#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৫)
দুই মাস পর,
সবুজ রঙের কাপড়ে তৈরি বালিশের কভারটা। এক পাশ ভিজে কালো রঙ-য়ে রুপ নিয়েছে। মাথায় এলোমেলো,অগোছালো চুল। শোয়া থেকে উঠে বসলো তিথি। হাত খোপা করলো কোঁকড়ানো কেশে-দের। ফ্যাকাশে মুখে, চোখ মুছে বিছানা থেকে নামলো। ঘড়িতে তখন রাত আটটা। তিথিদের বাড়িতে একটাই ওয়াশরুম। যেতে হলে বসার ঘর পার হতে হয়।তিথি সে পর্যন্ত আসতেই চোখে পরলো মাকে। হাত সেলাই দিচ্ছেন কোনো কাস্টমারের সুতির জামার কর্লারে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছেন ওয়াড্রবে রাখা টেলিভিশন। সিরিয়াল চলছে সেখানে। সুচিত্রার পড়নে ধবধবে সাদা থান। কালো সুন্দর চুল হাঁতড়ে এক ফোঁটাও সিঁদুরের দাগ পাওয়া যাবেনা। হাতে নেই শাঁখা পলা। কি বিবর্ন মুখখানা! তিথির বুক মুচড়ে এলো মায়ের বেশভূষায়। মাকে বিধবার বেশে দেখতে কোন সন্তানের আরাম বোধ হয় জানা নেই । কারন তার বুকতো পুঁড়ছে,জ্বলছে, উঠছে ধোঁয়া। তিথি ঠোঁট ভেঙে চাঁপা কান্না কঁাদলো।
দু মাস আগে,
সেদিন তুষারের জন্মদিন থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর নির্মম,নিষ্ঠুর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে।গভীর রাতে মায়ের ফোনে বাবার নম্বর থেকে কল আসে। মা অবাক হয়না,কারন এই নম্বরের মালিক তাকে কল করবেনা সে জানে।হয়ত স্বপ্নেরই কাজ। তিথি তখন পড়ছিলো ঘরে। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে উচ্ছ্বাস নিয়ে এসে বসে ছিলো মায়ের পাশে।ভাইটার সঙ্গে একটুখানি গলা জুড়িয়ে কথা বলার আশায়। কিন্ত হলো তার উল্টো, সুচিত্রা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে স্বপ্ন। কাঁন্নার তোপে কথা অব্দি পরিষ্কার বোঝার উপায় ছিলোনা। টানা দশ মিনিট ওভাবেই কাঁদে ছেলেটা। তিথি,সুচিত্রার দুজনের মনে ভয় বাসা বাঁধে। সুচিত্রা আকুলিত কন্ঠে বারবার প্রশ্ন করেন,
‘ বাবা কি তোকে মেরেছে স্বপ্ন? কাঁদছিস কেন বল আমায়?
স্বপ্ন তাও কাঁদে।অনেকক্ষন পর অস্পষ্ট শব্দে বলে,
‘ বাবা আর নেই মা।বাবা মরে গেছে…
কথাটা মনে পড়লে এখনও কাঁন্নায় বুক ভেঙে আসে তিথির।এইত কদিন আগেও মায়ের বলা কথা স্পষ্ট বাঁজছে কানে,
” তোর বাবা যেখানে থাকুক, ভালো থাকুক।তার সাথে সংসারের স্বপ্নটা আমার অপূর্ন থাকলেও শাঁখা সিঁদুর নিয়ে মরতে পারার ইচ্ছেটা যেন পূরন হয়!
না হয়নি।মায়ের এই ইচ্ছে পূরন হয়নি। ছোট বেলা থেকে মা-বাবাকে আলাদা দেখেও একটা স্বপ্ন চোখ জুড়ে থাকত।থাকত একটু আশা । একদিন এক হবে বাবা-মা।তাদের সব অভিমান একদিন না একদিন ধুঁয়ে যাবে। আবার একটা পরিবার হবে তার। প্রান জুড়িয়ে দেখবে বাবা-মায়ের ভালোবাসার সংসার। কিন্তু সেসব হয়নি।তার আগেই বাবা স্বার্থপরের মত পাড়ি জমালো ওপারে। যাওয়ার আগে একবার বলেও গেলোনা!
