পূর্ন__তিথি লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (১০)

0
200

#পূর্ন__তিথি
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১০)

খুলনা হাসপাতালের করিডোর এটা। পাশে ছোট ছোট বেঞ্চ থাকা সত্ত্বেও মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে আছেন সুচিত্রা। ফ্যাকাশে মুখ,এলোমেলো চুল।ফর্সা মুখে নাকের ডগাটা ভীষণ কান্নায় হয়ে উঠেছে টকটকে লাল। পাশেই পরে আছে কাঁধ ব্যাগটা।পড়নের সুতির কাঁপড়ের আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে পায়ের কাছে। জীবনের পুরোটা অংশ ব্যার্থতায় পরিপূর্ণ। একটু সুখের মুখ সৃষ্টিকর্তা দেখালোনা তাকে।

সারাদিন খেটেখুটে,ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত নেতানো দেহ নিয়ে যখন ঘরে ফিরলেন, তখন চারদিক অগোছালো,ভাঙাচোরা। এর থেকেও বেশি অবাক হন যখন দেখলেন পুরো বাড়ি খালি।তিথিকে অনেক বার ডেকেও পাননি। একটা সময় ফোনে কল এলো সুচিত্রার। তন্ময়ের কল। তন্ময় তিথির সব থেকে ভালো বন্ধু হিসেবে পরিচিত তার কাছে।

সেখান থেকেই জানতে পারলো তিথি এই মুহুর্তে হাসপাতালে ভর্তি। বেশি কিছু শোনার আগেই ছুটে এলেন সুচিত্রা। সাথে নিয়ে এলেন একরাশ দুঃশ্চিন্তা, মেয়ের জন্যে মাত্রাতিরিক্ত উৎকন্ঠা। কিন্তু আসার পর,আরো এক কান পুঁড়িয়ে দেয়া খবর শুনতে হলো । তার অতি আদরের,কলিজার টুকরো, মেয়ে বিয়ের আগেই গর্ভবতী। আর এই সন্তান সেই আদিত্যর,যাকে নিজের ছেলের মতই স্নেহ করতেন তিনি। যে ছেলেটা সারাক্ষন কাকীমা কাকীমা বলে ঘুরতো তার পাশে। এমনও দিন ছিলো যখন এক লোকমা ভাত তিথিকে খাইয়ে পরের লোকমা তুলে দিয়েছেন আদিত্যর মুখে।এ যে অনেকটা দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষার মতন ব্যাপার হলো। তবুও আদিত্য পরের ছেলে,বিশ্বাসে দাম সেকি দেবে? যেখানে নিজের পেটের মেয়ে তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিলোনা।মূল্য দিলোনা মায়ের ভরসার। সেতো সম্পর্ক টাকে মেনেই নিয়েছিলো।আদিত্যর একটা হেলদোল হতো, তিথির পড়াশোনা শেষ হতো,চার হাত এক করে দিতো না হয়! কিন্তু তার আগেই দুজন যৌবনের কামুকতাকে সামলে উঠতে পারলোনা?তার ভোলাভালা মেয়েটা কি করে পারলো এমন অন্যায় করতে! ভাবতেই বুক হুহু করছে সুচিত্রার। এখন এই সন্তানের কি হবে? কে নেবে এই বাবার পরিচয় বিহীন সন্তানের দ্বায়ভার? সমাজ কি বলবে তার মেয়েকে? যেখানে স্বামীর সাথে আলাদা থাকার অপরাধে তার চরিত্রে কালি ছেটায় সমাজ, সেখানে অবিবাহিতা গর্ভবতী মেয়েকে এরা ছেড়ে দেবে? কখনোই দেবেনা।এ সমাজ যে বড়ই নিষ্ঠুর! এরা হাত বাড়ায় স্বান্তনা দিতে নয়,বরং তোমার গায়ে কাঁদার দলা ছুঁড়তে।

