#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৭)
হারার সময় এলে, সময় আসে হারানোরও। পাশে থাকা কাছের মানুষ গুলো নির্নিমেষ দূরে চলে যায়,এক এক করে কমতে থাকে। একটু একটু কমে তাদের অস্তিত্ব। সব যেন থেকেও নেই ,কুয়াশার মত বোধ হয় চারপাশ৷ দূর থেকে কাউকে ধোয়াসা ধোয়াসা দেখতে পায় চোখ,নিকটে গেলেই সব ফাঁকা। একাকীত্ব তখন গলা চেপে ধরে। শ্বাস আটকে মারতে চায়। দম বন্ধ রুদ্ধশ্বাস মুহুর্তে, হঠাৎই আবার প্রানের সঞ্চালনা । এটাইতো একা থাকার বর্বর সত্যি। সত্যি এর নির্মমতা!
আদিত্য সব হারিয়েছে। বাবা -মা, বোন, ঘরে বউ,একটা পূর্ন পরিবার থাকা সত্ত্বেও পূর্নতা তাকে ছোঁয়নি। মুখ ফিরিয়ে পারি জমিয়েছে বহুদূরে।একমাত্র রঞ্জন আর আরিফ ছিলো প্রানের বন্ধু।সুখ দুঃখের সঙ্গী। আরিফ ঢাকায় যাওয়ার পর রঞ্জন হয়ে ওঠে আরো কাছের। খারাপ সময় গুলোতে পাশে থেকে কি সুন্দর তাকে ভালো মন্দের জ্ঞান দিয়েছিলো ছেলেটা।অথচ এখন সেও চলে যাচ্ছে। অনেকটা দূরে। রঞ্জনের এক জেঠু থাকেন ভারতের কলকাতায়। রঞ্জনের জন্যে একটা চাকরি ঠিক করে ডেকেছেন উনি। মাইনে মোটামুটি ভালোই।রঞ্জনের অনার্স কমপ্লিট।তাই একেবারে নূন্যতম চাকরি তো আর পাবেনা। এইতো এ মাসেই চলে যাচ্ছে রঞ্জন।খবর টা শুনে এক প্রকার হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসেছে আদিত্য। রঞ্জন তখন চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টানছিলো। আদিত্য এসে দাঁড়াতেই রঞ্জন তাকালো।শুভ্র হেসে বলল,
‘ কখন ডাকলাম আর এলি এখন? সাজগোজ করছিলি নাকি রে শালা?
আদিত্য উত্তর দিলোনা।থমথমে মুখটা দেখে রঞ্জনের খটকা লাগলো।নতুন কোনো অশান্তি হলো কি বাড়িতে!
সিগারেট শেষ না করেই ফেলে দিলো মাটিতে। বিল মিটিয়ে আদিত্যর কাঁধে হাত রেখে বলল ‘চল।
আদিত্য চুপচাপ হাটছে।রঞ্জন নিশ্চিত হলো আদিত্যর মেজাজ ঠিক নেই। মেজাজ ঠিক নাহলে আদিত্যর সাথে কথা বলা ব্যার্থ! ওর তখন ভালো কথাও শুনতে তেঁতো লাগে ভীষণ। হঠাৎ আদিত্য নিজেই বলল,
‘ না গেলে হয়না রে!
কথাটায় বিস্মিত হয়ে তাকালো রঞ্জন।চোখ ছোট করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে টানটান করলো কপালের ভাঁজ। আদিত্যর তার যাওয়া নিয়ে মন খারাপ?
আদিত্য আবার শুধালো,
‘ যেতেই হবে?
