#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১২)
পশ্চিমের লাল সিঁদুরের ন্যায় রঙটা মুছে গিয়েছে। চারপাশটা এখন নিকষ কালো।ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবেছে চাঁদ।আকাশের বুকে তারা উঠেছে বেশ ক ‘ডজন। বাইরে বইছে ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের শীতল স্পর্শ গায়ে লাগতেই লোম গুলো দাঁড়িয়ে পরছে তাৎক্ষণিক । গুরু- গুরু নেঘ ডাকছে মৃদূ স্বরে।বৃষ্টি হবে কি? এই সময়?
দূরের জারুল গাছে উল্টো হয়ে ঝুলছে সাড়ি সাড়ি বাঁদুর৷ রাতের এই সময়ে কি অদ্ভূত দেখাচ্ছে ওদের! বকুল ফুলের ম- ম ঘ্রান নাকে এসে বিঁধছে।মন মাতানো সুবাস আজ বোধ হচ্ছে বিদঘুটে। নিরস,নিরানন্দ মস্তিষ্কে সবকিছু বিকৃত ঠেকছে।ভোঁতা মনে হচ্ছে সব অনুভূতি।
বাতাসের বেগ হঠাৎই বেড়ে এলো।জানলার কপাট একটার ওপর আঁছড়ে পরলো আরেকটা।
।শব্দ শুনে ধ্যান ভাঙলো আদিত্যর। বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে আনলো। জানলা আটকে ঘাঁড় ফেরালো ঘরের দিকে। খাটের এ মাথা থেকে ও মাথা তাজা ফুলে স্বাজানো। মনে হচ্ছে একজন তার সমস্ত পরিশ্রম ঢেলেছে ঘর স্বাজানোয়।কোথাও কোনো ফাঁকফোঁকড় রাখেনি। বিছানার ঠিক মধ্যিখানে গোলাপের টকটকে পাঁপড়ি দিয়ে হার্টশেভ আঁকানো।আর তার ভেতরে লিখেছে, (A+P)
আদিত্য খুব মন দিয়ে লেখাটা দেখলো।তার কাছে ভীষণ অপ্রিয় আর অদ্ভূত ঠেকলো “P “শব্দটা।মনে হলো বেমানান।বিছানার ওপর এক হাটু ভাঁজ করে বসলো সে। হাত এগোলো লেখাগুলোর দিকে। সুগভীর মনোযোগে “P “শব্দটাকে বদলে দিলো ‘T’তে। লেখাটা এখন (A+T)। এটুকু করায় আদিত্যর ভীষণ আনন্দ হলো।ঝুঁকে গিয়ে চুঁমু খেলো তাতে।
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ আসে কানে।আদিত্য তৎপর হয়ে উঠে বিছানার এক পাশে বসলো।পুতুল বেরিয়েছে।হাতে তোয়ালে,পড়নে সুতির শাড়ি। রিসিপশনের রমরমা আয়োজন শেষ হয়েছে অনেকক্ষন।একটু আগে তাদের দুজনকে ঘরে দিয়ে সব নিয়ম শেষে বেরিয়েছে সবাই।আদিত্য একবার পুতুলের দিকে তাকালো। গোসল সেড়েছে।ভারি মেক আপ তুলে বেরিয়ে এসছে নিজস্ব মুখ। মেয়েটার গায়ের রং টাই শুধু ফর্সা।এছাড়া কোনো বিশেষত্ব নেই।
অথচ তিথির? ধবধবে ফর্সা না হলেও মুখ জুড়ে যেন মায়াবি পরিরা ছুটে বেড়ায় ।আদিত্য চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলো।গায়ের কোর্ট টা খুলে রাখলো চেয়ারের হাতলের ওপর। টেবিলের ওপর রাখলো কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটাকে। পুতুল আস্তে করে এসে বসলো বিছানার ও-পাশে।আড়চোখে বারবার মাথা তুলে নিজের স্বপ্নপুরুষ কে দেখছে সে।ফর্সা গাল, ভর্তি দাঁড়িতে।মনে হয় অনেক দিন সেলুনের মুখ দেখেনি।তবুও কি সুন্দর মানিয়েছে!লোকটা অন্য রকম। নতুন বউকে সরাসরি দেখেনা। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে কি? এখান- কার সবাই তার গায়ের রংয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । শাশুড়ি পরতে দিয়েছে পাতলা শাড়ি। সুস্মিতা বলেছে যতটা পারা যায় শরীরের ভাঁজ মেলে রাখতে আদিত্যর সম্মুখে। কিন্তু সে লোককি একবারও তাকাচ্ছে?
