পূর্ন__তিথি লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (২৯ ও শেষ পর্ব)

0
268

#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৯ ও শেষ পর্ব)

এক চঁড়ে ছিটকে মেঝেতে পরলো পুতুল।গালে হাত দিয়ে কাঁদোকাঁদো চেহারায় তাকালো শ্বাশুড়ির দিকে। শকুন্তলা আগুন চোখ নিক্ষেপ করে চেয়ে আছেন।ফোঁসফোঁস করছেন ডোরা সাপের মত। সুস্মিতা দৌড়ে গিয়ে পুতুলকে মেঝে থেকে তুলল।

‘ আহ মা,বৌদিকে মারলে কেন?

পুতুল মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগের ঝোঁকে কথা অব্দি মুখে আসছেনা শকুন্তলার। সমিরন ঘরে নেই।ব্যাবসার জন্যে ঢাকায় গিয়েছেন কাল রাতে। নাহলে আজকের বিচারপতি হতো সেই।শকুন্তলা চেঁচিয়ে বললেন,

‘ তোর এত সাহস,এত বড় একটা কথা বেমালুম চেঁপে গেলি?

পুতুল উত্তর দিলোনা। চুপচাপ কাঁদছে সে।বুঝে নিলো, “হয়ত তার লুকিয়ে রাখা ছাই,বাতাসে ধূলোর মত উড়তে শুরু করেছে। আদিত্য তখন বাড়িতে ঢুকছিলো। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে আসতেই মায়ের গলা শুনে পা থামলো তার। তিথির থেকে পাওয়া কষ্টে,ভারি বুক নিয়েও সামনে এগোলো, সেদিকে, যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে। গিয়ে দেখলো,ক্রুদ্ধ মা,ক্রন্দনরত স্ত্রী, আর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বোনের কৌতুহলী চেহারা। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে ভুল হলোনা। শকুন্তলা খেপে বললেন,

‘ কথা বলছিস না কেন মুখপুঁড়ি? উত্তর দে আমার? কবে জেনেছিস এই কথা?

আদিত্য ভ্রু কোঁচকালো।ঘরের ভেতর ঢুকে বলল,

‘ কি হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?

শকুন্তলা বললেন,

‘ চেঁচাবো না তো কি করব? তোর বউ কি করেছে জানিস?

সুস্মিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ কি করেছে? যার জন্যে গায়ে হাত তুলতে হলো তোমার?

আদিত্য ভ্রু কুঞ্চন গাঢ় হলো বিস্ময়ে।মা তার আদরের বউকে চড় মেরেছে? এও সম্ভব! ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করলো,

‘ কি করেছিস তুই পুতুল? চুরি টুরি করেছিস নাকি?

আদিত্যর কথায় পুতুল ব্যাস্ত ভাবে মাথা নেঁড়ে বলল,

‘ না না। আমি চুরি কেন করব?

শকুন্তলা আহত স্বরে বললেন,

‘ চুরি করলে কি হতো? আমি তাতে ওকে কিছু বলতাম? ও তার থেকেও জঘন্য অপরাধ করেছে। একটা মারাত্মক ব্যাপার লুকিয়েছে আমাদের থেকে।

আদিত্য চোখ সরু করে বলল,

‘ কি লুকিয়েছে?

সুস্মিতাও চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি লুকিয়েছো বৌদি?বলো?

পুতুল উত্তর দিলোনা এবারেও।শকুন্তলা তেঁতানো সুরে বললেন,

‘ ও জবাব দেবেনা। দেবেনা জবাব।ওর কাছে আছে নাকি উত্তর? আদি রে,বাবা তোর বৌয়ের বাচ্চা হবেনা কখনও। মুখ পুঁড়ি মা হতে পারবেনা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চুপচুপ করে চিকিৎসা করে এসেছে। আমাদের জানায়ওনি। ভাবতে পারিস কত সাহস! ভাগ্যিশ আমি কদিন ওকে চোখেচোখে রাখছিলাম।আজ সকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে খোঁজ নিয়েইই তো জানতে পারলাম।

সুস্মিতার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে এলো।অবিশ্বাসের কন্ঠে বলল,

‘ এসব সত্যি বৌদি?

