পূর্ন__তিথি লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (১৩)

0
190

#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৩)

ভাঙা আয়না জোড়া লাগে।তবে গায়ের ওপর জোরের চিহ্ন চেয়ে থাকে স্পষ্ট । যতবার দেখবে,,তাকাবে, সে দাগ যেন চিৎকার করে বলবে আমি কখনও গুড়োগুড়ো হয়ে ভেঙছিলাম।কখনও হয়েছিলাম চূর। তবুওতো জোড়া হয়।এক হয় আলাদা দুটো অংশ।কিন্তু ভাঙা মন? সেকি আর জোড়া লাগে? কাঁচা, তাজা ক্ষত, বুকের বা পাশে বিশ্রামহীন রক্তক্ষরণ এসব কি থেমে যায়? একমুহুর্ত শান্তি নেই, স্বস্তি নেই।নেই স্থিতি, নেই সুখ। শুধুই জ্বালা।এক বুক জ্বালা।

তিথি বালিশ টা বুকে চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলো। আজকেও সেই একি দৃশ্য,একি ছবি।আদিত্যর ফুলসজ্জার ছবিগুলো কেউ একজন ওকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে। আর সেটাই বেঁধেছে তিথির চোখে।ক্লান্ত চোখ আবার নেমেছে অশ্রু গড়ানোর প্রতিযোগিতায়। এর একটা ছবিতে পুতলের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে আদিত্য। তিথির বুক জ্বালা করছে ।এই হাত কতবার তাকে খাইয়েছে হিসেব নেই। আচ্ছা, এখন তো মধ্যরাত, আদিত্য নিশ্চয়ই তার নতুন বউকে বুকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে!যে বুকে একটা সময় মাথা রাখতো সে,সেই বুকে অন্য কেউ! এরই নাম কি ভালোবাসা? আদিত্য ঠিক সেইভাবে ভালোবাসছে পুতুল কে,যে ভালোবাসায় একদিন হারিয়েছে সে?

দক্ষিনের জানলাটা হা করে খোলা। এক ধ্যানে বাইরে চেয়ে আছে তন্ময়।শ্যামবর্ণ মুখটা ঘন কালো মেঘে ঢাকা।বিষন্নতায় ছেঁয়েছে বুক। তিথি আদিত্যর স্ত্রী? কথাটা এত জঘন্য আর অসহ্য লাগছে, কানের কাছে বাজছে বিশ্রামহীন। এই পৃথিবীতে সব থেকে ভয়ানক আর কষ্টের হলো
‘ এক তরফা ভালোবাসা।

আর সেই ভয়ানক খেলাতেই মেতেছে তার হৃদয়। কেন তিথিকে ভালোবাসতে হলো! বন্ধুত্বটাই তো ঠিক ছিলো। তিথি জানেনা, ওর হাসি খুশিতে মেতে থাকা সেই বন্ধুত্ব গুলোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে।প্রতিনিয়ত ডুবে ডুবে ভাসছে। কখনও আবার তলিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে।

তন্ময়ের চোখে ভাসছে তিথির সাথে সেই প্রথম দেখার দৃশ্য,

___
সোমবার। তিথি কলেজে যাচ্ছিলো সেদিনও।বরাবরের মত সাদা ইউনিফর্ম এর সাথে কাঁধে ব্যাগ তার। কলেজের রাস্তাটায় রিক্সা আর সি এন জি চলা বাহুল্য।এরবাইরের যানবাহন ওভার লোডেড যাকে বলে। আর সেই ভুলটাই করলো তন্ময়।শর্টকার্ট নিতে গিয়ে ওমন চাপা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঢুকলো। এমনিতে বর্ষাকাল, সারারাত বৃষ্টির দরুন রাস্তার দু পাশে নোংরা পানি জমেছে। একদিকে সাদা পোশাক,তারওপরে পীচের রাস্তায় যাই চলুক সেসবের চাকার ছিটকে আসা পানি থেকে নিজের পোশাক বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা হিসেবে নিঁচের দিক চেয়ে পা টিপে টিপে হাটছিলো তিথি। বর্ষার ঋতুতে রিক্সাওয়ালা গুলো সিনেমার হিরোদের মত ভাবে থাকে।কিছুতেই তাদের রাজি করানো যায়না, দশ টাকার রাস্তায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা দাবি করে। তাই বাধ্য হয়ে হেটেই আসতে হচ্ছে আজ।
এদিকে তন্ময় ও বিপাকে পরেছে গাড়ি নিয়ে।ডান বাম, সামনে, পিছনে সব দিক খেয়াল করে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। দুজনের অমনোযোগ নির্নিমেষ মিলিয়ে দিলো এদের। তন্ময় আশপাশ খেয়াল করতে গিয়ে ওপাশ থেকে হেটে আসা তিথিকে চোখে পরেনি।ব্যাস লেগে গেলো সংঘর্ষ!