লোকটা ভাত কাঁপড় দেয়ার সময় মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো।সবাই কতবার বলতে বলল শিখিয়ে দেয়া কথা,
” আজ থেকে আমি তোমার ভাত কাঁপড়ের দায়িত্ব নিলাম।
অথচ এই লোক বলেইনি। তবুও খারাপ লাগেনি পুতুলের। থালাটা হাতে দেয়ার সময় যখন আদিত্যর একটা আঙুলের স্পর্শ লেগেছিলো তখন সমগ্র শরীরে বয়েছে তুমুল শিহরন। তখনও সে মুগ্ধ চোখে দেখছিলো কালো রং এ মোড়ানো লোকটার ফর্সা সৌন্দর্য।
পুতুলের লজ্জ্বা -লজ্জ্বা অনুভূতি হচ্ছে। গলা থেকে শব্দ বের করতে বুক কাঁপছে যেন।হঠাৎ উঠে
আদিত্য টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বার করলো। লাইটার দিয়ে সিগারেটের তামাটে মাথাটা ধরিয়ে আধশোয়া হলো বিছানার এক কোনে। চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করলো তারপর । কি মনোনিবেশ তার! পুতুল এক ধ্যানে চেয়ে থাকলো। মনে হলো এই পৃথীবিতে পুরুষের রুপ তখনি খোলে যখন তার ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেটের পোঁড়া অংশ থাকে। এই যেমন এখন,কি অদ্ভূত সুন্দর লাগছে তার বর নামক ব্যাক্তিকে।
পুতুল অপেক্ষা করছে। আদিত্যর কাছে আসার। তাকে বুক ভরে ভালোবাসার। অনেকক্ষন কেটে গেলেও আদিত্য এলোনা।সিগারেট একটা শেষ করে আরেকটা ধরাতে ব্যাস্ত সে।
পুতুল পা দুটো ওঠালো বিছানায়৷ শেষ অব্দি লজ্জ্বা বিসর্জন দিয়ে এগোলো আদিত্যর দিকে। কাঁপা হাত এগিয়ে আদিত্যর উরুতে রাখলো।আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল। ঠান্ডা দৃষ্টি রাখলো পুতুলের মুখের ওপর। পুতুল মৃদূ হাসলো। নিঁচের দিকে চেয়ে।পরমুহূর্তেই আবার মাথা তুলে তাকালো।
আদিত্য নিশ্চুপ।চেয়ে আছে শুধু । পুতুল এবার ভ্রু কুঁচকে আস্তে করে বলল,
‘ আপনার কি কিছু হয়েছে? চিন্তা করছেন কিছু নিয়ে?
আদিত্য উত্তর দিলোনা।পুতুল আবার বলল,
‘ আমাকে বলুন না,কি হয়েছে আপনার?
আদিত্য চুপ।পুতুল আরেকটু এগিয়ে এসে আদিত্যর বুকের ওপর মাথা রাখলো।লম্বা শ্বাস টেনে আদিত্যকে শক্ত করে ধরলো। বলল,
‘ জানেন,আমি যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম, আমাদের বসার ঘরে?ঠাকুরে কাছে দিন -রাত প্রার্থনা করেছি যাতে আপনার সাথেই আমার বিয়ে হয়।আপনাকেই যেন স্বামী হিসেবে পাই। আর দেখুন, ভগবান আমার সেই ইচ্ছে পূরন করলো।খুব তাড়াতাড়ি। আপনার মত একজন আমার স্বামী, এ আমার পরম সৌভাগ্য বলে আমি মানি.. আপনাকে আমি আমার সর্বচ্চ দিয়ে সুখি করার চেষ্টা করবো।আমি…
কথাটা শেষ করার আগেই আদিত্য বুক থেকে ছিটকে সরিয়ে দিলো পুতুল কে। পুতুল অবাক চোখে তাকালো। আদিত্য ওর দিকে না তাকিয়ে সিগারেটের মাথায় টান বসালো আবার।ধোঁয়া ছেড়ে কড়া কন্ঠে বলল,
‘ বিছানা থেকে নামো।
পুতুল খানিক ভঁড়কে গেলো। বিস্মিত কন্ঠে সুধালো,
‘ জ্বি?