চিকচিকে চোখের পানিটুকু মুছে ওয়াশরুমের দিকে হাটা ধরে তিথি। অতীত মনে করতে সে চায়না।কেন তার অতীত গুলো এত বিদঘুটে? যতবার মনে পড়ে কাঁন্না চোখ ফেটে আসে। মনে পড়ে বাবার গোল-গাল মুখটা। মানুষ টার সাথে দেখা হয়েছে কত বছর আগে! মৃতূর আগে একবার শেষ দেখা হলোনা।যদি জানত বাবা হারিয়ে যাবে,শক্ত করে জড়িয়ে রাখতো বাবাকে। সম্পর্কের সুতো দিয়ে বেঁধে রাখত । বাবা হারিয়ে যেতেই পারতোনা তখন। কেন এভাবে হারালে বাবা?বাবা তুমি ভাবো আমি মাকে বেশি ভালোবাসি? তাই তোমার কাছে যাইনি? এটা সত্যি নয় বাবা,আমি তোমাকেও খুব ভালোবাসি।তোমাদের দুজনকেই আমার চাই। একবার যে বলব বাবা তোমায় ভালোবাসি সে সুযোগ টুকু দিলেনা! তুমি কি অভিমান করেই চলে গেলে?
ওয়াশরুমের দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো তিথি।বেসিনের কলটা তখন সর্বচ্চ গতিতে পানি দিচ্ছে। এ এক অভনব পন্থা, কান্নার শব্দ মায়ের কানে না পৌঁছানোর।
সুচিত্রা একবার তাকিয়ে মেয়ের যাওয়া দেখলেন। না বললেন কথা,না কোনো আলাপ।মন ভালো নেই আজও। মানুষটার মৃত্যুর আজ অনেক দিন।কিন্তু শোক কাটছেনা কিছুতেই।যতবার মনে পড়ছে ততবার উত্থাল-পাতাল হচ্ছে ভেতরে।জীবনের প্রথম পুরুষ, প্রথম ভালোবাসা তার স্বামী। দূরে থাকলেও সেতো ভালোবাসে।সে স্বামী।স্বামীর তুলনা নেই। জীবনে দুঃখ পাওয়া আজ নতুন নয়। নাই বা হলো এক সাথে সংসার। মানুষ টার দীর্ঘকাল ছিলো তার একমাত্র কামনা।অথচ ভগবান সে আশাটুকুও অপূর্ন রাখলেন। সুচিত্রা মনে মনে পণ করেছেন, এজীবনে সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি আর কিছুই চাইবেন না।সে যা চায়, হয় যে তার উল্টো ।
সুচিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যদি শেষ বার মানুষ টাকে দেখতে পারত! চোখের পলকই ফেলতোনা।বেহায়ার মত তাকিয়ে দেখত সেই শ্যামবর্ন মুখ খানা।
সুচিত্রার ফর্সা মুখ খানিক শুকিয়ে গিয়েছে। সামনে আরো দায়িত্ব। স্বপ্ন টা ঢাকায় এখনও। ওকে আনতে যেতে হবে।ছেলেটা রোজ কাঁদে। বাড়িতে ফেরার বায়না ধরে। বৃষ্টি নিজের মত থাকছে যদিও কিন্তু সে-ও সন্তান। তাকে নিয়েও চিন্তা হয়।কোথায় কি করে কে জানে? বাবার মৃত্যুর কদিন বাড়িতে থেকে আবার কোথায় চলে গেলো। আর তিথি? জনম দুঃখী মেয়েটা। না পেলো বাবার ভালোবাসা,না পেলো ভালোবাসার মানুষ। ঠকলো মেয়েটা।সামান্য কিছু বোকামি আর আবেগের দৌলতে সব হারালো।কিন্তু ওকেও এভাবে চলতে দেয়া যায়না।একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়ার কথা না থাকলেও স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? মেয়েটার একটা ভুল কি ওর ভালো বর, ভালো ঘর পাওয়ার অধিকার কে নাকচ করে দেয়?
