#রজনীগন্ধা_১৭ [শেষ পর্ব]
লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়া রুহি
সকালের নাশতা করতে বসেছে অভি আর তার পরিবার। বড় ভাবী আনিকা অভির প্লেটে ভাজি বেড়ে দিলেন, অভি অন্য আরেকটি প্লেট থেকে রুটি তুলে নিলো। দোলা চলে যাওয়ার পরের দিনই ওই বাসা ছেড়ে দিয়ে আবার নিজের পরিবারের সাথে একত্র হয়েছে অভি। শুভ ইনিয়েবিনিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল, বউ আনতে যাবে কী-না! অভি সরাসরি ‘না’ বলেছে। অপরদিকে জহুরা বেগম, দোলাকে আনার ব্যাপারে কিছু না বললেও, তার দোয়া ছাড়া অভির সংসার এক মিনিটও চলবে না, এটাই তার বাস্তব প্রমাণ- এমন কথাই বার বার বলেছেন। অভি জবাব দেয়নি, জবাব দিতে ইচ্ছে করেনি।
খাওয়া দাওয়া অর্ধেক হলো কেবল, এমন সময়ে উঠোন থেকে পরিচিত কারও গলার স্বর ভেসে এলো। আনিকা উঁকি দিয়েই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। ঘরে এসে ফিসফিস করে বলল,
—“তোমার বউ আইছে।”
অভি হাত ধুঁয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত চেহারায় দোলা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। অভিকে বেরিয়ে আসতে দেখে শুকনো ঢোক গিললো। ব্যাগ উঠোনে ফেলে একপ্রকার ছুটে অভির হাতজোড়া মুঠোয় ভরে নিলো। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,
—“আমায় মাফ করো তুমি, আমায় মাফ করো। আমি আর তোমার কথার বাইরে এক পা-ও দিবো না। তুমি যেমনে বলবা, ওমনেই চলবো। পাক্কা ওয়াদা দিতাছি…”
বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কেন যেন শক্ত হতে গিয়েও হতে পারল না অভি। গম্ভীর কণ্ঠটা নাড়িয়ে বলল,
—“ভিত্রে যাও। আম্মার পায়ে ধইরা মাফ চাও। উনি মাফ করলেই আমি মাফ করুম। আর থাকলে এইহানে থাকন লাগবো। আমি আলাদা হইতে পারুম না।”
হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিলো,
—“তুমি আমারে যেইনে রাখবা, হেইনেই থাকুম। তোমার লগে থাকতে পারলেই হইলো। আর কিচ্ছু চাই না।” ব্যাগ ফেলে রেখেই ঘরের ভিতর পা দিলো দোলা। অভি যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল। ব্যাগটাকে একহাতে তুলে ঘরের ভেতর ঢুকলো।
দোলা অনেকক্ষণ ধরে জহুরা বেগম এর পা আঁকড়ে ধরে বসে রইলো, প্রথম প্রথম কাইকুই করলেও দোলার কান্না দেখে জহুরা বেগমের রাগ গলে গেল। তিনি দোলাকে থাকার অনুমতি দিলেন, কিন্তু বললেন, আনিকার মতো কাজকর্ম করে থাকতে হবে। বিলাসিতা করলে চলবে না।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর অভি শুয়ে আছে নিজের ঘরে। দোলা হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। অভির ভাবান্তর নেই। শূন্য চোখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। দোলা শরীর থেকে ওড়না খুলে পাশে রেখে অভির রোমশ বুকে মাথা গুঁজলো। মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করলো,
—“উনার কী বিয়া হইয়া গেছে?”
—“কার?” অভির দায়সারাভাব।
—“আপনের আগের বউয়ের।”
—“তা দিয়া তোমার কাম কী? আর একটা উল্টাপাল্টা কথা কইলে…” অভির কথা শেষ হওয়ার আগেই দোলা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
—“এই না, না, আমি উল্টাপাল্টা কিচ্ছু কমু না, বিশ্বাস করেন। আমি এমনেই জিগাইছি।”
শান্ত হয় অভি। তারপর নরম সুরে বলল,
—“না হয়নাই। হইলে টিভিতেই দেখবা। ওত বড় নায়ক তো আর লুকাইয়া বিয়া করবো না। ধুমধাম কইরা বিয়া করবো।”
—“হুম। তালাক দিয়া দিছেন?”