পুতুল অপরাধির মত মাথা দোলালো শুধু। কিন্তু আদিত্যর ওপর বিন্দুমাত্র এর প্রভাব পরলোনা। সে নিরুদ্বেগ ভাবমূর্তি নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো।
ছেলেকে যেতে দেখে শকুন্তলা বললেন,

‘কোথায় যাস আদি? একটা বিহিত করবিনা এর?

পুতুল ছুটে গিয়ে আদিত্যর এক পা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ বিশ্বাস করুন,আমার কোনো দোষ নেই। আমি কি করব বাচ্চা নাহলে? আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে যখন জানলাম আমার পেটে একটা ছোট্ট টিউমার হয়েছে বাচ্চা আসেনি,তখন আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।যদি আপনারা আমাকে আর না রাখেন বাড়িতে।তাই কাউকে কিছু বলিনি। লুকিয়ে লুকিয়ে জমানো টাকা দিয়ে টিউমারের চিকিৎসা করেছি। আমাকে শাস্তি দেবেন না।আমাকে এ বাড়ি থেকে বার করে দেবেন না। আমার বাবা খুব গরিব।আমি কই যাব?

শকুন্তিলা খেঁকিয়ে বললেন,

‘ বংশধর না দিলে তোকে দিয়ে কি আমরা পূজো করব হতচ্ছাড়ি? ছাড় আমার ছেলের পা ছাড়!

আদিত্য মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদূ হাসলো।শান্ত হাতে পুতুল কে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করালো। তার থেকেও অধিক শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি তোমাকে এ বাড়িতে আনিনি।তাই তোমাকে বের করার দ্বায় আমার নেই। আমি তোমাকে আগেও আমার স্ত্রী মানিনি,ভবিষ্যতেও মানবনা।তাই আশাও রাখিনা তোমার গর্ভে আমার সন্তান আসবে। আমার জন্যে এই সংবাদ, সুংসবাদ নয় আর না দুঃসংবাদ।তোমার দায়িত্ব যাদের, তারাই তোমার ব্যাপার বুঝে নেবে।আমিতো বাড়িতে এসেছিলাম আমার কিছু জিনিস নিতে। তামাশা দেখতে নয়।তুমি বাড়িতে থাকবে কি থাকবেনা সেসব তাদের ব্যাপার যারা তোমাকে এখানে এনেছিলেন। আমার নয়।

আদিত্যর দিকে হা করে চেয়েছিলো পুতুল।আদিত্য ঘুরে হাঁটা দিতেই সুস্মিতা ব্যাস্ত কন্ঠে বলল

‘ জিনিস নিবি কেন দাদা? কই যাবি তুই?

আদিত্য একবার ওর দিকে তাকিয়ে ঘরের দিকে হেঁটে গেলো। শকুন্তলা পুতুলকে মুখ ঝাঁমটা মেরে বললেন,

‘ তোর জন্যে কি এখন আমার ছেলে বাড়ি ছাড়বে নাকি?

উত্তরে সুস্মিতা তেঁতে বলল,

‘ এখন সব দোষ বৌদির তাইনা? নিজেইতো আহ্লাদে এতদিন মাথায় তুলে রাখছিলে।যেই শুনলে বৌদির বাচ্চা হবেনা ওমনি আসল রুপ বেরিয়ে এলো।পারোও বটে।তুমিও শ্বাশুড়ি আর আমারও শাশুড়ী।

শকুন্তলা ধমকে বললেন,

‘ চুপ কর। নিজের সংসারে গিয়ে মাথা ঘামাস।আমার সংসারে নয়।

‘ হ্যা তাই যাব। তোমার এই অশান্তির ভান্ডারে থাকার ইচ্ছেও আমার নেই।

সুস্মিতা ঘরে যেতে নিয়েও থেমে গেলো।আদিত্যকে ব্যাগপ্যাক সমেত বের হতে দেখে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। শকুন্তলা দৌড়ে গিয়ে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন,

‘ ও আদি! তুই এই মেয়ের জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি বাবা? না না এমন পাগলামি করিস না।দরকার পরলে ওকে তুই বাপের বাড়ি দিয়ে আয় বাবা।তাও যাসনে।