তন্ময় কে নিয়ে অনেকবার ভেবেছেন সূচিত্রা। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো। কিন্তু ভয় হচ্ছে, আজ বাদে কাল যদি মেয়েটাকে অতীত নিয়ে খোঁচা মেরে বসে? যদি বলে,
‘ তুই চরিত্রহীন” অন্যের স্পর্শ লেগেছে তোর গায়ে।তার অবৈধ সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছিলি। তখন কই যাবে আমার মেয়ে? ওর যে গলায় দঁড়ি দেয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা। ভগবান,পৃথিবীতে মা হওয়া এত কষ্টের কেন? কেন এত দায়িত্ব দিয়ে পাঠাও তাদের? এ বোঝা যে বড্ড ভারি।সব মা এ ভার বইতে পারেনা।
চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বেরিয়েছে তিথি।দেখে বোঝার উপায় নেই,মেয়েটা এতক্ষন কতটা কেঁদেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে মায়ের সামনে থেকে হেটে ঘরে গেলো সে। বুক ভাড় লাগে খুব।আদিত্যর থেকে আঘাত পেয়েও এতটা কাঁদেনি যতটা বাবা হারানোতে কাঁদছে। এত দিনেও বাবার শোক লুপ্ত হলোনা তার।বাবা তো একটাই,একবার হারালে আর কি পাওয়া যায়?
তিথি ঘরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলো।গ্লাশের ঢাকনা সরিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে গলা ভেজালো। বিছানার ওপর রাখা ছিলো ফোন। হঠাৎ ভাইব্রেট হতেই,তিথি তাকালো সেদিকে। দূর থেকে দেখেই বুঝলো তন্ময়ের কল। গ্লাস টা টেবিলের ওপর রেখে ফোন হাতে তুলে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।
‘ হ্যালো,
ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘ কেমন আছো? গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? আবার কেঁদেছো?
তিথি জবাব দিলোনা,চুপ থাকলো।তন্ময় নিজেই বলল,
‘ খেয়েছ?
তিথি ভাঙা কন্ঠে বলল,
‘ না। তুমি?
‘ উহু।
এরপর দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ।তন্ময় আস্তে করে বলল,
‘ একবার দেখা করোনা তিথি…কতগুলো দিন তোমাকে দেখিনি..
তিথি বিছানার ওপর বসলো। এক হাতে ফোন,অন্য হাত দিয়ে কপালের এক পাশ চেপে ধরে বলল,
‘ আমার ভালো লাগছেনা তন্ময়।জোর করোনা।
তন্ময় একটু চুপ থেকে বলল,
‘ আমি একবার আসি?
‘ তোমাকে তো বললাম,মা নিষেধ করেছেন।দরকার নেই।
‘ দূর থেকে দেখব তোমায়। আন্টিকে জানাবনা।
তিথি বিরক্ত হলো এবার।
‘ বারবার এক কথা কেন বলছো? আর আমাকে দেখার কি আছে? আমি সার্কাসের প্রানী?
তন্ময়ের রাগ হয়নি।শান্ত কন্ঠে সে জবাব দিলো,
‘ সার্কাসের প্রানীদের দেখায় পিপাসা থাকেনা। তাদের দেখার জন্যে বুক ছটফট করেনা। ওটাতো শুধু এই তন্ময়ের তার তিথির জন্যেই করে…
তিথি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ দেখো আমার মন মেজাজ ভালো নেই।এখন দেখা হলেও বা, তোমারই খারাপ লাগবে।
‘ খারাপ তো অনেক কিছুই লেগেছে।সেগুলোর মতো এটাও না হয় অপ্রকাশিত রাখব?
তিথি আর কথা খুঁজে না পেয়ে বলল,
‘ জানাচ্ছি…
লাইন কেটে দিলো তিথি। তন্ময়ের আরো অনেক কিছু বলার থাকলেও সুযোগ পেলোনা। ফোনের দিকে নিষ্প্রান চোখে চেয়ে রইলো..
পরমুহূর্তে মৃদূ হাসলো। মেয়েটার মনের যে অবস্থা, দেখা করবে এই ঢেড়! কিন্তু,একটা বিষয় তাকে ভীষণ ভাবায়,তিথির মনের কোথাও কি সে নেই? সেখানে আদৌ সে ঢুকতে পারেনি? এখনও তিথি আদিত্যর জন্যে কাঁদে? হয়ত কাঁদে। বাবার মৃত্যুতে যে শোক সবার সামনে দেখানো যায়,সবাইকে দেখিয়ে যেভাবে কাঁদা যায়,ভালোবাসার মানুষ হারালে সেভাবে কাদতে পারেনা কেউ। স্বজন হারানোর বেদনায় তুমি কাঁদলে তোমাকে দেয়া হবে সহানুভূতি। আর ভালোবাসা হারানোর বেদনায় কাঁদলে পিঠপিছে মানুষ হাসবে, জানাবে ধিক্কার। মজা নেবে তারা। তাচ্ছিল্য করে বলবে
‘ এত পিরিত কই গেলো এখন?