উত্তরে আদিত্য শান্ত ভাবে আবার বলল,
‘ বিছানা থেকে নামো।
পুতুল ঠাঁয় বসে রইলো।আদিত্য তাকালো এবার। হঠাৎই ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ শুনতে পাসনি? নাম বিছানা থেকে…
এমন বাজখাই ধমকে কেঁপে উঠলো পুতুল।ধড়ফড় করে নেমে দাঁড়ালো। আদিত্য এবার পা দুটো মেলে দিলো বিছানায়। বলল,
‘ আজ এসেছিস, এসেছিস।পরের বার আমার ধারে কাছে আসার সাহস করবিনা। আদিত্যর চেহারায় মুগ্ধ হয়েছিস? এরপর তার রাগ ভয় পাবি।
পুতুল কাঁপা স্বরে বলল,
‘ ককিন্তু কি… কররেছি আমি?
আদিত্য আগুন চোখে তাকালো। পুতুল ভয়ে নামিয়ে নিলো চোখ। আদিত্য প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ দরজার পেছনে পাটি রাখা আছে,আর ওয়াড্রবে কাথা, বালিস।বিছিয়ে, শুয়ে পর নিঁচে।ঘরে জায়গা দিয়েছি এই অনেক।ভুলেও আমার বিছানায় উঠবিনা।
এটুকু বলে আদিত্য পাশের খালি জায়গায় হাত বোলালো।অস্পষ্ট স্বরে বলল,
‘ এইখানে জায়গা শুধু একজনের।
পুতুল স্তম্ভিত চোখে চেয়ে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফুলসজ্জার রাতে স্বামী সোহাগের বদৌলতে এমন ব্যাবহারে হতভম্ব সে। পুতুল কে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদিত্য ধমকে বলল,
‘ সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর সামনে থেকে।
পুতুল আবার কেঁপে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে পাটি,বালিশ, কাঁথা এনে মাটিতে বিছায়। তড়িৎ বেগে শুয়ে পরে।আদিত্য হাতের সিগারেট শেষ করে এস্ট্রে -তে ফেলল। বিছানা ছেড়ে নেমে হেটে গেলো দরজার দিকে। পুতুল মুখ উঁচিয়ে দেখলো একবার।পরমুহূর্তেই বালিশে মুখ গুঁজলো। মনে প্রশ্ন এলেও ছোঁড়ার সাহস পেলোনা। আদিত্য দরজা খুলতেই ওপাশে রঞ্জন কে দেখে ভ্রু কোঁচকালো।রঞ্জন অবাক হয়ে বলল,
‘ বাহ,মাত্রই দরজায় টোকা দিতে যাচ্ছিলাম।খুলে দিলি এর আগেই?
‘ তুই এ -সময়?
রঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করলো,
‘ তার আগে তুই বল, কোথাও যাচ্ছিস?
আদিত্য নিঁচের দিকে চেয়ে ছোট করে বলল,
‘ হু।
রঞ্জন ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ কোথায় জানতে পারি?
আদিত্য বলল,
‘ জানিনা।
রঞ্জন খোঁচা মেরে বলল,
‘ আর ফুলসজ্জার কি হবে? করবিনা?
আদিত্য তাকালো।অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আমি পারছিনা রে রঞ্জন।তিথির জায়গায় অন্য মেয়ে কে ভাবতে, আমি কোনো দিন পারবোনা।
রঞ্জন তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল,
‘ এটা আগে ভাবা উচিত ছিলো না?
