#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_৩০
Tahrim Muntahana
হরেক রকমের লাইটের আলোয় শীতের কুয়াশ তেমন ধরা দিচ্ছে না। আনন্দের মধ্যে থেকে; শীত কে সেভাবে পাত্তা না দিয়ে যার যার কাজ করে যাচ্ছিলো সবাই। মুহূর্তেই সব বন্ধ হয়ে গেলো। একটু আগের বিয়ে বাড়ির হইচই টা আর নেই। গুমোট পরিবেশ ধারণ করেছে। সবার মুখেই অবাকতা। আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে তো হৃদানের চোখ মুখে। আদরের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফোনের দিকে তাকাতেই তার মাথা নিচু হয়ে যায়। হৃদপিন্ডটা কেমন করছে। আদরের এই না শব্দটাই হৃদানের চারপাশ অন্ধকার লাগছে। আদর তাকে সত্যিই ভুল বুঝলো? আর সে হিয়াকে এইভাবে বিশ্বাস করে ঠকলো? সে তো ভুলেই গিয়েছিলো মায়ের মেয়ে তো! কিন্তু সে কিছু বলবে না। কেন বলবে? তার প্রতি কি আদরের একটুও বিশ্বাস নেই। যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সে সম্পর্কে ভালোবাসাটাও নিছক তালবাহানা ছাড়া কিছু না। সে শেষ পযর্ন্ত দেখতে চায় আদর কাকে বেছে নেয়। তাকে? নাহ সামান্য একটা মিথ্যেকে?
হিয়ার মুখে ফুটে আছে উৎফুল্লতার হাসি। সে যেন ভেবেই নিয়েছে এই বিয়ে হবে না! আর আদর তাকে জিজ্ঞেস করবে ছবির কারণ। সে কেঁদেকেটে বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবে; আদর তার সাথে হৃদানের বিয়ে দিয়ে দিবে! জেগে যেন সে স্বপ্নটা দেখে ফেললো। নিজের ভাবনায় এতই বিভোর ছিলো যে কেউ যে তার একদম সামনে এসে দাড়িয়েছে টের ই পায়নি। যখন পেলো মুখ তুলে আদর কে দেখে চমকে দু’পা পিছিয়ে গেলো। এত তাড়াতাড়ি আদর এখানে আসলো কি করে? মুহূর্তেই মুখটা মলিন করে নিলো। আদর একপলক হৃদানের দিকে তাকিয়ে হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
এসব কি মিস হিয়া? ছবি গুলো সত্য? আপনি আর উনি এতটা কাছাকাছি?
আদরের কন্ঠে মলিনতা। হিয়া বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
ছবিগুলো সত্য আদর। আমি আর হৃদান রিলেশনে ছিলাম। তখন কার সময়ের ছবিই। নাহলে এত ঘনিষ্ঠ কেউ হয়? তাও ওইরকম পোশাকে? এখন আমাকে তার ভালো লাগেনা। বড়লোকদের একটা দিয়ে কি হয়! মধ্য থেকে আমার জীবন টা তো নষ্ট হলোই সাথে তোমার জীবনডাও হবে।
আদর তীক্ষ্ম চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার চাহনী, কথা বলার ধরনে; আদর নিজেও বাঁকা হাসলো। কিছু বলবে তার আগেই পান্চু দৌড়ে এসে বলল,
ম্যাম ওইসব ছবি সত্য হলেও এর পেছনের কারণ টা সত্য নয়। আমার কথা বিশ্বাস করো! আমি তোমাকে…
হাত উঠিয়ে পান্চুকে থামিয়ে দিলো আদর। পান্চু হৃদানের মুখের দিকে তাকিয়ে আদরের পায়ের কাছে বসে পড়লো। চমকে উঠলো সবাই। হৃদান তো দাড়িয়ে পড়েছে। পা ধরে বলে উঠলো,
আমি তোমার পায়ে পড়ি ম্যাম। আমার কথাটা একবার শুনো। আমার বস তোমাকে খুব ভালোবাসে। প্লিজ আমার বসকে কষ্ট দিয়ো না। বিয়েটা ভেঙে দিও না ম্যাম। আমার বস মরেই যাবে। প্লিজ ম্যাম আমার কথা টা শুনো। দেখো বসের মুখটা। তোমাকে হারানোর ভয়ে হৃদান চৌধুরী কেমন থমকে আছে। কত খুশি ছিলো আজকে আমার বস। এত খুশি বসকে কখনো হতে দেখিনি। এই বদ ডায়নির কথা বিশ্বাস করে আমার বসকে কষ্ট দিও না ম্যাম। দরকার পড়লে আমাকে মারো! যত থাপ্পড় দাও; নিজের রাগ কমিয়ে নাও। আমাকে যত ইচ্ছে আধা টাকু পান্চু কাকু বলে ডাকবে, টাক মাথায় হাজার বার তবলা বাজাবে তবুও বিয়ে ভেঙো না ম্যাম! বিয়ের পর আলোচনা করবে। প্লিজ ম্যাম!