তিথি ছিটকে গিয়ে পরলো নোংরা পানির ওপর । সাদা ড্রেস মুহুর্তেই হলো ছাই- রঙ। চুলের মোটা বেনির গোছাটা অব্দি কাঁদায় মাখামাখি। কাঁধ ব্যাগটাও বাদ পরেনি। তিথি আপাদমস্তক নিজেকে দেখলো। রাস্তার অন্যরা মিটিমিটি হাসছে।নির্ঘাত মজা পেয়েছে ভীষণ। তিথির চেহারা কাঁদোকাঁদো হয়ে এলো । মস্ত বড় ব্লান্ডার করে ফেলেছে বুঝতেই গাড়িতে ব্রেক কষলো তন্ময়।তড়িঘড়ি করে গাড়ি সাইডে নিয়ে নেমে এসে তিথির কাছে ছুটে গেলো।তিথি তখন হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। তন্ময় হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আই এম স্যরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি।উঠে আসুন প্লিজ।

তিথি চোখ পাকিয়ে তাকালো,

‘ ইচ্ছে করে করেননি বুঝলাম।কিন্তু এখন আমি কলেজ যাবো কি করে? দেখলেন তো কি করলেন?

তন্ময় অতি নম্র কন্ঠে বলল,

‘ স্যরি মিস! আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি।প্লিজ এভাবে বসে থাকবেননা আসুন।

তিথি তন্ময়ের পেতে রাখা হাতের দিকে তাকালো। ধরবে কি ধরবেনা ইতস্তত করতে থাকলো কিছু সময়। তন্ময় বুঝতে পেরে চোখের সানগ্লাশ টা খুলে হেসে বলল,

‘ আপনি এত ভাববেন না। হাত ধরা তেমন খারাপ কিছু নয়।বিপদে পরেতো আরো-ই নয়।

তিথি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত ধরলো তন্ময়ের।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো তখন, যখন উঠতে গিয়ে ডান পা টা স্বায় দিলোনা। নড়তেই পেশিতে টান লাগায় ব্যাথায় মুখ কুঁচকে ফেলল তিথি। তন্ময় উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ আপনার বোধ হয় পা মচকে গিয়েছে। দেখিতো আপনার পা টা।

তিথির পায়ে সাদা কেডস। ঠোঁট উল্টে বলল,

;’ আজ আমার কলেজ টা মিস হলো। পা ভাঙলো,ড্রেস নোংরা হলো।সব আপনার জন্যে।

‘ বুঝেছি। আচ্ছা একটু চেষ্টা করুন আমাকে ধরুন। এই এখানে ধরুন।

তন্ময় ইশারায় নিজের কাঁধ দেখালো।তিথির চোখ কপালে।অজানা অচেনা ছেলের কাঁধ ধরবে?তাছাড়া আদিত্য? সেতো যে কোনো সময় চলে আসতে পারে,সে দেখলে কি হবে? যেখানে কোচিং এর ছেলেদের সাথে কথা বললেই আদিত্য রাগে ফেঁটে পরে সেখানে এই অপরিচিত ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে হাটলে আদিত্যতো ফেঁটে দুভাগ হয়ে যাবে।
তিথির ভাবনার কিনারা পেলোনা তন্ময়। তবে ভাবলো হয়তো এবারেও ইতস্তত করছে। তাই বলল,

‘ আপনারা মিডেল ক্লাশ মেয়েরাও নাহ, কি না কি ভাবেন!

