পূর্ন__তিথি লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (১৬)

0
148

#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৬)

সন্ধ্যের আজান পরেছে। সেই সাথে শঙখ আর উলুধ্বনির শব্দ। তুলসি গাছের গোঁড়ায় প্রদিপ জ্বালিয়েছে পুতুল।আরতি করে সন্ধ্যে দেয়ার নিয়ম শেষে ঘরে গেলো সে। বাড়িটা বেশ নিরিবিলি এখন।আদিত্যর দাদু বাড়ির লোকজন ছাড়া অন্যরা প্রস্থান নিয়েছে বিকেলেই।সুস্মিতারাও চলে গিয়েছে আজ।
বসার ঘরে থমথমে মুখে বসে আছেন সমিরন। সদর দরজা বরাবর রাখা তার নির্দিষ্ট কেদারা। এক পায়ের ওপর পা তুলে ঠান্ডা চোখে দেখছেন গেটের দিকটা। তার প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে আদিত্যর বাইকের শব্দ এলো। সমিরন একটু নঁড়ে চড়ে বসলেন।আদিত্য ঢুকতেই দুটো কঠিন কথা শোনানোর উদ্দেশ্যে শক্ত করলেন মুখ। সারাদিন বাড়িমুখো হয়নি সে,আত্মীয় স্বজনের এত এত প্রশ্নের উত্তর বানিয়ে বানিয়ে দিতে হয়েছে তাদের৷ কি চাইছে সে? বিয়ে করে বউ রাখবে সাথে ঐ মেয়েকেও? মান সন্মানের পরোয়া নেই?
এত সাহস কই পাচ্ছেন তিনি? বাপের ঘাঁড়ে খেয়ে বাপকেই বুড়ো আঙুল দেখানো!ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার ফন্দি। এই বাড়িতে এসব চলবেনা।

দেখতে দেখতে আদিত্য ঢুকলো। বাবাকে দেখে খানিক থমকালো, তবে পা থামায়নি।সোজা ঘরের দিকে হাটা ধরলো। ওমনি পেছন থেকে ডাকলেন সমিরন,

‘ দাঁড়াও!

আদিত্য যেন ডাকটার অপক্ষাতেই ছিলো।সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালো সে।সমিরন উঠে দাঁড়ান বসা থেকে। পেছনে দুহাত বেঁধে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ কোথায় গেছিলে?

উত্তরে আদিত্য শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ বলেই তো গিয়েছি আপনাকে।

সমিরন অবাক হয়ে বললেন,

‘ এর মানে সত্যি সত্যি ওই নিঁচু জাতের মেয়ের কাছে গিয়েছিলে?

আদিত্য ঘুরে তাকালো। সামান্য তেঁজ নিয়ে বলল,

‘ ওকে এসব বলে সম্বোধন করবেন না বাবা।ওর একটা নাম আছে।

সমিরন ফুঁসে উঠে বললেন,

‘ এখন তুমি আমায় শেখাবে কাকে কি ডাকবো আমি? নিঁচু জাতের মেয়েকে নিঁচু জাতই বলবো। কি করবে তুমি হ্যা?

চেঁচামেচি শুনে ভেতরের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন সকলে। শকুন্তলা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,

‘ কি হয়েছে? চেঁল্লাচ্ছো কেন? কি করেছে ও?

সমিরন শকুন্তলার দিকে একবার তাকালেন।পরের বার তাকালেন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তার মা,বিবাহিতা বোন, বোনের মেয়ে, আর পুতুলের দিকে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে কঁড়া কন্ঠে বললেন,

‘ তোমরা ঘরে যাও। এখানে এখন কেউ আসবেনা। যাও।

কথা মতো সমিরনের মা,বোন চলে গেলেও পুতুল কান সজাগ করে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো।
সবাই চলে গিয়েছে বুঝতে পেরে সমিরন আবার তাকালেন আদিত্যর দিকে। ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ তোমার লজ্জ্বা করেনা আদিত্য? ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের কাছে যেতে?