আদিত্য উত্তর দিলোনা।রঞ্জন একবার ঘরের ভেতর তাকালো। পুতুলকে মাটিতে শুতে দেখে বুঝে নিলো সবটা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আয় আমার সাথে। কথা আছে।
আদিত্যকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে চলল রঞ্জন।আদিত্য চুপচাপ হাটছে।যন্ত্রের মত।সিড়ির গোড়ায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। রঞ্জন আদিত্যকে নিয়ে সোজা চলে গেলো ছাদে। মাঝখানে দু একজন বাঁধলেও তারা প্রশ্ন করেনি। সৃষ্টি কর্তার অশেষ কৃপায় আদিত্যর বাবা- মা, বোন কেউই সামনে পরেনি।
ছাদে উঠে দরজা চাপালো রঞ্জন।আদিত্য ততক্ষনে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। চোখ রাখলো রাস্তায়। বাড়ির গেট -টা আহামরি স্বাজানো।ঘরের বউ তুলেছে তার বাবা। তার কথায়,যেমন তেমন হলে চলবেনা।
আদিত্য নিষ্প্রান দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো গেটের দিকে। হঠাৎই চোখে ভেসে উঠলো এক কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। এইতো স্বাজানো একটি গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। সবার প্রথমে নামলো সে। এরপর হাত বাড়িয়েছে কারো আশায়। অতি আকাঙখিত একটি হাত তার হাত ছুঁলো।ধীর পায়ে নামলো গাড়ি থেকে। মেয়েটির মুখ তখনও অস্পষ্ট। একটু বাদেই সে মুখ তুললো। এইতো তিথি! হ্যা তিথিইতো,ইশ! বউ সেজেছে মেয়েটা।লাল টুকুটুকে বেনারসি গায়ে মুড়িয়েছে।কি সুন্দর! কি সুশ্রী লাগছে । আদিত্য তাকে কোলে তুলল। চারপাশ থেকে হচ্ছে ফুলের বর্ষন,সেই সাথে ভাসছে উলুধ্বনি। তিথিকে কোলে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলো অাদিত্য।এমন রঙিন মুহুর্ত,মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির আস্বাদন দিলো। খাঁ খাঁ করা বুকটা তৃপ্তি পাচ্ছে। ভীষণ তৃপ্তি।
রঞ্জন আদিত্যর কাঁধে হাত রাখতেই আদিত্য চমকে উঠলো। একবার রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আবার গেটের দিকে ফিরলো। হতাশ হলো দৃষ্টি। বুঝতে অসুবিধে হলোনা,এতটা সময় স্বপ্ন সমুদ্রে ডুবে ছিলো সে।
রঞ্জন কোমল কন্ঠে বলল,
‘ আমি জানি তোর মনের অবস্থা।তবুও একটা কথা বলতাম।শুনবি?
আদিত্য সামনে চেয়ে থেকেই বলল,
‘ বল।
রঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বলল,
‘ তিথি হাসপাতালে।
আদিত্য তড়িৎ গতিতে ঘাঁড় ফেরালো রঞ্জনের দিকে। চোখে মুখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বলল,
‘ কি বলছিস? ওতো তন্ম..
রঞ্জন মৃদূ হেসে বলল,
‘ না। ও তন্ময়ের কাছে নয়।ও হাসপাতালে।
আদিত্যর উদ্বিগ্নতা কয়েক গুনে বেড়ে এলো।ভীত কন্ঠে শুধালো,
‘ তুই জানলি কি করে?