রঞ্জন নিজেও মুখ উদাস করে নিলো।
নিঁচের দিকে তাকিয়ে ওপর নিঁচে মাথা নাঁড়লো। যার অর্থ ‘হ্যা।মন খারাপ করে বলল,
‘ যেতে যে আমারো ইচ্ছে করেনা আদি।কিন্তু তুইতো সবই জানিস, বাবা নেই আমার। তোদের মত স্বর্নের ব্যাবসাও নেই। জেঠুই পড়িয়েছেন,খাইয়েছেন।আজ ওনার আমাকে দরকার হলে আমি কি মুখ ফেরাতে পারি? তাছাড়া এখানে লাভ আমারই বেশি।মাকে দেখব,বোনকে পড়াব।ওর ভালো ঘরে বিয়েও দেয়া বাকি।কত দায়িত্ব আমার কাঁধে! এমন মুহুর্তে এত ভালো সুযোগ ফেরাই কি করে?
আদিত্যর দিকে তাকালো রঞ্জন। ছলছল করছে ওর চোখ। ছোট্ট বেলার বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ঠিকড়ে পরছে মুখমন্ডলে।ঘোষণা করছে এই বন্ধুত্ব কতটা গভীর! রঞ্জন আদিত্যকে জড়িয়ে ধরলো, আদিত্যও ধরলো শক্ত করে। রঞ্জন ধরা ধরা কন্ঠে বলল,
‘ মেয়ে মানুষের মত কাঁদবিনা একদম।আমি কি আজই যাচ্ছি? এখনও এক সপ্তাহ বাকি।
এই এক সপ্তাহ চুটিয়ে আড্ডা দেব সারাদিন।
আদিত্য আস্তে করে বলল,
‘ আমার যে এখানে নিজের বলতে কেউ থাকবেনা রে রঞ্জন! আমি তো আরো একা হয়ে যাব।
রঞ্জন হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো।
‘ একা হবি কেন? আমি যোগাযোগ রাখব না নাকি?
আদিত্য সরে এলো।রঞ্জন তড়িঘড়ি করে চোখের কোনার জল টুকু মুছলো আঙুল দিয়ে। হেসে বলল
‘ আমি না থাকলে মা আর জ্যোতিকে একটু দেখিস।বোনটা বড় হচ্ছে।এলাকার ছেলেপেলে তো সুবিধের নয়।
আদিত্য চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলো।রঞ্জন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
‘ একটা কথা রাখবি?
‘ বল!
রঞ্জন আগ্রহি কন্ঠে বলল,
‘ এবার সব কিছু ভুলে সংসারে মন দে!
আদিত্য হেসে ফেলল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ যা হওয়ার নয়, সে নিয়ে না বল।
রঞ্জন চুপ করে যায়।আদিত্য উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ তুই যা তবে, তোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক।আমার মত না হোক এইটুকু প্রার্থনা করব।
রঞ্জন শ্বাস টেনে বলল,
‘ কখনও যদি মনে হয় আমি তোর কাজে লাগছি,প্লিজ অপেক্ষা করবিনা।চলে আসবি…
কথাগুলো এখনও কানে বাজছে আদিত্যর। আজ তিন মাস হলো রঞ্জন চলে গিয়েছে ভারতে৷ তাই বেশিক্ষন বাড়ির বাইরেও মন টেকেনা।হাসিবের সাথে ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে বলে ওর বাড়িতে থাকে প্রায়।কিন্তু সবার সাথে মিশে কি আর আনন্দ মেলে? রঞ্জন আরিফ,ওদের সাথে সম্পর্কের সুতোটা যেমন, হাসিবের সাথে ততটা গাঢ় নয়। আদিত্যর হঠাৎ মনে হয়,সেও চলে যাবে।পরমুহূর্তে তিথির জন্যে যাওয়া হয়না।কোথাও না কোথাও একটা বাঁধা আসে মনে। এখনও আশা জাগে,হয়ত তিথি ফিরবে। পরিবারের প্রত্যেকে তাকে ঠকালো। বাবা মিথ্যে অসুস্থতার নাটক করে বিয়ে করালো,মা বোন কারোর ভূমিকাই কম নয় এখানে। আগের জন্মের কোন পাপের শাস্তি এটা? যাদের কাছে নিজ সন্তানের আবেগের দাম নেই,যাদের কাছে দামী উঁচু জাত, তাদের কোলেই কেন পাঠিয়েছিলো তাকে? এর থেকে একটা ভিখারির ঘরের ছেলে হলেও ভালো হত।অন্তত তার যথাযথ মূল্যটুকু পেত সে। পেত তিথি নামক সুখকে।
