#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_৯
Tahrim Muntahana
আতইয়াবের হসপিটালে আজ মানুষের ভিড়। যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই কালো শার্ট পড়া গার্ড দাড়ানো। আতইয়াব বিরক্ত হয়ে কেবিনে বসে আছে। সেই যে সকালে এসেছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার উপক্রম কেবিন থেকে বের হয়নি। হৃদান চৌধুরীকে দেখলেই তার শত শত খুনের কথা মনে হয়। কত নিষ্ঠুর ভাবে একেকটা খুন করে তার চিত্র নিজের চোখে ভাসে। নক পড়লো দরজায়। বিরক্ত হলো আতইয়াব। তবুও বিরক্তি ভাব মুছে মুখটা গম্ভীর করে অনুমতি দিলো। লোকটি ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসলো পায়ের উপর পা তুলে। আতইয়াব নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। লোকটি মুচকি হেসে বলল,
‘ডক্টর আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ দেখছি খুব আপসেট।’
আতইয়াব ফট করে মাথা তুলে হৃদান কে দেখতেই দাড়িয়ে গেলো। রাগ লাগে তার এই মানুষটাকে দেখে। আতইয়াবের দাড়িয়ে যাওয়া দেখে বাঁকা হাসলো হৃদান। আতইয়াব নিজেকে গম্ভীর রেখে বসে পড়লো। হৃদান ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,
ভয় নাকি অবাক মি. ডক্টর?
আতইয়াব ভ্রু কুচকালো। আজ হৃদান কে অন্যরকম লাগছে। হৃদান চৌধুরীর সাথে ঠাট্টা জিনিসটা যায় না। কিন্তু আজ হৃদান চৌধুরী তার কেবিনে এসে তার সাথে ঝগড়ার মুডে কথা বলছে। স্ট্রেন্জ! আতইয়াব কথা বলছে না বলে হৃদান আবার বলে উঠলো,
হোয়াট এভার মি. ডক্টর আমি আপনাকে থ্যাংকস এন্ড সরি জানাতে এসেছি।
আতইয়াব চমকালেও ভাবটা প্রকাশ করলো না। সে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে। আতইয়াবের এমন ডন্ট কেয়ার ভাব হৃদানের কেন জানি ভালো লাগলো। রাগ হলো না। তার জীবনের সাথে জড়িত সবাইকে স্ট্রং থাকতে হবে; বউ তো মাশাআল্লাহ তাকেও হার মানায়! বড় শালা হবে না কেন? মুচকি হাসলো হৃদান। এবার আতইয়াব চমকালো। হাসি! আতইয়াব বলে উঠলো,
হৃদান চৌধুরী চেন্জড! হাউ পসিবল?
ইয়াহ, ইটস পসিবল! দেট মিনস মেবি সামথিং হেপেন্ড! বাট হোয়াট হেপেন্ড? উমমমমম ওয়ান ডে ইউ উইল ডেফেনেটলি ক’নো হোয়াট হেপেন্ড ফর হুইচ হৃদান চৌধুরী চেন্জড! আ’ম শিউর ইউ উইল বি মস্ট সারপ্রাইজড দেট ডে। আ’ম ওয়েটিং! সেদিন ই তো আমার জীবনের সব থেকে সেরা জয়টা হবে!
আতইয়াব জাস্ট স্পিচলেস। হৃদান চৌধুরী অনায়েসেই এত কথা তার সাথে বলছে, আবার নিজের পরিবর্তন নিয়ে এত খুশি! তাকে ভাবাচ্ছে; তার সাথে হৃদানের পরিবর্তনটা মেলাতে পারছে না সে। সে জানে হৃদান চৌধুরী কখনোই কারো কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করে না। তাই আর প্রশ্ন না করে বলল,
আ’ম অলসো ওয়েটিং ফর দেট ডে। দ্যা মেটার সিমস ডিফাল্ট!