রঞ্জন ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আমাকে ওর চাচা সঞ্জিব মিত্র বলেছেন।আজ দুপুরে দেখা হয়েছিলো ওনার সাথে। যদিও তিথির কথা যেঁচে আমিই জিজ্ঞেস করেছিলাম।কারন তোর কাছে শোনা কথাটা আমার হজম হয়নি। তখন বললেন,উনি
‘ কাল রাতে তিথিকে বাসায় না পেয়ে তিথির মা সঞ্জিবকে ডাকেন।ওনার সামনেই তিথির মায়ের ফোন আসে।আর তখন ওনার কথাবার্তা শুনে সঞ্জিব বুঝতে পারেন যে তিথি অসুস্থ আর হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু কোন হাসপাতালে বা ওকে কে নিয়ে গিয়েছে এসব উনি জানেন না।সেসব না বলেই তিথির মা হাস্পাতালের উদ্দেশ্যে ছুট লাগান।
রঞ্জনের কথায় যেন আকাশ থেকে পরলো আদিত্য। স্তব্ধ হয়ে বলল,
‘ এর মানে আমি…
রঞ্জন মাঝপথে ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘ তুই তিথিকে ভুল বুঝেছিস।আমার তো মনে হয় তুই তিথিকে কখনও বুঝতেই পারিস নি। হয়তো তন্ময় তিথির কাছে হাসপাতালে ছিলো বলেই ও ওই কথাটা বলেছিলো। আর তুই কি না কি ধরে নিলি!
আদিত্য অনুশোচনায় মাথা চেঁপে ধরলো। রঞ্জন আবার বলল,
‘ তুই বিয়ে করলি আদিত্য।এটা জেনেও যে তিথি তোর সন্তানের মা হচ্ছে।অপরাধ কি তোর কম? এত কিছুর পরেও যদি তিথি সত্যি তন্ময়ের কাছে যেত তবে তাতে অন্যায় অন্তত আমি দেখছিনা।
আসলে আমরা মানুষ এরকমই,নিজের একশ ভুল শুধরে নিতে পারি,কিন্তু অন্যের একটা ভুল ভালোবেসে শোধরাতে পারিনা। নিজের ত্রূটি মেনে নিয়ে বলি আমি ভালো, অথচ অন্যের বেলায় এই নিয়ম কখনোই না।তার সামান্য ভুল অন্যায়,আর আমার অন্যায় আমার কাছে একমাত্র ন্যায়।
আদিত্য তাকালো।অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে।রঞ্জনের মত চুপচাপ,শান্ত, ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বিস্মিত সে।রঞ্জন একটু হেসে বলল,
‘ অবাক হচ্ছিস? আমিও অবাক হয়েছিলাম যেদিন তুই নিজের মুখে তিথিকে বললি এবোরশন করতে।।আমিও তখন ভাবছিলাম এটা আদৌ তুই ছিলি?
আদিত্য ধরা কন্ঠে বলল,
‘ সব জেনেও এই কথা বলিস না রঞ্জন।আমার হাত পা বাঁধা ছিলো।
‘ না । তোর হাত পা তুই নিজে বেঁধেছিস।অন্যকে তোকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধতে সাহায্য করেছিস।তুই যখন কাল সাত পাঁক অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেলি,বিশ্বাস করবিনা আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছিলাম,ভেবেছি হয়ত তুই তিথির কাছে ফিরছিস। মেয়েটা আমাকে একের পর এক কল করেছে ফোনে,কি উত্তর দিতাম আমি? সব জেনেও তোর সঙ্গ আমাকে দিতে হচ্ছে। ওর চোখে আমিও কি কম অপরাধি? তাই ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলাম। কিন্তু এরপর তুই যখন আবার এসে বিয়ের মন্ডপে বসলি আর একের পর এক নিয়ম পালন করে শেষ অব্দি বিয়েটা সেড়ে নিলি? তখন আমার মনে হলো যে তুই আসলে তিথিকে কখনও ভালোইবাসিস নি।
আমি জানতাম তিথি আমার কাছে প্রশ্ন করতো,তুই বিয়ে করছিস কিনা? বা আমি বললেও বিশ্বাস করতোনা।তাই ওর উত্তর হিসেবে তোর বিয়ের ছবি সঙ্গে সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছিলাম।নিজের চোখ কে তো আর অবিশ্বাস করবেনা বল!