কতটা বিশ্বস্ত হলে এমনটা কেউ করতে পারে! হৃদান জানতো পান্চু তার জন্য জান ও দিয়ে দিবে কিন্তু এতটা করবে সে ভাবতেও পারেনি। পান্চুর কথায় আদর হাসলো। পান্চুর গালে হাত রেখে বলল,
বসকে খুব ভালোবাসো না আধা টাকু পান্চু কাকু?
পান্চু কিছু বললো না ; ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি টুকু মুছে নিলো। আদর হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
পা ছাড় গাধা! আক্কেল পছন্দ বলতে আছে? আমি তোমার ছোট পা ধরেছো কোন আক্কেলে। বসের মতোই বেক্কল হইছো। মাথা মোটা বস, তার মাথা মোটা সেক্রেটারি! আরে তোমার বসকে বলে দাও ওই ক্যাবলাব্রিটিশের কোনো ছাড় নেই। আজীবন আমার সাথে থাকতে হবে। এএ বিয়ে হবে নাহ বলছি বলেই খুশিতে নাচার কিছু হয়নাই। আমি আদর আহমেদ এত তাড়াতাড়ি ছাড়ার পাত্রী না!
আদরের কথায় পান্চু হা করে তাকিয়ে রইলো। এখনো সে আদরের পা জড়িয়ে বসে আছে। হৃদানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। চোখের কার্ণিশে পানিটুকু সবার অগোচরে মুছে নিলো। কেউ দেখলে তার আর ইজ্জত থাকবে না। ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে, বিয়ে ভাঙার বিরহে হৃদান চৌধুরী মঞ্চে দাড়িয়ে কাঁদছে! পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়লো নিজের চেয়ারে। এখন সে পরের মুহূর্ত গুলো উপভোগ করবে! হিয়া তো চমকে আদরের দিকে তাকিয়ে আছে! আদর কি বলছে এসব? এসব বলার তো কথা না? তাহলে কি তার প্ল্যান ফ্লপ! আদর একগাল হেসে হিয়ার দিকে তাকালো। ডং করে বলে উঠলো,
আপনি কি পরোপকারী মিস হিয়া। ঠিক কবুল বলার আগে আমার হাব্বুতাব্বুর ক্যারেক্টারের সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। আপনার এই পরোপকারের পুরস্কার তো দিতেই হয়! কি দিই বলুন। উফ দাড়ান!
কথাটা বলেই আদর এদিক ওদিক চোখ বুলালো। নাহ পান্চু কোথাও নেই। হঠাৎ নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো পান্চু এখনো মাটিতে বসে হা করে তাকে দেখছে। পার্থক্য এটাই এখন আর পা ধরে নেই। পান্চুর অবস্থা দেখে আদরের হাসি পেলো বাট হাসলে চলবে না এখন। পান্চুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
চৌধুরী বাড়িতে গার্ড আছে না? ফোন দাও আধা টাকু পান্চু কাকু।
পান্চু কিছু না বুঝলেও ফোন দিলো। আদর ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। লাউড দিয়ে বলে উঠলো,
স্যারের ঘরে ঢুকেন ফাস্ট।
গার্ডটি আদরের গম্ভীর কথায় উল্টো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। হৃদানের ঘরের দিকে হাটা ধরলো। আদর পেছন ঘুরে হৃদানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
কাপড় গুলো কোথায় রেখেছেন যেগুলো পড়েছিলেন শেরওয়ানি পড়ার আগে?
