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। সেটা বলার জন্যেও আসা অবশ্য।

তিথি চোখ ছোট করে বলল,

‘ কি কথা?

‘ পরশু তুষারের জন্মদিন।সন্ধ্যেয় পার্টি রাখব ছোট খাটো।আন্টিকে নিয়ে আসবেতো?

তিথি ভাবতে বসলেই তন্ময় উদ্বেগ নিয়ে বলল,

‘ এত ভাবলে চলবে? তুষার যে কাল রাতেই হুকুম জারি করেছে, তিথিদি কে নিয়েই কেক কাটবে!

তিথি হালকা হেসে বলল,

‘ ওকে বলো,আদেশ শিরধার্য!

‘ আসছি।

‘ সাবধানে যেও।

তন্ময় যেতে যেতে হঠাৎ পিছু ফিরে বলল,

‘ পরশু তোমাকে একটা কথা বলব তিথি,আমার জীবনের কিছু অজানা সত্যি। প্লিজ এসো।আন্টি না এলেও তুমি অন্তত এসো।

তিথি উত্তর না দিয়ে চেয়ে থাকলো। তন্ময় বেরিয়ে যেতেই উঠে গিয়ে দরজা চাঁপালো। কিন্তু কি অদ্ভূত! এতক্ষন প্রচন্ড কান্না পেলেও এখন কেমন অস্থির লাগছে ভেতরটায়।কি বলবে তন্ময়? আবার কোন সত্যি?

_____

রাত তখন দশটা।পড়ার টেবিল থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোলো তিথি। ঘুমে ঢলছে চোখ। পড়া হচ্ছেনা একটুও। যেতে যেতে একবার মায়ের ঘরে উঁকি দিলো।সুচিত্রা সেলাই মেশিনে কাঁপড় সেলাই করছেন দেখে ঘরের ভেতর এলো তিথি। সহজ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ চা খাবে মা?

সুচিত্রা মেশিন থামিয়ে তাকালেন।ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ এখন?

‘ হু। আমি বানাবো।খাবে তুমি?

‘ ঠিক আছে, চা-পাতা কম দিস ,তোর চা তেঁতো হয় প্রায়ই।

‘ আচ্ছা।

সুচিত্রা মেয়ের যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।খানিক বাদে হাতে দুটো কাপ নিয়ে রুমে এলো তিথি। টেবিলের ওপর একটা রেখে মায়ের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,

‘ বিস্কিট দেবো?

সুচিত্রা নিশব্দে মাথা নেড়ে “না “জানালেন।তিথি নিজের কাপ সমেত রুম থেকে বের হতে উদ্যত হলেই ডেকে উঠলেন সুচিত্রা।

‘ একটু দাঁড়া। কথা আছে।

তিথি দাঁড়িয়ে পরলো। সুচিত্রা বিছানা দেখিয়ে বললেন,

‘ বোস ওখানে।

তিথি বসলো। সুচিত্রা উঠে এসে বসলেন তিথির সামনে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন। শ্বাস ফেলে বললেন,

‘ চিনি কম দিয়েছিস।

‘ নিয়ে আসবো?

‘ না থাক।কথাগুলো আগে বলব নাকি আগে চা শেষ করবি?

‘দুটো একসাথে করব।চায়ের সাথে সাথে কথা।

সুচিত্রা কাপে আবার এক চুমুক দিয়ে বললেন,

‘ বাসায় কখন ফিরেছিস?

তিথির নিরুদ্বেগ উত্তর,

‘ সন্ধ্যেবেলা।

‘ কোথায় কোথায় ছিলি অতক্ষন?

‘ অতক্ষন কোথায়? তুমিইতো দুপুরের পর বের হলে।তোমার একটু আগে আমরা বের হয়েছি।প্রথমে লাইব্রেরি গেছিলাম বই কিনতে, এরপরে একটা ক্যাফেতে, এইটুকুই।

‘ তন্ময় অস্বাভাবিক কিছু বলেছে? মানে বিয়ে টিয়ে নিয়ে কিছু ?

‘ নাতো।আগের মতোই কথাবার্তা।

সুচিত্রা একটু চুপ থেকে বললেন,

‘একটা কথা সত্যি করে বল,
তন্ময়কে কখনও বিয়ে করবি এই চিন্তা আছে?

