#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বিতীয় পর্ব
বগুড়া সদরে আকবর পরিবার ব্যবসায়িক অঙ্গনে ভীষণ পরিচিত মুখ। অনেক বছর ধরে এরা বগুড়ায় সবজির ব্যবসা করে আসছে। কাঁচা বাজারে তাদের সবজির আড়ত। এছাড়াও এখন স্টক বিজনেস এর দিকে ঝুঁ কেছে। আলী আকবর ছিলেন এই বংশের বড় ছেলে। উনার ছোট দুই ভাই আতেফ আকবর, আদিল আকবর মিলে সবজির আড়তের ব্যবসার পরিব্যপ্তি বাড়িয়েছিলেন। আলী আকবর মারা যাওয়ার পর উনার বড় ছেলে বাবার ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। আলী আকবরের ঘরে চার ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে দিদার ও ছোট ছেলে দিহানের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ থাকলেও অন্য দুজন ছেলে দানেশ ও দাউদের আগ্রহ ছিলো লেখাপড়ায়। ওরা দুজন লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে এখন ঢাকা শহরে ভিন্ন দুটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করছে। দিদার সবজির আড়ত সামলায় আর দিহান সামলায় স্টক বিজনেস। যদিও যুবক দিহান ব্যবসায় সময় দেয় খুব কম। অল্প মনোযোগ দিয়েও তার ব্যবসা যে এখনো টিকে আছে এবং সামান্য লাভের দেখাও মিলছে তাতেই দিদার খুশি। তার বিশ্বাস বয়সের ফেরে দিহান একদিন ঠিকই দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। আর এখন তার বয়সটাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার, ঘুরে বেড়ানোর। দিদার সেই সকালে আড়তের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে রাতে। তারপর খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। সকাল ছয়টায় তার আড়তে থাকা চাই, চাই।
আজ ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শর্মী বললো,
– আর একটা বছর পরেই মেয়েটার এইচএসসি কমপ্লিট হয়ে যেতো। তারপর বিয়ের তোড়জোর করলে হতো না? কী বা বয়স হয়েছে ওর!
দিদার বালিশে মাথা দিয়ে চোখে বন্ধ রেখেই উত্তর দিলো,
– পড়াশোনা করে কি হবে শুনি? তুমি নিজেও তো অনার্স শেষ করে বিয়ে করেছো। সেই তো সংসার সামলাচ্ছো। তাছাড়া ওর নিজেরই তো ঘরে মন টিকতেছে না। স্বামীর ঘর করার তাড়া বেশি কিনা।
বোনের জন্য ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে শর্মী ভীষণ বিরক্ত হলো। কিন্তু সে পাক্কা অভিনেত্রীর মতো অনুভুতি লুকাতে শিখে গেছে অনেক আগেই। তাই বিরক্তিকে একপাশে রেখে বলল,
– সন্দেহের বশে মেয়েটাকে তো অনেক ভুগতে হলো। সেই এক কারনে এখন বিয়েও দিয়ে দিতে চাইছো? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে….
– সামান্য ব্যাপার মানে? এখন কি পাড়ায় ছিঃ ছিঃ রব পরার অপেক্ষা করবো? তারপর কোন ভালো ছেলেটা ওকে নিতে আসবে? আমার বোনের একটা ভালো ঘর হতে প্রস্তাব এসেছে বলে তুমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো । সকাল থেকেই দেখছি সমন্ধ ভেস্তে দেওয়ার পায়তারা করছো।
শর্মীর কথা শেষ করার আগেই দিদার ধমকে উঠলো। অপরদিকে শর্মী হতবাক। সে হিংসা করছে? এতে তার কী লাভ! এই বাড়ির মানুষগুলোকে শর্মীর অদ্ভুত মনে হয়। নেহাৎ গরীব ঘরের মেয়ে শর্মীর কোথাও ঠাঁই নেই, তাই শত অপমান সহ্য করে ও এখানে পরে আছে। এতোদিন অবশ্য সব দেখেশুনে, বুঝেও চোখ বন্ধ করে নির্বিকার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। গুলিস্তার বিয়ের তোড়জোড় দেখে মনটা মানছিলো না দেখে একটু চেষ্টা করে দেখতে চাইছিলো। কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে দেখে শর্মী সিদ্ধান্ত নিলো সে এই ব্যাপারে আর কিছু বলবে না। নির্বিকার ভাবে দর্শকের মত শুধু দেখে যাবে।