—“হ।”
দু’জনেই নীরব হয়ে পড়ল। দোলার কেন যেন মনে হলো, অভির মন খারাপ। রজনীর জন্য নয়তো? প্রশ্নটা করতে গিয়েও করল না সে। অভিকে রাগাতে চায় না। অতিরিক্ত সন্দেহ এবং বদমেজাজের কারণেই আগের স্বামীর সংসার করে উঠতে পারেনি সে। এবারও যদি না পারে, তাহলে তার বাবা বলে দিয়েছে, দুচোখ যেদিক খুশি সেদিক চলে যেতে। সে আর মেয়ের বোঝা ঘাড়ে টানতে পারবে না। তাই সুড়সুড় করে আবার অভির কাছেই ফিরে এসেছে সে। নিজের মনও বলছে, এবার একটু সংসার নিয়ে সিরিয়াস হওয়া দরকার।সংসার তো কোনো খেলা না!
অভির রোমশ বুকে মুখ ঘঁষলো দোলা। অভির সুড়সুড়ি লাগলো। মৃদু ধমকের স্বরে বলল,
—“কী করতেছো! লাগতাছে..”
—“লাগুক.. আমার আদর চাই।” আহ্লাদী কণ্ঠ দোলার।
অভি কপাল কুঁচকে ফেললো।
—“ঢং রাখো তো।”
—“ঢং না… সত্যি আমার আদর চাই।”
—“আদর নাই।”
—“না থাকলে আমি বানাইয়া নিমু।” বলে উঠে বসলো দোলা। তারপর দু’পা দু’দিকে ফাঁক করে অভির পেটের উপর চড়ে বসলো সে, তবে সম্পূর্ণ ভার অভির গায়ের উপর দিলো না। অভি হৈহৈ করে উঠল,
—“আরে কী করতেছো! ধুরো… মাত্র খাইয়া আইছি। মেজাজটা…” অভি কথা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই নিজের ঠোঁটে অন্য কারো ঠোঁটের অস্তিত্ব অনুভব করলো। না চাইতেও দোলার পিঠে দু’হাত ছড়িয়ে জাপ্টে ধরলো সে।
★
রজনীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
—“আমার বিরক্ত লাগছে। এই বিয়ে ফিয়ে ক্যান্সেল..”
দুপুর থেকে ঘন্টা পাঁচেক সময় নিয়ে কী সঙ সাজিয়ে দিয়েছে তিনজন মিলে। তার উপর গায়ের শাড়িটা এর ভারী! কয় মন কে জানে! এগুলো পুতি নাকি পাথর! উফ আল্লাহ..! বিরক্তিতে তেতো হয়ে আছে মুখের ভেতরটা। পেট গুড়গুড় করছে, গা গুলোচ্ছে। বমি টমি হবে নাকি আবার! পার্লারের একটা মেয়ে রজনীর চুলের সেটিংগুলো চেক করছিল, রজনী তাকে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল,
—“আমার ফোনটা বেডরুমেই রেখে এসেছি। একটু কষ্ট করে আদ্র সাহেবকে কোনোভাবে ডেকে পাঠাতে পারেন, প্লিজ? জরুরি দরকার…”
মেয়েটা প্রত্যুত্তরে নরম কণ্ঠে “জি” বলে বেরিয়ে গেল। আদ্র’র পরনে ডিপ মেরুনের শেরওয়ানি। মাথায় পাগড়ি নেই, বাম হাতের ঘড়িটা এত সুন্দর দেখতে! দূর থেকেই চকচক করছে যে বোঝা যায়… ঘরে ঢুকে দরজাটা আঁটকে রজনীর দিকে এগিয়ে এলো সে। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
—“কী হয়েছে? এনি প্রব্লেম?”