___
চারদিন হয়েছে সুস্মিতা বাপের বাড়ি এলো। এ কদিনে সীমান্ত ওর সাথে যোগাযোগ করেনি। আজ সকাল সকাল তাকে বাড়ির দোরগোঁড়ায় দেখতেই অবাক হলেন শকুন্তলা।সাথে ভয় ও পেলেন। সমিরন নেহাত বাড়িতে নেই,নাহলে কেলেংকারী কান্ড ঘটাতেন।মানুষ টা রেগে ছিলেন খুউব। সুস্মিতা সেই যে ঘরে ঢুকেছে বের হয়নি।তবে চোখ গুলো চাতকের মত দরজার দিকে যাচ্ছে।এই বুঝি সীমান্ত এলো,তার অভিমান ভাঙালো আর তাকে ফিরিয়ে নিলো ঘরে। কিন্তু অনেকক্ষন কেটে গেলেও সীমান্তর দেখা নেই।পুতুলের দেয়া চা -নাস্তা ছোঁয়নি সে। শুধুমাত্র বসার ঘরে মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর দেয়ায় ব্যাস্ততা তার।সামনে বসে থাকা শাশুড়ী মহাদয়া কেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা। পুতুল শকুন্তলার পাশেই দাঁড়ানো। এতক্ষন পর শকুন্তলা মুখ খুললেন,
‘ এসব তোমার ব্যাপারে কি শুনলাম বাবাজীবন?
সীমান্ত তাকালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ জ্বি মা? কি শুনেছেন?
সীমান্তর স্বর বড্ড স্বাভাবিক।শকুন্তলার মেজাজ চটে এলো। এত কাহিনি ঘটানোর পরেও এত নিরুদ্বেগ ভঙ্গি কেবল পুরুষরাই পারে,এমন ঘোষণা করলেন মনে মনে। সীমান্ত এদিক ওদিক তাকালো।পুতুল উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
‘ সুস্মিদি কে খুঁজছেন দাদা? উনি নিজের ঘরেই আছেন।আপনি যান না..
সীমান্ত একটু হেসে বলল,
‘ না,আমি আদিত্যদা আর বাবাকে খুজছিলাম।ওনারা বাড়িতে নেই? থাকলে একটু ডাকবেন।কথা ছিলো আমার!
পুতুল মিনমিনে স্বরে বলল,
‘ বাবা সকালে বেরিয়েছেন।আর উনিতো রাতে ফেরেননি।
সীমান্ত ছোট করে বলল,
‘ ওহ! আজ তবে আমি উঠি। বৌদি,এই ব্যাগে আমি আমার মেয়ের জন্যে কিছু জামাকাপড় এনেছিলাম,ওকে আপনি স্নান করে পরিয়ে দিয়েন। ওর মা আসার সময় ওর বেশি জামাকাপড় আনেনি।
পুতুল একবার শ্বাশুড়ির দিকে চেয়ে একপাশে ঘাঁড় নাঁড়লো।
শকুন্তলা অবাক হয়ে বললেন,
‘ তুমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে আসোনি সীমান্ত? ভুল করেছো তার জন্যে ক্ষমাও চাইবেনা?
সীমান্ত ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ আমি ক্ষমা চাইব? কেন মা?
‘ কারন তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছো…
পাশ থেকে কথাটা বলে ওঠেন সমিরন।সবাই চকিতে তার দিকে তাকায়।সীমান্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড় হয় শ্বশুর কে দেখে।এগিয়ে প্রনাম করতে গেলে সমিরন পা সরিয়ে নেন।
সীমান্ত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শুধুই হাসলো।সমিরনের রাগে হিরহির কর উঠলো শরীর।
ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
‘ নিজেকে কি ভাবছো সীমান্ত? অনেক কিছু? এই হাসি দিয়ে কি প্রমান করছো? আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার পরিনাম তুমি জানো?
