#কৃষ্ণচূড়া🍂
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১৪
গুরুগম্ভীর মেঘ গুলো বর্জনের থেকে বর্ষন ঘটায় বেশি।এক নিমিষেই এমন মেঘে প্রশান্তিময় নীল রঙের সুন্দর আকাশটাও পাল্টে যায় নিকষ কালো অন্ধকারে।
যার কোল থেকে বিচ্ছুরিত বজ্রপাতে কেপে ওঠে পুরো ধরিত্রি।
ছবির ধারণা এমনই সর্বনাশা মেঘ ঘনিয়ে এসেছে তার নিজের জীবনেও। যবে থেকে এমন জীবনে পা বাড়িয়েছে তবে থেকেই কুচকুচে কালো অন্ধকার ছেয়ে দিচ্ছে তার প্রত্যেকটা সময় কে।
পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন হলো যে কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোরপূর্বক করতে হয়। আর এহেন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াই যেন ছবির জীবনের প্রত্যেক টা দিনলিপি তে আক্ষরিত এখন।
ইরফান তখন থেকে সিন বুঝিয়ে দেয়ার নাম করে ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে ছবিকে। সেটা অবশ্যই খুব একটা ভালো ভাবে নয়। নিজের সুবিধে অনুযায়ী বড্ড বাজে ভাবে। যার দরুন প্রবল অস্বস্তির স্বীকার ছবি।
এমনিতেই ইরফান কে শুরু থেকেই অজানা কারনে তার এতটা অপছন্দ,,,,যেটা আজকে আরও প্রগাঢ়তা পেলো।
কাব্যকে নিষেধ করা সত্বেও কিভাবে পারলো তার সঙ্গে এমন টা করতে?? এখানে একমাত্র কাব্যকেই অন্তত আপন মনে হতো ছবির। আর যাই হোক একটা মেয়ের সুবিধে অসুবিধে তো দেখবে!! এতোটা অমানবিক মানুষ হতে পারে??
এগ্রিমেন্টে সই করেছে,,,, যা বলবে সেটাই মানতে হবে,,,তাই বলে সে কি মানুষ নয়?? নিজের ইচ্ছের এতোটুকুও দাম নেই???
বারবার অসহায় চোখে চেয়ে চেয়ে কাব্যকে দেখছে ছবি।যার অর্থ ইরফান কে থামতে বলা। কিন্তু কাব্য নির্বিকার ভাবে দাড়িয়ে আছে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই নিজের মধ্যে এমন টাই মুখের ভঙ্গিমা তার।
কাব্যর দিক থেকে আশানুরূপ ফল পেলোনা ছবি। উল্টে ইরফানের স্পর্শ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
শেষমেষ না পেরে চোখ মুখ খিচে সবার সামনেই ইরফান কে নিজের থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো ছবি। ফলে বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলো ইরফান।
এহেন কাজে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম উপস্থিত সকলের।
ইরফানের রাগ এবার চড়ে বসেছে। এই মেয়ে শুরু থেকে তাকে অপমান করে যাচ্ছে। ইগনোর করে যাচ্ছে। তাও মানানসই হলেও আজ একেবারে
সবার সামনে তাকে ধাক্কা মেরে দিলো ? কত্ত বড় সাহস এর।ইরফান রাহমানকে ধাক্কা মারা?
দ্রুতগামী কয়েক পা চালিয়ে ছবির একহাতের বাহু চেপে ধরলো ইরফান। ফলশ্রুতিতে ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো ছবি।
শক্ত চোয়াল নিয়ে ইরফান কিছু বলতে নেয়ার আগেই অপর পাশ থেকে ছবিকে ধমকে উঠলো কাব্য।
— মিস ছবি?? কি অসভ্যতা এটা। ইরফান কে ধাক্কা কেনো মারলেন আপনি….??