—“ঘোর প্রব্লেম। আমার এসব সহ্য হচ্ছে না। অনেক অস্বস্তি লাগছে।” বলে গায়ের ভারী ভারী গয়নাগাটি গুলোর দিকে ইশারা করল সে।
আদ্র ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে বলল,
—“একটু সহ্য তো করতেই হবে।”
—“হুঁ.. কিন্তু আমার কেমন যেন লাগছে। বমি হবে মনে হচ্ছে।”
—“প্লিজ, প্লিজ, বমি করে এখন সর্বনাশ করে দিয়েন না। আমি বমির ট্যাবলেট আনাচ্ছি। ওকে?”
—“হুঁ…”
আদ্র বেরিয়ে যেতে গিয়েও গেল না। আবার পেছনে ঘুরলো। সেকেন্ড কতক একদৃষ্টে রজনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। রজনী প্রথমে তার দৃষ্টির অর্থ ধরতে না পারলেও পরে পারল, আর পারতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন উনি! এভাবে তাকাতে হয়? আর কতক্ষণ পর থেকে তো রজনী তারই.. মানুষটা এত রসিক! রজনী তৎক্ষনাৎ আদ্র’র একটা নিক নেম দিয়ে দিলো, “রসিক প্রেমিক” পরক্ষণেই মুচকি হেসে উঠল সে। আদ্র এবার এগিয়ে এলো, রজনী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাসি থামালো। ফ্যালফ্যাল করে তাকালো তার দিকে। রজনীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আদ্র। মেহেদীতে লাল টকটকে হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভরাট কণ্ঠে বলে উঠল,
—“আপনার এসব অসহ্যকর লাগছে,তাই না? আমি পারলে একদম সাদামাটা বিয়ের আয়োজন করতাম। কিন্তু কত নামী-দামী গেস্ট আসবে, বুঝছেনই তো। তাই একটু ধৈর্য্য ধরেন,অন্তত আজকের দিনটা। এরপর আর কখনো এসব সহ্য করতে হবে না আপনাকে। আপনি আর দশটা সাধারণ নারীর মতো নিজের সংসার গুছিয়ে রাখবেন শুধু। আপনাকে কখনো কোনো ঝামেলার ভেতর দিয়ে নিবো না আমি। প্রমিস…” বলেই ডান হাতের উল্টোপিঠে চুমু এঁকে দিলো আদ্র। রজনীর অস্বস্তিকর ভাবটা নিমিষেই হাওয়ায় উবে গেল। লোকটা এত ভালো কেন? এই কেন’র উত্তর আদৌও কোনোদিন খুঁজে পাবে কী রজনী?
রজনী মৃদু গলায় বলল,
—“আপনার অপমান হোক, এমন কোনোকিছু আমি করবো না। এইটুকু ধৈর্য্য ক্ষমতা আমার আছে।”
—“সেটা আমি জানি। আপনিও আমাকে ভালোবাসেন, আমি বুঝি…”
রজনী লজ্জা পেয়ে গেল। কথাটা ঘুরানোর জন্য বলল,
—“আচ্ছা, আপনি তো এখনো আমাকে আপনি আপনি করে বলেন! লোকে কিছু ভাববে না?”
—“ভাবলে ভাবুক। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে একদম তুমি তুমি… এর আগে আপনিই থাকুক।”
—“আচ্ছা।” হেসে উঠল সে।
আদ্র উঠে দাঁড়াল,
—“আমি বমির ট্যাবলেট আনিয়ে দিচ্ছি। আর ক্ষিদে পেয়েছে?”
রজনী উত্তর দিলো,
—“ট্যাবলেট লাগবে না। মন ভালো হয়ে গেছে। আর ক্ষিদে পায়নি। পেলে আপনাকে জানাবো। আপনি আমার ফোনটা আমার বেডরুম থেকে এনে দিন না.. ”
—“দিচ্ছি ম্যাডাম..”
আদ্র বেরিয়ে গেল। রজনী হেলান দিয়ে বসলো চেয়ারে। বিয়ে নিয়ে মেয়েদের কত জল্পনা কল্পনা থাকে। তারও ছিল, তবে সেটা অভিকে বিয়ে করার সময়। এখন নেই… আবার আছেও!