আদিত্য মায়ের দিকে ঠান্ডা চোখে চেয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটে।

‘ মা না হলে আজ অনেক কিছু বলতাম তোমায় মা।শুধু মাত্র ওই সম্পর্ক টার জন্যেই সব জ্বিভের ডগায় এসেও আটকে যাচ্ছে। তবে এতটাও স্বার্থপর হওয়োনা যাতে সন্তানের চোখে ঘৃনার যোগ্য হতেও কাতরাতে হয়।

শকুন্তলা স্তম্ভের মত শক্ত হয়ে এলেন।

‘ তুই আমায় এত বড় কথা বলতে পারলি আদি?

‘ বাধ্য হলাম মা,যে বউমা নিয়ে এতদিন আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলে এখন তাকেই চোখের বালি মনে হচ্ছে? তোমার ঠিক কতগুলো রুপ আমি বুঝে পাচ্ছিনা। বুঝতে চাইছিওনা।তোমাদের নিয়ে ভাবার মত মন আমার নেই।আমি নিজের পথ নিজে বেছে নিচ্ছি।তোমরা আমার কেউ নও।বাবাকে বলে দিও,আমি নিজের প্রয়োজনে তোমাদের কাছে আসবনা।আর তোমাদের যা ধনসম্পদ আছে তাতে আমার প্রয়োজন তোমাদের কখনওই হবেনা।

আদিত্য হাটা ধরলে এবার সামনে দাঁড়ালো সুস্মিতা।চোখে থৈথৈ জল। নরম কন্ঠে বলল,

‘ দাদা বাড়ি ছেড়ে যাসনে দাদা।

আদিত্য ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ,

‘ বাড়ি ছাড়ছিনা।অশান্তির গুহা ত্যাগ করছি।তুইও সংসারে ফিরে যা সুস্মি।সীমান্ত বড্ড ভালো ছেলে।ভাগ্যগুনে ওরকম কাউকে পাওয়া যায়।হেলায় হারাসনে।পরে আমার মত ছটফট করে মরবি। আমি আর এখানে থাকবনা রে,এবার নিজের মত বাঁচব।এখানে আমাকে বোঝার মত কেউ নেই।তবে দুবেলা খাবারের খোঁটা দেয়ার লোক আছে। তাই নিজের মত থাকব এবার।দেখি কি করতে পারি! আমায় নিয়ে চিন্তা করবিনা।জানবি আমি ভালো আছি।খুব ভালো।

আদিত্য বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।শকুন্তলা, পুতুল,সুস্মি গভীর চোখে দেখলো তার অদৃশ্য হওয়ার দৃশ্য। কোথায় গিয়েছে বলে যায়নি আদিত্য।কোথায় আর যাবে,হয়ত রঞ্জনের কাছেই তার গন্তব্য।শকুন্তলা এ নিয়ে সব দোষ চাপালেন পুতুলের ঘাঁড়ে।ওর জন্যেই আজ ছেলে ঘর ছেড়েছে এই ধারনা তার।অন্তরালে নিজেদের দোষ টুকু দেখলেনইনা। পৃথিবীতে এমন লোক আছেই বলেই হয়ত পৃথিবী এখনও বিষাক্ত হাওয়ায় ভর্তি।

___

তিথি মেঝেতে বসেই কাঁদছে।তন্ময় ঘরে ঢুকলো।দরজা যে হা করেই খুলে রাখা। রাস্তায় আদিত্য যাওয়ার সময় দুজন মুখোমুখি হয়েছে।তন্ময়ের হাতে টসটসে গোলাপ,উপহারের বাক্স দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিলো আদিত্য। বুঝে ফেলল,তিথি আর তার নেই। কষ্টে,হতাশায় মরে যেতে ইচ্ছে হলো। আদিত্যর ফ্যাকাশে চেহারা,ভেজা চোখের পাপড়ি সুক্ষ্ণ ভাবে নজরে পরেছে তন্ময়ের।ভেতরে কিছু একটা ঘটেছে বেশ বুঝলো সে। আদিত্য তন্ময়ের সাথে একটা বাক্যও বিনিময় করেনি।করার মত মানসিকতা কি আছে? চুপচাপ বাইক সটার্ট দিয়ে চলে গিয়েছে। স্বপ্ন সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