মুচকি হেসে হৃদান আতইয়াবের সামনে একটা গিফট বক্স তুলে ধরলো। আতইয়াব বিরক্ত হলো। টাকাওয়ালা মানুষরা এসব ছাড়া কিছু পারে না। তার ও তো কম টাকা নেই সেতো এমন টাকার গরম দেখায় না। কিছু বলবে তার আগেই হৃদান বললো,
ভুল ভাবার কিছু হয়নি। উপর টা দেখেই ভেতর টা বিবেচনা করবেন না। আপনি আমাকে আমার জীবনের একটা অংশ ফেরত পাওয়ার মাধ্যম দিয়েছেন। বারো টা বছর আমি অপেক্ষা করেছি। শুধুই অপেক্ষা। আজ অপেক্ষার অবসান একটু হলেও হয়েছে। তাই সামান্য কিছু!
হৃদান আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাড়ালো। এখানে থাকলেই কথা বাড়বে। আর আতইয়াব সে তো নিজের চোখ আর কানকেই বিশ্বাস ই করতে পারছে না। লোকটির সাথে হৃদানের সম্পকই বা কি? কিসের জন্য এত বছর ধরে অপেক্ষা করছে সে? গিফট বক্সটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো সে। কি থাকতে পারে এতে? টাকা থাকলে হৃদান চৌধুরীকে কিভাবে উচিত জবাব দিতে হয় সে ভালোয় জানে। তাই ঝটপট বক্সট টা খুললো। খুব সুন্দর একটা ধূসর রঙের ফুলদানি যেখানে আতইয়াব নাম লিখা আছে। তার পাশেই সুন্দর দুটি লাভ সেইফ শোপিস! প্রথমটির সাদা,কালো, নীলের মিশ্রণে; দ্বিতীয়টি কালো, সবুজের মিশ্রণে। দুটো শোপিসের একদম নিচে আদর এবং তারিম নামটা খোদাই করে লিখা। আতইয়াবের চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার কাছে গিফট খুব ভালো লেগেছে। ভালো লাগার মতোই। ইমিডেটলি ওর্ডার দিয়ে করিয়েছে তাও বুঝলো নাহলে নেইম লেখা থাকতো না। আর সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে হৃদান ওদের পছন্দের রং সম্পর্কে কেমন করে জানলো। পরে ভাবলো হৃদান চৌধুরী দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব নয়!
তারিমকে দেওয়া শোপিসটা হাতে তুলে নিলো আতইয়াব। যেখানে সবুজ রঙের গ্রাউন পড়ে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। যাকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে ধূসর রঙের জ্যাকেট পড়া একটি ছেলে। গভীর ভাবে দেখছে আতইয়াব। তার মনে হচ্ছে ভেতরে দুজন কপোতকপোতি আর কেউ না সে আর তারিম! এমন মনে হওয়ার কারণ সে ধরতে পারলো না। বাট সে এতটাও অবুঝ নয় যে মনের অনুভূতি সম্পর্কে বুঝবে না। সে বুঝতে পারে তারিমের জন্য তার মনের কোণে সফট একটা অনুভূতি রয়েছে। যা আজ থেকে না ; অনেক বছর ধরে। মাঝখানে অর্ণাবি নামক মেয়েটা এসে অনুভূতিটাকে চাপা দিয়ে দিয়েছে।
ভাবলো আজ বোন আর বউ কে নিয়ে ঘুরতে যাবে। অনেকদিন হলো একান্তে সময় কাটানো হয়না। বের হয়ে এলো কেবিন থেকে। আবার ও চোখে পড়লো হৃদানের গার্ডদের। এবার আতইয়াবের বিরক্তি বা রাগ হলো না। সে একটু হলেও বুঝতে পেরেছে এত গার্ড এমনি এমনি রাখেনি। হয়তো বিশাল কারণ আছে। আর হৃদান চৌধুরীর তো শত্রুর অভাব নেই। প্রকাশ্যের থেকে গোপনে বেশী!