তন্ময় কে এসে থেকে একবার দেখেছে সুচিত্রা।ছেলেটা ভীষণ ব্যাস্ত।কখনও ডাক্তারের পিছু ছুটছে কখনও মেডিসিনের জোগাড় করছে। জিরূচ্ছে না পা দুটো।সুচিত্রা তখন অবাক চোখে চেয়ে থাকেন,ছেলেটার ওই শ্যামবর্ন মুখের দিকে। হাতের পাঁচটা আঙুল এক হয়না।তফাৎ থাকে।তেমন তফাৎ থাকে মানুষে মানুষেও।এইতো তন্ময়,এই ছেলেটা নিঃস্বার্থ ভাবে তার মেয়েকে সাহায্য করে।যা কিছু হোক।হয়তো ভালোওবাসে।

অথচ আদিত্য নামক কালসাপ! কি প্রতিদান দিলো তার মেয়ের ভালোবাসার? বিয়ে অব্দি সবুর করতে পারলোনা? ভুলিয়ে ভালিয়ে তার মেয়ের এত বড় ক্ষতি করলো? আর এখন?অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়েও সেড়ে নিলো চুপচাপ। এত বড় ধোঁকা কি ভগবান সইবেন? কোনো শাস্তি দেবেন না? দেশের আঈনে তো মন ভাঙার বিচার নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে? সেখানেও কি নেই?

তন্ময় ডাক্তারের সাথে কথা বলা শেষে এসে দাঁড়ালো সুচিত্রার পাশে। হাটু মুঁড়ে বসলো তারপর।সুচিত্রা জলমাখা চোখ তুলে তাকালেন, ভাঙা কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

‘ কেমন আছে সোনু?

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” ভালোনা।

সুচিত্রা ডুকরে কেঁদে বললেন,

‘ আমার মেয়েটার কি হবে তন্ময়? ওর চরিত্রে যে কালি লেগে গেলো।ওই বাচ্চাটারই বা কি হবে?যার জন্যে আমার মেয়ের এই অবস্থা সেতো নতুন বউ নিয়ে দাঁপাচ্ছে।আমি আদিত্য কে কোনো দিন ক্ষমা করবোনা তন্ময়।বিশাস করো।

তন্ময় খানিকক্ষন চুপ করে থেকে বলল,

‘ একটা খারাপ খবর আছে আন্টি..

সুচিত্রা শুকনো ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বললেন,

‘ আর কি খারাপ খবর বাকি বলোতো বাবা!

তন্ময় ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ অক্সিজেনের অভাবে তিথির বাচ্চাটা মারা গিয়েছে। পেটেই!

সুচিত্রা বিস্মিত হয়ে তাকালেন। এক আহত দৃষ্টি কথা বলল তখন। পরমুহূর্তে শাড়ির আঁচলে মুখ চেঁপে হাউমাউ করে কাঁদলেন।কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘ হায় ভগবান! এ কোন পরীক্ষায় ফেললে তুমি? নিজের মেয়ের প্রথম সন্তানকে কোলে নিয়ে চুঁমু খাওয়ার বদলে তার মৃত্যু সংবাদ শুনতে হলো!পৃথিবীতে আসার আগেই ধ্বংস হলো একটা নিষ্পাপ প্রান?

সুচিত্রা হঠাৎ কান্না থামিয়ে তন্ময়ের দিকে চাইলেন,প্রচন্ড জিজ্ঞাসা নিয়ে বললেন,

‘ আমি কাঁদছি কেন তন্ময়? আমার তো খুশি হওয়ার কথা,তাইনা?যা হয়েছে ভালোই হয়েছে,হ্যা ভালোই হয়েছে।নাহলে আমার মেয়েটা সমাজে কি করে মুখ দেখাতো? আমার ওই টুকু মেয়েটা যে শেষ হয়ে যেত সবার বিষ বাক্যে।

সুচিত্রা ধড়ফড় করে তন্ময়ের হাত ধরলো।অনুরোধ করে বলল,

‘ এই তন্ময় তুমি এ কথা কাউকে বলোনা বাবা! কাউকে বলোনা। আন্টি তোমার গোলাম হয়ে থাকব।