সীমান্ত উত্তরে সহজ কন্ঠে বলল,
‘ স্ত্রী অন্যায় করলে স্বামীর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাকে শাসন করার।আমি তাই করেছি।এখানে অন্যায় কিছু নেই।
এত চেঁচামেচি শুনে আর ঘরে টিকতে পারলোনা সুস্মিতা।ছুটে এসে দরজার পর্দার আঁড়ালে দাঁড়ালো। সমিরন সবাইকে চমকে দিয়ে সীমান্তর কলার চেঁপে ধরলেন,এক প্রকার শাসিয়ে বললেন,
‘ তুমি আমাকে চেনো? চেনো আমায়? তোমার কি হাল করব তুমি ভাবতেও পারবেনা কিন্তু!
সমিরনের গরম চোখ,উচু স্বরের প্রভাব সীমান্তর ওপর পরলোনা,যতটা বাকি সদস্য গুলোর ওপর পরেছে।তবে সব থেকে বেশি ভয় পেলো সীমান্তর কোলে থাকা তার মেয়ে। ভয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। বাবাকে ছোট্ট আঙুল দিয়ে শক্ত করে খাঁমচে ধরলো। সমিরন থেমে গেলেন নাতনীর কান্নায়। ছেড়ে দিলেন সীমান্তর কলার। সীমান্ত মেয়ের পিঠে আদুরে চাঁপড় কাটতে কাটতে শ্বাশুড়ির কোলে দিলো। মেয়েটা যেতে না চাইলেও। এরপর গিয়ে আবার দাঁড়ালো সমিরনের সামনে। বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে বলল,
‘ আমি জানি আপনি কে বা কি, আপনি যাই হন না কেন আপনি কখনও ভালো বিচারক হবেন না এটুকু আমি নিশ্চিত। সুবিবেচনা আপনার দ্বারা হবেনা।আপনার মেয়ের গায়ে আমি হাত তুলেছি আপনি সেটুকু দেখছেন।তার পেছনের ঘটনা গুলো জানেন আপনি? পয়সার দুটো পিঠই দেখা জরুরি বাবা।আপনার মেয়ে আমার মায়ের সাথে যে ব্যাবহার টা করেছে কোনো সন্তান সেটা সহ্য করবেনা। আমিও করিনি, তাই মেরেছি।
শকুন্তলা খ্যাকিয়ে বললেন,
‘ তোমারও দোষ ছিলো,তুমি বিয়ের পর অন্য মেয়ের সাথে কথা বলবে কেন? আমার মেয়ের মাথাতো ঠিক ছিলোনা ওইজন্যে।তাই ও…
সীমান্ত কঁড়া কন্ঠে বলল,
‘ আপনারা নিজেদের দোষ কখনও দেখবেন না আমি জানি।মেয়েকেও তৈরি করেছেন তেমনই।কিন্তু কি জানেন,আমি যেমনই হই চরিত্রহীন নই।আমার রক্তে নেই এসব। আমার অতীতে যাই থাকুক,সুস্মিতাকে বিয়ের পর আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্যেও অনুভব করিয়েছি কিনা যে আমি অন্য কাউকে পছন্দ করতাম,সেটা ওকে জিজ্ঞেস করবেন।মেয়েটা আমার প্রাক্তন বলে আমাকে ফোন করতে পারবেনা এই আঈন কোথায় লেখা? ফোন করলেই আমরা নেগেটিভ কথা বলছি তাও বা কোথায় লেখা?একটা মানুষ কোনও সাহায্য চাইতেও তো কাউকে ফোন করতে পারে!