বাসায় পৌঁছাতে লাগলো ৩০ মিনিট। এখন বাজে বিকাল ৪:৩০। বাড়িতে পৌঁছেই দেখলো দুজনে মিলে টিভি দেখছে। রোমান্টিক মুভি! আতইয়াব কে এসময়ে দেখে ওরা দুজন ই অবাক হলো।
হাতে গিফট বক্স দেখেই আদর লুফে নিলো আতইয়াবের হাত থেকে। এত সুন্দর গিফট দেখেই আদরের চোখ ভরে গেছে। আতইয়াব যখন জানালো হৃদান দিয়েছে। আদর যত্ন করে নিজের জন্য দেওয়া গিফট টা ছুঁয়ে দিলো। যেন সে হৃদান কেই ছুঁয়ে দিচ্ছে। তারিমের ক্ষেত্রে অনুভূতিটা অন্যরকম ছিলো! গিফট গুলো একপাশে রেখে টিভিতে মন দিলো ওরা। বেশী অভার ইমোশনাল হলে সমস্যা!
আতইয়াব নিজের রুমে যেতে যেতে বলল,
তাড়াতাড়ি রেডি হও দুজন। আজ ঘুরতে যাবো।
ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনেই আদর লাফিয়ে উঠলো। কিসের মুভি, মুভি দেখা বাদ। কিন্তু তারিমের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে এক ধ্যানে মুভি দেখেই যাচ্ছে। একদম ডুবে আছে মুভিতে। এই মুভিটা তার খুব প্রিয়। কিস মোমেন্ট দেখার আগেই আতইয়াব ঠাস করে টিভিটা অফ করে দিলো। তারিম রেগে তাকাতেই আতইয়াবের মুখে দুষ্টু হাসি দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই লোকটার যে কি হয়েছে কে জানে। দুদিন ধরে কেমন কেমন করে লোকটা। প্রেমিকা হারানোর শোকে পাগল হলো নাকি! শেষমেষ তাকে পাগলের সাথে সংসার করতে হবে? তারিম নিজের আবুল তাবুল ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলো যে আতইয়াব যে তার একদম কাছে চলে এসেছে টের ই পায়নি। আতইয়াব তারিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
রোমান্টিক সিন টিভি তে দেখার থেকে ক্রিয়েট করার বেশী মজা। অনুভূতিটাও তুখোড়। একদম যেন সারা শরীর শিরশির করে। হৃদপিন্ডটা দ্রুত গতিতে লাফাতে শুরু করে। শিরায় উপশিরায় অনুভূতিটা মিশে যায়। মুভিতে কি এতকিছু হয়। তো মিসেস আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ রোমান্স কি একটু হবে? নাকি রেডি হওয়ার তাড়া আছে?
আতইয়াবের কথা মতোই তারিমের সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। এ কেমন অনুভূতি! আতইয়াব যে তাকে ইনডাইরেক্টলি থ্রেট দিচ্ছে তাও বুঝতে পারছে কিন্তু নড়ার শক্তি টুকু সে পাচ্ছে না। ঘাড়ে এখনো আতইয়াবের নিশ্বাস বিচরণ করছে। তত বার কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। আতইয়াব তারিমের অবস্থা বুঝে বাঁকা হেসে আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলো। দুজনের শরীরের মধ্যে ফাঁকা নেই। লেপ্টে আছে দুজনে। তারিম শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। আতইয়াব দুষ্টুমির সুরে বলে উঠলো,
রোমান্স শুরু করবো নাকি রেডি হতে যাবি!