আদিত্য স্বভাবতই শীতল কন্ঠে বলল,

‘ কে বউ?
আমি ওই মেয়েকে বউ বলে মানিনা।

সমিরন, শকুন্তলা ধাক্কা খেলেন। মাথায় চক্কর কাটলো পুতুলের। শকুন্তলা চেঁতে বললেন,

‘ মানিস না মানে কি? বিয়ে করিস নি?

‘ করতে চাইনি।তোমরা জোড় করে বিয়ে করিয়েছো।

সমিরন – শকুন্তলা একে অপরের মুখ দেখলেন।শকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন,

‘ আমরা জোর করেছি? সিঁদুর কি জোর করে পরিয়েছিলাম? তুই -ই তো পরিয়েছিস!

‘ তাও চাইনি।সুস্মি বাবার হৃদরোগের কথা মনে করিয়ে দেয়ায়…..

আদিত্যর কথার মাঝে সমিরন ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে নম্র কন্ঠে বললেন,

‘ দেখো আদি, যা হওয়ার হয়েছে।এখন পুতুলই তোমার স্ত্রী।অস্বীকার করতে পারবেনা তুমি।

আদিত্য মৃদূ হেসে বলল ,

” আমার প্রথম স্ত্রী তিথি বাবা।ওর গর্ভে আমার সন্তান ছিলো।সেটাও বা অস্বীকার করি কি করে?

সমিরন ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

‘ আবার? আবার এই মেয়র কথা?শকুন্তলা তোমার ছেলেকে বোঝাও,এরকম করলে কিন্তু এই বাড়িতে ওর ঠাঁই হবেনা বলে রাখলাম।

শকুন্তলা আদিত্যর উদ্দেশ্যে হা করতে নিলে আদিত্য মাঝপথে বলে ওঠে,

‘ এই বাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। যদি আমার ঘরে পুতুল থাকে তবে আমি এ বাড়িতে পা রাখবোনা।তাই যত দ্রুত পারো ওর ঘর আলাদা করে দাও মা…

শকুন্তলা বিস্মিত হয়ে বললেন,

‘ কি? কি বলছিস এসব? স্বামীর ঘর ছেড়ে ও আলাদা কেন থাকবে?

আদিত্য এবার চিঁল্লিয়ে বলল,

‘ কে স্বামী হ্যা? বলেছিনা আমি ওকে আমার স্ত্রী মানিনা? শোনোনি তুমি? বিয়ে করতে বলেছো করেছি,সংসার করা না করা আমার ব্যাপার। আর বাবা, আপনি যে বারবার বলন তিথি নিঁচু জাত নিঁচু জাত আপনাদের পছন্দের এই মেয় কত বড় জাত? হ্যা?

সমিরন দাঁত চিঁবিয়ে বললেন,

‘ চুপ কর বেয়াদব! ভালোই অধপতন হচ্ছে দিন দিন। আগে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে না আর আজ কৈফিয়ত চাইছো?

‘ হ্যা চাইছি।চাইছি কৈফিয়ত।তোমরা আমার জীবন টাকে শেষ করে দিয়েছো। আমার বাচ্চাটা দুনিয়ায় আসার আগেই মারা গেলো,শুধু তোমাদের জন্যে।

শকুন্তলা কোপিত কন্ঠে বললেন,

‘ আস্তে কথা বল । তোর ফুপিরা শুনে ফেললে কি হবে ভাবতে পারছিস? আর আমাদের জন্যে তোর সন্তান মরেছে? কেন আমরা বলেছিলাম তোকে বাচ্চা পয়দা করতে? বলিনিতো, বাচ্চা মরেনি, দ্যাখ গিয়ে ওই মেয়ে ওষুধ টষুধ খেয়ে মেরে দিয়েছে।মুখে কালি লেগেছে, মুছতে হবেনা?