তিথি অবাক হয়ে বলল,

‘ হঠাৎ এই কথা?

‘ আগে উত্তর দে…

তিথি দুদিকে মাথা নেঁড়ে বলল,

‘ জানিনা।

সুচিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘জানিস না কেন? জানতে হবে সোনু। যদি তোর এমন ভাবনা চিন্তা নাই থেকে থাকে , তবে তন্ময় এ বাড়িতে যেন আর না আসে। একি ভুল আমি বারবার করতে চাইনা।

তিথি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমাকে তুমি আর বিশ্বাস করোনা, তাইনা মা?

সুচিত্রা কোপিত কন্ঠে বললেন,

‘ অস্বাভাবিক কিছু? তুই আমার জায়গায় থাকলে পারতি? পারতিনা।শোন সোনু, আগে তন্ময়ের সাথে তোর মেলামেশা নিয়ে আমি কিছু বলিনি কারন তোরা বন্ধু। তাছাড়া আদিত্য ছিলো তোর জীবনে।উল্টোপাল্টা ভাবার সুযোগ ছিলোনা তখন।হ্যা আজকেও তন্ময়কে নিয়ে কিছু বলতাম না যদি না আমি জানতে পারতাম ছেলেটা তোকে ভালোবাসে।তাও ভালো ও আদিত্যর মতন না ঠকিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। হয়ত সিরিয়াসলি ভাবছে তোকে নিয়ে।এটাতে ওর ওপর আমি খুশি।কিন্তু, আমি কাউকে ঠকাতে চাইনা।যদি তুই রাজিও হতি আমি নিজে গিয়ে আগে নির্মলা দেবিকে সত্যিটা বলতাম,সব জেনে উনি মেনে নিলে তারপরেই বিয়ের কথা। কিন্তু যেখানে তুই-ই রাজি নোস, তন্ময়ের প্রতি ভালোবাসা নেই, সেখানে ওর সাথে মেশার কোনো প্রয়োজন নেই।কে বলতে পারে কোন পুরুষের ভেতর কি আছে?আদিত্য কেও তো সাধুপুরুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু কি হলো শেষে? কথাটা তোকে সকালেই বলতে পারতাম আমি, কিন্তু বলিনি। কারন এই দশ টা দিনে তুই যতটা স্বাভাবিক হয়েছিস তার পুরো কৃতিত্ব তন্ময়ের।কৃতজ্ঞাবোধ থেকে ওর সাথে ঘুরে বেড়ানোটা আজ আমি এলাউ করেছি।তার সাথে এতটা পথ অত ভোরবেলা এলো। কিন্তু এমন রোজ হলে ও তোর প্রতি আরো দূর্বল হয়ে পরবে।প্রত্যাশার থেকেও অনেক বেশি কিছু চেয়ে বসতে কতক্ষন? তুই-ই ভেবে দ্যাখ, কতটা ভালোবাসলে ভালো মন্দ না ভেবেই রাত্রির বেলা বাসার সামনে চলে আসে কেউ? তোর বয়স কম তুই বুঝবি কম,তাই ভালো করে বোঝাচ্ছি।তন্ময়কে বাসায় আসতে নিষেধ করবি,হ্যা যখন আমি থাকব আসতেই পারে কিন্তু আমার অবর্তমানে আমার বাড়ির চৌকাঠ যেন পার না হয়।