এক দৌড়ে তারিম নিজের রুমে চলে গেল। এখন সে আতইয়াবের সাথে থাকে না। যদিও আতইয়াব আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো তারিম কে মানাতে কিন্তু তারিম প্রচন্ড জেদি। আতইয়াব কে হার মানতে হয়েছে। তারিমের দৌড় দেখে আতইয়াব শব্দ করে হেসে দিলো। নিজেও রুমের দিকে হাটা ধরলো। ফ্রেশ হতে হবে তাকে।
সিড়ির পেছনে আদর মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। এতক্ষণ লুকিয়ে দেখছিলো সবকিছু। তার ভাই যে এত রোমান্টিক সে ভাবতেও পারেনি। কামাল করে দিয়েছে।এই ট্রিকটা কাজে লাগাতে হবে তার। নাহলে তার ক্যাবলাব্রিটিশ কে চমকে দিবে কি করে! নাচতে নাচতে রেডি হতে গেলো আদর।
কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে হৃদান। রিসিব করার নাম ই নেই। তবুও হৃদানের রাগ হচ্ছে না। এতটা ধৈর্যশীল সে কি করে হলো! সে জানে যে মেয়েটার প্রেমে সে ডুবেছে সে একটা বাচ্চা। তার থেকে বেশী এক্সপেক্টেশন সে রাখে না। সে নিজের মতো করে গভীর ভাবে ভালোবেসে যাবে ওই মেয়েটিকে। আদর না হয় একটু কম ই বাসলো। তার সাথেই থাকুক শুধু। দেখে দেখে জনম কাটিয়ে দিতে পারবে সে।
বাহ! হৃদান চৌধুরী দেখছি সেই লেভেলের প্রেমিক হয়ে গেছে। প্রেমিকার নম্বরে ফোন দিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।
শান্ত ভঙ্গিতে পাশে তাকালো হৃদান। পিয়াস এসেছে। তার মুখে অবাকতা। হৃদান হাসলো। পিয়াস আর অবাক হতে পারলো না। দেখা যাবে এত অবাক হতে হতে সে হার্ট এট্যাক করে বসবে তখন তার হানিমুনে যাওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হবে না। এই স্বপ্নটা পূরণ না হলে সে মরেও শান্তি পাবে না! কিন্তু হানিমুনে কি একা যাবে সে? একটাও প্রেম করতে পারলো না আজ পযর্ন্ত। ছ্যাহ ছ্যাহ! এ মুখ দেখানো যায়? মানুষ ভাববে তার মাঝে কোনো ফিলিংস ই নেই। কিন্তু তা না তো। ফিলিংস সব যে সে বস্তায় বন্ধি করে এই বাড়িতে রেখে যায়। হাহ কপাল কবে যে প্রেম করবে সে, কবে যে বিয়ে করবে! কবে হানিমুনে যাবে! এসব ভেবেই দুঃখী মনে বলে উঠলো,
হৃদান চৌধুরীও প্রেম করছে আর এই রোমান্টিক বয় পিয়াস! এ মুখ কাকে দেখাবো। কতদিন ধরে আয়না দেখি না লজ্জায়। ছি ছি!
হৃদান বিরক্ত হলো। এই ব্যাটা নিজেই মেয়েদের দেখেলে দূরে থাকে আর ঘরে বসে সারাদিন ই বিয়ের করার চিন্তা করে। তার নাকি মেয়ে দেখলেই মা মা লাগে। হৃদান কিছু বললো না সে একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে আদর কে। আদর কেবল ঘরে এসে দাড়ালো। আলমিরা তে গিয়ে দেখতে লাগলো কোনটা পড়বে সে। তখন ই ফোনের আওয়াজ আসতেই খুঁজতে লাগলো ফোন। কোথায় রেখেছে মনে হয়। অবশেষ রিংটন অনুসরন করে দেখতে পেলো তার স্টাডি টেবিলের একটা বইয়ের নিচে রেখে দিয়েছে। ফোনটা হাতে নিতেই কেটে গেলো। কল লিস্ট চেক করেই আদরের হাত আপনাআপনিই মাথায় চলে গেলো। ৫২ মিসড কল উঠে আছে তাও একটা নম্বরে। আমার ক্যাবলাব্রিটিশ দিয়ে সেইভ করে রেখেছে হৃদানের নম্বর। আবার ফোন বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি করে রিসিব করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,
কোথায় ছিলে?