আদিত্য হুঙ্কার দিয়ে বলল ‘ খবরদার! আমার তিথিকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেনা।

‘ কি করবে তুমি?হ্যা কি করবে? দু পয়সা রোজগারের মুরদ নেই বাবা মাকে শাষাচ্ছে। এক কলম পড়াশোনাওতো জানোনা যে চাকরি বাকরি করবে।এখন অব্দি আমার ঘাঁড়ে বসে খাচ্ছো, আমি যাকে বলবো তার সাথে সংসার করতে বাধ্য তুমি বুঝলে? নাহলে নিজের রাস্তা নিজে বেছে নাও।

সমিরনের কথাগুলো গলায় কাঁটার মতন বিঁধলো আদিত্যর। ঢোক গিলে শক্ত কন্ঠে বলল,

” হ্যা তাই করবো। তাই করবো আমি…থাকবোনা এই পাপ পুরিতে।এই স্বার্থপর মানুষদের সাথে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।

আদিত্য আবার বেরিয়ে যেতে নিতেই শকুন্তলা তড়িঘড়ি করে ওর হাতটা চেঁপে ধরে বললেন,

‘ কোথায় যাচ্ছিস বাবা!

‘ হাত ছাড়ো মা।

সমিরন গুমোট স্বরে বললেন,

‘ ওকে যেতে দাও, দুদিন বাইরের বাতাস খেয়ে দেখবে সুরসুর করে আবার ঘরে চলে আসবে।

শকুন্তিলা স্বামীকে চাঁপা স্বরে বললেন,

‘ আহ তুমি চুপ করোনা। সব সময় মাথা গরম করলে হয়না।
শকুন্তলা আদিত্যর পিঠে হাত ছুঁইয়ে কোমল কন্ঠে বললেন,

‘ যা বাবা তুই ঘরে যা।এরকম সব সংসারেই হয়। তাই বলে রাগ করে বাড়ি ছাড়তে হয় নাকি রে!

আদিত্য হয়তো দমে গেলো।চুপচাপ মায়ের কথায় ঘরের দিকে হেটে গেলো। আদিত্য আসছে বুঝতে পেরে আঁড়াল ছেড়ে সরে পরে পুতুল। ছেলে চলে যেতেই শকুন্তলা স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন।ফিসফিস করে বললেন,

‘ সব সময় এরকম হাই-হুই না ছাড়লে চলেনা তোমার তাইনা? একটা মাত্র ছেলে আমাদের।বাড়ি ছাড়বে কেন? দেখলে, ভালোবেসে বলেছি লক্ষি ছেলের মতন ঘরে চলে গেলো!

সমিরন ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,

‘ এরকম ভালোবেসে বললে সংসার করবে? নাকি তিথির নাম ঘোঁচাতে পারবে?

‘ আহা,হবে হবে এত তাড়াহুড়ো করোনা। আস্তে আস্তে সব হবে। পুরুষ মানুষের মন পাথর হলেও চরিত্র বরফের মত। মেয়ে মানুষের সংস্পর্শে এলেই গলে যায়।

সমিরন গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললেন,

‘ সব পুরুষ মানুষ এক নয়। বুঝেছো!

সমিরন কথাটা শেষ করতে না করতেই ভেতরের ঘর থেকে কিছু উৎকট আওয়াজ এলো কানে। শব্দটা আদিত্যর ঘর থেকে আসছে। দুজনে ভঁড়কে একে অপরের মুখ দেখে ছুট লাগালো সেদিকে। এই ছেলে আবার নতুন কোন অশান্তি বাঁধালো!

……………
ঘরের সামনে এসে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো তাদের। আদিত্য পুতুলের সমস্ত জিনিস বাইরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। এমনকি চুল আঁচড়ানোর চিরুনি,ব্রাশ সব কিছু লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে।পুতুল দরজার এক কোনে অসহায়ের মত গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য সব শেষে পুতুলের ব্যাবহার করা তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলল।সমিরন হতভম্ব কন্ঠে বললেন,

‘ এসব কি?