হৃদান বাঁকা হাসলো। আদরের কাজ সে একটু হলেও ধরতে পেরেছে। বলে উঠলো,
সোফার উপরেই আছে। খুশিতে বেমালুম ঠিক করতে ভুলে গেছি!
আদর মিষ্টি হাসি দিলো। হৃদান বুকে হাত দিয়ে পড়ে যাওয়ার ভান করতেই আদর খিলখিল করে হেসে উঠলো। আহা আনন্দ! গার্ড কে বলে উঠলো,
কাপড় গুলোতে এখনি আগুন ধরিয়ে দিবেন। ভিডিও করে আধা টাকু পান্চু কাকু কে পাঠিয়ে দিবেন। আর ছাই গুলা শহরের বাইরে ফেলে আসবেন। ওকে লেটস স্টার্ট!
ফোন কেটে হিয়ার দিক তাকিয়ে আরেকটা হাসি দিলো। হিয়া তখন ভয়ে কাঁপছে। বেশী সাহস দেখিয়ে ফেলেছে সে এখন বুঝতে পারলো। আদর হিয়াকে এখন পাত্তায় দিলো না। সার্ভেন্ট কে ডাক দিয়ে বলল,
একটা পটে পানি, সাবান আর একটা গামলা নিয়ে আসুন। জলদি!
সার্ভেন্ট দৌড় ছুটলো সাবানের জন্য। কিছুসময় অতিবাহিত হতেই আদরের সামনে উপস্থিত করলো সরঞ্জাম গুলো। বিয়েতে উপস্থিত সবাই শুধু অবাক, হতভম্ব হয়ে দেখছে। পান্চুর হাতে সাবান ধরিয়ে দিয়ে; সার্ভেন্ট দুটো কে পানি পট ও গামলা নিয়ে তার পিছু আসতে বললো। মঞ্চে উঠেই হৃদানের দিকে চোখ রাঙিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে র ইলো। আদরের লাল চোখ দেখে হৃদান চেয়ার বসে কাচুমাচু করতে লাগলো। সারা দেশ তাকে দেখে ভয় পায় আর সে তার বউ কে দেখে ভয় পাচ্ছে! পুরুষ মানুষ আসলেই বউয়ের কাছে ভেজা বিড়াল থেকে যায়! সংসারের সুবিধার্থেই তারা বউকে ভয় পায়; কেউ কেউ হয়তো ভয় পাওয়ার অভিনয় ও করে। কিন্তু সে এখন সত্যিই ভয় পাচ্ছে। ঢোক গিলে আমতা আমতা কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই আদর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
শেরওয়ানি খুলুন!
চমকে উঠলো হৃদান। এতগুলো মেয়ের সামনে শেরওয়ানি খুলবে? ইজ্জত সব লুটে নিবে দেখছি। হৃদান হে হে করে হেসে বলে উঠলো,
কি বলছো কি আন্ডাবাচ্চা? এত তাড়া কিসের। বাসর হবে তো জমিয়ে বাসর হবে। এখানে সবাই আছে; সবার সামনে আদর করবো কি করে!
আদরের চোখ এবার বড় বড় হয়ে এলো। এ কে? হৃদান চৌধুরী তার সামনে দাড়িয়ে আছে? হতাশার শ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে গার্ডদের বলে উঠলো,
সামনে দাড়িয়ে থাকেন!