( একটু থেমে)
যাক গে পুরোনো কথাতো বলে লাভ নেই। আসলে ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটেনা আদিত্য। তুই পেয়েও হারিয়েছিস। না, তুই হারাস নি,তুইতো একটা কচি বউ পেয়েছিস উল্টে।এখন তো প্রত্যেক রাত তোর সোহাগ রাত হবে।
আদিত্য ধমকে বলল,
‘ রঞ্জন!
রঞ্জন শুকনো হেসে বলল,
‘ এইটুকুতেই চেঁতে যাচ্ছিস? অথচ বিশ্বাস কর আদি, আমি যদি তোর বন্ধু না হয়ে তিথির দাদা হতাম? আজ তিথি নয় হাসপাতালে তুই থাকতি।
শেষ কথাটায় আদিত্যর প্রতি রঞ্জনের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেলো। কি শান্ত ভাবে জানালো সে।আদিত্য অবাক হয়ে তাকালো। হা হয়ে এলো গোলাকার মুখ। রঞ্জন চলে গেলো। পেছনে ফেলে গেলো ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যকে। আদিত্য অনেকক্ষন চেয়ে থেকে হঠাৎ ধুপ করে বসে পরলো।
নিচে স্পিকারে গান বাজছে তখন। আনন্দ করছে, নাঁচে গানে মশগুল বিয়ে বাড়ির সিংহভাগ সদস্য। আদিত্যর কাছে বিষের মত মনে হলো এই আওয়াজ,দু হাত দিয়ে কান চেঁপে ধরলো।শুনবেনা এই শব্দ।কিছুতেই না।
____
পরের দিন তিথিকে আনা হলো বাড়িতে। বিশ্রাম হীন কান্নাকাটির ফলে মেয়েটা নেতিয়ে পরেছে।চোখমুখ ফুলে ফেঁপে একাকার। গলা বসে গেছে।
এই দুটো দিন তন্ময় পুরোটা সময় ওর সাথে ছিলো।সুচিত্রা হাজার বার বললেও হাসপাতাল থেকে এক চুল নঁড়েনি। শুধু খাবার,ওষুধ এগুলো আনতে যা! বাকি পুরোটা সময় তিথির সঙ্গ দিয়েছে ছেলেটা।সুচিত্রা কৃতজ্ঞ তাতে। টেইলার্স বন্ধ রাখতে পারলেও স্কুল থেকে যত্র ছুটি পাননি। তাই ইচ্ছেসত্ত্বেও মেয়ের কাছে থাকা হয়নি। সে জায়গায় তন্ময় ছিলো বলে নিশ্চিন্ত ছিলো । অন্তত অসুস্থ মেয়েটাকে একা থাকতে হয়নি।
শরীর থেকে অনেক রক্ত চলে যাওয়ায় তিথির উজ্জ্বল ফর্সা মুখটা এখন ধবধবে ফর্সা লাগছে।চিকন চোখের নিঁচ কালিতে ভর্তি। ঠোঁট শুকিয়ে হয়েছে মড়মড়ে।শুকনো মরা সাদা চাঁমড়া ভাসছে তাতে। ভাগ্যবশত আজ শুক্রবার থাকায় সুচিত্রার কাজে যেতে হয়নি। তিথিকে খাটের শুইয়ে, এসে প্রথমে রান্না চাপালেন তিনি। মেয়েটা অনেকদিন ঠিকমতো খায়না।শুকনো শরীর শুকিয়েছে আরো।কাজের চাপে ঠিকমতো খেয়াল রাখতে না পারলেও মায়ের চোখেতো সব-ই ধরা পরে। সুচিত্রা এক চুলোয় ভাত আর অন্য চুলোয় মুরগির মাংস বসিয়েছেন। তন্ময় বাইরে গিয়েছে। কিছু একটা কাজে। তিথি তখন বিছানায় হেলান দেয়া।চোখ বন্ধ। মাথাটা দপদপ করছে।চোখের আশপাশ ব্যাথা করছে।সুচিত্রা রুমে এসে চুল হাত খোপা করতে করতে বললেন,
‘ সোনু! চল তোকে স্নান করিয়ে দেই!