কনভেনশন হল রঙিন আলোতে ডুবে রয়েছে। যেদিকে চোখ রাখা যায়, চোখ ধাধানো আলো। আর লোকে লোকারণ্য। এত লোক গরুর হাটেও হয় কী-না সন্দেহ! ঘন্টা দুই হলো স্টেজে বসে রয়েছে রজনী। বিরক্তি যে লাগছে না, তা ভুল। একটু একটু লাগছে, সম্পূর্ণ লাগতে পারছে না আদ্র’র কারণে। কেননা সে তার কথা রেখেছে। রজনীকে লোকের প্রশ্নের মুখে পড়তে দিচ্ছে না। তাদের হঠাৎ বিয়ে নিয়ে অনেক প্রশ্ন সবার, সব কিছু আদ্র খুব সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে নিচ্ছে। সবাইকে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, একবারও মুখ থেকে হাসি মুছলো না। রজনী অবাক চোখে চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে বলল,
—“মানতেই হবে। এনার ধৈর্য্য আছে। বাব্বাহ!”
রাত আটটার দিকে কাজী এলেন, উকিল এলেন। নাছির উদ্দীন আদ্র-রজনীর উকিল বাপ হলেন। দু’জনকে দু’দিকে বসিয়ে মাঝে পাতলা ফিনফিনে সাদা পর্দা টানিয়ে দেওয়া হলো। কাজী প্রথমে রজনীর কাছে কবুল জানতে চাইলেন। রজনী ঘোমটার তল দিয়ে চোখ উঁচিয়ে আদ্র’র দিকে তাকালো। আদ্র হাসিমুখে তার দিকেই চেয়ে আছে,বোঝা যাচ্ছে পর্দার ভেতর দিয়েও। মুচকি হেসে রজনী সায় দিলো,
—“আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল সমস্বরে। তারপর আদ্রও তার তরফ থেকে কবুল জানালো। বিয়েটা হয়ে গেল! কী নাটকীয় ব্যাপার… একটা শব্দ ‘কবুল’ অথচ এর জোর কতখানি! অবাক লাগে ভাবলে…
বিয়ে হওয়ার পর বেশিক্ষণ রজনীকে স্টেজে রাখে না আদ্র। রজনীর যে শরীরটা খারাপ হচ্ছে, বুঝতে পেরে দশটার মধ্যেই তাকে তার রুমে পাঠিয়ে দিলো সে। নাচগান যা করার কথা ছিল, তা এর মধ্যেই সেড়ে নেওয়া হলো।
ফুলে ফুলে সজ্জিত রুমটা। ঘ্রাণে মাথা ধরে আসছে। অন্যরকম নেশালো ঘ্রাণ! একজন এসে একটা প্লেটে অল্প কিছু খাবার দিয়ে গেল। কোনো পোলাও টোলাও না, গরম সাদা ভাতের উপর কালাবাউছ মাছ ভাজা। একপাশে অল্প একটু শুটকি ভর্তা। খাবার দিকেই জিভে জল চলে এলো রজনীর। আদ্র নিশ্চয়ই তার মনের কথা টের পেয়েই এই খাবার পাঠিয়েছে। লোকটা তার দিকে কত খেয়াল রাখছে! উফ… আপ্লুত হয়ে উঠল মনটা। ভাতগুলো শেষ করলে মেয়েটি প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেল। রজনী ভাবছে শরীর থেকে শাড়ি,গহনা খুলে ফেলবে কী-না,তখনি অর্থি ঘরের ভেতর ঢুকলো। ছোট্ট পুতুলের গায়ে গাঢ় নীলের আভা। একটুকরো শুভ্র মেঘের ন্যায় লাগছে তাকে। রজনী হাত ইশারায় কাছে ডাকলো। অর্থি খাটের উপর উঠে বসলো।
—“তুমি কিছু খেয়েছো অর্থি? নাকি খাবার আনাবো?” প্রশ্ন করলো রজনী।
অর্থি মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে জবাব দিলো,
—“আমার এখন কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না মাম্মাম। তুমি জোর করবে না একদম…প্লিজ।”
রজনী থমকালো একমুহূর্ত। অর্থি তাকে কী বলে ডাকলো? মাম্মাম? হ্যাঁ, সে তো অর্থিরই মাম্মাম… অর্থি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসলো। রজনীর বুকের উপর আলতোভাবে মাথাটা ঢুকিয়ে দু’হাতে দু’দিক দিয়ে জাপ্টে ধরে বলল,
—“তুমি এখন থেকে আমার মাম্মাম। আমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। আমরা অনেক অনেক মজা করব, ওকে মাম্মাম?”