গার্ডরা তাই করলো। হৃদান তখনো হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। আদর নিজেই শেরওয়ানি খুলার জন্য হাত বাড়ালো। হৃদান তবুও পাগড়ি খুললো না। শেরওয়ানি টা খুব কষ্ট করে খুলতেই আদর চোখ বুজে নিলো। এক চোখ খুলে হৃদানের বডির দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা লাগছে না তার! হৃদান বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। আদরের এমন বোকা বোকা কাজ গুলোয় তাকে মুগ্ধ করে। বারবার! আদর হৃদানের দিকে কড়া চোখে চাইতেই হৃদান চোখ নামিয়ে অবলা বাচ্চার মতো চেয়ারে বসে রইলো। আদর খপ করে পান্চুর হাত থেকে সাবান টা নিয়ে হৃদানের বাম পাশের গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ঘসতে লাগলো। উন্মুক্ত ছিলো; আর হিয়া হাত রেখেছিলো এখানেই! হৃদান তো ভাবতেই পারেনি এমন কাজ করবে আদর!
খুব শখ না অন্য মেয়ের স্পর্শ পেতে ? আজকের কথা মনে থাকলে ভবিষ্যতে এরকম করার দুঃসাহস আর করবে না এই পৃদান চৌধুরী। সাহস কত বড় আমার হক নষ্ট করে। খুব ভালো লাগছিলো তখন? কষিয়ে এক থাপ্পড় দিলে কি হইতো? এই না নিজ হাতে থাপ্পড় দেওয়া যাবে না। গালে স্পর্শ লেগে যাবে! এই হিয়া কে তো উচিত শিক্ষা আজ আমি দিবো!
ঘসতে ঘসতে বিড়বিড় করে বলছে আদর। হৃদান আদরের কথাগুলো শুনেই ফিক করে হেসে দিলো। আদর চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মুখে হাত দিয়ে হাসি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেছে এখনো আদর ঘসেই যাচ্ছে। গলা থেকে কাঁধ পযর্ন্ত একদম লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে কেমন! তবুও হৃদান ঠোঁট কামড়ে চুপ করে আছে। এর মধ্যেও যে আদরের ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সে ঢের জানে। আদরের এই বাচ্চাসুলভ পাগলামি এই মুহূর্তে আর পছন্দ হলো না আদরের মামির। ছেলেটা কি ইচ্ছে করে করেছে নাকি? মঞ্চে উঠে আদরের হাত ধরে নিলো। আদর তো অন্যমনস্ক হয়ে ঘসেই যাচ্ছিলো। কারোর হাত ধরাই খানিক টা ভড়কে যায় সে! সামনে মামিকে রাগি চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে নিলো। হৃদানের গলার দিকে চোখ যেতেই মামি আতকে বলে উঠে,
কি করছো আদর? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার। দেখোতো গলাটা কেমন লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে না?
আদর ফট করে তাকালো হৃদানের গলার দিকে। চমকে উঠলো নিজেও। ইশ কি অবস্থা হয়ে গেছে। মুহূর্তেই চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে এলো। হৃদান এবার চমকালো। এই মেয়ের চোখের পানি তার বুকে রক্তক্ষরণ হয় মেয়েটি কি জানে! হৃদান বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
স্টপ স্টপ আন্ডাবাচ্চা। আমার কিছুই হয়নি। তোমার যত ইচ্ছে ঘসতে পারো। একটুও জ্বলছে না আমার। এই কষ্টটা আমার কাছে কিছুইনা আদরপরী যতটা কষ্ট দেয় তোমার নীলাভ চোখের একটু পানি!