তন্ময় উত্তর খুঁজে পেলোনা । নিরব চোখে শুধু স্বায় দিয়ে “হ্যা জানালো। তার বুকটা তো ফেঁটে যাচ্ছে।প্রতিনিয়ত ফাঁটছে।হচ্ছে চৌচির। উন্মত্ত মন বলছে

‘ আমিও যদি আপনার মতো কেঁদে কেঁদে নিজেকে একটু হালকা করতে পারতাম! জীবন টা যে ধন্য হতো।কিন্তু না! পারছিনা।সমাজের কিছু নিয়ম পুরুষের চোখে বেড়ি বেঁধেছে।এ চোখ দিয়ে জল গঁড়ানো নিষিদ্ধ।যা কিছু হোক,পুরুষ তোমাকে কাঁদতে নেই।

তন্ময় নম্র কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

‘ আন্টি! এভাবে কাঁদবেন না। আপনি ভেঙে পরলে তিথিকে আমি একা সামলাতে পারবোনা। আপনি শক্ত হন।আসুন উঠে আসুন।

সুচিত্রা নিরবে অশ্রু ঝড়াচ্ছেন তখনও।তন্ময় ধরে ধরে তার দূর্বল শরীরটা মেঝে থেকে তুলে বসালো চেয়ারে।ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললো।তখন তিথি ওভাবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় অতটাও ভয় পায়নি যখন পেলো বারবার ওর মুখে জল ছিটিয়েও জ্ঞান না ফেরায়। ভাগ্যিস দেরি না করে হাসপাতালে এনেছিলো।তিথিতো অন্তত বাঁচবে। কিন্তু বাচ্চা হারানোর শোক? সইতে পারবে তো মেয়েটা?

তন্ময় এলোমেলো পায়ে হেটে গেলো তিথিকে শুইয়ে রাখা কেবিনের দিকে। কাঁচের জানলা দিয়ে উঁকি দিলো।পিপাসু দু চোখ নিবদ্ধ করলো ভেতরে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা উঠলো সাথে সাথে।

‘ কেন তিথি? কেন একটু ভালো বাসলেনা আমায়? পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ে এনে দিতাম আমি। চেষ্টাতো করতাম।তবু একবার ভালোবাসতে! বেসেই দেখতে, অবাধ্য অশ্রু গুলোকে বারন করতাম তোমাকে ছুঁতে। বাধ্য করেই ছাড়তাম ওদের।

______

কুন্ডলি থেকে ধোঁয়া উঠছে।আগুন নেভানো হয়েছে অনেকক্ষন।সানাইয়ের শব্দের সাথে সাথে সেই হৈহৈ পরিবেশটা এখন শান্ত,স্তব্ধ।প্রত্যেকের মুখ থমথমে। কেউ কেউ গুজগুজ, ফিসফিস করছেন নিজেদের ভেতর।সবার মধ্যে চাঁপা অস্থিরতা, উত্তেজনা।

সমিরন অঢেল চিন্তা নিয়ে বসে আছেন পুতুলের বাবার পাশে। পুতুলের বাবার মুখ কালো মেঘের মত। পুতুল মাটিতে বসে আছে। পাটির ওপর। সাথে আরো ক’জন।সুস্মিতা পায়চারি করছে। একটু পরপর কল করছে আদিত্যর নম্বরে। সুস্মিতার দেড় বছরের মেয়েটা তখন তার বাবার কাঁধে ঘুমন্ত। লাগাতার ফোনে না পেয়ে সুস্মিতা অধৈর্য পায়ে এসে পুতুলের পাশে বসলো।পুতুলের দু হাতের ভাঁজে আদিত্যর গায়ে প্যাঁচানো সেই কাঁপড়।মাথার সিঁদুর গুঁড়ো নাকের ডগাতেও লেগেছে। গায়ের অলংকারের সাথে চকচক করছে রুপ। অথচ মুখটা ভীষণ ভাঁড়। সাথে মনটাও।বিয়ে শেষে আদিত্যকে খুঁজে পাচ্ছেনা কেউ। তার বন্ধুরা বর কনে নিয়ে বাসর জাগার কত পরিকল্পনা করলো,কিন্তু সব মাটি করে দিয়ে আদিত্য নিরুদ্দেশ।একটা বার তার বিয়ে করা বউটার কথা ভাবলোনা? ভাবতেই অভিমানে ছেঁয়ে এলো পুতুলের কিশোরি মন। এত লোক গিজগিজ না করলে এখন ঠিকই ভারি বর্ষন ঘটাতো তার চোখ দুটো।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পুতুলের ধ্যান কাটলো।তাকালো পাশ ফিরে।সুস্মিতা আশ্বাস দিয়ে বলল,