‘ প্রচুর ঝগড়া করেছে দুজন। সোনু নিশ্চয়ই কাঁদছে?
আমি যাই..
স্বপ্ন ঘরের দিকে ছুটতে চাইলে এবার তন্ময় আটকালো। হাতের বাক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এর মধ্যে চকলেট আছে। তুমি এখানে বসে এই গুলো শেষ করো।তোমার সোনুকে আমি সামলাচ্ছি?
তন্ময় ভালো লোক।স্বপ্নের বেশ ভালো লাগে তন্ময়ের মিষ্টি কথা গুলো।সব সময় দাদাটার মুখে হাসি লেগে থাকে। তাছাড়া উনিতো সোনুর ভালো বন্ধু।মাও চেনেন। তাই আর আপত্তি জানালোনা।বাক্স নিয়ে নিলো হাতে।তন্ময় আস্তে করে বলল,

‘ এর মধ্যে একটা ছোট্ট টেডি আছে।ওটা তোমার সোনুর জন্যে এনেছি।দেখে রেখো?

স্বপ্ন ঘাঁড় কাঁত করে বলল’

‘ ঠিক আছে।

.

কাঁধে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো তিথি।মুখ তুলল। তন্ময়কে দেখে যত্র উঠে দাঁড়ালো। তিথির পড়নে শাড়ি,খোলা চুল,চোখের নিঁচে লেপ্টে থাকা কাজলেও মুগ্ধ হলো তন্ময়ের চোখ।শ্যাম বর্ন মুখে হাসির রেশ হালকা ভাবে ফুঁটলো। তিথি তার বর্ননার মত স্বেজেছে। তার জন্যে স্বেজেছে। এর থেকে বেশি আর কি চাই?

তিথির আপাদমস্তক মন ভরে দেখলো তন্ময়। উচ্ছ্বল হেসে বলল,

‘ অপরুপ লাগছে!

তিথির অবাক লাগলো। আদিত্যকে নিশ্চয়ই যেতে দেখেছে তন্ময়। ওকে নিয়ে একটা প্রশ্নও করলোনা? সে যে কাঁদছিলো সে ব্যাপারেও জানতে চাইলোনা? ছেলেটাকি মুখ দেখেই সব বুঝে ফেলে। তন্ময় এগিয়ে এসে তিথির ল্যাপ্টানো কাজল আঙুল দিয়ে মুছলো,
সেটুকু তিথির কানের লতিতে সামান্য লাগিয়ে বলল,

‘ আর কারো নজর লাগবেনা।

তিথি বুঝে উঠলোনা তার অভিব্যাক্তি কি হওয়া দরকার! শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। তন্ময় হেসে বলল,

‘ কি দেখছো তিথি? আমাকে বুঝি তোমার মত সুন্দর লাগছে?

তিথি অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ তন্ময়, আদিত্য…

তন্ময় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল

‘ আমি শুনতে চাইনা। তিথির কান্নার কারন খুঁজতে আমার ভালো লাগেনা। আমি তিথির হাসির কারন খুঁজতে চাই।তার ঠোঁট প্রসারনের কারন হতে চাই।

এটুকু বলে তন্ময় হাতের ফুল গুলো দেখিয়ে বলল’

‘ গ্রহন করবে ওদের?

তিথি সাথে সাথে ফুল গুলো নিয়ে নিলো। পরমুহুর্তে অসহায় কন্ঠে বলল

‘ বন্ধু হয়ে নিলে কি খুশি হবে? অন্য কিছু হওয়ার মত শক্তি যে এখনও আমার হয়নি।

তন্ময় তিথিকে ধরে বিছানার ওপর বসালো।নিজে বসলো ওর পাশে। শীতল দৃষ্টিতে তাকাতেই তিথি হুহু করে কেঁদে উঠলো।

‘ তন্ময় আমি পারছিনা,আর নিতে পারছিনা।বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কথাটা অনেক বার বলতে চেয়েছি,কিন্তু যতবার বলার প্রস্তুতি নিতাম,তোমার মুখ দেখে আর বলা হতোনা আমার৷