কাঁপা কাঁপা হাতে হৃদানের গলায় হাত বুলিয়ে দিলো আদর। হৃদান মুচকি হেসে ভালোবাসার মানুষটার স্পর্শটা অনুভব করলো। এ যেন স্বর্গীয় সুখ! এবার সব রাগ এসে জমা হলো হিয়ার উপর। কন্দনরত চোখ দুটোতে এখন রাগ লুটোপটি খাচ্ছে। হৃদান কে শেরওয়ানি পড়তে বলে নিচে নেমে একদম হিয়ার দুহাত সামনে দাড়ালো আদর। গার্ড কে ইশারা করতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। পায়ের উপর পা তুলে বসলো সে। হৃদানের যেন চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আদরের এমন গুন্ডি রূপ দেখে। আর কত রূপ দেখাবে এই মেয়ে। প্রত্যেকটা রূপেই তো সে ঘায়েল হয়ে যায়! গম্ভীর কন্ঠে হিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
কি বলছিলি যেন। তোর আর আমার ক্যাবলাব্রিটিশের রিলেশন ছিলো? কত বছর, কত মাস, কত সপ্তাহ, কত দিন, কত ঘন্টা, কত মিনিট, কত সেকেন্ড? বল বল। আচ্ছা যা বাদ দিলাম এইটা। তোর কেন মনে হলো এই দু’তিনটা ছবি দেখে আমি উনাকে ভুল বুঝবো? আমাকে নতুন চিনছিস তুই? সেদিনের চড় টার কথা ভুলে গেছিস? আমি খুব ভালো জানিস? একদম পিউর ভালো। খুব সরল, যে কেউ দেখলেই বলে তোমাকে দেখে আদর আদর পায়, তুমি এতটা মিষ্টিভাষী কিন্তু বিশ্বাস কর যারা আমার অন্য ভাষা একবার দেখে তারা আর আমার দিকে তাকানোর সাহস করে না। আমি খুব নরম: তাদের ক্ষেত্রেই যারা আমার নমনীয়তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে; কিন্তু তুই তো আমার নমনীয় তা কে দুর্বলতা ভেবে বসলি, আবার আমাকে বোকাও ভেবেছিস! তোর কত্ত বড় সাহস একবার ভাব! এই আদর আহমেদ কে একমাত্র বোকা তার ক্যাবলাবিট্রিশ ভাবতে পারে; তুই তো অনাধিকার চর্চা করে ফেলেছিস! আবার আমার বরের কোলে বসেছিস। আল্লাহ কি করে ফেলেছিস একবার ভাব। এবার তো শরম রাখ। তোর কোলে উঠার খুব শখ না! দাড়া তোর শখটা আমি পূরণ করে দিবো।
আহ কি মেয়ে রে বাবা! রূপের বাহার যেন! আদরের কথাগুলো তো হৃদানের একদম বুকে গিয়ে লাগছে। যতবার লাগছে ততবার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে সে। আতইয়াব গভীর ভাবে বোনকে দেখছে। তার বোন কে সে এতটাও স্ট্রং ভাবেনি! মুখে একছিটে হাসি লেগে আছে। আদর এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। যখন পেলো না তখন হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠলো,
বীরহককককক! কইরে আমার বীরু? আয় তো এখানে। তোর রানীসাহেবা তোকে ডাকছে। আদেশ পালন কর!
আদরের কথাগুলো শুনেই ইয়া মোটা, ইয়া লম্বা কালো মতো একটা লোক দৌড়ে আদরের দিকে আসতে দেখা গেলো। লোকটিকে দেখেই আদরের মুখে হাসি ফুটে উঠে। মূলত লোকটি একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আদরের থেকে বয়স কম কিন্তু মোটা আর লম্বার জন্য বড় দেখা যায়। ভার্সিটি যাওয়ার পথে একদিন আদর বীরহক কে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। হাতে ফুসকা পড়া ছিলো। বীরহকের দাদি গরম পানি ঢেলে দিয়েছিলো। স্বাস্থ্য এমন হওয়ায় কেউ পছন্দ করতো না বীরহক কে। অবজ্ঞা করতো। আদর বীরহক কে নিজের সাথে নিয়ে আসে। অনেক কিছু শেখায়। বীরহকের বান্দরবন যাওয়ার খুব শখ ছিলো। আদর আতইয়াবের দুজন গার্ডসহ বীরহককে বান্দরবন ঘুরতে পাঠিয়েছিলো। তাইতো এতদিন তাকে আদরের সাথে দেখা যায়নি। বিয়ের জন্য ফোন দিয়ে নিয়ে এসেছে। বিয়েতে আসার পর থেকেই খাওয়ার উপরেই ছিলো। রানীসাহেবার ডাক শুনেই ছুটে এসেছে।
বীরহক নামটা আতইয়াব দিয়েছিলো। সবাই তাকে ভিতু পাগল বলে ডাকতো তাই এই নামটা দিয়েছে। আদর আদর করে বীরু বলে ডাকে। বীরু কে দেখেই আদর একগাল হেসে কাছে ডাকলো। আদরের পায়ের কাছে কিছুটা সময় নিয়ে বসলো বীরহক। আদর বীরুর চুলে হাত দিয়ে বলল,
বারে আমার বীরু দেখছি সুন্দর হয়ে গেছে। কত্ত কিউত লাগছে তোকে। শোন এখন বেশী কথা বাড়ানো যাবে না। তোর সামনে যে মহিলা দাড়িয়ে আছে তার কোলে উঠার খুব শখ জানিস? তোর রানীসাহেবার বর মানে তোর রাজাসাহেবের কোলে উঠেছিলো এতে তোর রানীসাহেবা বহুত দুক্কু পেয়েছে। তুই কিছু করবি না?