তিথি মৃদূ হেসে বলল,

‘ মা,আমি জানি তন্ময় আমাকে ভালোবাসে,আমাকে চায়। সব জেনে ওর সাথে এভাবে মেশা ঠিক হচ্ছেনা যেহেতু আমি ওকে চাইনা।কিন্তু শত বারন সত্ত্বেও ওর করুন কন্ঠের আবদার গুলো ফেলতে পারিনা আমি।ওই ছেলেটা আমার ছোট বড় সব বিপদে পাশে ছিলো,যেখানে আদিত্যকে আমি চেয়েও পাইনি।তাছড়া তন্ময়ের ইন্টেনশন যদি খারাপ হতো ও ওদের বাড়িতেই আমার সুযোগ নিতে পারতো।কারন এমন অনেক দিন গিয়েছে যখন ওর মা ভাই বাড়িতে ছিলো না। ছিলাম আমরা দুজন।কিন্তু বিশ্বাস করো, ও আমার একটা নখ স্পর্শ ও করেনি।কখনও বাজে ইঙ্গিত দেয়নি।কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে ভালোবাসলে সেটা সেই মেয়ে বুঝতে পারে। কিন্তু আমি তন্ময়ের দিক থেকে এই কথাটা কোনো দিন বুঝতে পারিনি, আজও পারতাম না যদি ও না বলতো। এই যে আজ একসাথে বের হলাম,ও আমাকে ইঙ্গিত দিয়েও বোঝায়নি যে আমার ওর ডাকে সাড়া দেয়া উচিত।এসবের জন্যেই ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বোধ বাড়ছে।ভালো না বাসলেও ওকে সন্মান করি আমি। সর্বপরি
আমি ওকে বিশ্বাস করিনি মা,ও আমার বিশ্বাস জিতে নিয়েছে।

সুচিত্রা হেসে বললেন,

‘ বিশ্বাস তো আদিত্যও জিতেছিলো।

” না মা। আদিত্য আমার বিশ্বাস জেতার আগেই আমি সব খুইয়ে বসেছিলাম। আমি যেঁচে ওকে বিশ্বাস করেছি এটাই ভুল ছিলো আমার। ভালোবাসায় বিশ্বাস বাধ্যতামূলক বলেই হয়ত করেছি।কিন্তু তন্ময়কে বিশ্বাস করা বাধ্যতামূলক ছিলোনা আমার। তোমার কি মনে হয়,আদিত্য তন্ময় এক নয় এই কথা আমার মুখ থেকে এমনি এমনি বার হয়েছে ? একদম নয়। আমি পরিস্থিতির স্বীকার হয়েই বলেছি এই কথা।

সুচিত্রা মাথা নেঁড়ে বললেন,

‘ বুঝতে পেরেছি রে সোনু।তাও মা তো, ভয় হয় তোকে নিয়ে।বাবার ছায়া নেই মাথার ওপর। একা একা বাসায় থাকিস।সুযোগ নিতে কতক্ষন?

তিথি মায়ের হাত ধরে বলল,

‘ ভয় পেওনা।আমি আর কখনও এমন কিচ্ছু করবোনা যাতে তোমার বিশ্বাস, ভরসার অমর্যাদা হয়।কথা দিলাম মা। তাছাড়া আদিত্যকে সবটা নিজের ইচ্ছেয় সপেছিলাম।সেই ইচ্ছের দাফন করেছি অনেক আগেই। তন্ময়কে নিয়ে এরকম কিছু আমার মাথাতেও আসবেনা কখনও।

সুচিত্রা মুগ্ধ হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ ভগবান তোর সব দুঃখ আমায় দিয়ে, আমার সব সুখ তোকে দিক সোনু।

তিথি নিঁচের দিকে চেয়ে ছিলো।কিছুক্ষন পর মুখ তুলে বলল,

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

‘ বল না!

তিথি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘ বাবার কাছে ফিরতে ইচ্ছে করেনা তোমার?

সুচিত্রার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলো সাথে সাথে।উদাস কন্ঠে বললেন,

‘ জানিনা। করলেই বা,সেকি ফিরিয়ে নেবে? সে আমায় ছাড়ছেওনা আবার শক্ত করে ধরেও রাখছেনা।মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়েছে আমাকে। এমন রাস্তায়, যে কেউ কাঁদামাটির মত মিশে যায়, কেউ আবার ধূলোর মত উড়ে যায় বাতাসে।