কথাটা বলেই তিথিকে কোলে তুলল তন্ময়। তিথির গায়ের ল্যাপ্টানো কাঁদায় ভ্রুক্ষেপ করলোনা।চমকে গেলো তিথি। হকচকালো। ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। সকাল বেলায় লোক সমাগম কম হলেও যারা আছে তারা উৎসুক হয়ে দেখছে। মফস্বল শহরে কোনো মেয়েকে কোলে তোলা, আমাবস্যার চাঁদের মত দূর্লভ তো বটেই সাথে অস্বাভাবিকও ! তন্ময় তিথিকে বসালো গাড়িতে। পা দুটো বাইরের দিকে রেখে নিজে বসলো হাটুমুড়ে। তিথি ঝটকা খেয়ে বোবা বনে গেছে।তন্ময় হাত দিয়ে তিথির জুতোটা খুলল। তিথি ধড়ফড় করে বলল,

‘ আরে আরে কি করছেন?

তন্ময় চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ চুপ থাকুন।

তিথি আর কথা বললনা।ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক দেখছে।আদিত্য বা তার বাবা, কিংবা পরিচিত কেউ, অন্তত এখন যেন ভুলেও এই রাস্তা না মারায়।
তন্ময় তিথির পা হাতে নিয়ে তিথির দিকে তাকালো। বলল,

‘ চোখ বন্ধ করুন।

তিথি ভ্রু কোঁচকালো,

‘ কেন?

‘ করুন না।

তিথি মুখের ওপর বলল,

‘ না।কেন চোখ বন্ধ করবো?

তন্ময় লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

‘ ঠিক আছে তবে চেয়েই থাকুন।

তন্ময় হাসলো,হাসির কারন বুঝতে পারলোনা তিথি। কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলো। আচমকা তিথির পায়ের গোঁড়ালি ধরে মোঁচড় দিলো তন্ময়।ব্যাথায় চিল্লিয়ে উঠলো তিথি,

‘ আউচ! কি করলেন এটা? আপনি কি মানুষ? এভাবে কাউকে ব্যাথা দেয়? বাজে লোক! ভেঙে দিলো আমার পা।

তন্ময় হাসছে।তিথি মুখ ঝামটা মেরে মাটিতে পা ছোয়াতেই অবাক হলো। পায়ে ব্যাথা নেই। একটুও না।খানিক আগে তো নাঁড়াতেই পারছিলোনা। তিথি চোখ বড় বড় করে তন্ময়ের দিকে তাকাতেই তন্ময় ভ্রু নাঁচালো। তিথি মুখ কাচুমাচু করে বলল

‘ স্যরি!

তন্ময় হেসে সানগ্লাস টা চোখে পরলো,

‘ ইটস ওকে। এবার নামুন।

তিথি আস্তে আস্তে নেমে দাঁড়ালো। মৃদূ স্বরে ডাকলো,

‘ শুনুন?

তন্ময় তাকালো।তিথি বলল,

‘ আপনার গাড়িটা ধুঁয়ে নেবেন। আর আপনার শার্ট টাও।নোংরা হয়ে গিয়েছে।

তন্ময় হেসে বলল,

‘ আগে আপনি নিজের মুখটা ধুয়ে নিন।আপনার গালের কি অবস্থা!

তিথি গালে হাত বুলিয়ে সামনে এনে দেখলো হাতের আঙুল কাঁদায় ভরেছে। তন্ময় হেসে গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো। বলল,

‘ এটা দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

তিথি কথা বাড়ালোনা,পানি দিয়ে প্রথমে হাত ধুলো,এরপর মুখ। গাল, ঠোটের আশপাশ সব কাঁদায় মাখা। তিথি মুখটা ভালো করে ধুয়ে বোতল টা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ধন্যবাদ।

তন্ময় কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বলল,

‘ ইটস ওকে। বাড়িতে যেতে পারবেন? নাকি পৌঁছে দেবো?

তিথি হঠাৎই হেসে ফেলল । সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধুক করে উঠলো তন্ময়ের। এতক্ষনে তাকালো সুগভীর মনোযোগে। মেয়েটার গালে টোল পরে।ইশ! হাসলে মনে হয় মুক্তো।

তিথি হেসে বলল,

‘ তার আগে এই সরু গলি থেকে নিজেকে আর নিজের গাড়িকে বার করুন।কেন যে ঢুকেছেন এখানে!এই রাস্তায় তো প্রাইভেট কার যায়না।

তন্ময় মাথা চুলকে বলল,

‘ আসলে আমি এদিকটায় নতুন।আমি খুলনাতে থাকি। এখানে একটা কাজে এসে ফেঁসে গেছি। এখন কি কোনো উপায় নেই?