মলিন মুখে ন্যাকা ন্যাকা কন্ঠে কথা গুলো বলতেই মুহূর্তেই বীরহকের মুখ একদম রাগান্বিত হয়ে গেলো। আদর হাসলো। বীর হক রেগে হিয়ার দিকে তাকিয়ে ঘুসি দিতে যাবে আদর বলে উঠলো,
এই না না বীরু। মহিলার কোলের রোগ হয়েছে। তুই আজ সারারাত মহিলাটাকে কোলে নিয়ে থাকবি। একটুও নামাবি না। মহিলা যেন ঘুমোতে না পারে। কাল সারাদিন ঘুমাবি আর রিসেপশনে জম্পেস খাবার!
বীরহক হো হো করে হেসে হিয়াকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে আবার বসে পড়লো। হিয়া তো মরি মরি অবস্থা। কেমন গন্ধ বের হচ্ছে গা থেকে। চিৎকার করে বলে উঠলো,
এই ছাড় আমাকে, আদর খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু? ওয়াক ওয়াক ছিহ কি গন্ধ। আমি এখান থেকে চলে যাবো তবুও ছাড়ো আমাকে।
বীরহক আরেকটু চেপে ধরলো। যেন কোলবালিশ নিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। নরম দেহখান ঝাপটে ধরে বসে রইলো। ভালোয় লাগছে! আদর হিহি করে হেসে বীরহক কে বাহুবা দিয়ে বলে উঠলো,
এই না হলে আমার বীরু। সাবাশ বীরু সাবাশ। মহিলা যেন চিৎকার না করতে পারে সেই ব্যবস্থা কর। তোর রানী সাহেবা এখন বিয়ে করবে নো সাউন্ড ওকে!
বীরহক মাথা ঝেঁকে সায় দিতেই আদর হাসলো। হিয়া কিছু বলবে তার আগেই বীরহক চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই চুপ হয়ে গেলো। এখন যদি ওই দাবাং মার্কা হাতে ঘুসি দেয় সে মরেই যাবে! আদর জোরে বলে উঠলো,
মিউজিককককক!
সাথে সাথে গান বেজে উঠলো। কিছুক্ষণ নেচে মঞ্চে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। উপস্থিত সবাই আজ ব্যপক মজা পেয়েছে। এরকম বিয়ে বাড়িতে এসেও যেন তারা নিজেকে ধন্য মনে করছে। কিছুক্ষণ পর পর হিয়ার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসছে সবাই। দেখ কেমন লাগে। দুটো লাভবার্ড কে আলাদা করার শাস্তি! হৃদান আদরের আচরণে জাস্ট শকড। এ কেমন শাস্তি রে বাবা। মারের থেকেও ভয়াবহ এই শাস্তি! সে তো ভেবেছিলো কিছুক্ষণ হিয়াকে পিটিয়ে বন্ধী করে রাখবে! হৃদানের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আদর ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে উঠলো,
চিন্তা করবেন না! আপনার জন্যও এরকম শাস্তি রয়েছে। বাসর ঘরের বাইরে আজ সারা রাত দাড়িয়ে থাকবেন!