তন্ময় আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘ এত ভাবার কিচ্ছু নেই তিথি। তোমার মনে যেটা আসবে তুমি সেটাই বলো।আমি সব শুনতে প্রস্তুত।

মুখে প্রস্তুত বললেও ভেতরটা ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছে তন্ময়ের। কি বলবে তিথি? পারবেতো সহ্য করতে? পারতেই হবে।এত আঘাত সইতে পারলে এটাও পারবে।এতদিনে এতটুকুও কি শক্ত হয়নি তার মন? নিশ্চয়ই হয়েছে।

তিথি কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমি তোমাকে নিয়ে অনেক বার ভেবেছি তন্ময়,তোমার ডাকে সাঁড়া দিতে চেয়েছি।তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি।কিন্তু আমি পেরেই উঠছিনা। আমার মন প্রান জুড়ে এখনও ওই আদিত্যর বিচরন।আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই আমার মনে হয় আমার এই শরীরে প্রথম স্পর্শ ওর। আমার তখন নিঃশ্বাস আটকে আসে। আজ আমি তোমার জন্যে স্বেজেছি কারন তুমি খুশি হবে।সেই আমি কি করে তোমাকে সারাজীবনের কষ্ট উপহার দিতে পারি? আমি যদি এখন তোমার কথা ভেবে,তুমি কষ্ট পাবে ভেবে তোমাকে মেনেও নেই সেটা ভালোবাসা হবেনা।হবে অপশন হিসেবে তোমাকে বেছে নেয়া।যেটা আমি পারবনা।পারতেও চাইনা। আমি তোমাকে আমার জীবনের অপশন বানাতে চাইনা তন্ময়। জোর করে বিয়ের সম্পর্কে গেলে তুমি সুখি হবেনা।তোমার প্রত্যাশিত ভালোবাসা আমি তোমায় কখনোই দিতে পারবনা। আমি অনেক চেষ্টা করেও আদিত্যর ওপর থেকে মন সরিয়ে তোমার ওপর বসাতে পারছিনা। বারবার আদিত্য,আমার সন্তান এরা আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনুশোচনা হচ্ছে আমার। আমি কিছুতেই তোমাকে ভালোবাসতে পারছিনা তন্ময়। কিছুতেই পারছিনা! পারছিনা তোমায় ঠকাতে।

তিথি হাটুর ওপর ঝুঁকে মুখ দুহাতে ঢেকে গা কাঁপানো কান্নায় ভেঙে পরলো। তন্ময়ের অভিব্যক্তি টা ঠিক বোঝা গেলোনা।তার চেহারা বড়ই স্বাভাবিক। তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ এই সামান্য কথার জন্যে এত কাঁদতে হয় বোঁকা মেয়ে?

তিথি চোখ তুলে তাকালো। দুচোখে বিস্ময়। তন্ময় নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ জোর করে আমায় ভালো বাসতে কে বলেছে তোমায়? কে বলেছে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় মানতে? আমি বলেছি? বলিনিতো! তাহলে কেন এত জোরাজুরি তোমার? শান্তি দাও এই মন কে।আরাম করতে দাও ওকে।যখন ওর ইচ্ছে হবে আমার ওপর গলতে ও গলবে।ওকে প্রেশার দিলে ও যে বেঁকে বসবে তিথি।মন বড্ড অবাধ্য!

তিথি উদ্বেগ নিয়ে বলতে নিলো,

‘ তন্ময় আমি…

তন্ময় একটা আঙুল চেঁপে ধরলো তিথির পাতলা ওষ্ঠে।মাথা নেঁড়ে বলল,

‘ উহু! এখন আমি বলব,তুমি শুনবে…

তিথি চুপ করে যায়।তন্ময় দুহাতে তিথির গাল ছুঁয়ে বলল,

‘ বন্ধুর মত ভালোবাসোনা আমায়? বাসোতো?

তিথি ওপর নিচে মাথা দুলিয়ে “হ্যা জানালে তন্ময় প্রসারিত হাসলো।বলল,

‘ ব্যাস! আমার এতেই হবে।বন্ধু হিসেবেও যদি ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকতে পারি এর চেয়ে ভাগ্যের কি আছে বলোতো?

তিথি অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ তুমি একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও তন্ময়..