আমি একজন মুহরী। মেয়েটার স্বামী মারা যাবার পর সে কিছুতেই শ্বশুর বাড়ির যথার্থ ভাগ পাচ্ছেনা সম্পত্তির। তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চলছে দেখে আমার কাছে সাহায্য চাইছিলো।কারন আমি ওর জানাশোনা। খালি হাতে এলেও ওর পাশে দাঁড়াব।
শকুন্তলা বিদ্রুপ করে বললেন,
‘ সাহায্য বুঝি মাঝরাতেই দরকার পরে? সাহায্য করতে গেলে বউয়ের থেকে লুকিয়ে কথা বলতে হয়?
‘ মাঝরাতে ফোন করার কারন ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের ভয়।তারা জানতে পারলে ওকে আস্ত রাখবেনা।একমাত্র রাতেই ও একা থাকে। আর দ্বিতীয় কারন আপনার মেয়ের সন্দেহ। আমি যদি ওর সামনেও কথা বলতাম ও একই রিয়্যাক্ট করতো।চার বছর সংসার করেছিতো,আমি ওকে চিনি।কিন্তু আফসোস ও আমাকে এখনও চিনলোনা। মেয়েটার একটা ছেলে রয়েছে, আমার নিজের মেয়ে রয়েছে।আপনাদের মাথায় এমন নিঁচু ভাবনাও আসে? আপনার মেয়ে যদি আমায় ভালোয় ভালোয় প্রশ্ন করতো আমি বলতাম।সে প্রথমে এসেই আমার ফোন ছুড়ে মেরে ভেঙেছে, চিল্লাপাল্লা জুড়ে দিয়েছে। এতবার শান্ত হতে বললেও শোনেনি।শেষে যখন মা ঘরে এলো,মাকেও যা তা বলেছে।এমনকি ও যখন এখানে আসার জন্যে কাপড় গোছানোর উদ্বেগ নিচ্ছিলো মা আটকাতে গেলে তাকে ধাক্কা মেরেছে।এই জন্যেই আমি আপনার মেয়েকে মেরেছি। একই কাজ করলে আবার মারব। আমার মায়ের গায়ে হাত দিলে আমি ওর হাত গুড়ো গুড়ো করে দিতেও ভাববনা। বুঝলেন?
সীমান্তর গলার ঝাঁঝে সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সমিরন যেন একটু দমে গেলেন।নরম স্বরে বললেন,
‘ ওতো আমাদের এসব বলেনি। হয়ত ভুল ওরই। আর রাগারাগি রেখোনা,ওকে নিয়ে যাও।
সীমান্ত কাটকাট কন্ঠে বলল,
‘ আমি ওকে ফিরিয়ে নিতে আসিনি। আমার মেয়েকে দেখতে এসছি। আপনার মেয়েকে আদব কায়দা শিখিয়ে বিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। তখন শেখাননি বলে আজ সে গুরুজন মানছেনা।তাই এখন শেখান।আর হ্যা ও- বাড়িতে যেতে হলে ওর আমার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে তারপর যেতে হবে। তার আগে নয়। অনেক সহ্য করেছি আপনার মেয়ের আর আপনাদের হম্বিতম্বি ,আর পারছিনা। আপনাদের মেয়ে আপনাদের কাছে রইলো,আমার মেয়েকে দেখে রাখবেন।আর বোঝা মনে হলে আমাকে ডাকবেন, আমার মেয়েকে এসে আমি নিয়ে যাব।
সীমান্ত আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি।হনহন করে হাটা দিয়েছে সে। পেছনে সমিরনের ডাক,শকুন্তলার অনুরোধ সব কিছু ফেলে এগিয়েছে। সামনে আদিত্য বাঁধলে তাকে দেখে মলিন হেসেছে।আদিত্যও কিছু বলেনি।শুধু কাঁধে হাত রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলেছিলো থেকে যেতে। সীমান্ত তো থাকতে আসেনি।তাই আর দাঁড়ানো হয়নি।
