#পূর্ণ_তিথি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
(০৪)
শুকনো গলা ঠান্ডা পানিতে ভেঁজাচ্ছে তিথি। এই নিয়ে পুরো এক জগ পানি পেটে চালিয়েছে।ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে শরীর।অস্থির ভাবমূর্তি। তিথির কাজ কর্ম স্থির চোখে দেখছে স্বপ্ন আর বৃষ্টি। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ক্ষনে ক্ষনে। বৃষ্টি তিথির বড় বোন। দু বোনের সম্পর্ক মাখোমাখো নাহলেও খুব একটা খারাপ ও নয়। আজই ঢাকা থেকে ফিরেছে বৃষ্টি। ফিরতেই বোনের এমন অবস্থা দেখায় বিস্মিত সে।
ভ্রু কুঁচকে বৃষ্টি কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো তিথির দিকে। তিথির ঘন ঘন নিঃশ্বাস, ভয়ার্ত চোখ মুখ, তার সূক্ষ্ণ বুদ্ধিকে নাড়া দিচ্ছে।উল্টোপাল্টা কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে।
উঠে গিয়ে তিথির পাশে বসলো বৃষ্টি। নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে সোনু?
বোনের কথায় হাতের ফাঁকা গ্লাস টেবিলে রাখলো তিথি। জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল,
— আচ্ছা দিদি ,আমাদের বাবা যদি আজ আমাদের সাথে থাকতো তবে আমাদের সাথে কেউ কখনও খারাপ কিছু করার চিন্তা করতো না তাইনা..??
বৃষ্টি বুঝতে না পেরে বলল,
—-ঠিক বুঝলাম নাহ,,হঠাৎ এই কথা?আর তোর চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছিস??
তিথি ক্ষুন্ন গলায় বলল,
— অনেক বড় বিপদ এর হাতে পড়েছিলাম আজ… ভাগ্যিস আমার ভাগ্য সাথে ছিলো….
তিথির কথায় একঝাক উৎকন্ঠা এসে ঘিরে ধরলো বৃষ্টি কে। ধড়ফড়িয়ে বলল,
— কি হয়েছিলো?? বল আমাকে…
ফাঁকা এক ঢোক গিললো তিথি।একটু আগের ঘটনা মনে করলেই এখনও আত্মা শুকিয়ে আসে প্রায়।
কিছুক্ষন আগে…..
গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাতে টান পরতেই ভয়ে হতভম্ব হয়ে এলো তিথি। উদ্বিগ্ন হয়ে আশেপাশে তাকালো। কেউ নেই। এখন কি করে বাঁচাবে নিজেকে? তিথির কপালে ঘাম জমেছে। ঢোক গিলছে বারবার। ছেলেগুলো কি তার অপরিচিত? নাকি এলাকার ছেলে এরা? এরা কি অনেকদিন ধরে অনুসরণ করছে তাকে?
নিজেকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তিথির মস্তিষ্ক। কোনও একটা উপায় হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। তিথি কাঁপা স্বরে বলল,
‘ পথ আটকিয়েছেন কেন? কারা আপনারা?
ছেলেগুলো উত্তর দিলোনা। তিথি আবার বলল,
‘ আমাকে যেতে দিন। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
কথাটায় কাজ হলো কিনা বুঝলোনা তিথি।তবে ওদের একজন আরেকজনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ মামা যা করবি তাড়াতাড়ি কর,কেউ এসে পরবে।কোথায় নেবো এটাকে?
ছেলেটা ফিসফিস করে বললেও কন্ঠস্বর শুনতেই চিনে ফেলল তিথি। কথাটা একটু আগে যে বলেছে ওর নাম শাওন। এই রাস্তার পারে বসে আড্ডা দিতো অনেকে মিলে। তাহলে সে ঠিক ভেবেছিলো, এই ছেলে গুলো তাদের এলাকারই।
এবার অন্যজন বলল,
‘ অনেক দিন ধরে সুযোগ খুঁজছি,চল উঠা এটারে।
তিথির বুক ধক করে উঠলো। ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো। চিৎকার করে বলল,
‘ কেউ বাঁচান,
পরেরবার চিৎকার করার আগেই দুজন এসে মুখ চেপে ধরলো ওর। তিথি গোঙাতে থাকলো, অন্য ছেলেটি হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিলো। গলার ওড়নাটা অার ফোন ছুঁড়ে ফেললো দূরে। তিথি আর উপায় দেখলোনা নিজেকে বাঁচানোর।শরীর নেতিয়ে এলো এদের শক্ত হাতের কাছে। মনে মনে প্রার্থনা করলো যদি একবার তার সন্মান টা বেঁচে যায়।কোনো এক মিরাকল হয়ে?