আসলে নিচে ছিলাম। মুভি দেখছিলাম। সরি সরি ফোনটা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।আপনি কি রাগ করেছেন? রাগ করলেই আমার কি? আচ্ছা আপনি কি সত্যিই রাগ করেছেন? রাগ করলেই বা কি করার আছে। আমি কি জানতাম আপনি এই সময়ে ফোন দিবেন। আপনাকে আমি ক্যাবলাব্রিটিশ এমনি এমনি ডাকি। ঠিক এই কারণেই ডাকি। সব কাজ ই আপনার ক্যাবলাব্রিটিশদের মতো। কখন কি করতে হয় আমার কাছে শিখবেন। কিছুই তো পারেন না দেখছি। আপনাকে ট্রেনিং দিতে হবে বুঝেছি। চিন্তা নেই একবার যখন এই আদরের হাতে পড়েছেন মানুষ করেই ছাড়বো!
হৃদান হা করে আদরের কথা শুনছে। রাগ দেখানোর কথা ছিলো তার উল্টো মেয়েটি তাকে রাগ দেখাচ্ছে। আর সে কি ভুল সময়ে ফোন দিয়েছে নাকি। এই বিকেলে কম বেশী সবাই ফ্রি থাকে। তাই তো ভাবলো একটু কথা বলা যাক। মানুষ করবে! মানে হৃদান চৌধুরী এখনো মানুষ হয়নি! এ কার সাথে প্রেম করে সে! না সে তো প্রেম করেনা ভালোবাসাবাসি করে। তার যে জীবনভর এসব সহ্য করতে হবে বুঝতে পারলো সে। পরক্ষণেই আদরের বাচ্চামো কথা শুনে জোরে হেসে উঠলো।
মেয়েটি জাদু জানে। গম্ভীর হৃদান চৌধুরী তুচ্ছ কারণেও হাসে এখন! আদর নিজেও হেসে উঠলো। সে সবকিছুই বুঝে। এমন না যে বুঝে না। সে এরকম থাকতে কমফোর্ট তাই বেশী বড় বড় ভাব তার মাঝে নেই। সে ভালো আছে, ভালো থাকবে, এমন ই বাচ্চাই থাকবে সারাজীবন। আদর হাসি থামিয়ে বলল,
আচ্ছা শুনুন। আমি এখন ঘুরতে যাচ্ছি। আমি না আমরা! ভাইয়া তারিম সুবাহ ফালাহ ভাইয়া সবাই। এখন রাখছি রেডি হবো। টাটা! আর গিফট টা আমার জীবনে সেরা প্রাপ্তির মধ্যে একটি!
কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে দিলো। আদর যে ঘুরতে যাওয়ায় বেশ খুশি হৃদান বুঝতে পারছে। তাই আর বিরক্ত করলো না। তার ও কাজ আছে এখন। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পিয়াস এখনো বসে আছে। আগের মতো রসিকতার মুখ নেই; মুখটা গম্ভীর! হৃদান পিয়াসের দিকে তাকাতেই বলল,
মুখ খুলেছে। নাম বলেছে এমপি হাসান শিকদারের! এখন দেশের মধ্যেই আছে। বাট কোথায় আছে কেউ জানেনা। হয়তো বুঝতে পেরেছিলো এমন টাই হবে তাই তো আগেই নিরুদ্দেশ।
হৃদান তখনো শান্ত। পিয়াস জানে হৃদানের শান্ত ভঙ্গি অনেক কিছু ঘটাতে সক্ষম। কিছুক্ষণ ভেবে হৃদান বলল,
ছেলে কোথায়? দেশের বাইরে যায়নি সেটা নিশ্চিত!
পিয়াস মাথা নেড়ে সায় জানালো। রেডি হয়ে ড্রয়ার থেকে রিভলবারটা সামনের পকেটে নিয়ে বের হয়ে গেলো হৃদান। পিয়াসের বা কি করা সেও ছুটতে লাগলো হৃদানের পিছু। আজকে বড় কিছু হবে সে জানে!