আদিত্যর নির্লিপ্ত জবাব,

‘ এই মেয়ে আমার ঘরে থাকবেনা।

শকুন্তলা ক্ষেপে বললেন,

‘ থাকবেনা মানে কি? কোথায় থাকবে ও?

আদিত্যর নিরুৎসাহিত উত্তর,

‘ আমি কি জানি? এত গুলো ঘর তো আছে,থাকুক কোনো একটাতে। কিন্তু আমার ঘরে নয়।

কথাটা বলেই সবার মুখের ওপর ধঁড়াম করে দরজা লাগালো আদিত্য।পুতুল ফুঁপিয়ে কাঁদছে।শকুন্তলা গিয়ে ওকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে বললেন,

‘ কাঁদিসনে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সমিরন ছেলের ওপর তীব্র রাগ,বিরক্তিতে ফোস করে দম ছাঁড়লেন। এই ঘাঁড় বাঁকা ছেলেকে সোজা করার সাধ্য কি নেই?
হঠাৎ পেছন থেকে আদিত্যর ফুপু শান্তা খোঁচানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

‘ এগুলো তোমার বাড়িতে কি হচ্ছে দাদা? ফুলসজ্জার পরের দিন তোমার ছেলে,তার বউকে ঘর থেকে বার করে দিলো? এই বউয়ের মধ্যে আবার কোনো দোষ টোষ আছে নাকি?

সমিরন গরম চোখে চেয়ে বললেন,

‘ তোকে এখানে আসতে কে বলেছে? যা ঘরে যা!

শান্তা মুখ ভেঙিয়ে ঘরের দিকে এগোয়।তবে বিলাপ তার কমেনা। বউদির সংসারের প্রতি একশ অভিযোগ তার। সমিরন রাগে পাশের বেতের চেয়ারের কোনায় লাথি মারলেন। যেদিন থেকে ঐ মেয়ের ছায়া পরেছে, এই ঘরের শান্তি নিঃশেষ হলো।সব দোষ ঐ তিথি নামক দুই পয়সার মেয়ের।মা যেমন মেয়েও তেমন!

____

তারপর, কেটেছে বেশ কদিন। কত আর, আট -দশ দিন হবে! পৌষের শুরু। শুষ্ক কাঠিন্য আর রিক্ততার বিষাদময় প্রতি মূর্তি হিসেবে আবর্তিত হয়েছে শীতকাল। ভোরবেলার স্নিগ্ধ প্রকৃতিতে তখন ঘনকুয়াশার সবিস্তর প্রভাব।সবুজ ঘাসের ওপর টলমলে শিশিরবিন্দু সূর্যের সোনালি রশ্নিতে মুক্তদানার রুপ নিয়েছে।এমনই শান্ত এক সকালে ফোনের রিংটোন এর শব্দে ঘুম ভাঙলো তিথির। এখনও সে তন্ময়দের বাসায়। যেতে চাইলেও যেতে দেয়া হয়নি। তন্ময়ের মা ভাইয়ের সাথে এত টাই মিশে গয়েছে তিথি,এত অল্প দিনে মন খারাপের রেশ তার কেটেছে বেশ খানিকটা। ঘুমের মধ্যে হাঁতড়ে হাঁতড়ে বালিশের নিঁচ থেকে ফোন বের করলো তিথি। অচেনা নম্বর দেখে ভ্রু কোঁচকালো। কৌতুহলে কল রিসিভ করে বলল,

‘ হ্যালো..!

মুহুর্তেই ওপাশ থেকে এক রাশভারি- অধৈর্য কন্ঠে ভেসে এলো,

‘ হ্যা..হ্যালো তিথি,তিথি আমি আদিত্য।প্লিজ কল কেটোনা..

কল কাটতে গিয়েও থমকালো তিথি।এই দশ দিনে আদিত্য তাকে হাজার বার কল করেছে।কিন্তু সে ফোন তোলেনি,মনকে যথাসাধ্য কঠিন করে নিজেকে দমিয়েছে।তিথি ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘ নম্বরটা কার?