আচমকা কড়া লাইটের আলো পরলো জায়গাটায়। সব গুলো ছেলে চোখ কুঁচকে নিলো। তিথিও বুজে নিলো চোখ। ভেসে এলো বাইকের ভোঁ ভোঁ শব্দ।
পুরুষালী কড়া কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো কেউ,
‘ কে ওখানে?
সাথে এলো আরো দুটো পুরুষের কন্ঠ,
‘ এই দাঁড়া!
মেয়েদের বিরক্ত করছিস? মজা দেখাচ্ছি,
ছেলেগুলো ভয় পেলো।ছেঁড়ে দিলো তিথির হাত। একে অন্যের দিকে গোল চোখে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছূট লাগালো। নির্নিমেষ পালিয়ে গেলো দৌড়ে। তিথি বুকে হাত দিয়ে বাঁচার মত নিঃশ্বাস ফেললো। বাইক থেকে নেমে এলো তিনজন। তিথি তাড়াহুড়ো করে ওড়না উঠিয়ে গায়ে প্যাঁচালো। একজন এগিয়ে এলো তার দিকে। আলো বরাবর আসতেই স্পষ্ট হলো সেই পরিচিত মুখটা, “আদিত্য”
তিথি অবাক হলো ওকে দেখে। এই লোক আবার? তাকে বাঁচিয়েও নিলো আজ?আদিত্যর চোয়াল শক্ত।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এভাবে একা একা বাসায় ফিরছেন কেন ? সাহস তো মন্দ না।এরকম আর করবেন না। প্রত্যেক দিন আমি থাকবোনা।
আদিত্যের কন্ঠে স্পষ্ট ঝাঁঝ। সাথে মৃদূ অধিকার বোধের আভাস। তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। কথাটা বলেই আদিত্য মাটি থেকে তিথির ফোন তুলে নেয়।তিথি এখনও বিস্মিত হয়ে দেখছে। আদিত্য ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ স্ক্রিন ফেটে গিয়েছে।সাড়িয়ে নেবেন।
এরপর পাশের ছেলে দুজনের দিকে চেয়ে একজন কে বলল,
‘ আরিফ ওনাকে পৌঁছে দিয়ে আয়তো।
তিথি কোনো কথাই বললনা। হাত পায়ের কাঁপুনি এখনও তার কমেনি।আরিফ বলল,
‘ চলুন ভাবি মানে বৌদি,না মানে আপু.. চলুন চলুন।
তিথি কপাল কুঁচকে তাকালো। আদিত্য থতমত খেয়ে বলল,
‘ না মানে চলুন।
তিথি বেশি ভাবলোনা। ভাবার মত মানসিকতা নেই। মাথা নেড়ে হাটা ধরলো সামনে। আরিফ আড়চোখে আদিত্যের দিকে ফিরতেই আদিত্য দাঁত কটমট করে ঘুষি দেখালো ওকে।আরিফ কানে হাত দিয়ে নিশব্দে ঠোঁট নেড়ে বলল,
‘ স্যরি!
যেতে যেতে তিথি আরেকবার আদিত্যের দিকে ফিরলো। আদিত্য নিরুদ্বেগ চোখে তাকিয়ে আছে। তিথি তাকাতেই হাত নেঁড়ে বিদায় জানালো। তিথি লজ্জ্বা পেলো। চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে হাটা ধরলো। ভেতরে থেকে গেলো এক গুচ্ছ এলোমেলো প্রশ্ন।
___
তিথি থামলো। বৃষ্টি বিস্ময়ে বিমুঢ়। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে স্বপ্ন আর সে। বৃষ্টি আহত কন্ঠে বলল,
— তুই অনেক সাহসী….আমি হলে তো ভয়ে মরেই যেতাম….