‘ হ্যা আছে তো!

তিথি দূরে হাত ইশারা করে বলল,

‘ ওই যে ওই অব্দি একটু কষ্ট করে যাবেন। তারপর মোটামুটি ভালো রাস্তা আছে।এরপর অনেকটা গেলে মেইন রাস্তা পেয়ে যাবেন আবার।সেখান থেকে যেখানে যাওয়ার যেতে পারবেন।

তিথি কি বলল তন্ময় বুঝলো কিনা কে জানে।সে নিষ্পলক চেয়ে আছে ওর দিকে।তিথি ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

‘ বুঝতে পেরেছেন

তন্ময় হুশে ফিরে বলল

‘ না পারিনি।আপনার তো আজ কলেজ যাওয়া হবেনা।আপনি আমার সাথে যাবেন প্লিজ?

তিথি গোল চোখ করে বলল,

‘ আমি?

তন্ময় ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘ হ্যা।ভয় নেই। আমি খারাপ ছেলে নই।

তিথি মুখ কুঁচকে বলল

‘ আমি সে ভয় পাচ্ছিনা।আমি ভাবছি আমার সারা গায়ে কাঁদা লেগে আছে। আপনার গাড়ি নোংরা হলে?

তন্ময় সুন্দর করে হেসে বলল,

‘ দ্যাটস ডাজ’ন্ট ম্যাটার। গাড়ি ধোঁয়ার লোক আছে আমার।আপনি চলুন।

তিথি মাথা নেঁড়ে বলল,

‘ না।শুধু শুধু একজনের কষ্ট বাড়াতে যাবো কেন বলুন। অহেতুক গাড়িটা নোংরা করে লাভ নেই।যে আপনার গাড়ি ধুয়ে দেবে তার তো কষ্ট বলে কিছু আছে! আমি বরং সামনে সামনে হাটছি আপনি স্লো মোশনে গাড়ি নিয়ে আসুন। মেইন রাস্তাটা অব্দিই তো।

তন্ময় অবাক চোখে দেখলো মেয়েটাকে। কি সুন্দর তার চিন্তা ধারা। এই ধারার স্রোতে কখন যে তার মন ভেসে গেছে টের-ই পায়নি। সেই দিন শুরু হলো গল্পের।তারপর থেকে তিথিকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা, কাজের অজুহাত দিয়ে তিথির সাথে কথা বলা দৈনিক রুটিনে বদলালো। হলো বন্ধুত্ব। বেশি করে মজলো তিথিতে। ভালো লাগা রুপ নিলো ভালোবাসায়।ভাবলো খুব গোপনে স্থান নেবে তিথির অন্তস্থলে। কিন্তু যেদিন আদিত্যের সাথে তিথি পরিচয় করালো,জানলো আদিত্য নামক কেউ একজন অনেক আগেই সে জায়গা দখল করে আছে।কিন্তু তখন আর পিছু হটার উপায় ছিলোনা।চাইলেও দূরে যেতে পারেনি তিথির থেকে।ততদিনে তিথি যে অনেকটা মিশে গেছিলো হৃদয়ে। না। অনেক নয়। পুরোটাই। আর সেই শুরু হলো হৃদয় ভাঙনের পালা। স্থল ভাঙতে ভাঙতে আজ সেখানে সমুদ্রের সৃষ্টি। লবনাক্ত সমুদ্র,যেখানে ভালোবাসা নামক মিষ্টতা নেই। দুটো বছর ধর এক তরফা ভালো সে বেসেছে।দুই বছর চোখের সামনে কখনও স্বীকার হয়েছে আদিত্য তিথির প্রেম দেখার।তখনও জানতো তিথিকে সে পাবেনা।এখনও জানে তিথি তার হবেনা। কিন্তু মন যে বড়ই বেহায়া।সে শুনতে চায়না,চায়না বুঝতে।তিথির কাছে ছুটে আসতে ইচ্ছে হয় বারবার।আচ্ছা যেদিন তিথি জানবে, এই অধম তাকে ভালোবেসে কতটা দিশেহারা! কতটা কাঙাল!মেয়েটা কি মেনে নেবে তাকে? বুঝবে তার অনুভূতি ? ভালোবাসবে একটুও? বাসবেনা? কেন বাসবেনা? আদিত্য তো দ্বিতীয় বউ নিয়ে সুখে আছে,তবে তিথিরও কাউকে ভালোবাসার অধিকার আছে নিশ্চয়ই। মেয়েটার অপেক্ষায় থাকবে সে। মৃত্যু অব্দি।