রাত ৮ টা বাজে। আদর রা একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। আতইয়াব-তারিম, ফালাহ-সুবাহ, পরশ-রাইসা, আদর-রোহানি এই ৮ জন একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে। ডিনার করেই বাড়ি ফিরবে সবাই। হালকা আড্ডা চলছে। রেস্টুরেন্ট টিতে তেমন মানুষ নেই। দু একজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসানো। আতইয়াবের চোখ পাশের দুই টেবিলে যেতেই অবাক হলো সে। ফালাহ কে ইশারা করে দেখাতেই ফালাহ’ও অবাক হলো। দুজন উঠে দাড়িয়ে সেদিকে হাটতে লাজলো। আদর ওরা কি হলো কিছুই বুঝলো না।
পাশের দুই টেবিল পরেই তিনজন ছেলে দুটো মেয়ে বসে আছে। আতইয়াব ফালাহ গিয়ে একটা ছেলের পিঠে মারতে লাগলো। ছেলেটি প্রথমে চমকে উঠলেও পেছনে তাকিয়ে ভার্সিটি বন্ধুদের থেকে অবাক হলো। খুশিতে জড়িয়ে ধরলো দুজন কে। আতইয়াব বলে উঠলো,
নিয়ান তুই দেশে এসেছিস কবে? একবার ও জানালি না শা ** লা!
নিয়ান হেসে বলল,
বেশী দিন হয়নি। এই তো কয়েকটা দিন। ব্যস্ত ছিলাম খুব। হসপিটালে যেয়ে চমকে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি। কেমন আছিস বল?
তিনজনে হেসে হেসে কথা বলতে লাগলো। অনেক পুরোনো বন্ধু। নিয়ান হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
বিয়ে করেছিস শুনলাম দুজনে। ভালোয় চলছে তাহলে? তা তোর বোন মিষ্টু টা কেমন আছে?
আতইয়াব হেসেই বলল,
হ্যা বিয়ে নামক ফাঁদে আটকে পড়লাম আরকি। আদর ভালো আছে। চল কথা বলবি ওরা ওই টেবিলে বসে আছে।
নিয়ান ফট করে সেদিকে তাকলো। মেয়েটিকে কত দিন পর দেখবে। ভালোবাসে আদরকে সে। কিন্তু সাহস করে বলে উঠতে পারেনি। তাড়াতাড়ি হাটা দিলো সেদিকে। আদর বিরক্ত হলো নিয়ান কে দেখে। কেমন করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা। আদর নিয়ানের নাম দিয়েছিলো কুমড়া। কুমড়া তার জঘন্য লাগে ; যেমন এই ব্যক্তিটি। তাই তো এই নাম। সবাই মিলে আড্ডা দিলেও আদর চুপচাপ ফোন দেখছে। তার মনটা আকুবাকু করছে হৃদানের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সবার মাঝে কথা বলা যাবে না। তার ভাই যদি টের পায় তাহলে তো হলোই। আদরের মন খারাপ হয়ে গেলো। ভফিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে সে জানে না। তার ভাই যে হৃদান কে একদম পছন্দ করে না এটা সে জানে। তাই তো ভয় হয়। সে তো ওই মানুষটাকে ভালোবাসে। অন্যমনষ্ক হয়ে ভাবছিলো এসব। দরজার কাছে চোখ যেতেই হৃদান কে দেখে আদর চমকালো। প্রচন্ড রেগে আছে হৃদান। চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তারিমের হাত চেপে ধরলো সে। ভয় পাচ্ছে আদর। কিসের জন্য রেগে আছে কে জানে? তারিম ও ভয় পেলো। যদি সরাসরি আদরের সামনে আসে ভয়ংকর এক কান্ড হবে এখানে। তার বর টা তো আরেক মফিজ! হৃদান আদরদের টেবিলের দিকেই আসছিলো। তার আশেপাশে কোনো খেয়াল নেই। পিয়াস ঢুকেই রেস্টুরেন্ট তালা মেরে চাবি নিজের কাছে রাখলো। গার্ডদের ইশারা করতেই তারা তাদের প্ল্যান মতো কাজ করতে লাগলো। আদর দের টেবিলের কাছে এসেই হৃদান নিয়ানের কলার চেপে ধরলো। বাকি সবাই চমকে উঠলো। আতইয়াব ফালাহ এগিয়ে যাবে তার আগেই হৃদান রক্ত লাল চোখ দেখে থেমে গেলো। তারা এসব পরোয়া না করলেও এখানে শুধু তারা নেই। তাই চুপ থাকায় শ্রেয়!