সুচিত্রা একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন,

জানিস ছোট বেলা থেকে ভীষণ সুন্দরী ছিলাম।বাবা মা, সব ভাই বোনের থেকে আমায় আদর করতেন বেশি। চৌদ্দ- পনের বছর বয়সেই নানান দিক থেকে আসতে লাগল বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু বাবার এক কথা, আমার সুন্দরী মেয়ের জন্যে চাই রাজপুত্র। আমিও বিশ্বাস করতাম, বাবা আমার জন্যে রাজপুত্র আনবেন। তারপর একদিন এক ঘটকের সাথে তোর দাদু এলেন বাড়িতে। তোর বাবার এত ভালো চাকরি দেখে বাবা আর না বললেন না। শুভ দৃষ্টির সময় প্রথম দেখলাম তোর বাবার মুখটা। পান পাতার আঁড়ালে একটা কালো মুখ দেখে প্রথমেই ধরে নিলাম এই আমার রাজপুত্র। তোর বাবাও আমায় খুব ভালো বাসতেন।কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতেন, আমায় ছাড়া অফিসেও নাকি মন বসতোনা তার। কিন্তু সন্দেহ করতেন তার থেকেও বেশি।দুধ ওয়ালাকে টাকা দিতে গিয়ে একবার তার হাতের সাথে আমার হাতের স্পর্শ লাগে, সেবার তোর বাবা প্রথম আমাকে চড় মারলেন। আমি বুঝে নিলাম,হয়ত আমার সৌন্দর্যই কাল হবে একদিন। কিন্তু কি করার! চেহারা পুড়িয়ে ফেলার তো উপায় নেই। বাসায় দুধ নেয়া বন্ধ, পেপার নেয়া বন্ধ, এভাবেই আস্তে আস্তে তোর বাবার অতিরিক্ত ভালোবাসা আমার জন্যে বিপদ হয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টি হওয়ার পর একটু পাল্টালেন তোর বাবা।আগের মত সন্দেহ করতেন না তবে কম ও করেননা এইরকম।কিন্তু স্বপ্ন হওয়ার পর হুট করে আবার বাড়লো। বাজার করতে গিয়ে কেউ বৌদি বলে ডাকলেও তার কথা এটাই থাকতো য
,
“অন্য কাউকে তো ডাকেনি, তোমায় কেন ডেকেছে? নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে কিছু না কিছু রয়েছে। সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি তো ছিলোই।

আমার আর্থিক সুখ ছিলো, ছিলোনা মানসিক শান্তি।প্রত্যেকটা দিন তোর বাবার কটু কথায় আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম। কিন্তু তোর বাবার স্বভাব কমার বদলে দিন কে দিন বাড়তেই থাকলো। এরপর খুঁটিনাঁটি বিষয়ে আমার দোষ ধরা শুরু করলো,সাথে গায়ে হাত তোলা। এক প্রকার অসহ্য হয়ে উঠছিলাম বলে বেরিয়ে আসি ওখান থেকে।তোর বাবাও আমায় আটকায়নি। স্বপ্ন দুধের শিশু বলে ওকেই সাথে আনি শুধু, কিন্তু কিছুটা রাস্তা অব্দি গিয়ে দেখলাম তুই পেছনে দৌড়ে আসছিস।

সুচিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ তোর বাবা হয়ত গোপনে খোঁজ নিয়েছিলো কোথায় আছি,কিন্তু ফেরত নিতে আসেনি।বৃষ্টির অনেক কান্নাকাটির জন্যে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।কিন্তু তিনজন কে মানুষ করতে হিমসিম খাচ্ছিলাম,ওদিকে ওর চাহিদাও পূরন হচ্ছিলোনা।তাই আবার তোর বাবার কাছে চলে যায় ও।স্বপ্ন কে তো আমি নিজেই পাঠালাম।এখন শুধু তুই বাকি।

তিথি যত্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবোনা।

সুচিত্রা মৃদূ হাসলেন। মেয়েকে দুহাতে পেঁচিয়ে ধরলেন।মায়ের কথায় তিথির বুক ভারি হলো। বাবার প্রতি জমলো আগের থেকেও বেশি চাঁপা অভিমান।

সুচিত্রা খন্ড কন্ঠে বললেন,

‘ তোর বাবা আমাকে না নিক সাথে,সে সুখে থাকুক।ভালো থাকুক।আগেও চেয়েছি এখনও চাই। তার সাথে সংসার করার ইচ্ছে পূরন না হলেও শাখা সিঁদুর নিয়ে মরতে পারার ইচ্ছেটুকু পূরন হোক অামার।

চলবে,

ভীষণ জ্বর😓 রিচেক করিনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।সামনের পর্ব গুলো অনেক তাড়াতাড়ি আগাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here