” মন খারাপ করোনা বউদি।দাদা নিশ্চয়ই দরকারি কাজে গেছেন।

পুতুল মেকি হেসে বলল,

‘ হয়তো!

সুস্মিতা লম্বা শ্বাস টেনে উঠে দাঁড়ালো আবার। মেজাজ ভারি খারাপ হচ্ছে দাদার প্রতি।ওদিকে তার মা, ছেলের চিন্তায় হা -হুতাশ করছেন।তাকেই দোষ দিচ্ছেন।সে কোনো চোখে চোখে রাখলোনা!ভরা বাড়ি থেকে কি করে যেতে পারলো? আচ্ছা যে যেতে চায় তাকে কি ধরে বেঁধে আটকানো যায়!

সুস্মিতা নখ কাঁমড়াচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একটু বাদে পাশে এসে দাঁড়ালো তার স্বামী সীমান্ত।মেয়ের পিঠে আলতো আদুরে চাঁপড় কাটছেন।সুস্মিতাকে জিজ্ঞেস করলো,

” দাদাকে ফোনে পেলে?

সুস্মিতা ওর দিকে একবার চোখ বোলালো শুধু।আবার আগের জায়গায় তাকিয়ে দুদকি মাথা নাঁড়লো।যার অর্থ না।

সীমান্ত হাসলো।আস্তে করে।তবুও চোখ এড়ালোনা সুস্মিতার।সতর্ক চোখে চেয়ে বলল,

‘ হাসছো কেন?

সীমান্ত খাপছাড়া কন্ঠে বলল

‘ হাসছি তোমাদের অবস্থা দেখে।বিয়ের পর বর উধাও।কি সুন্দর শিরোনাম!

সুস্মিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ তুমি কি মজা নিচ্ছো?

সীমান্ত যত্র উত্তর দিলো,

‘পাচ্ছি,কারন বিগত দিন গুলোতে দেখেছিতো স্বচক্ষে, কি দারুন মানসিক প্রেশার তোমরা ওনার ওপর দিয়েছো!প্রত্যেকে মিলে। কি হলো এখন? বিয়ে হলো কিন্তু এরা সুখি হবে কি? এই জন্যেই কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করাতে নেই সুস্মি।কি হতো যদি তিথি নামের মেয়েটাকে মেনে নিতে তোমরা?দুজনেই ভালো থাকতো।এভাবে তিনটে জীবনে অহেতুক নষ্ট হতোনা।

সুস্মিতা জ্বলে উঠে বলল,

‘ এই চুপ করোতো! আমাদের ব্যাপার আমাদের বুঝে নিতে দাও।ওই ছোট জাতের মেয়েকে বাবা কোনো দিনও মেনে নেবে? এত খারাপ দিন আসেনি আমাদের। দাদা একটা ভালো মেয়ের সাথে প্রেম করলে অবশ্যই মানতো সবাই।পাতে দেয়া যায় ওই মেয়েকে?

‘ এখন বুঝি পাতে দেয়ার যোগ্য কাউকে পেয়েছো?