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘ আমার ছেলের দেবদাস হতে বাকি নেই।তা অফিসে যাওয়া হবে কাল? নাকি কালও…
উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো তন্ময়।কথাটায় পেছন ফিরে তাকাল।দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন নির্মলা। গম্ভীরস্বর। গম্ভীর মুখ। তন্ময় উঠে বসে বলল,
‘ ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো…
‘ কি করব ভেতরে এসে?
‘ কেন? এখন আর ছেলের সাথে কথা বলতে মন চায়না?
নির্মলা ভেতরে এলেন।তন্ময় বিছানা দেখিয়ে বলল,
‘ বসবেনা?
নির্মলা বসলেন।ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ তারপর?
‘ তারপর কি?
‘ তিথিকে বিয়ে কবে করছিস?
তন্ময় প্রস্বস্থ হেসে বলল,
‘ সেটাকি আমার জানার কথা?
‘ তাহলে কে জানে?
‘ ভগবান চাইলে হবে।ওসব ভাবিনা। মেয়েটার বাবা মাত্র মারা গেলো, তাছাড়া…
নির্মলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ তাছাড়া কি?
তন্ময় চুপ হয়ে যায়।নির্মলা নিজেই বললেন,
‘ তাছাড়া ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাইতো?
তন্ময় চোখ নামিয়ে নিলো।নির্মলা মৃদূ হেসে বললেন,
‘ মনে আছে সেদিন আমায় বলেছিলি,
অতীত সবার থাকে। তোর ছিলো, তিথির ও আছে। তাহলে আমি কেন আপত্তি করব বিয়ে নিয়ে?
আমি তোর কথাটা সে-রাতে খুব ভেবেছি।কিন্তু ঘুরে ফিরে আমার মাথায় একটা কথাই আসছে,
‘তিথি তোকে ভালোবাসেনা,ওর জীবনে অন্য কেউ ছিলো”।
এখন হয়ত তুই বলবি,তুইও অন্য কাউকে ভালোবাসতি তাও তো তিথিকে ভালোবাসলি,সেভাবে ও-ও একদিন তোকে ঠিক ভালোবাসবে।কিন্তু কি জানিস তন্ময়?মেয়েরা আর যাই হোক,জীবনের প্রথম পুরুষটিকে কোনও দিন ভুলতে পারেনা। তাকে তুই হিরে -জহরত দিয়ে ভরিয়ে রাখলেও, রাতেরবেলা সেই পুরুষটিকে ভেবেই সে বালিশ ভেজাবে।এটাই মেয়ে মানুষ। বড্ড চিন্তা হয় রে বাবা,তোর বাবার মৃত্যুর সময় থেকে আজ অব্দি একা দুহাতে আগলেছি তোদের।সেই তোরা কেউ কষ্টে থাকবি,ধুঁকে ধুঁকে যন্ত্রনা পাবি, মা হয়ে সইবো কি করে?
নির্মলা থামলেন। নিঁচের দিকে তাকাতেই দুফোঁটা জল গঁড়িয়ে গালে পরলো। তন্ময় মায়ের এক হাত মুঠোতে ধরে কোমল কন্ঠে বলল,