নিয়ান নিজেও চমকে গেছে হৃদান কে দেখে। বাট সে বুঝতে পারছে না তার সাথে হৃদানের কি হলো! আর আদর তো ভয়ে একদম জমে গেছে। সে মনে করছে হৃদান বুঝি তার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য এমন করছে। কি হবে এখন। ভেবেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। হৃদান একপলক সেদিকে তাকালো বাট তার মুডের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে জানতো না আদর রা এখানে আছে।ছক কষানো টা ভুল হয়েছে। বাট কিছু করার নেই। নিয়ান কে টেনে নিয়ে রেস্টুরেন্টের মাঝখানে বসালো। ইতিমধ্যে মাঝখানের সব চেয়ার টেবিল সরানো শেষ। নিয়ানের সামনে হৃদান ও বসে পড়লো। গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,
হোয়ার ইস হাসান শিকদার?
নিয়ান বুঝলো শত্রতা তার বাবার সাথে। আদর হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি ভেবেছিলো সে। আদর আরাম কে চেয়ারে পা তুলে বসলো। আজকে সে ক্যাবলাব্রিটিশের পারফরম্যান্স দেখবে। মারামারি দেখতে তো তার ভিষণ ভালো লাগে। আতইয়াব বোনের কান্ডে বিরক্ত হলো। সে ভেবেছিলো চলে যাবে কিন্তু বোনের বসা দেখেই বুঝেছে তা এখন কোনো কালেই সম্ভব না। তাই দাড়িয়ে চুপচাপ দেখতে লাগলো। রেস্টুরেন্ট টিতে হৃদানের গার্ডে ভরপুর। নিয়ানের গার্ড দের ও আটক করেছে তারা। নিয়ান হেসে উঠলো। তার কাছে জিজ্ঞেস করছে হাসান শিকদার কই! সে কি জানে নাকি? তার সাথে তার বাবার তো ফরমালিটির সম্পর্ক। নিয়ান কে হাসতে দেখে হৃদান ভ্রু কুচকালো। নিয়ান কিছু ক্ষণ হেসে বলল,
হাসান শিকদার কোথায় সেটি আমার জানার কথা না। কারণ তার কোনো ব্যাপারেই নিয়ান থাকে না। আমাকে ধরেও হাসান শিকদার কে পাবেন না। কারণ তার কাছে আমার বাঁচা মরা কিচ্ছু না। সো ইউর টাইম লস!
হৃদান বাঁকা হাসলো। সে একদম ফুলফিল প্ল্যান করেই এসেছে। হৃদান বলে উঠলো,
কল হিম ইমিডিয়েটলি।
নিয়ান ফোন বের করে কল লাগালো। প্রথম রিং এ কেটে গেলেও দ্বিতীয় বার দেওয়ার সাথে সাথে ধরলো। নিয়ান বলে উঠলো,
কোথায় আপনি?