সীমান্তের প্রশ্নে স্পষ্ট বিদ্রুপ।সুস্মিতা তেঁতে বলল,

‘ তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন? দেখো মেজাজ চটে আছে অামার।দাদার রং তামাশা সহ্য হচ্ছেনা এমনিতেই।একেতো সাত পাঁক ঘোরার সময় ওইভাবে চলে গেছিলো,যা হোক বুঝিয়ে ভাজিয়ে এনেছিলাম।কোনো মতে মাথায় সিঁদুর তুলে দিতেই লা -পাত্তা হয়ে গেলো?বাবার মান সন্মান রইলো কি আর? আরে বাবা এত সুন্দর,ভদ্র মেয়ের সাথে বিয়ে হলো তাকে নিয়ে থাকনা। কি আছে ওই মেয়ের মধ্যে? যার শোকে একবারে জীবন উৎসর্গ করতে হবে?

সীমান্ত আবার প্রস্বস্ত হেসে বলল,

” রং তামাশা উনি নয়,করছো তোমরা। একদিন ঠিক বুঝবে। হতে পারে যাকে যেমন দেখছো সে তেমন নয়।গায়ের রং সাদা মূলোর মত হলেই মন সাদা হয়না। দেখলে যাকে ভদ্র ভাবছো পরে সে চূড়ান্ত অভদ্র হলো? হতেও তো পারে!আর জীবন উৎসর্গ ভালোবসে মানুষ একবার নয় বহুবার করবে।যখন তোমার সাথে তেমন কিছু ঘটবে তখন আন্দাজ পাবে ঠিকই।

সুস্মিতা জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলল,

‘ মানে? কি বলতে চাও?

সীমান্তর তর্ক করার ইচ্ছে হলোনা। প্রশ্নটা সম্পূর্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘ মেয়েকে কোথাও শোয়ানোর ব্যাবস্থা করো।ওর আমার দুজনের ঘাড়েই ব্যাথা হচ্ছে।

সুস্মিতা নিভে গেলো। কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে তুলে নিলো কোলে। হেটে গেলো কোথাও একটা। সীমান্ত ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললো। আদিত্যর জন্যে চিন্তাও হলো মনে মনে।কোথায় গেলেন উনি?

সমিরন গুম মেরে বসে আছেন।একটা মাত্র ছেলে তার জীবনের এত বড় ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াবে এও কি ভেবেছিলো কখনও? মান, ইজ্জ্বত আর কিচ্ছু রইলোনা। কেমন বাঁকা চোখে দেখছে সকলে।কানাঘুষা করছে।এমনও দিন আসবে কল্পনার বাইরে ছিলো তার।পুতুলের বাবা,সেও বা কি ভাবছেন? নিশ্চয়ই খুব খারাপ মন্তব্য করছেন মনে মনে। না এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে তার বুক ব্যাথা উঠবে।যত্রতত্র পালাতে হবে। সমিরন একটু ঘুরে বসলেন পুতুলের বাবার দিকে।গলা ঝেড়ে বললেন

‘ বলছিলাম যে বেয়াই মশাই…

পুতুলের বাবা ঠান্ডা চোখ তুলে তাকালেন।সমিরন বললেন,

‘ ছেলে আমার ভীষণ বেপরোয়া আগেই তো বলেছিলাম বউমাকে।এখন আপনারাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন?

পুতুলের বাবা উত্তরে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সমিরন ইতস্তত করে বললেন,

‘ বলছিলাম যে,বেয়াই মশাই..বিয়ের বর যখন নেই বাদ বাকি নিয়ম তো আর হচ্ছেনা।হওয়া সম্ভবও নয়। আপনি বরং এক কাজ করুন, মেয়ে বিদায়ের ব্যাবস্থা করুন।আমি আজই আমার ঘরের লক্ষী তুলবো।