তিথি কেমন নঁড়ে উঠলো। আতঙ্ক ফুটলো মুখ জুড়ে। ভাঙা কন্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ না মা,আমি পারবো।লাগবেনা।
সুচিত্রা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ কেন আমি করিয়ে দিলে কি হবে? মায়ের কাছে লজ্জ্বা পাচ্ছিস?ছোট বেলায় তো জামা কাপড় ছাড়া ঘুরতিস! আজকের দিন পুরোটা সেবা করবো তোর।আমি অসুস্থ হলে তুই করিস না?
তিথি তবুও আপত্তি করলো,
‘ মা আমি পারবো!
সুচিত্রা চোখ পাকিয়ে বললেন,
‘ চুপ।আয় নাম…
অনেক বলে কয়েও কাজ হলোনা যখন অগত্যা নেমে দাঁড়ালো তিথি।শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। মুখে পারবে বললেও সত্যিই নিজেকে পরিষ্কার করার শক্তিটুকু নেই। সুচিত্রা তিথিকে ধরে ধরে নিয়ে গেলেন ওয়াশরুমে। প্লাস্টিকের টুল পেতে বললেন,
‘ এখানে বোস।
তিথি বসলো।সুচিত্রা প্রথমেই ওর গায়ের ওড়না সরালেন।এরপর পাঞ্চ ক্লিপে বাঁধা উশখোখুশকো চুল টা খুলে দিলেন। তিথির মুখ ছোট হয়ে এলো ভয়ে। সুচিত্রা চুলে হাত বুলিয়ে নাক কুঁচকে বললেন,
‘ ইশ! কি অবস্থা! কাকের বাসা হয়েছে দেখেছিস।শ্যাম্পু করে দেই দাঁড়া।
তিথি আস্তে করে বলল,
‘ মা দরকার নেই..থাকনা।চুল ভেঁজাতে হবেনা।যেমন আছে থাক।
সুচিত্রা মৃদূ ধমকে বললেন,
‘ তুই থামতো
সুচিত্রা বালতি থেকে সবুজ মগ টা ভরে পানি তুললেন।চুলের জট ছাড়াতে ব্যাস্ত হলেন আগে। তিথির চুলে কানা সিঁথি করা। সুচিত্রা চুল নাড়াচাড়া করার ফাঁকে হঠাৎই এক জায়গায় চোখ আটকে এলো। থমকে থেমে গেলো হাত দুটো।মেয়ের মাঝের সিথি ভর্তি লাল সিঁদুর! কানা সিথিতে ঢেকে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস করেছিলো মাত্র । সুচিত্রার চোখে ঠিক পরলো আজ। । হাত থেকে মগ টা ফেলে দিলেন।পানি টুকু ছিটকে পরলো এদিক ওদিক। সিমেন্টের ফ্লোরে অদ্ভূত শব্দ হলো তাতে। তিথি বুঝে নিলো মায়ের কাছে ধরা পরেছে সে৷
অপরাধির মত মাথা নামিয়ে নিলো নিঁচে। সুচিত্রা অবাক কন্ঠে বললেন,
‘ এই সিঁদুর? আদিত্য পরিয়েছে? তার মানে তোরা বিয়ে করেছিস?
তিথি মাথা নেঁড়ে ‘হ্যা জানালো। সুচিত্রা কেঁদে ফেললেন। বসে পরলেন তিথির পাশে। তিথি ক্ষীন আওয়াজে বলল,
‘ তোমার কি মনে হয় মা? তোমার মেয়ে বিয়ের আগেই কারো সন্তানের মা হবে? এতোটাও অধম শিক্ষা আমি পাইনি।
সুচিত্রা জলমাখা চোখে চেয়ে বললেন,
‘ কিন্তু কবে হলো এসব?
‘ দেড় বছর আগে।
সুচিত্রা অবাক হয়ে বললেন, ‘ কি?