ওদিকে দরজা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুস্মিতা চোখের জলে বানিয়েছে থৈথৈ নদী। ইশ! বড় ভুল হয়ে গেলো।কেন মাথা গরম করে অতটা বাড়াবাড়ি করলো,সেই আক্ষেপেই মরে যাচ্ছে সে। একটা কথাতো সত্যি,সীমান্তর কোনো আচরন খারাপ ছিলোনা এই চার বছরে। না তার কখনও মনে হয়েছে সীমান্তা তাকে ভালোবাসেনা। সব না জেনে এমন করা ঠিক হয়নি।এখন কি আবার ফিরে পাবে সীমান্তকে? ওকি ক্ষমা করবে? কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে শাশুড়ী মায়ের সামনে।বুড়ো মানুষ টাকে ধাক্কা দেয়ার অপরাধবোধ হঠাৎই দ্বিগুণ বেড়ে এলো সুস্মিতার। কেমন গলাকাটা মুরগির মত ছটফট অনুভব হতে লাগলো।
আবার অনুভব হলো আদিত্যর কষ্ট! স্বামীর থেকে কটা দিন দূরে থেকেই তার অবস্থা এমন।অথচ তার দাদা ভালোবাসার মানুষ টাকেই হারিয়ে ফেলল।এখানে দোষ একটু হলেও তার আছে। আচ্ছা এই শাস্তিই তাকে দেয়া হচ্ছেনাতো!
____
এরপর বেশি কিছু দিন পার হয়। চলে আসে হাজারো কপোত-কপোতীর স্বপ্নের, হাজারো অপেক্ষার , ‘ভালোবাসা দিবস’ । সবার সব পরিকল্পনা তার প্রেয়সীকে ঘিরে।কিন্তু পৃথিবীর এক কোনে অবস্থান কারী এই দুটো মানুষের জল্পনা কল্পনা একজন কে নিয়ে।নিসন্দেহে ‘তিথি’।
আদিত্যর চোখ জোড়ানো স্বপ্ন।আগের বারের মত এবারেও তিথির সামনে হুট করে হাজির হবে।তারপর একটা গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলবে, ‘ভালোবাসি তিথি’।
উত্তরে তিথি মুচকি হেসে ফুল হাতে নেবে। সুন্দর, কাঁপানো ঠোঁট নেঁড়ে বলবে “আমিও ভালোবাসি। তারপর পুরোটা দিন পার করবে একে অন্যর হাত জড়িয়ে ঘুরে। সময় কাটাবে ইচ্ছেমতো।
আদিত্যর দৃঢ় বিশ্বাস, এই দিনে অন্তত তিথি আর অভিমান করে থাকবেনা।সমান ভাবে তাকে মিস করবে,মনে করবে। পুরোনো কথাগুলো মনে করে একা একা হাসবে। আদিত্যকে মনে করে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, ঠিক তখনি আদিত্য সামনে গিয়ে দাঁড়াবে।চমকে দেবে।নিবেদন করবে ভালোবাসার লাল গোলাপ। পুরনো দিনের মত বলবে ভালোবাসার কথা।তিথি হাসবে, সে মন ভরে দেখবে ওর গালে পরা টোল। যেখানে অজস্র বার চুমু একেছে সে। তিথির সব অভিমান ভাঙতেই এই দিনটি আসছে। তিথি বুঝবে আদিত্য কারোর নয়,শুধু তার।তারই।
”
তন্ময়ের মন চঞ্চল গতিতে ছুটছে। এই প্রথম বার তিথিকে ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানাবে সে। টকটকে তাজা গোলাপ এগিয়ে বলবে, শুভ ভালোবাসা দিবস।শুভ হোক তোমার জীবন।
ভালোবাসাময় হোক তোমার প্রতিটি মুহুর্ত। আর মনের মধ্যে বলবে
‘ ভালোবাসি তিথি।
টানা দু বছর তিথিকে শুভেচ্ছা দেওয়া হয়নি।এই দিনে একজন মানুষ যে তার ভালোবাসার মানুষ কে প্রত্যাশা করে। তার ভাঙা মনের শুভেচ্ছা কোনও কাজেই আসতোনা। আদিত্যই ছিলো সবার আগে। এবার আদিত্য নেই, তাই হয়ত তার ইচ্ছে হলো। একটু স্বার্থপরতা নাহয় করলো, কিন্ত তিথির হাসি দেখা হবে এই অনেক। আচ্ছা তিথিকি গ্রহন করবে ফুল? ছুড়ে ফেলে দেবেনাতো!