হঠাৎ কানে গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজ এলো। এতক্ষনের ভাবনার ফিনফিনে সুতোটা ছিঁড়লো তন্ময়ের।বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে তিথির ঘরের দিকে তাকালো। শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। নিশ্চয়ই কাঁদছে। আদিতর স্মৃতিচারনে। মেয়েটাকে আজ একা শুতে দেয়া ঠিক হয়নি আন্টির। কথাটা ভেবে তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সুচিত্রা আজ তাকে যেতে দেয়নি। অনেক অনুরোধ করে রেখেছেন। নিজ হাতে রেধে বেড়ে ভালোমন্দ খাইয়েছেন। তন্ময় গুটিগুটি পায়ে এসে তিথির রুমের সামনে দাঁড়ালো। দরজা চাঁপানো থাকলেও ঠেলে ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করতে থাকলো।আর যাই হোক! এত রাতে একটা মেয়ের ঘরে প্রবেশ করা খুব একটা দৃষ্টিমধুর লাগেনা।

তিথির কান্নার মাত্রা আরো স্পষ্ট হলো। ফোঁপানোর শব্দ টা হলো তীব্র।তন্ময় আর ভাবলোনা। গলা ঝেঁড়ে কেঁশে, ঢুকলো দরজা ঠেলে। তন্ময় কে দেখতেই তিথি তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছলো। ফোনটা রেখে দিলো পাশে।সেদিক তাকিয়ে তন্ময় শুকনো হেসে বলল,

‘ কি লুকোচ্ছো?

তিথি নাক টেনে বলল,

‘ কিছুনা।ঘুমোওনি এখনও?

তন্ময় অাবার পাল্টা প্রশ্ন করলো,

‘ বসতে পারি?

তিথি ছোট করে বলল, ‘ হু।

তন্ময় বসলো।তিথির সামনে বিছানার ওপর।লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

‘ মাঝরাতে যদি কেউ এভাবে সুরেলা কন্ঠে গান শোনায়! ঘুম কি আর আসবে?

তিথি মাথা নিঁচু করে বলল ‘ স্যরি।

তন্ময় হেসে বলল

‘ সমস্যা নেই।এখানে কেন এলাম জানো?

তিথি জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো।তন্ময় বলল,

‘ ভাবলাম তুমি একা কাঁদলে শুনতে ভালো লাগবেনা।আমিও এসে একটু কাঁদি।

তিথি মুখ কুঁচকে তাকাতেই তন্ময় হেসে ফেলল।
পরমুহূর্তে উদ্বেগ নিয়ে বলল

‘ তিথি! চোখ আমাদের,একে আমরা চাইলেই কাঁদাতে পারি। তেমনি ঠোঁট দুটোও কিন্তু আমাদের
। চাইলে একেও আমরা হাসাতে পারি।

তিথি বুঝতে না পেরে বলল,

‘ মানে?

‘ মানে এই যে,আমি জানি তুমি কেন কাঁদছিলে! তবে আমার মতে যা হলো তাতো আর পাল্টাবেনা।নরমাল হওয়া উচিত তোমার। কেঁদে কি লাভ বলতে পারো? আদিত্য কি ফিরবে?

তিথি ম্লানমুখে হাসি টেনে বলল,

‘ তোমার কি মনে হয় তন্ময়? আমি আদিত্যর ফেরার আশায় বসে আছি?

তন্ময় কিছু বলতে নিলে তিথি বলে উঠলো,

‘ আমি জানি আদিত্য ফিরবেনা।আমি চাইওনা ও ফিরুক। ওর ফেরার হলে সেদিন আমাকে এবোরশন করাতে অন্তত বলতোনা। আর না অন্য কারো সিঁথিতে সিঁদুর দিতো।

‘ আর যদি ফিরে আসে? কি করবে?