‘ ওসব ছাড়োনা,তিথি আমার সাথে একবার দেখা করবে?

আদিত্যর অনুরোধে বুক ভেঙে এলো তিথির। কিন্তু এই অনুরোধ সে রাখবেনা।এমন শত শত অনুরো‍ধকে পায়ে মাঁড়িয়ে বিয়ের পিড়িতে বসা লোকের তো নয়ই। গলা শক্ত করে বলল,

‘ না।

আদিত্য অবাক হয়ে বলল

‘ একটা বার আমার কথা শুনবেনা?

তিথি এবারো মুখের ওপর বলল,

‘ না।

আদিত্য ধরা কন্ঠে বলল,

‘ এতটাই পর হয়ে গেলাম?

‘ আপনার আর কিছু বলার নেই নিশ্চয়ই?

‘ কল কাটার এত ব্যাস্ততা?

‘ হ্যা।

‘ একবার বলোনা তুমি কোথায়? জানো এই কটা দিন আমি তোমার বাড়িতে কতবার গিয়েছি? কত খুঁজেছি তোমায়?

তিথি কাটকাট গলায় বলল,

‘ সেসব আপনার ব্যাপার। নির্লজ্জ্বতার পরিচয় দিতে আপনার অসুবিধে না থাকলে আমার কিছু করার নেই।

কথাটায় কাঠ হয়ে এলো আদিত্যর মুখমণ্ডল। অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ ওহ!

‘ আমি রাখছি।

আদিত্য উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ না না লাইন কেটোনা, তিথি শোনোনা একটাবার,দেখো আমি যা করেছি …

ওপাশ থেকে সাঁড়া না পেয়ে আদিত্য ফোনের স্ক্রিনে চোখ দিলো। তিথি অনেকক্ষন আগেই লাইন কেটেছে। কষ্টে স্তব্ধ হয়ে এলো আদিত্য।তিথি তাকে এতটাই ঘৃনা করে বুঝি?এতই অসহ্য লাগে এখন? চোখ জ্বলে উঠলো আদিত্যর। কোটর ভর্তি পানিটুকু আঙুল দিয়ে মুছে ফোন পকেটে রাখলো।তিথি যতই বলুক,যতই এড়িয়ে যাক সে জানে এইসব অভিনয়। আর এই অভিনয়ের পেছনে আছে প্রকান্ড অভিমান। তিথির সব অভিমান সে ভাঙাবেই ভাঙাবে। কোনো একদিন।

___
শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে তিথির রুম ঢুকলো তন্ময়। তিথি তখন কাঁদছে। দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদছে। তন্ময় এসেছিলো হাসি মুখে, অথচ তিথিকে দেখতেই হাসিটা উবে গেলো। বুঝে নিলো কিছু একটা হয়েছে আবার।উদগ্রীব হয়ে ওর পাশে এসে বসলো তন্ময়।

‘ কি হয়েছে তিথি?

তিথি চোখ তুলল। চিকন চোখে থৈ-থৈ অশ্রু।তন্ময় কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বলল,

‘ কাঁদছো কেন তুমি?

তিথি কথা বললনা।ঠোঁট দুটো কাঁপছে। তন্ময় নিজের মতন করে বুঝে নিলো, হয়তো আদিত্যর জন্যেই কাঁদছে। মেয়েটা দিনের বেলায় সবার সামনে হাসলেও গভীর রাতে কান্নার শব্দ তার কান এড়ায়না। তিথি কি ভাবে,তার কোনো খোঁজ রাখেনা তন্ময়? তন্ময় কথা না বাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কি করবে এখন? তিথিকে একা ছেঁড়ে দেবে কাঁদার জন্যে? নাকি ওর পাশে বসে ওকে সান্ত্বনা দেবে? তন্ময় দ্বিধা নিয়ে বলল,

‘ তুষার কে পাঠিয়ে দেবো? বা মাকে? গল্প করলে ভালো লাগবে?