কথাটা বলে কাব্য নিজেও এগিয়ে গেলো ছবির দিকে,,,,,ইরফানের হাতের মুঠো থেকে অতি সন্তর্পনে ছাড়িয়ে নিলো ছবির হাত।
ব্যাপারটা খানিক অবাক লাগলো ইরফানের কাছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী করতে দিলোনা কাব্য। শান্ত্বনামূলক স্বরে বলে উঠলো…
—- কাল্ম ডাউন ইরফান,তুই বোস। আমি ওনাকে বোঝাচ্ছি।
কাব্যকে বরাবর -ই মেনে এসেছে ইরফান। আর যাই হোক কাব্য তার ভালো বন্ধু। আর তাই চুপচাপ সে বসে পরলো নিজের জায়গায়।
সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ছবির দিকে তাকালো কাব্য। ছবির চোখ বেয়ে সরল রেখার মত অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে।
এই একটা ব্যাপার কাব্যর ভীষন অদ্ভুত লাগে ছবির,মেয়েটা কাদে কিন্তু কখনওই শব্দ হয়না। কেউ তাকিয়ে না দেখলে বুঝতেই পারবেনা যে ইনি আদৌ কাঁদছে।
স্পটের সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাব্যর দিকে। কাব্যর রাগ সম্পর্কে তারা একটু হলেও অবগত৷ ছবিকে ঠিক কি কি বলবে সেই অপেক্ষায় আপাতত তারা সবাই। কিন্তু কাব্য কিছু না বলে ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। আর সাথে তার ভ্রু গুলোকে সঙ্কুচিত করে। হয়তো কিছু পর্যবেক্ষন করছে।
অনেক ক্ষন ধরে কাব্যর দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে মাথা তুলে তাকালো ছবি। কাব্যকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অশ্রুসিক্ত চোখে কাব্য কে একবার দেখে নিলো সে,,,, তাৎক্ষণিক চোখ পাকিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা ধরলো সামনের দিকে।
ছবির এমন কার্যে চমকিত হয়ে গেলো ইরফান।
— দেখলি কাব্য?? মেয়েটার কি সাহস। কাউকে তোয়াক্কা করেনা এমন এটিটিউড নিয়ে চলে।
ইরফানের এমন কথায় কিছুটা হাসলো কাব্য। ইরফানের দিকে খানিকটা ঝুকে এসে গলার স্বর আস্তে করে নিয়ে বলে উঠলো……..
— এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? সুন্দরী মেয়েদের রাগ ঢাক একটু বেশিই থাকে… এটাতো আমার থেকে তোর ভালো জানার কথা।
কিছুদিন সময় দে। দেখবি নিজেই গায়ের ওপর হুমড়ি খাবে।আফটার অল ইউ আর ইরফান রাহমান….!!
কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কাব্যর সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো ইরফান।
— ব্যাপারটা আমি দেখছি দাড়া।( কাব্য)
🍁
🍁
🍁
🍁
🍁
🍁
🍁
নরম ঘাসের ওপর পা গুটিয়ে বসে আছে ছবি। খানিক বাদে বাদে চোখ মুছছে সে। সেই তখন থেকে এক মুহুর্তের জন্যেও কান্না থামেনি তার।
আজ এতোটা অপমানিত হওয়াও লেখা ছিলো ভাগ্যে?? এত জঘন্য কোনও পাপ করেছিলো কি? যার শাস্তি এভাবে পেতে হচ্ছে??
কিছুক্ষন বাদে নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ছবি। কাব্য এক পার্শ্বিক ভাবে ঠোঁট বাকিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কখন এসেছে,,,,আর এভাবে পাশে বসেছেই বা কখন,,, সেসব কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি ছবি।
— কাঁদছেন??