জবাবে নিশ্চুপ তিথি। এতক্ষনে উঠে এসে ওদের পাশে দাঁড়ালো স্বপ্ন।উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— কিন্তু সোনু,,,ওরা কারা ছিলো তুই কি দেখেছিস?
তিথি মৃদূ স্বরে বলল,
—- একজন কে চিনি।শাওন ছিলো।
স্বপ্ন অবাক হয়ে বলল,
‘ ওই যে ইয়াবা খায় ওই ছেলেটা?
বৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তুই কি করে জানলি?
স্বপ্ন থতমত খেয়ে বলল,
‘ আমাকে আমাদের ক্লাশের ভৈরব বলেছে। ওর খুড়তোতো দাদা হয়তো।
পরমুহূর্তে স্বপ্ন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু সেই হিরো কে? কে ছিলো সেই বাইক দাদা?
তিথি ছোট করে বলল — জানিনা।
কিন্তু বৃষ্টির মনে হলো তিথি মিথ্যে বলল।চোখমুখ তাই বলছে। তাও প্রশ্ন করলোনা।এখনও ভয় কাটেনি তিথির।একটু রিল্যাক্স হলে সব ঘেটেঘুটে জেনে নেবে না হয়!
বৃষ্টি তিথিকে বলল,
‘ ছাড় ওসব।জীবনের কালো অধ্যায় ভেবে ভুলে যা। এখন গিয়ে হাত মুখ ধো,মা আসলে মাকে বলে দেখিস,কিছু হয় কিনা…
তিথি ঘাড় কাত করলো। বৃষ্টি স্বপ্নের দিকে চোখ সরু করে বলল,
‘ আর তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পড়তে বোস যা…
স্বপ্নের মুখটা ছোট হয়ে এলো তাৎক্ষণিক। পা দাঁপিয়ে অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও গিয়ে বসলো পড়ার টেবিলে। এই বড় দিদি এলেই তাকে জোর করে পড়তে বসায়।পড়া পড়া করে মাথা খেয়ে নেয়।
বৃষ্টি তিথির কাঁধের ওপর তোয়ালে এনে রাখলো, তিথি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে।যেতে যেতে আবার পেছনে ফিরলো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ দিদি! তুই কখন এলি?
স্বপ্ন চট করে বলল,
‘ সন্ধ্যে বেলায়।
বৃষ্টি তাকাতেই স্বপ্ন ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ পড়ছিতো। এভাবে দেখার কি হলো?
ভাইয়ের কাজে হাসলো তিথি। বলল,
— বাবা তোকে আসতে দিলো দিদি ?
বৃষ্টি দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ তোর তাই মনে হয়? বাবা আমাকে মায়ের ধারে কাছে ঘিষতে দেয়? বাবা জানেইনা আমি এসেছি।বাবা কে বলেছি কিছুদিন পর রওনা হবো। আর সেই কদিন তোদের কাছে থেকে তারপর যাবো না হয়?
তিথির আগেই স্বপ্ন উত্তেজিত হয়ে বলল,
— বাহ,,কি বুদ্ধি রে তোর বড়দি!একেই বলে কি জানো একটা প্রবাদ দেখলাম সেদিন কার্টুনে? ওহ হ্যা,,,সাপও মরে আর লাঠিও ভাঙেনা।
বৃষ্টি চোখ রাঙিয়ে বলল,
— আজকাল বয়সের তুলনায় বড্ড পেঁকেছিস তুই। মারবো একটা।
স্বপ্ন মুখ কালো করে ফেলল।তিথি বলল,
‘ থাক ওকে বকিস না। এসেছিস ভালোই হয়েছে।সামনে দোল। জমিয়ে আনন্দ করবো।
বৃষ্টি হাসলো। তিথি ওয়াশ রুমে ঢুকলো। চোখের সামনে হঠাৎই আদিত্যের মুখটা ভেসে উঠলো। আজ ওই লোকটা না থাকলে কি হতো তার?
_______
কি বলছেন বৌদি… তিথির সাথে আজ এত কিছু হয়ে গেলো আর আমরা কিছু টেরও পেলাম না?