—“ওকে।” ধরে আসা গলায় বলল রজনী। অর্থির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অর্থির চোখ নিভে আসছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন ওর উপর দিয়েও কম প্রেশার যায়নি… অর্থি নিভে আসা গলায় বলল,
—“আমি রুমে যাই। আমার ঘুম পাচ্ছে মাম্মাম।”
—“যেতে হবে না, মাম্মাম ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। জুতো খুলো।”
—“কিন্তু এটা তো তোমার আর পাপার ঘর…”
—“তাতে কী? কোথাও লেখা আছে যে এখানে আমার অর্থি মামনি ঘুমোতে পারবে না? কোনো কথা না… চুপচাপ শোও।”
অর্থির পা থেকে জুতো খুলে নিচে রেখে দিলো রজনী। তারপর উঠে গিয়ে বাহিরে একটি মেয়েকে ডেকে বলল, অর্থির স্লিপিং স্যুট নিয়ে আসতে। অর্থিকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো রজনী। মুখের সাজগোজ সব ধুঁইয়ে দিয়ে স্লিপিং ড্রেস পরিয়ে দিতেই অর্থির নিজের কাছে নিজেকে হালকা মনে হলো। দাঁত ব্রাশ করে আবার কোলে করেই বিছানায় এনে শুইয়ে দিলো রজনী। বিছানার উপরে থাকা ফুলের পাপড়ি গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে এক সাইডে রেখে দিলো। অর্থিকে শুইয়ে দিলো মাঝখানে। নিজেও পাশে হেলান দিয়ে বসে অর্থির চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। রজনীকে দু-হাতে জাপ্টে ধরে কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে একসময় গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল অর্থি। রজনীর চোখটাও লেগে এলো একসময়। খুটখুট শব্দে রজনীর ঘুম ছুটে যায়। পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখলো চারপাশে অন্ধকার… মস্তিষ্ক সজাগ হতেই ভালোমতো চোখ খুললো সে। আগে হাত বাড়িয়ে অর্থিকে ধরলো, অর্থি ঘুমোচ্ছে। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে বসলো। ঘরের সব বাতি নেভানো, টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে একটা। আর কিছু টিমটিমে আলো দেওয়া ডিম লাইট…
ঘাড় ঘুরাতেই কাবার্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রকে দেখতে পেল রজনী। একটু চমকালো সে। কখন এলো ইনি? রাত কত হলো? সবাই কী চলে গেছে? নানান ধরনের প্রশ্নে ভেতরটা উশখুশ করে উঠল তার। আদ্র নিজ থেকেই বলল,
—“তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম, সরি।”
রজনীর চমক বাড়লো। হঠাৎ তুমি? তখনি তার মনে পড়ল আদ্র’র বলা কথাটা, বিয়ের পর থেকে তুমি তুমি… মৃদু হাসলো সে। এই লোক দেখছি এক জবানের মানুষ!
—“আপনি এখানে? গেস্ট চলে গেছে?”
—“রাত দেড়টা বাজে। এতক্ষণ নিশ্চয়ই কেউ থাকবে না আর। আবার কালকে আসবে, বউভাতে।”
—“দেড়টা বাজে!” রজনী থতমত খেলো। কতক্ষণ যাবত ঘুমোচ্ছে সে!
রজনীর মনের কথা নিমিষেই পড়ে ফেলল আদ্র। কাবার্ড থেকে কী যেন বের করতে করতে বলল,
—“সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে। তাই আমি ডাকিনি আর। আর মা-মেয়ে যেভাবে আরাম করে ঘুম দিয়েছো.. এইজন্যে আর ডিস্টার্ব করার সাহস পাইনি।”
রজনী বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
—“আপনি খেয়েছেন?”