চুপসে গেলো হৃদান। এ কি বলছে তার বউ। অসম্ভব। বাসর ঘরে না ঢুকলে বাসর করবে কে? আদর কে আদর করবে কে? এহ আসছে। সবার আগে ঘরে ঢুকে লুকিয়ে থাকতে হবে। ভেবেই হাসলো। কাজির দিকে তাকাতেই কাজি আগে হৃদানদের বিয়েটাই পড়ানো শুরু করলো। আতইয়াব এসে আদরের পাশে বসেছে। কবুল বলার সময়টাই হৃদান একটুও দেরি করলো না। তিন কবুল বলেই সেই একটা বিজয়ীর হাসি দিলো। এখন শুধু আদরের পালা। হৃদান ভেবেই নিয়েছে আদর কবুল দেরী করে বলবে! আর সবার মতো খুব আস্তে ধীরে ধীরে নিচু কন্ঠে আলহামদুলিল্লাহ্ বলবে! কিন্তু না! সে তো ভুলেই গিয়েছিলো তার বউ জিনিয়াস, ইউনিক! সবাই কে অবাক করে দিয়ে আদর হৃদানের থেকে দ্বিগুন জোরে হিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে কবুল বলে উঠলো। চারদিক হাসি ও করতালির আওয়াজে মুখোরিত হয়ে উঠে। পরক্ষণেই আদরের মুখ মলিন হয়ে যায়। শক্ত করে আতইয়াবের হাত টা ধরে ছেড়ে দেয়। ওদের বিয়েও তো হবে! আতইয়াব-তারিমের বিয়ে পড়ানোর সময় এবার আর আতইয়াব ধীরে না খুব তাড়াতাড়ি খুশি মনে কবুল বলে দেয়। দু’বিয়ে কমপ্লিট হতেই কাজি মোনাজাত ধরে। বৈবাহিক জীবন সুখের দোয়া করে মিষ্টিমুখ করানো হয়। বর-কণের দু জুটি তো আগেই খেয়ে নিয়েছে। এখন আর খাবে না। আর সবাই খাবার খেতে চলে যায়। হৃদান আদরের দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না শেষ পযর্ন্ত বিয়েটা হলো। পাশে বসে থাকা রমনীটা তার বউ! তার অর্ধাঙ্গীনি! তার সহধর্মীনী! শান্ত কন্ঠে ডেকে উঠে,
বউজান!
চমকে উঠে আদর। ইশ এত সুন্দর কেন ডাকটা! একদম বুকে গিয়ে লাগে। টিপটিপ করা হৃদস্পন্দন নিয়ে আদর হৃদানের চেয়ারে গিয়ে বসে। হৃদান হাসে, প্রাণখোলা সেই হাসি; হাসির শব্দটাও যেন আদরের কানে বার বার বারি খায়। আজ । আদর হুট করেই হৃদানের কাঁধে মাথা রেখে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। হৃদান ঠোঁট কামডে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আজ একটু কাঁদবে সে জানে; তবুও তো সে মানতে পারে না! কষ্ট হয়! আদর কে স্বাভাবিক করতে হৃদান সুর তুলে বলে উঠে,
কেঁদনা না কেঁদনা আদর
কেঁদনা আর
ও আদর
তোমার কান্না দেখলে আমার
বুকে হয় যে দহন
স্বামীর ঘরেই ঠাই যে মেয়েদের
মানতে হবে সবার
ও আদর
কেঁদে কেঁদে
আমার বাসর রাত
করে দিও না বরবাদ…
আদর কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকে। আশেপাশে ক’জন না পারে তো হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। আদর হাসবে কি কাঁদবে নিজেও বুঝতে পারছে না। এই মুহূর্তে তার মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার মাথা ফাটাবে বুঝতে পারছে না! পান্চুকে দেখেই আদর পান্চুর টাক মাথায় তবলা বাজাতে থাকে। পান্চু ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে তাকিয়ে থাকে। হাইরে কপাল তার! একদম হীরের কপাল!
চলবে…?
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শুকরিয়া!)