‘ হু। তবে এই বিয়েতে কোনো পুরোহিত ছিলো না।না ছিলো অগ্নিকুণ্ড, আর না কোনও মন্ত্রপাঠ। সেদিন মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলাম। আদিত্য ফোন করে বলল, দেখা করবে।বললাম ওখানেই চলে আসতে। ও এলো। ওর মনে তখন কি চলছিলো আমি জানিনা। তবে কথা বলার এক পর্যায়ে সিদুর তুলে মাথায় পরিয়ে দেয় আমার।ঠাকুরের সামনেই।
বলল,আজ থেকে আমি ওর স্ত্রী।
আমিও মেনে নেই।ভালোবাসি বলে।
তারপর থেকেই সিদুর পরে লুকিয়ে রাখতাম।কেউ জানতোনা। আজ তুমি জানলে।
সুচিত্রা ভারি নিঃশ্বাস ফেললেন,
‘ এ জন্যেই আমার হাতে স্নান করতে চাইছিলিনা?
তিথি মাথা নাড়লো।
সুচিত্রা ফিচেল হেসে বললেন,
‘ ছেলেটা সিঁদুর পরিয়ে প্রেমের দোহাই দিয়ে বোঁকা বানিয়ে তোর সর্বস্ব কেঁড়ে নিলো। কি চালাক!
তিথি জবাবা দিলোনা।ভেতরটা পুঁড়ছে। চোখের সামনে ভাসছে সেই অতীত। তখনও কি বুঝেছিলো? আদিত্য তার হবেনা? তিথি তপ্ত শ্বাস ফেলল। হঠাৎই বৃষ্টি কে মনে পড়লো।বৃষ্টি আদিত্যকে তার “কৃষ্ণ “বলে সম্বোধন করতো।নিস্তেজ ঠোঁট প্রসারন করে হাসলো তিথি।মনে মনে বলল,
‘ তুই ঠিকই বলতি দিদি।আদিত্য আমার “কৃষ্ণ”।রাঁধা যেমন তার কৃষ্ণকে পেলোনা। তেমনি পেলাম না আমিও। কিন্তু রাঁধা জলে ডুবে মরলেও আমি বাঁচবো।মাথা উঁচিয়ে বাঁচবো।বাঁচতে তো আমাকে হবেই।
দরজার ওপাশে বাড়ানো পা টা গুটিয়ে আবার আগের জায়গায় আনলো তন্ময়। দুহাতে ফুচকার প্যাকেট।তিথির জন্যে আনা।বুকের মধ্যে পোষা চাপা উচ্ছ্বাস নিয়ে,তিথির রুমে ঢুকতে গিয়ে সুচিত্রা আর তিথির সব কথা কানে এসেছে তার।
ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে তন্ময়ের।এর মানে তিথি আদিত্যর স্ত্রী? আদিত্য তিথির সিঁথিতে সিঁদুর তুলেছে কথাটা সূচের মতন বিঁধলো বুকে।মরন যন্ত্রনার সৃষ্টি করলো। তিথিকে এ জন্মে সত্যিই সে পাবেনা? তিথি তাকে ভালোবাসবেনা? কোনও দিন না?
চলবে,
গত পর্বে জাত নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিলো সে ব্যাপারে একটু বলি,ভারতে কি নিয়ম আমি জানিনা,তবে বাংলাদেশে সাহা-রা নিজেদের উঁচু বংশ মানে,স্বভাবত তারা অনেক অহংকারী হয় এবং নিজেদের বংশ ছাড়া বিয়ে দিতে চায়না। আমি এই দেশের নিয়ম অনুযায়ীই দেখিয়েছি আদিত্যর বাবা মা তাদের উঁচু বংশ মানে।
দ্বিতীয়ত,
আজকের পর্বে বিয়ের যে বিষয় টা রয়েছে,রীতি অনুসারে হয়তো অনেক নিয়ম পালন করে তারপর বিয়ে হয়,কিন্তু এখানে শুধু সিঁদুরের ভিত্তিতে বোঝানো হয়েছে তারা বিবাহিত। এটা তাদের দুজনের সিদ্ধান্ত। যারা মন থেকে নিজেদের স্বামী স্ত্রী মেনেছেন। আশা করি এই ব্যাপার নিয়ে কেউ মতবিরোধ করবেন না।
(বিঃদ্রঃ) রিচেক করিনি।