তন্ময়ের চোখে মুখে উৎকন্ঠা পরিষ্কার। তিথি বুঝে উঠলোনা এই উৎকন্ঠা কিসের।তবে কন্ঠস্বর শক্ত করে বলল,

‘ আদিত্য আমার ভালোবাসাকে খুন করেছে।খুন করেছে আমার সন্তান কে।আর একজন খুনিকে আমি আমার জীবনে কখনওই জায়গা দেবোনা।
কোনো দিন ক্ষমা করবোনা আমি ওই বিশ্বাসঘাতক কে।

একটু আগে ঠিক যতটা শক্ত ছিলো তার মুখ, এখন ঠিক ততটাই ভঙ্গুর। তিথি আবার কাঁদছে। তন্ময় আস্তে করে মাথায় হাত ছোঁয়ালো ওর। তিথি তাকালো। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তন্ময়। আমি একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই।সেই ছোট্ট বেলা থেকে কষ্ট, অবহেলা পেতে পেতে আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বাবা কাছে নেই,মা ব্যাস্ত, দিদি নেই, ভাইটাও বাবার কাছে চলে গেলো। কার বুকে একটু মাথা রেখে কাঁদবো আমি তন্ময়? আমি কেন এত একা? কেন কেউ নেই আমার? কেন আমার ভাগ্য এত নির্মম ?

তন্ময় শুকনো ঢোক গিলল। তিথির মাথাটা অতি যত্নে চেঁপে ধরলো বুকে। একটা আশ্রয় পেয়ে যেন লুফে নিলো তিথি।তন্ময়ের শার্ট আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো।প্রচন্ড ক্লান্তিতে ঘুমের মধ্যে কিছুই শুনলেন না সুচিত্রা। তন্ময় তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে ধরা কন্ঠে বলল,

‘ আমি আছি তিথি। পরিবার ছাড়া,ভালোবাসা ছাড়া জীবনের যে অংশটা সব থেকে প্রিয়, সেটা হলো বন্ধুত্ব। আর সেই বন্ধু হয়েই সারাটা জীবন তোমার পাশে আমি আছি, আমি থাকবো।

_________

লোহার দরজাটা দেয়ালের সাথে বাড়ি খেতেই বিকট এক শব্দ হলো। তাৎক্ষণিক ঘুম ভেঙে গেলো আদিত্যর। কপাল কুঁচকে নঁড়ে উঠলো সে। চোখ খুলল। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো এটা ছাদ।তার মানে কাল রাতে ছাদেই ঘুমিয়ে পরেছিলো? কি অদ্ভূত! আজকাল ছাদ, বাড়ির দরজা যেখানে সেখানে চোখ লেগে আসছে। আদিত্য উঠে দাঁড়ালো। কেউ দেখার আগে নেমে গেলো সিড়ি বেয়ে। ঘড়িতে নটা বাজলেও বাড়ি দেখে মনে হচ্ছে দুপুর গড়িয়েছে।এই হৈ-হল্লা যে কবে শেষ হবে!
আদিত্য সোজা গিয়ে রুমে ঢুকলো । পুরো কামড়ায় পুতুল কে না দেখে ভালো লাগলো বেশ । মেয়েটাকে দেখলেই গায়ের রক্ত গরম হয় । অসহ্য লাগে। আদিত্য তোয়ালে হাতে তুলতেই দেখলো ভেঁজা। মেজাজ বিগড়ে গেলো। কর্কশ গলায় ডাকলো,

‘ পুতুল!পুতুল..

পুতুল তখন আদিত্যর দাদু বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলছিলো। ডাক শুনতেই আদিত্যর ঠাম্মি রসিয়ে বললেন

‘ ও বাবা বউ এসে বসতে না বসতেই ডাকছে দেখছি। একেবারে চোখে হারাচ্ছে।

বাকি সবাই তাল মিলিয়ে হাসলো।ঠাম্মি তাড়া দিয়ে বললেন,
‘ এই যা যা নাতবউ।বরের কি লাগবে দ্যাখ গিয়ে…

পুতুল উঠে হাটা ধরলো।কিন্তু অবাক লাগছে আদিত্য তাকে ডাকছে দেখে। কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছেনা ভালোবেসে ডাকছে। রুমের দরজা আগলে দাঁড়ালো পুতুল। মৃদূ স্বরে বলল,

‘ জ্বি? ডাকছিলেন?