‘ মা,আমি জানি, তুমি আমাকে নিয়ে খুব ভাবো।এই পৃথিবীতে সবার থেকে বেশি ভাবো।কিন্তু বিশ্বাস করো মা, তিথিকে জীবনে পেলে আমি ভালো থাকব, সুখে থাকব। মা আমি তিথির চোখে ভালোবাসা হয়ত দেখিনি, তবে অদ্ভূত কিছু দেখেছি জানো।সেটা ভালোবাসা কিনা আমি জানিনা।ওর সাথে কথা বললে মনে হয়, ও খুব দোটানায় ভোগে আমায় নিয়ে।
আমি অবাক হই মাঝে মাঝে, যেখানে ছেলে হয়ে ভালোবাসায় ঠকে ভেঙে পরেছিলাম, সেখানে জীবনের এত বড় আঘাত পেয়েও মেয়েটা কত শক্ত!কি হাসিখুশি ঘুরে বেড়ায়! আমার সাথে কি সাবলীল ভাবে কথা বলে। ওকে চাই, ওকে ভালোবেসি জেনেও। আবার মুখের ওপরই বলবে, “আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখোনা তন্ময়। আমি তোমার হতে পারবনা। কিন্তু আমি জানি,ওর আমাকে ‘না’বলতে কষ্ট হয়,’হ্যা ‘বলতে অনুভব হয় প্রচন্ড দ্বিধা।কারন ওর মতে, আমি ওর অতীত জানি।হয়ত কখনও এ নিয়ে ওকে আঘাত দেব,কথা শোনাব।তাই আমি নিজে যেঁচে ওকে আমার সবটা বলেছি।ওর সামনেও একিরকম দূর্বলতা প্রকাশ করেছি যতটা দূর্বল নিজেকে ও আমার কাছে ভাবে।
কথাগুলো বলার সময় আমি স্পষ্ট ওর চোখে জল দেখেছি মা।
সে জল কিসের আমি জানিনা।আমি জানি ও এখনও হয়ত আদিত্যকে ভালোবাসে।ভবিষ্যতেও বাসবে।আমি চাই বাসুক।যদি আমাকে পেয়ে আদিত্যকে ভুলে যায় তবে অন্য কাউকে পেলে সে হয়ত আমাকেও ভুলে যাবে! আমি চাইনা ও আমাকে আদিত্যর মত ভালোবাসুক।আদিত্যর মত ভালোবাসা পেতে আমি চাইনা।আমি চাই ও আমাকে আমার মত ভালোবাসুক। আদিত্যকে সরিয়ে জায়গা দখল করলে সেটা হবে প্রতিযোগিতা। আমিতো প্রতিযোগিতায় নামিনি।আমি ভালোবেসেছি। আমি তিথির মনের একটা ছোট্ট অংশে জায়গা পেতে চাই।সেখানে স্বাজাতে চাই নিজের জগৎ।বুনতে চাই ভালোবাসা,বিশ্বাস,ভরসার বীজ। ওর সব দুঃখ,দুহাতে মুছিয়ে দিতে চাই।জানো মা,ও যখন দূরে থাকে,আমার কেমন অস্থির লাগে।কিচ্ছু ভালো লাগেনা।
কিন্তু আমি যখন ওর সাথে থাকি,কথা বলি, আমার মনে হয় আমি সব থেকে সুখি।সুখের রাজত্বে আমার বসবাস। আমি শান্তি অনুভব করি,স্বস্তি পাই।এর থেকে আর কি চাই মা? বলোতো!
নির্মলা চুপ।তন্ময় বলল,
‘ আমি জানিনা মা, তিথি আমার হবে কিনা!যদি ভাগ্যগুনে পেয়ে যাই ওকে, আমার তোমার কাছে অনুরোধ মা,কখনও ওকে ওর অতীতের জন্যে ছোট করে দেখোনা। মেয়েটার যে অনেক কষ্ট!
নির্মলা মলিন হেসে বললেন,
‘ মাকে এই চিনলি?
তন্ময় মায়ের চোখে চোখ রাখলো। মায়ের অভিমানি চোখ, থমথমে নরম মুখ জানান দিলো “এই মুখ পৃথিবীর সব থেকে পবিত্র মুখ।এর থেকে সত্য আর ,দ্বিতীয় টি নেই। সত্যিই নেই!