তিথি উত্তর দিলোনা। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে খুব। কি অদ্ভূত,শরীর কাঁপিয়ে কাদলেও মুখ থেকে শব্দ আসছেনা। তন্ময় ভাবলো,
হয়তো তার উপস্থত ভালো দেখাচ্ছেনা। চলে যাওয়া উচিত।

তন্ময় উঠে চলে যেতে নিলেই তাকে এক রাশ চমক উপহার দিয়ে তিথি বাম হাতটা টেনে ধরলো ওর। তন্ময় আকাশসম বিস্ময় নিয়ে ফিরলো।
তিথি অনুরোধ করে বলল,

‘ একটু থাকোনা তন্ময়!

তন্ময়ের বুক দুমড়ে মুচড়ে এলো তিথির এই আকুতিতে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়,থাকতেতো আমি চাই-ই তিথি।তুমি কি রাখবে?
কিন্তু প্রশ্নটা করা হয়না। নিজের কাছে জমা রেখে আবার চুপচাপ বসলো তিথির পাশে। তিথি মাথা নিঁচু করে কাদছিলো তখন।তন্ময় হঠাৎ প্রচন্ড অধিকারবোধ পেলো, তিথির মুখটা দুহাতে তুলে চোখ দুটো মুছে দিলো। এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে গুঁজে দিলো কানে। মৃদূ হেসে বলল,

‘ শিশির বিন্দু ঘাসেই মানায়।এমন মুক্তোর মত মুখে নয়।

তিথি চুপ করে চেঁয়ে থাকলো। তন্ময় দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ কি হয়েছে? এই অধম কে বলা যাবে?

তিথি নাক টানলো।একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলো একটু আগে আদিত্যর ফোন করার ব্যাপারটা। সব শুনে তন্ময়ের বুক ভারি হলেও সহজ কন্ঠে বলল,

‘ তাহলে বরং দেখা করে নাও।এত করে বলছে যখন…

তিথি স্তম্ভিত হয়ে বলল,

‘ তুমি কি পাগল হলে? আমি কেন ওর সাথে দেখা করবো?

‘ না মানে,উনি হয়তো নিজের ভুল বুঝেছেন।অথবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন!

তিথি মলিন হেসে বলল,

‘ ওর আবার গুরুত্বপূর্ণ কথা! হয়তো শরীরের ঘ্রান নিতে ইচ্ছে করছে। খুব সহজে পেয়েছিলো কিনা আমায়!

তন্ময় তপ্ত কন্ঠে বলল,

‘ ছি তিথি! নিজেকে এতটাও সস্তা ভেবোনা। তুমি যা করেছো তাতে পাপ নেই।কারন তুমি মনে প্রানে তাকে নিজের স্বামী জেনে নিজেকে সপেছিলে।দোষ তার যিনি তোমার এই ভরসার মূল্য রাখেনি।

তিথি ডুকরে কেঁদে উঠলো,বলল

‘ কেন তন্ময়? কেন আমার সাথে এমন হলো? আদিত্য কে ভালোবাসায় কোনো ফাঁক তো আমি রাখিনি। ওকে তো সম্পর্কের পর সব জানিয়েছিলাম আমার বাবা মায়ের সংসার ভাঙনের ব্যাপারে। অথচ আমার থেকে রেহাই পেতে ও তখন আমায় কি বলেছিলো জানো?