হৃদান পিয়াস কে ইশারা করতেই পিয়াস ঝটপট হাসান শিকদারের লোকেশন ট্রেক করে ফেললো। সাথে সাথেই কিছু গার্ড নিয়ে বের হয়ে গেলো। হাসান শিকদার বেশী দূরে না। কাছাকাছিই লুকিয়ে আছে। যাতে কেউ ভাবনাতেও না আনতে পারে যে সে এখানে আছে! হৃদান বাঁকা হাসলো। নিয়ান কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিলো। পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে হৃদান। নিয়ান নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। কি এমন করেছে হাসান শিকদার বুঝতে পারছে না।
দরজা খোলার শব্দে সবার চোখ ই সেদিকে গেলো। আতইয়াব জোরে বলে উঠলো,
মি. হৃদান চৌধুরী আপনি যা ইচ্ছে করেন বাট আমাদের যেতে দিন। আপনার এসব নাটক দেখতে আমি রাজি না।
হৃদান কিছু বললো না। পিয়াস কে শুধু ইশারা করলো। আবার তালা মারলো সে। আতইয়াব রেগে বসে পড়লো। হাসান শিকদার হৃদান কে দেখেই কাঁপাকাঁপি করছে। তার যে আজ মৃত্য নিশ্চিত সে জানে। হৃদান বলে উঠলো,
হোয়ার ইস মাই লিটিল সিসটার?
আদর চমকে দাড়িয়ে গেলো। আতইয়াব রাও চমকে গেছে। হৃদানের বোন আছে? কই কখনো শুনেনি তো। হৃদান কারোর দিকেই তাকালো না। আবার প্রশ্ন করে উঠলো,
হোয়ার ইস মাই সুপারহিরো? আই মিন কমিশনার আংকেল? আজ প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তোকে। নাহলে একটু একটু করে মারবো তোকে। মৃত্য যন্ত্রণায় ছটফট করবি। আর আমি হাসবো, আনন্দ পাবো!
আদর এবার বড় রকমের চমক পেলো। বুকটা তার দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। আদরের এমন অস্বাভাবিক আচরণ হৃদানের চোখে পড়তেই আতকে দাড়িয়ে গেলো সে। দৌড়ে আদরের কাছে এসেই বলতে লাগলো,
এই আন্ডাবাচ্চা, আদুপরী কি হয়েছে? এমন করছো কেন? অসুস্থ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমাকে? এমন করছো কেন? আন্ডাবাচ্চা এই আন্ডাবাচ্চা বল না কি হয়েছে?
আতইয়াব রা হৃদানের আচরণে বিস্ফোরিত। হৃদান চৌধুরীকে এমন করতে দেখে সবাই অবাক হবে। তারা তো আর জানে না সব। আদর ঢকঢক করে এক বোতল পানি শেষ করে ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ করে নিশ্বাস নিয়ে হৃদানের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো। হৃদান মনে করেছে আদরের কষ্ট লাগছে তার চোখটাও যেন ছলছল করে উঠলো। আদর বলে উঠলো,
আপনার সুপারহিরো? কমিশনার আংকেল? আপনিই কি সুপারহিরোর সুপারচ্যাম্প?
হৃদান চমকালো। আতইয়াব রা কিছুই বুঝতে পারছে না। হৃদান ভাবছে আদর কি করে জানলো এতসব? আর আদর ভাবছে অন্য কিছু! আজ অজান্তেই তার কাছে সকল কিছুর রহস্য খুলে গেলো। চোখে আকুলতা নিয়ে হৃদানের দিকে তাকিয়ে আছে আদর। হৃদান মাথা নেড়ে সায় জানাতেই আদর হৃদান কে সবার সামনেই ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো! সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুই এখন আদর-হৃদান!
কি এমন রহস্য? কিসের জন্য আদরের চোখে এত আকুলতা। কে ই বা সেই সুপারহিরো? আদরের সাথে কি সম্পর্ক এসবের? আদর ই বা কি করে জানলো এসব? সব রহস্য কি খোলাসা হবে নাকি এই রহস্যের বেড়াজালেই আটকে পড়বে সবাই?
চলবে…?
(মানুষ মাত্রই ভুল! ক্ষমা মহৎ গুন! ভুল-ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো। শুকরিয়া!)