পুতুলের বাবা অবাক হয়ে বললেন,

‘ এ কি করে সম্ভব বেয়াই মশাই? লোকে কি বলবে…

সমিরন নিশ্চিন্ত কন্ঠে বললেন,

‘ আহা লোকে কি ভাবলো তাতে আমাদের কি? আমার ছেলের বউ আমি নিয়ে যাচ্ছি এখানে ভাবা ভাবিরই বা কি আছে? আর বর-ই তো নেই,কার সাথে নিয়ম কানুন পালন করবেন আপনি? বলুন তো? আমার ছেলে গিয়েছে যখন আর আসবেনা।শুধু শুধু বসে থেকে কি লাভ হচ্ছে? লোকের কানাঘুষা তো কমছে না তাইনা? তার থেকে এটাই ভালো হবে যা বলছি শুনুন। আপনি কনে বিদায়ের ব্যাবস্থা করুন।

পুতুলের বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।ভেবে বললেন

‘ ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন। আমি বন্দোবস্ত করছি।

পুতুলের বাবা উঠে চলে গেলেন।সমিরন মুখ ফুলিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। মানুষ কে ভুজুংভাজুং দেয়ার বুদ্ধি তার অসামান্য।এখানে সেই অনন্য। ভাবতেই নিজের মনে প্রসারিত হাসি টানলেন পানের রসে টুকটুকে হয়ে যাওয়া লাল ঠোঁটে।

_____

আদিত্য মাত্রই বাইক থামালো বাড়িটার সামনে। রাত সাঁড়ে বারোটা বাজে এখন।এত রাতে বাইকের ভোঁ ভোঁ শব্দ কান ঝাঁঝিয়ে দিলো জেগে থাকা পাখি গুলোর। অন্ধকার ভয় পেলো হেডলাইটের কঁড়া আলো ঠিঁকড়ে আসায়। বাইক থেকে তাড়াহুড়ো করে নামলো আদিত্য। পড়নে ধুতি পাঞ্জাবি এখনও আছে। শুধু মাত্র রঞ্জন কে দিয়ে বাইকে টা আনিয়েছিলো। আদিত্য বাইক দাঁড় করিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ঘরটির দিকে। সিমেন্টের তৈরি ছাদের এক তলা বিশিষ্ট ঘর। আদিত্যর বুক কাঁপছে। ধড়ফড় করছে। হাত এগিয়ে ডোরবেল বাজালো প্রথমে। কেউ খুললোনা।আদিত্য আবার বাজালো ডোরবেল।খুললোনা কেউ। আদিত্য জানলার কপাট খোলার চেষ্টা করলো,ভেতর থেকে বন্ধ।এবার জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো সে।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলতে থাকলো,

‘ তিথি,আমি এসেছি। দরজাটা খোলোনা! এই তিথি।দেখো আমি এসেছি তোমার কাছে, তিথি…

দরজার নিঁচের দিকে মস্ত বড় ঝুলন্ত তালা টাকে তখনও উৎকন্ঠায় চোখে পরেনি তার। সমানে দরজা ধাক্কাতে ব্যাস্ত সে। হয়তো তিথি রাগ করে খুলছেনা। আদিত্য করুন কন্ঠে তিথির মাকে ডাকতে শুরু করলো,

‘ কাকিমা প্লিজ আপনি অন্তত দরজাটা খুলুন না।আমাকে তিথির সাথে একবার দেখা করতে দিন!

ভেতর থেকে কেউ উত্তর দিচ্ছেনা। দরজা ধাক্কানোর শব্দটা রাতের অন্ধকারে হাওয়ায় ভাসছে শুধু। টানা এক ঘন্টা দরজা ধাক্কিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরলো আদিত্য। হাতের কব্জি ব্যাথায় টনটন করছে। কপাল,ঘাঁড়,বুক বেয়ে তরতর করে ঘাম পরছে । আদিত্য আরেকবার দরজার দিকে চেয়ে উঁচু স্বরে বলল,

‘ তুমি দরজা না খোলা অব্দি আমি এখানেই বসে থাকবো তিথি।কতক্ষন আমার সাথে অভিমান করে থাকবে দেখবো আমি!