______
হাতে ধারালো ছুড়িটা দিয়ে আলু ছিলছে পুতুল।চোখ হাতে থাকলেও মন অন্য কোথাও। আজ দুটো সপ্তাহ এতটুকু আনন্দে নেই সে। খুব, খুব কষ্ট সমস্ত শরীরকে জব্দ করেছে।অবশ করেছে সব উচ্ছ্বলতা। কদিন আগে অব্দি সব ঠিক ছিলো। তারপর হঠাৎ শুরু হলো অশান্তি।ঠিক মত খেতে পারতনা, আর না ঠিকঠাক ঘুমোতে পারতো ।বমি হতো, মাথা ঘুরতো। অস্বস্তি লাগতো প্রচন্ড।এ কথা সে কাউকে বলেনি। গ্রাম্য আর পাঁচটা মেয়ের মত আশার আলো ফিনকি দিয়ে উঠেছিলো মনে। আদিত্যর সন্তান আসছে গর্ভে। এর থেকে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে! সবার আগে নিজে জেনে বাকিদের জানাবে ভেবেছিলো। খুশিতে ঝলমলিয়ে বাজার থেকে প্রেগন্যান্সি কিট আনলো।সবাইকে লুকিয়ে। কিন্তু টেস্ট করার পরে মুখে নামলো অন্ধকার। রিপোর্ট নেগেটিভ এসছে। ভাগ্যিশ আগেভাগে কাউকে বলেনি।ভাবলো হয়ত এমনিই অসুস্থ থাকে।মাথা ঘুরলে আর বমি পেলেও তো কেউ মা হয়না।তাছাড়া শেষ মাসে প্রিয়ডও হয়েছে।
কিন্তু বিপদ কমলোনা। তার অসুস্থতা কমার বদলে তরতর করে বাড়ছিলো। মুখে নেমে এলো তীব্র অরুচি।খাবার মুখে নিলেই উৎকট গন্ধ। আস্তে আস্তে সবার সাথে খাওয়া ছেড়ে দিলো।একা ঘরে বসে খেত।অল্প কাজ করলেই ক্লান্ত লাগতো। বেশিদিন টিকতে না পেরে
শেষ মেষ লুকিয়ে চলে গেলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তারপর যা জানলো, সে খবর আজ অব্দি কাউকে বলেনি সে।বললে হয়ত সেদিনই এ-বাড়িতে শেষ দিন হবে তার। শকুন্তলা যতই আদর করুক না কেন, যখন সত্যিটা জানবে, নিশ্চয়ই আর মানবেন না তাকে। আদিত্য সেতো মানেইনা। সেই যে শেষবার তাকে ছুঁলো, তারপর আর ফিরেও তাকায়নি। একবারের জন্যেও না! ইদানীং তার বাইরে থাকা প্রবল হয়েছে। সারাদিনে একবার দেখা যায় বাড়িতে। কোনও দিন তো টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়না। বাবাকেও মানেনা আজকাল ।নিজের মত থাকে,নিজের মত সব কিছু। ঘর এলে খিল দিয়ে বসে থাকে।কেউ ডাকলেও বার হয়না। খেতেও আসেনা।কোথায় খায় কে জানে!
পুতুলের এখন খুব করে মনে হচ্ছে,তিথির সাথে সে অন্যায় করেছে।আর সেই অন্যায়ের ফলস্বরূপ ভগবান হয়ত এমন শাস্তি দিলেন তাকে।
হঠাৎ তীব্র চেঁচামেচির আওয়াজে ধ্যান কাটলো পুতুলের। বসার ঘরে ভিন্ন কারোর কন্ঠস্বর।সাথে বাচ্চার কান্না। কৌতুহল নিয়ে আলু আর ছুড়ি ওখানে রেখেই ঘরে ছুটলো পুতুল। দরজা অব্দি আসতেই ফ্লোরে গুটিগুটি পায়ে হাটতে দেখলো সুস্মিতার দেঁড় বছরের মেয়েটাকে। পুতুল অবাক হলো।তার মানে সুস্মিতা এসেছে? কিন্তু কোনো খবর না দিয়ে ওতো এভাবে আসেনা। ভ্রু কুঁচকে একটু ভেতরের দিকে তাকালো পুতুল।সোফার ওপর বসা শকুন্তলা। তার সামনে সুস্মিতা। শকুন্তলার পিঠের জন্যে সুস্মিতার মুখ দেখা যাচ্ছেনা।তবে সামনের সোফায় সমিরনের থমথমে মুখ জানান দিচ্ছে কিছু হয়েছে। পুতুল ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। সুস্মিতার মুখ দেখতেই অবাক হলো। সুস্মিতা কাঁদছে। নিশব্দে চোখে জল ফেলে ফুপিয়ে কাঁদছে। আর শকুন্তলা সান্ত্বনা দিচ্ছেন মেয়েকে। পুতুল কিছুই বুঝে উঠছেনা। তবে ফ্লোর থেকে তুলে কোলে নিলো সুস্মিতার মেয়েকে। সুস্মিতাকে প্রশ্ন করলো,
‘ কিছু হয়েছে দিদি? কাঁদছো কেন?
সুস্মিতা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছলো। হেঁচকি তুলে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলো। শকুন্তলা তেঁতানো স্বরে বললেন,
‘ কি আর হবে? কপাল পুঁড়েছে আমার মেয়ের। এত ভালো ছেলেটাও কিনা এমন? দুনিয়ায় কে কাকে বিশ্বাস করবে তাহলে?
চলবে