সুচিত্রা বিচলিত হয়ে বললেন,
— তবে আর বলছি কি দাদা? এমনিতেও নানান চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা,,তার মধ্যে এসব…
সঞ্জিব আশ্বাস দিয়ে বললেন,
— থাক ভাববেন না আপনি। আমরা আছি আপনার পাশে।এর একটা ব্যাবস্থা করছি,কার কার এত সাহস বেড়েছে যে এই এলাকায় এসে এখানকার মেয়েকেই উত্ত্যক্ত করছে? এর শেষ তো দেখেই ছাড়বো।
সুচিত্রা মুখে হাসি টেনে বললেন,
— ধন্যবাদ দাদা….
আপনারা আছেন বলেই টিকে আছি।
— আরে না ঠিক আছে,আপনারা তো আমাদের নিজেদেরই লোক।তাছাড়া বিকাশ দাদা থাকলে সেও এরকম পদক্ষেপই নিতো।এতে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই…আমি এখন যাই,, পরে আপনাকে জানাবো…
চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন সঞ্জিব রায়। হাতে উঠিয়ে নিলেন মুঠো ভর্তি সন্দেস।তিথির দুঃসম্পর্কের কাকা তিনি।তাই বাবার অবর্তমানে ভালো মন্দ যা কিছু তাকে জানান সুচিত্রা। আজকেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।
সঞ্জিব রায়ের যাওয়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তিথি।এই কাকার ওপর তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই।মুখে বললো পদক্ষেপ নেবে,কিন্তু আদৌ নেবে কি?? শুধুমাত্র তার বাবার জমির লোভে একটু তেল দেয় তাদের। মা না বুঝলেও সে ঠিকই বোঝে।
সঞ্জিব বেরিয়ে গেলে সূচিত্রা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ভেতরে এলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল,তিথির দিকে চেয়ে কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ সন্ধ্যের পর আর বাইরে যাবিনা। কিছু দরকার পরলে স্বপ্ন কে বলবি।
তিথি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়লো। সুচিত্রা আবার বলেন,
‘ তেল আর চিরুনি নিয়ে আয়।চুল টা আঁচড়ে দেই।
রাত অনেক এখন।স্বপ্ন ঘুমিয়েছে। হা হয়ে আছে ঠোঁট দুটো। বৃষ্টি ফোন ঘাটছে বিছানায় হেলান দিয়ে। বাম পায়ের ওপর ডান পা তোলা।একটু একটু নাড়াচ্ছে পা টা৷ তিথি মায়ের কোলের কাছে গিয়ে বসলো। সুচিত্রা ব্যাস্ত হলেন তিথির ঘন ফ্যাকাশে চুল আঁচড়াতে৷ আড়চোখে একবার সেদিকে তাকালো বৃষ্টি। মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো সাথে সাথে। তিথিকে এই এক বিষয়ে দারুন হিংসে হয় ।মা সব সময় তার ছোট মেয়েকে বেশি ভালোবাসে,আদর করে।অথচ আসার পর থেকে তার সাথে একটা কথাও বলেনি।এতদিন পর এলো জিজ্ঞেস অব্দি করলোনা কেমন আছে?
বৃষ্টির আর সহ্য হলোনা। দুম করে উঠে হনহন করে হেটে গেলো রুমে। সুচিত্রা একবার আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার মনোযোগ দিলেন নিজের কাজে। নিরুদ্বেগ ভঙ্গি তার।তিথি বুঝলো। মিনমিনে স্বরে বলল,
‘ মা দিদিকেও একটু…
পুরো কথা শেষ করার আগেই সুচিত্রা ধমকে বললেন,
‘ মুখ বন্ধ রাখ। চুল ছিড়বে।
তিথি চুপসে গেলো।মায়ের কন্ঠস্বরে স্পষ্ট রাগ,ক্রোধ, অভিমান, তার দিদির প্রতি।কবে ঠিক হবে এই এলোমেলো অগোছালো সম্পর্ক গুলো ?
মা বাবা,দিদি, কবে সবাই আগের মত এক হবে? কবে আসবে সুদিন? সেইদিন!
চলবে,