বলেছিলো,আমার বাবা মা রাজি হচ্ছেন না,তোমার বাবা মা আলাদা থাকেন এটা জানার পরতো আরোই না।আমিও পারছিনা তাদের রাজি করাতে। আমার কিছু করার নেই,ছোট বেলায় মাত্রাতিরিক্ত বাউন্ডুলে থাকায় পড়াশোনায় তীব্র অনীহা ছিলো। আমি পড়াশোনা শিখিনি।আদরের ছেলে বলে কেউ জোর করেনি।তোমাকে আলাদা রেখে আমি খাওয়াবো কি? অথচ ও যদি আমাকে নিয়ে গাছতলায়ও রাখতো আমি তাও থেকে যেতাম তন্ময়! জানি আমার কথাটা ফিল্মি শোনাচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্যি।আমি থেকে যেতাম ও যেখানে রাখতো। তুমিই বলোনা,অর্থই কি সব? ভালোবাসা কিছুনা?

তন্ময় নিশ্চুপ। তিথি আবার বলল,

‘ আর কি বলেছিলো জানো? বলেছিলো, বাবা অসুস্থ,এই মুহুর্তে ওনার মুখের ওপর কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না।সুস্থ বাবার মুখের ওপর কখনও” না “বলতে পারিনি তারপর তো এখন! তাছাড়া বাবা বলে দিয়েছে ওনার কথা না শুনলে উনি আমায় ত্যাজ্য করবেন।একজন ত্যাজ্য পূত্র,বেকার, অশিক্ষিত ছেলের সাথে সারাজীবন কাটাতে তুমি হীনমন্যতায় ভুগবে।ভালোবাসা তখন মুখ লোঁকাবে। অভাব দরজায় এসে দাঁড়ালে এসব আবেগ দৌড়ে পালাবে। আমি পারবোনা তিথি,এত প্রতিকূলতা নিয়ে তোমায় বিয়ে করতে আমি পারবোনা।এবোরশন করে নিও।টাকা যা দরকার হবে জানিও, পাঠিয়ে দেবো।
ও একবারও ভাবলোনা,যত সহজে কথা গুলো বলা যায় সেসব করা আদৌ সহজ কিনা! আমি ওর পা জড়িয়ে কেঁদেছিলাম,মিনতি করেছিলাম,

‘ আদি আমায় ছেঁড়ে যেওনা। ও শোনেনি।আমাকে কাঁদামাটির মত ছঁুড়ে ফেলে ও এগিয়ে গেছিলো সামনে। একটাবার ফিরে চায়নি।আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখেনি। অমর্যাদা করলো আমার ভালোবাসার,আমার আর আমার সন্তানের। এত কিছুর পরেও ওর এক ডাকে আমি ছুটে যাবো? আমি এত ছোট করবো নিজেকে? ও যদি আজ
নিজের ভুল বুঝেও নেয়,আমার কি সত্যিই আর কিছু পাওয়ার আছে? আমি কি আমার হারানো সব ফিরে পাবো?

তিথির প্রতি তন্ময়ের দুঃখ অনুভব নতুন নয়।কিন্তু এখন ভীষণ রাগ লাগছে আদিত্যর প্রতি।এই দশ দিনে তিথিকে বেশ অনেকটা গুছিয়ে এনেছিলো। আজ আবার একটা ফোন কলে সব এলোমেলো করে দিলো লোকটা।কি চাইছেন উনি? তিথিকে ফিরিয়ে নিতে? যদি তিথিকে স-সন্মানে নিতে চায় আদিত্য, সে নিজে সাহায্য করবে।সাপোর্ট দেবে। তিথি অন্তত যাতে ভালো থাকবে সেসব কিছু করবে সে।
কিন্তু এভাবে কেন?

তিথির হেচকি উঠেছে। তন্ময়ের ভাবনা কাটলো। তিথিকে শান্ত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ওকে ঠিক করা। তিথির কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও থেমে গেলো তন্ময়।কোনো একটা বাঁধা ঠেকলো ভেতরে।জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু একটা ভেবে ওর মাথায় রাখলো হাতটা। আস্তে করে বলল,

‘ বাইরে যাবে? ঘুরতে!ভালো লাগবে।

তিথি তাকালো। পরমুহূর্তে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে বলল,

‘ ভালো লাগছেনা তন্ময়।যাবোনা।

তন্ময় বাচ্চামো কন্ঠে বলল,

‘ প্লিজ!