অনেক কিছু ভেবে তিথির নম্বরে কল দিলো তন্ময়।দুবার রিং হতেই ফোন তুলল তিথি।
‘ হ্যা বলো!
তন্ময়ের সব গুলিয়ে যাচ্ছে।এই মেয়েটার কন্ঠস্বর তাকে নার্ভাস করতে যথেষ্ট। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ ভালো আছি।
তিথি ভ্রু কোঁচকালো।সেতো জিজ্ঞেসই করলোনা কেমন আছে। ওপাশ থেকে তন্ময় বলল
‘ কি করছিলে?
‘ পায়েস রাঁধছি।
তিথির স্বর টা বেশ উৎফুল্ল শোনালো। আবার বলল,
‘ স্বপ্ন আসবেনা কাল? তাই এখন রেঁধে ফ্রিজে রেখে দেব।ওর ঠান্ডা পায়েস খুব পছন্দ।কত দিন পর আসছে আমার ভাই!
তিথির আওয়াজ খুশি খুশি।তন্ময়ের ভালোই লাগছে শুনতে। অন্তত তার জন্যে বিষয় টা সহজ হবে। তিথি তাড়া দিয়ে বলল,
‘ তুমি কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলো,আমার চুলোতে দুধ বসানো।উথলে পরবে।
তন্ময় একটু চুপ থেকে বলল,
‘ সময় লাগবে বলতে!
তিথি কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কেন? অনেক বড় কথা?
‘ তাতো বটেই!
‘ আচ্ছা বেশ আমি বরং ফোন নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছি।রাঁধতে রাঁধতে তোমার লম্বা কথা শুনবো।
তন্ময় জবাব দিলোনা। বড্ড দ্বিধা লাগছে। কথাটা বললে তিথি কি মনে করে বসবে কে জানে! হয়ত ওর খুশটাও উবে যাবে।কিন্তু বলা দরকার। নাহলে সেই যে উবে যাবে বলতে না পারার আক্ষেপে। এত না ভেবে বলাই যাক।ভাগ্যে যা আছে হোক!
তিথি বলল,
‘ তন্ময় কি হলো? বলো..
তন্ময় মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল
‘ পরশু মেলায় যাব তোমায় নিয়ে। সাথে স্বপ্নকেও রেখো।
তিথি প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ এটা বলার ছিলো?
‘ পরশু এক বিশেষ দিন।শাড়ি পরে বের হয়ো তিথি।শাড়ির প্রত্যেকটা কঁুচি আমার নামে দিও। একটু কাজল পরো চোখে,চুল গুলো ছড়িয়ে দিও পিঠে। আঁচল টা খোলা রেখো যেন বাতাসে দোল খায়। আর ঠোঁটে রেখো সেই ভুবন বোলানো হাসি যা দেখে তন্ময় শতবার ঘায়েল হয়।
তন্ময় ঠান্ডা স্বরে এক নাঁগাড়ে কথাগুলো বলেই লাইন কেটে দিলো।তিথি তব্দা খেয়ে তাকিয়ে থাকলো ফোনের দিকে। অর্ধেক কথা কানে ঢুকেছে বাকিগুলো প্রশ্নচিহ্নের মত এখনও ঘুরছে চারপাশে।
চলবে,
কার গোলাপ নেবে তিথি🤔দুজনেই তো আসছে।