তন্ময় কপট রাগ নিয়ে বলল,

” চুপ! এতক্ষন যা বলার বলেছো,এই কথা মুখেই আনবেনা তুমি।তাহলে যে এবার কষ্ট পাব।ভীষণ কষ্ট!

তিথি নিঁচের দিকে চোখ নামিয়ে দুঁফোটা জল ফেলল। তন্ময় হেসে বলল,

‘ এই তিথি! কাঁদছো কেন? আচ্ছা তুমি বলোতো,কজন পারে তোমার মত এত নিঃস্বার্থ ভাবে ভাবতে? আজ যদি তোমার জায়গায় অন্য মেয়ে হত,হয়ত সে নিজের জন্যেই ভাবত।নিজের ভালো থাকা নিয়ে ভাবত! যেটাতে তার ভালো, তার সুখ।তাতে হই আমি তার ভালোবাসা কিংবা কোনো অপশন। কিন্তু তুমিতো তা ভাবোনি,তুমি ভেবেছো আমার কথা।আমাকে মনের বিরুদ্ধে বিয়ে করলে, মেনে নিলে, আমি ভালো থাকব কিনা সেটা ভেবেছ তুমি। এত সুন্দর, সাবলীল ধারনা আমার তিথি ছাড়া কারোর হতেই পারেনা।আর এইজন্যে আমি তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসব। আমার সত্যিই কোনো দুঃখ নেই,কোনও আফসোস নেই।কারন আমি সঠিক একজন কে ভালোবেসেছি। সঠিক লোককে বেঁছেছি।
নাই বা হলো তোমাকে পাওয়া,ভালোবেসে যেতে দোষ কি? ভালোবাসার মানুষকে যে সব সময় পেতেই হবে এমন কি কোথাও লেখা আছে?

তিথি একভাবে চেয়ে আছে তন্ময়ের দিকে।জলমাখা চোখ উপচে পরছে মুগ্ধতায়। তন্ময় থামতেই তিথি ঝাঁপিয়ে পরলো ওর বুকে। দুহাতে জড়িয়ে,পেঁচিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,

‘ আমার জীবনে কেন আগে এলেনা তন্ময়? কেন এলেনা?

তন্ময় তিথির মুখ তুলে বলল,

‘ আগে আসিনি তো কি হয়েছে,ভবিষ্যতের জন্যে আমি শুধু তোমারই আছি।

তিথি ভাঙা কন্ঠে বলল,

‘ আমি কথা দিচ্ছি তন্ময়,আমার জীবনে আর কখনও যদি কোনো পুরুষ আসে,সে তুমি ছাড়া অন্য কেউ হবেনা। কোনও দিন না।

তন্ময় মৃদূ হাসলো।চোখ দুটো টলটলে জলে ভর্তি।

‘ এতেই আমার শান্তি তিথি।আমি আর কিচ্ছু চাইনা।
সামনে অনেক কিছুই তো বাকি।তুমি এখনি কেন এসব ভাবছো? তুমি পড়াশুনা করো,নিজের পরিচয় তৈরি হোক তোমার।আমিও আর একটু ম্যাচিউর হই,তারপর না হয়…
কে বলতে পারে,ততদিনে তোমার মনে সম্পূর্ণ জায়গা যদি আমারই দখলে হয়?

তিথি চোখ মুছে বলল,

‘ আমাকে ছেড়ে যাবেনাতো? এভাবে পাশে থাকবেতো?

তন্ময় ঠোঁট কাঁমড়ে হেসে মাথা নাঁড়লো।

‘ সারাজীবন থাকব।

তিথির ঠোঁটে ফুটলো উচ্ছ্বল হাসি। তন্ময়ের বুক ভরে এলো প্রশান্ত হাওয়ায়।সেই হাওয়ায় দুলে উঠলো এক পিপাসু বুকের তৃপ্তি মেটার শখের খুঁটি।মনে মনে বলল,

‘ অপেক্ষায় থাকব তিথি,কোনো এক পূর্নতিথিতে আমার ঘরে বউ হয়ে আসবে তুমি।হোক না আজ,কিংবা আগামী বছর,কিংবা মৃত্যুর আগের দিন।সেদিনও আজকের মত আমি তোমাকেই চাইব।শুধু তোমাকে।