—“হ্যাঁ।”
—“ওহ! আচ্ছা চেঞ্জ করে ঘুমোতে আসুন।” বলে নিজেও গয়নাগাটি খোলার জন্য আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক তখনি তার পেছনে এসে দাঁড়ালো আদ্র। রজনী থমকালো। আয়নার ভেতর দিয়েই আদ্র’র দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কিছু বলবেন?”
—“হুঁ… এদিকে ঘোরো।”
রজনী ঘুরে তাকালো।
—“কী?”
—“এক মিনিট…”
হাতের মুঠোয় থাকা বক্স খুলে একটা ছোট্ট সুন্দর নাক ফুল বের করে আনলো আদ্র। চকচক করছে পাথরটা। হীরের হবে! রজনীর নাকে যেই নাকফুলটা সেটা পার্লারের লোকজন শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরিয়েছে। তাই সেটা নিজ হাতে খুলে আদ্র’র হাতের নাকফুলটা পরিয়ে দিল রজনীকে। বলল,
—“তোমার গিফট।”
রজনী বিমুঢ় হয়ে রইলো। তার চোখ চিকচিক করছে জলে। এত ভালোবাসাও তার কপালে লিখে রেখেছিল বিধাতা? সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। এইজন্যেই বোধহয় বলে, আল্লাহ যা কেড়ে নেন, তার চেয়েও উত্তম কিছু দেন। রজনীর মনের অবস্থা টের পেয়ে তাকে নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো আদ্র। স্তব্ধ রজনীর শরীরে কিছু একটা ছুটে গেল। শিরশির করে সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে পড়ল। অজান্তেই হাতদুটো আদ্র’র পিঠ আঁকড়ে ধরলো। আদ্র আরও শক্ত করে রজনীকে নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো।
চোখের কোল ঘেষে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল রজনীর। বিষয়টা আদ্র বুঝতে পেরে অন্যরকম গলায় বলে উঠল,
—“কান্নাকাটি করছো কেন? আমি জড়িয়ে ধরলাম বলে?”
—“না, না.. ” সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল রজনী।
—“ভালো লাগছে?”
রজনী জবাব দিলো না। পরম আবেশে আদ্র’র কাধের উপর মাথা এলিয়ে দিলো। এভাবেই কেটে গেল অনেকটা মুহূর্ত। নীরবতা ভেঙে আদ্র সোজা হয়ে দাঁড়াল। রজনীও কাচুমাচু হয়ে গেল। উল্টো ঘুরে আবার আয়নার দিকে মুখ করলো। কাঁপা হস্তে চুরিগুলো খুলতে লাগল। আর তারদিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো আদ্র। চুরি খোলা হলে কানের বড় ঝুমকো খুলে মাথার টিকলি খুলে রাখলো রজনী। গলার বড় হার খোলার জন্য হাত বাড়াতেই আদ্র বলল,
—“আমি খুলে দেই?”
মিষ্টি আবদারের বিপরীতে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না রজনী। মৃদু হেসে হাত সরিয়ে নিলো। আদ্র মনোযোগ দিয়ে তার গলার হার খুলতে লাগলো। সুড়সুড় করছে রজনীর শরীরের ভেতর। আদ্র’র আঙুলগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। দাঁত কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। হার খোলা হলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেন। রজনী হালকা গলায় বলল,
—“শাড়িটা চেঞ্জ করে নিব?”
আদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো,
—“নাও।”
—“আচ্ছা।”
বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল রজনী। এবং সেকেন্ড না গড়াতেই বেরিয়ে এলো আবার। বলল,
—“আমার কোনো জামাকাপড় তো এই ঘরে নেই।”
আদ্র ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে বসে আছে। সে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
—“তুমি চেঞ্জ করো, আমি নিয়ে আসছি।”
রজনী মৃদু হেসে আবার ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। শাড়ি খুলে ভেতর থেকেই আদ্রকে ডেকে উঠলেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। ব্লাউজের পেছনে চেইন সিস্টেম করা। চেইনটা টেনে নামিয়ে নিজেকে আয়নায় আপাদমস্তক দেখে নিলো এক পলক। প্রথম যেদিন এখানে এসেছিল, আর আজকের দিনটা, কত পার্থক্য মাঝখানে! তার মতোন এত সাধারণ মেয়ে যে কারও চোখে অতি অসাধারণ হয়ে উঠবে- কল্পনাতেও ভাবেনি রজনী। কেউ যে তার মনবাড়িতে মুঠো মুঠো ভালোবাসা নিয়ে বেল টিপবে- তাও জানা ছিলো না।
দরজায় মৃদু চাপড় পড়ল, ভেসে এলো আদ্র’র গলা,
—“রজনী, দরজাটা খোলো। নিয়ে আসছি।”
রজনী ধ্যান ভেঙে দরজা খুলতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত খুলে রাখা শাড়িটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়ালো। তারপর খুব সন্তপর্ণে দরজা খুললো। দরজার পেছনে নিজেকে আড়াল করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
—“দিন।”
আদ্র দিল না। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
—“এভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সামনে আসছো না কেন?”
—“আপনি বুঝবেন না। আপনি জামা দিন।” তাড়া কণ্ঠে বলে উঠল রজনী।
আদ্র মৃদু হেসে বলল,
—“দিব না।”
—“দিব না মানে কী!”
—“দিব না মানে দিব না..”
রজনী গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলল,
—“একদম ফাজলামো না… দিন বলছি।”
—“রজনী, তোমার পেছনে ওটা কী?”
—“কী?”
রজনী চমকে পেছন ফিরে তাকাল। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে আদ্র’র দিকে ফিরতে ফিরতে আদ্র ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। হাত থেকে শাড়িটা অটোমেটিক পড়ে গেল নিচে। অসাড় পাজোড়া নিয়ে পালাতে পারল না রজনী। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। আদ্র’র দিকে ফিরেও ফিরলো না। সারা গায়ে অস্বাভাবিক কাঁপন ধরছে…
পিঠের মাঝখানে ডান দিকে একটু মোড় নিয়ে একটা ছোট্ট কালো কুচকুচে তিল ভেসে রয়েছে। আদ্র’র মাথা ঘুরে গেল… হাতে ধরে রাখা সাদা শাড়িটা ক্লজেটের উপর রেখে একটা হাত ওই তিল ধরার চেষ্টা করল। রজনী আঁতকে উঠে পেছনে সরলো। আদ্র নিজেকে থামানোর কোনো চেষ্টা করলো না এবার… রজনী এখন তার, বৈধতার সম্পর্ক দু’জনের। এখানে নিজের অনুভূতি আঁটকে রাখার প্রশ্নই তো আসে না!
পেছন থেকে রজনীকে বাহুডোরে আঁটকে নিয়ে তিলটির উপর নিজের অধরের স্পর্শ বসিয়ে দিলো আদ্র। রজনী হাত-পা নেতিয়ে গেল। লুটিয়ে পড়ল আদ্র’র বুকে। আদ্র চমকে বারকয়েক নাম ধরে ডাকল,
—“রজনী, রজনী.. এই রজনী।”
রজনীর সাড়া নেই। নেই কোনো হেলদোল। জ্ঞান হারিয়েছে বুঝতে পেরে আদ্র মুচকি হেসে বলে উঠল,
—“এক্ষুনি যদি না উঠো,তবে তোমার ব্লাউজ খুলে ফেলবো আমি।”
কথাটি বলতেই রজনী ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। আজকে তার চাল আর খাটলো না। আদ্র হু হু করে হেসে উঠল।
রজনী ঠোঁট কামড়ে নিচ থেকে শাড়িটা তুলে নিলো। গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,
—“আপনি একটা বেশরম..”
—“বউয়ের কাছে শরমের কী আছে?”
—“তবুও.. একদম হুটহাট সবকিছু.. এমন কেউ করে?”
—“হুটহাটের অনুভূতিই অন্যরকম। সেটা তোমার মতো গাধী বুঝবে না।”
—“আমি গাধী?” হতভম্ব কণ্ঠ।
—“তা নয়তো কী?”
—“গাধীকে বিয়ে করেছেন কেন তাহলে?” মেকী রাগ দেখালো রজনী।
—“কারণ আমি গাধা যে… তাই!”