আদিত্য বসে পরলো সদর দরজার সিড়িতে। দরজার সাথে মাথাটাকে এলিয়ে দিতেই তালাটার সাথে সংস্পৃষ্ট হয়।বড্ড কৌতুহল নিয়ে দেখলো সেদিকে।মুহুর্তেই চমকে উঠলো। ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরলো আবার। দরজায় তালা ঝুলছে।তাহলে তিথি কোথায়?

_____

তন্ময়ের চোখ ঘুমে ঢলছে।গত তিন মাস প্রত্যেকটা রাত জেগে কাটিয়েছে।অথচ আজ কেমন ঘুম জেঁকে বসেছে চোখে।বিষয়টা সুচিত্রার নজরে পরলে,তন্ময়ের কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত ভাবে বললেন,

‘ তুমি বোধ হয় ক্লান্ত বাবা! তুমি এখন বাড়ি যাও।আমিতো আছিই।

তন্ময় মৃদূ হেসে বলল,

‘ সমস্যা নেই আন্টি।আ’ম অলরাইট। এখন আমার ঘুমের থেকেও তিথির সুস্থতা জরুরি।

সুচিত্রা আর কথা বাড়ালেননা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন নিরবে।তারপর চোখ সরিয়ে নিলেন তিথির কেবিনের দিকে।হঠাৎ তন্ময়ের ফোনটা বেঁজে উঠলো।তন্ময় পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করলো ঠিকই তবে দেখলো তিথির ফোন।তার নয়।স্ক্রিনে “আদি লেখা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাৎক্ষণিক। কেটে দিলো লাইন। যথারীতি আবার কল এলো।তন্ময় আবার কাটলো।আবার কল এলো।এবার বিরক্ত হয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে অন্যদিকে চলে গেলো তন্ময়।ফোন রিসিভ করে শান্ত অথচ শক্ত গলায় বলল,

‘ কি সমস্যা..?

আদিত্য ‘হ্যালো’ বলতে নিচ্ছিলো।এর আগেই তিথির জায়গায় অন্য কারো স্বর পাওয়ায় এক মুহূর্তের জন্যে থমকে যায়। কোপিত গলায় প্রশ্ন ছোড়ে,

‘ কে আপনি? তিথি কোথায়? এটাতো তিথির নম্বর।আপনি কেন তুলেছেন?

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,

‘ আমি তন্ময়।

আদিত্য স্তম্ভিত। “তন্ময়’ নামটা তার পরিচিত।সব থেকে বেশি পরিচিত। এই নামক লোকের চোখে তিথির জন্যে ভালোবাসা উপচে পরতে দেখেছে সে। বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ তিথির ফোন তোমার কাছে কি করে এলো?

তন্ময় স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ ঠিক যেইভাবে তিথি আমার কাছে আছে।

আদিত্য চমকালো।কটমটে কন্ঠে বলল

‘ তিথিকে দাও ফোনটা।কোথায় ও?

তন্ময় কাটকাট জবাব দিলো,

‘ সেটা জানার কোনো প্রয়োজন আপনার নেই।আপনি ওর সাথে যা করেছেন তারপর আবার ওকে ফোন করছেন? লজ্জ্বা করছেনা আপনার? ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের খোঁজ করতে?তিথি ভালো আছে আর ভবিষ্যতেও ভালোই থাকবে।আপনি আপনার নতুন বউ নিয়ে আনন্দে থাকুন। দয়া করে ওকে বিরক্ত করবেন না।আই সোয়্যার খুব খারাপ হয়ে যাবে।ও হ্যা সোয়্যারের মানে বোঝেন তো? না বুঝলে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবেন।

কথাগুলো বলেই লাইন কেটে দিলো তন্ময়।রাগে শরীরের রগ ফুটছে তার।লোকটা বিন্দুমাত্র শান্তি দেয়নি,না তাকে আর না তিথিকে।ওদিকে আদিত্য কিছু সময়ের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে পরলো।তন্ময়ের কাছে তিথি? মানে কি এসবের?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here