তারপর দিন পার হয়।আদিত্যকে এক প্রকার হাতে পায়ে ধরেও বাড়ি ফেরানো যায়নি । আজ,পুতুলেরও ও -ঘরে ঠাঁই মেলেনি।শকুন্তলা নিজে ওকে বাপের বাড়ি রেখে আসেন।সব খরচা দিলেও ঘরে তুলবেন না এই এক কথা তার। কি নিষ্ঠুর,স্বার্থবাদি সমাজ!,এতদিন যেই মেয়ে ছিলো চোখের মনি একটা সামান্য খবরে সেই হলো চোখের বিষ! পুতুল কে তাঁড়ানোর জন্যে যেই আদিত্য ছিলো ভীষণ তৎপর, সে সব শুনেও ফেরেনি।ফিরে কি লাভ? তিথি তো নেই।আসবেওনা।বরাবরের মত একটা ভুলে হারিয়েছে তার প্রেয়সী।
শকুন্তলা আর সমিরন,ছেলের শোকে হা- হুতাস করেন। কাঁদেন।ভীষণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে রাত পার করেন। নিজেদের করা অন্যায় বুঝেছেন কিনা সেতো তারাই জানে। সুস্মিতা বর,শ্বাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে গিয়েছে নিজের সংসারে।সে এখন ভালোই আছে হয়ত। সবার খবর কি আর রাখা যায়?
সুচিত্রা ছেলে মেয়েকে নিয়ে আগের মতই থাকেন।স্কুল,তারপর টেইলার্সের কাজ সামলে দিন পার হয় তার। বৃষ্টিও আগের মত বেপরোয়া।আর তন্ময়,তিথি?
ওদের দিন কাটছে ভালোই। তিথির পড়া্শোনা চলছে। শোকের রেশ এখন তার শুধু দীর্ঘশ্বাসে বের হয়।আগের মত চোখের জলে নয়। তন্ময় তিথির পাশে আছে বন্ধু হয়ে। হয়ত সারাজীবন থাকবে।তবে বন্ধু থেকে প্রানের পুরুষ হবে কিনা সে ভাগ্য ছাড়া কে জানে? হতেও পারে,কোনো এক পূর্নতিথিতে সত্যিই ওদের মিল হলো!

সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ-
এটা আংশিক সত্যি ছিলো সবাই জানেন। আমি সেখানে কিছু যোগ করেছি মাত্র।জানিনা কতটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি।তবে আমার মূল লক্ষ্যই ছিলো এত কষ্টেও তিথির ভেঙে না পরার চিত্র টা তুলে ধরা।সাথে সব জেনেও একটা ছেলে কিভাবে একটা মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারে সেটা দেখানো। সমাজে অনেক ছেলে আছে, তন্মধ্যে কিছু আদিত্য হয়,কিছু হয় তন্ময়। তিথির ভাগ্যে তন্ময় আছে কিনা আমি জানিনা।ওর বর্তমান পরিস্থিতি ও দোটানায় ভুগছে ভীষণ। আমি সেটুকুই তুলে ধরেছি।ওর জীবনে যেমন এখনও বৈধ ভাবে কেউ আসেনি তাই আমিও কাউকে দেখাইনি। আর তিথির ভবিষ্যত আমি জানিনা।যত টুকু জানি তত টুকু লিখেছি।তার সামনের সিদ্ধান্ত কি হবে? নিজের পায়ে যোগ্য হয়ে দাঁড়াবে কিনা,কাকে বেছে নেবে আমি জানিনা।এর মধ্যে কিছু বানানো ছিলো।কিন্তু কারোর জীবনের শেষ পরিনতি তো আর না জেনেশুনে বানিয়ে লেখা যায়না! যদি এমন হয়,তিথিকে অন্য কেউ পেলো,কিংবা পেলো তন্ময়,কোনো একদিন একটা সারপ্রাইজ পর্বের মধ্যে আপনাদের জানাব কথা দিচ্ছি। ভালো থাকবেন সবাই।দোয়া রাখবেন তিথি নামক সেই শক্ত মনের মেয়েটির জন্যে। ধন্যবাদ।ভালোবাসা রইলো🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here