হেসে ফেলল রজনী। লোকটা গাধা কী-না তা জানা নেই, তবে পাগল বটে।
—“এবার বের হন, আমাকে চেঞ্জ করতে দিবেন কী-না বলেন!”
—“দিবো না।”
—“আপনি কিন্তু…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই রজনী থরথর করে কেঁপে উঠলো। আদ্র তার কোমর টেনে খুব কাছে নিয়ে এসেছে। এত কাছে যে আদ্র’র গভীর শ্বাসগুলোও অনুভব করতে পারছে সে। রজনী চোখ নামিয়ে নিলো। আদ্র’র ভেতর লজ্জাশরমের বালাই নেই। রজনীর চোখের উপর নিজের অধর ছুঁইয়ে গালের দিকে হাত বাড়ালো। রজনী মাথা সরিয়ে নিলো। মৃদু কণ্ঠে বলল,
—“এটা বাথরুম!!”
আদ্র মুচকি হেসে সঙ্গে সঙ্গে রজনীকে পাজাকোলে তুলে নিলো। একহাতে দরজার নব ঘুরিয়ে, রজনীকে নিয়ে বেডরুমে পা রাখতেই রজনী কাইকুই করে বলার চেষ্টা করলো,
—“অর্থি আছে!”
আদ্র জবাব দিলো না। এই ঘরের সঙ্গে আরেকটা এটাচড রুম আছে, তবে সেখানে কোনো বেড নেই। আদ্র’র পার্সোনাল সোফা ঘর বলা চলে… সেই ঘরে নিয়ে গেল রজনীকে। সোফার উপর বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। রজনী লজ্জায় নতজানু। আদ্র বলল,
—“এখন আর প্রবলেম নেই তো। তাই না?”
নির্বাক রজনী, উত্তর দেওয়ার মতো শক্তিটাও যেন নেই। আদ্র হাত ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল,
—“আর একটুও যদি ডিস্টার্ব করো, তবে আমি…”
—“কী?”
—“আদরের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”
রজনী আবার মাথা নুইয়ে ফেললো। কোলের উপর হাতজোড়া রেখে উশখুশ করছে। আদ্র ক্ষণকাল রজনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আচমকা রজনীকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
—“ফিল দিস মোমেন্ট রজনী। সব মেয়ের জন্য এই মোমেন্টটা অনেক স্পেশাল।”
ফিসফিস করে কথা বলার দরুন আদ্র’র শ্বাস গুলো ঘাড়ের উপর আছড়ে পড়লো। রজনীর বুক ফুঁড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। অজান্তেই আদ্র’র পিঠটা আঁকড়ে ধরলো, দৃঢ় ভাবে। আদ্র নিজের মাথা তুলে ওষ্ঠদ্বয় রজনীর দিকে এগিয়ে নিলো। এবার সরে গেল না রজনী, কাঁপলো না, অস্থির হলো না। স্থির মনে অনুভব করতে লাগলো চেনা অনুভূতিগুলোকে তবে নতুন রূপে…
রাতের মধ্য প্রহরে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠা কপোত-কপোতীকে দেখে দেয়ালগুলোও যেন লজ্জা পেয়ে গেল।
(সমাপ্ত)
[আগেই বলেছিলাম,রজনীগন্ধা একদম সাদামাটা একটা গল্প হবে। কোনো টুইস্ট থাকবে না, শুধু দু’জন মানুষের অপরিপূর্ণ জীবনকে পূর্ণ করে দেওয়া হবে। তাই দিলাম। পান্ডুলিপি লেখার কারণে আরও সুন্দর করে সাজাতে চেয়েও সাজাতে পারিনি। গল্পের অনেক জায়গায় ভুলত্রুটি আছে, সেটা আমিও জানি না। অনেক জায়গা অগোছালো.. তবুও অনুরোধ করব মানিয়ে নেওয়ার জন্য। আগামী গল্প আসতে টাইম লাগবে। পান্ডুলিপির অল্প কিছু কাজ বাকী। সেটা শেষ করেই গল্প নিয়ে ফিরবো ইনশাল্লাহ। ততদিন সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ এবং ঈদ মোবারক ❤️]