আদিত্য তাকালো।বলল,

‘ ভেতরে আয়।

পুতুল ভেতরে এসে দাঁড়ালো। আদিত্য হাতের তোয়ালে টা দেখিয়ে বলল,

‘ এই তোয়ালে ভেজা কেন?

পুতুল কাঁপা স্বরে বলল,

‘ জ্বি সস..কালে সস্নান…

আদিত্য কড়া কন্ঠে বলল,

‘ স্নান হোক বা অন্য কিছু, আমার কোনো জিনিসে তুই হাত দিবিনা। আমি পছন্দ করিনা।

পুতুল এবার কথা বাড়ালোনা।চুপচাপ স্বায় মূলক মাথা নাড়লো।আদিত্য ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,

‘ এই কপাল থেকে এত লম্বা করে সিঁদুর পরেছিস কেন?

পুতুল ঢোক গিলে বলল,

‘ মা বললেন, এটা নিয়ম।

‘ নিয়ম? বেশ! নিয়ম শেষ হোক।আমার সামনে এসব শাখা- সিঁদুর পরে আসবিনা।এসব পরে কি, তুই আমার সামনে যত পারবি কম আসবি। আর হ্যা আমি মাকে বলে রাখবো আত্মীয় স্বজন সব চলে গেলে তোর ঘর আলাদা করে দিতে।
যা এখন।

পুতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। স্বামীর থেকে এখন আলাদা ঘরে থাকতে হবে? হায় ভগবান! এসব কি শুনলো! কিন্তু আদিত্যকে কিছু বলে চটানো যাবেনা। পুতুল মুখে কালো মেঘ নিয়েই চলে গেলো। অার নিরুদ্বেগ আদিত্য ঢুকলো ওয়াশরুমে।

_____

প্যান্ডেল ভাঙা হচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষ। অর্ধেক আত্বীয় রা চলে গেলেও এখনও প্রায়ই আছে। এরা দূর থেকে আসায় আরো কদিন থাকবে। সমিরন ভীষণ ব্যাস্ত। প্যান্ডেলের লোকদের সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। উচু স্বরে বলছেন,

‘ এই এখান থেকে নামাও,আরে ওখানে না কাঁপড় ছিঁড়ে যাবে।

এমন অনেক নির্দেশনা দিচ্ছেন। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ব্যায় করছেন বাক্য। হঠাৎ পাশ থেকে আদিত্য ডাকলো,

‘ বাবা।

সমিরন তাকালেন।ছেলে কে দেখে শুভ্র হেসে বললেন,

‘ হ্যা আদি।বলো? কিছু বলবে?

আদিত্য শান্ত কন্ঠে শুধালো,

‘ আপনার শরীর এখন কেমন আছে?
সব ঠিকঠাক?

সমিরন ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ কি ব্যাপার বলোতো, বাবাকে আজকাল বেশি ভালো বাসছো মনে হচ্ছে।

আদিত্য ঠান্ডা স্বরেই বলল,
‘ বলুন।কি অবস্থা শরীরের? বুকে বা অন্য কোথাও সামান্য কোনও ব্যাথা আছে?

সমিরন হেসে আদিত্যের কাঁধ চাঁপড়ে বললেন,

‘ আমার ছেলে আমার কথা রেখেছে, বাড়ির মান সন্মান রেখেছে। আমি কি অসুস্থ থাকতে পারি?

আদিত্য মুচকি হাসলো। বলল,

‘ ঠিক বলেছেন।তার মানে আপনি একদম সুস্থ।

সমিরন হেসে বলল,

‘ একদম।

আদিত্য ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। বাইকের চাবি টা আঙুলে ঘুরিয়ে বলল,

‘ আমি তিথির কাছে যাচ্ছি। আশা করি আপনার বুকে ব্যাথা নতুন করে আর উঠবেনা।

কথাটুকু বলেই আদিত্য গেট ছেড়ে বেরিয়ে পরলো। সমিরন কিছু সময়ের জন্যে তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইলেন।বউ রেখে তিথির কাছে যাচ্ছে? মানে কি এসবের?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here