তন্ময়ের কন্ঠস্বর এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য হলোনা তিথির। চোখ মুছে বলল

‘ এত সকাল সকাল কে ঘুরতে যায়?

তন্ময় খানিক উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ কেন যায়না? কারোর মন খারাপ তো সকাল বিকেল মেনে আসেনা।তাহলে বাইরে ঘোরাঘুরি কেন সকাল -বিকাল মানবে?

তিথি কপাল কুঁচকে বলল,

‘ কথা ভালোই জানো..

তন্ময় একটু ভাব নিয়ে বলল,

‘ তাতো জানবোই।আফটার অল আ’ম আ বিবিএ’স স্টুডেন্ট।

তিথি সামান্য হাসলো। তন্ময় উদ্বেগ নিয়ে বলল ,

‘ হেসেছো? তাহলে এবার ফ্রেশ ও হয়ে নাও।মা ডাকছেন নাস্তা করতে।যাও যাও… না খেয়ে থেকে এতক্ষনে পেটে খিল ধরেছে আমার।উফ এতক্ষন না খেয়ে থাকা যায়?

তিথি অবাক হয়ে বলল,

‘ সেকি! এখনও খাওনি কেন?

তন্ময় একটু থতমত খেয়ে বলল,

‘ এমনি। যাও ফ্রেস হয়ে এসো।ওঠো ওঠো..

একেবারে তিথিকে ধরে উঠিয়ে ওয়াশ্রুমে ঢুকিয়ে দিলো তন্ময়। শার্টের ওপরের বোতাম দুটো খুলে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তে দৃষ্টি কোমল করে তাকালো ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে। হাসলো একটু,

” মেয়েটার প্রতি এত টান,এত মায়া। জানে সে তার হবেনা।তবুও কেন বাড়ছে? কেন কমছেনা? এমন মায়া একদিন তার সর্বনাশ করবে কি?

____

সূর্যের নির্মল রোদ পরেছে তখন।চারদিক ঝলমলে সুন্দর। ঘেমে জুবুথুবু হওয়ার ভয়টা নেই এখন। গায়ের গরম কাপড়ের ওম পেয়ে উল্টে হাঁড়কাঁপুনি ঠান্ডা কমছে। হঠাৎ পকেট শুদ্ধ কেঁপে ওঠায় ডান হাতের কেকের প্যাকেট টা বাম হাতে আনলো রঞ্জন।ফোন বের করে দেখলো আদিত্যর নম্বর।

‘ হ্যা বল আদি…

আদিত্য কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলো।রঞ্জনের চারপাশে গাড়ির প্যাপু শব্দটা স্পষ্ট ফোনে। জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোথায় তুই?

‘ এইতো একটু খুলনা নিউমার্কেট এসেছি। জ্যোতি( রঞ্জনের বোন) ওর আজকে জন্মদিন না? ওর জন্যে কিছু জামা-কাপড় নেবো।

আদিত্য একটু ভেবে বলল,

‘ আমি আসছি।তুই ওখানেই থাক।

‘ কেন রে? জরুরি কিছু? আমার আসতে বেশিক্ষন লাগতোনা কিন্তু…

‘ না জরুরি কিছু নয়।ভালো লাগছেনা। দুজন মিলে কেনাকাটা করবো জ্যোতির জন্যে।সমস্যা নেইতো!

‘ আরে না না।চলে আয় তুই।আমি মার্কেটের বাইরেই আছি।এসে একটা কল করিস, ঠিক আছে?

‘ হু।

আদিত্য লাইন কেটে শুষ্ক ঢোক গিললো। চোখের কোনা চিকচিক করছে এখনও। তিথির দেখা কি পাবেনা? আদিত্য আকাশের দিকে তাকালো, চোখ বুজে মনে মনে অনুরোধ করলো,

‘ ভগবান,তিথির সাথে একটাবার দেখা করিয়ে দাও!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here