কাব্যর এমন কথা ছবির নিকট একটু নয় বেশ অনেকটাই কৌতুকের মত মনে হলো।
মুহুর্তেই রাগীভাব চেহারায় ফুটিয়ে তুলে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো সে।
ছবির এমন কাজে মুচকি হেসে উঠলো কাব্য। দুহাতে মাটিতে ভর দিয়ে নিজেকে আর একটু এগিয়ে নিলো ছবির দিকে।
— আমি জানি আপনার আমার ওপর রাগ হচ্ছে।ভীষণ রকম রাগ হচ্ছে। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। ইরফান এভাবে টাচ করলো আপনাকে আর আমি কিছুই বললাম না।
কথাটা শুনেই কাব্যর দিকে ফিরে তাকালো ছবি।
— আপনি কি এখন জখমে লবন মাখানোর জন্যে এসেছেন মিস্টার রেয়ান??
— নাহ,,,জখমের মলম নিয়ে এসেছি।
— মানে??
— মানে হলো আজকের এ সব কিছুই আমি ইচ্ছে করে করেছি। চাইলেই আমি ইরফানের ওমন ব্যাড টাচ আপ থেকে আপনাকে মুক্ত রাখতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি। একচুয়েলি করতে চাইনি।
কাব্যর এমন কথায় আশ্চর্যকিত ছবি।
ছবির এমন দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে কাব্য নিজেই বলে উঠলো….
— ইরফানের সংস্পর্শে আপনার খুব খারাপ লেগেছে তাইনা???
— সেটা মেয়ে হলেই বুঝতেন।
— যাক সৌভাগ্যক্রমে যখন ছেলে হয়েই গিয়েছি তখন তো আর বুঝতে পারলাম নাহ। তবে
আপাতত আপনাকে যে ইরফানের ধারেকাছেই থাকতে হবে মিস ছবি।
পুনরায় বিষ্মিত হলো ছবি। কাব্যর এসব রহস্যময় কথার অর্থ পুরোপুরি মাথার ওপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে তার।
— আপনি কি বলতে চাইছেন মিস্টার রেয়ান??
— মিস ছবি আপনি কি জানেন?? আপনার বোন আরাবির সাথে ইরফানের একটা গভীর সম্পর্ক ছিলো??
— কিহ??এসব আপনি কি বলছেন??
— একদম ঠিক শুনেছেন। দে ওয়্যার ইন আ ভেরি ডিপ রিলেশন শীপ,,বাট কতোটা ডিপ সেটা আমি জানিনা।
— কক্ষনও না,,,,আমার বোন ওরকম একটা লোকের সাথে??…এসব আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনা।
— কিন্তু আপনার বিশ্বাসে যে কিছুই আসে যায়না মিস ছবি রাহমান। যেটা ঘটার ছিলো সেটা ঘটে গিয়েছে।
এনি ওয়ে,,,,আই থিংক আরাবি কোথায় সে ব্যাপারে ইরফান অবগত।
— সত্যি বলছেন? তাহলে চলুন ওনার থেকেই জেনে নেই আমরা।( উত্তেজিত হয়ে)
— আপনি সত্যিই বড্ড বোকা। আপনি জিজ্ঞেস করলেই ও বলে দেবে?? অদ্ভূত। হয়তো ও আরাবিকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে?
— উনি কেনো আরাবিকে লুকিয়ে রাখতে যাবেন? এতে ওনার কি লাভ??
— সেটাও একটা কথা। এমন ও হতে পারে যে আরাবিই লুকিয়ে আছে। আর এতে ইরফানের সহযোগিতা রয়েছে।
— আপনি এতোটা নিশ্চিতভাবে কি করে বলছেন?? আপনার কথা অনুযায়ী মেনে নিলাম ওদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো,,কিন্তু তাই বলে ওর নিখোজ হওয়ায় ওই লোকটা জড়িত এরকমটা নাও হতে পারে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমরা কাউকে ব্লেম দিতে পারিনা।
— মিস ছবি,,,, কাব্য রেয়ান কখনও হাওয়ায় ওড়ানোর মত কথা বলেনা। যা বলে ভেবেচিন্তে তার পরেই বলে। আপনার থেকে দুনিয়াটা আমি একটু বেশিই দেখেছি। শুধুমাত্র আন্দাজের বশে কথা গুলো আমি বলছিনা।
— তাহলে??
— নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনও কারণ রয়েছে।
তবে সেসব আমি আপনাকে এক্ষুনি বলতে পারবোনা।
— তবে?? কিভাবে জানবো আমার বোন কোথায়??
— সেটার জন্যে একটা কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আর ওসব আপনি করবেন।
— আমি?( অবাক হয়ে) আমি কি করবো??
মানে,,কি করতে হবে আমাকে??
— ইরফানের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে হবে। আই মিন,,,, ওর পাশাপাশি থাকতে হবে,ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে,,,
সব সময় ওকে দেখলেই যে নাক মুখ কুচকে ফেলেন এটা তো একদম ই করা যাবেনা। মোট কথা ইরফান কে আপনার বশে নিয়ে আসতে হবে। তারপর বুদ্ধি দিয়ে আরাবির কথা জেনে নিতে হবে,,
ইরফান টার মেয়েদের প্রতি যা দূর্বলতা,,,একটু পটাতে পারলে একেবারে সব উগড়ে দেবে।যদিও ব্যাপারটা একটু টাফ আপনার জন্যে। কারণ আপনি তো লজ্জ্বাবতি লতা একেবারে…….!!
তারপরেও,,,,বোনের জন্যে এটুকু কষ্ট করতে পারবেন না ??
— কিন্তু উনি খুব বাজে একটা লোক। ওনার আশেপাশে থাকা কি ঠিক হবে??না মানে আমি বলতে চাইছি…..
— বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাইছেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন,,,,এই কাব্য রেয়ান না চাইলে কেউ আপনার গায়ে স্পর্শ করতে পারবেনা। শুধুমাত্র আমি ছাড়া।
— আপনি ছাড়া?? মানে???
— আই মিন,,,আমি আপনার কো-আর্টিস্ট। একই সিনেমায় কাজ করছি তাও হিরো হিরোইনের রোল নিয়ে,,,,তখন মুভিতে একটু আকটু রোমান্টিক সিন তো থাকবেই। যেরকম টা আজ ছিলো,,,তো এর জন্যে আমার আপনাকে টাচ তো করতেই হবে তাই নয় কি..??
— ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে,,,
— হুম। তো এবার বলুন,,পারবেন?? যা যা বলেছি সেগুলো করতে??
বেশ কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে কাব্যর কথায় মাথা দোলালো ছবি,,,
— মাথা নেড়ে নয়,মুখে বলুন।
— হ্যা রে বাবা পারবো।
— গুড। তবে আজ থেকেই স্টার্ট…. না আজ নয়,আজ হলে ইরাফানের সন্দেহ হতে পারে। কবে থেকে শুরু হবে,,, সময় টা আমিই জানিয়ে দেবো আপনাকে।
— ঠিক আছে।
— তবে এবার চলুন।
বেশ উচ্ছাস নিয়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো ছবি কাব্য দুজনেই। কাব্যর আগে সামনে হাটা ধরলো ছবি। কিন্তু পা বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে ধরতেই পেছন থেকে এক হাত টেনে ধরলো কাব্য।
অনেকটা হকচকিয়ে পিছু ফিরলো ছবি। ছবির বিষ্ময়ের পরিমান আরো বাড়িয়ে দিতে হেচকা এক টান মেরে ছবিকে নিজের দিকে নিয়ে এলো কাব্য।
আকষ্মিক এমন কারণে হুমড়ি খেয়ে কাব্যর বুকে এসে পরলো ছবি। আবারও একরাশ চমক উপহার দিয় ছবিকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিজের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিলো কাব্য।
মুহুর্তেই এক ঠান্ডা শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়ে গেলো ছবির সমস্ত শরীর জুড়ে।
অন্যরকম অনুভূতি মিশ্রিত স্পর্শ খেলে গেলো তার শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায়,,,,,প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
চলবে,,,,