দানেশ যে কোম্পানিতে চাকরী করে সেখানের কলিগ আসাদের মাধ্যমে গুলিস্তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আসাদের বন্ধুর বড় ভাইয়ের জন্য জরুরি ভিত্তি পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো। অফিস ক্যান্টিনে বসে আড্ডার মাঝে আসাদ সে কথা বলেছিলো। দানেশের তখন গুলিস্তার কথা মনে পরে যায়। বাড়িতে বিয়ের বয়সী মেয়ে থাকায় প্রেমিকার বাড়ি থেকে বিয়ের আয়োজনে গাইগুই করছে। এদিকে দানেশের বউ ছাড়া আর চলছে না। ঢাকা শহরে একা থাকছে, বুয়ার হাতে খাচ্ছে। এই নিয়ে রত্নাকে যতোবার বলা হয়েছে, সে বলেছে তোমার বোনের বিয়ে হয়ে যাক। সংসারের সব দায়িত্ব মিটিয়ে নেও তারপর আমরা নতুন করে সংসার শুরু করবো।
সুযোগ দেখে দানেশ আসাদকে চেপে ধরলো। যেহেতু ছেলে পক্ষের তাড়া বেশি তাই ফোনে মাধ্যমে ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হলো আসাদের বন্ধু রাহিলকে। রাহিলের বাবা বেঁচে নেই, তাই ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব আপাতত সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। দানেশও ছেলের ছবি ফোনেই দেখেছে। গুলিস্তার থেকে বয়স তুলনামূলক বেশি হলেও চেহারা দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তাছাড়া ছেলের সিলেটে নিজের বাড়ি আছে, বিজনেস আছে। দুই ভাই ও মা নিয়ে ছোট্ট সংসার। ছিমছাম ছোট্ট সংসার। তাড়াহুড়ো থাকলেও নিজের একমাত্র ছোট বোনকে দানেশ তো আর জলে ফেলে দিতে পারে না।
আসাদের থেকে অল্পস্বল্প কিছু তথ্য যোগাড় করে ফোনালাপেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলো।
পাত্রের মা আম্বিয়া খাতুন একবার সরাসরি মেয়েকে দেখার কথা তুলেছিলেন কিন্তু সিলেট থেকে বগুড়া এসে মেয়ে দেখে যাওয়া অনেক ঝামেলার ব্যাপার।
অবশেষে দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, পাত্রপক্ষ সরাসরি এসে মেয়েকে দেখবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে ছোট পরিসরে আয়োজন করে সেদিনেই বিয়ে সম্পন্ন করা হবে। ছেলেপক্ষের আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। মা-ছেলে মিলে মাত্র তিনজন। তারা এসে দেখার পর যদি পছন্দ না হয় তাহলে চুপচাপ ফিরে যাবে। আর পছন্দ হলে বউ নিয়ে ফিরে যাবে।
এদিকে দানেশের দৃঢ় বিশ্বাস, তার বোনের মতো অপরুপ সুন্দরী মেয়েকে কেউ অপছন্দ করতেই পারে না। তাই নিজ পরিবারকে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছে। কিন্তু সীমা বেগমের কড়া নির্দেশ, বাড়ির বাইরে একটা কাকপক্ষীও যেনো বিয়ের আভাস না পায়। একে তো মেয়ে তাদের মানসম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। লোকজন এখন মুখ বন্ধ করে সব ভুলে থাকার ভান করতেছে। কিন্তু যখনি মেয়ের বিয়ের আলোচনা চলে তখনি অতীতের ঘটনার সাথে মশলা মিশিয়ে পাত্র পক্ষের কানে তুলে দেয়। এমন ধনী পরিবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাক, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না বাড়ির কর্ত্রী সীমা বেগম।
সবার এতো পরিকল্পনার মাঝে কেউ আয়োজনের মূল চরিত্রকে নিয়ে ভাবলো না। কথায় আছে না, যার বিয়ে তার হুশ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই।
গুলিস্তাকে কেউ একবার এসে জিজ্ঞাসাও করেনি, সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা। অন্য সকল দিনে সে যেমন ঘরবন্দী থাকে এখনো তেমনি আছে। নিজের ঘরে খাচ্ছে, ঘুরছে, ঘুমাচ্ছে। শর্মী না থাকলে মনে হয় সে জানতেও পারতো না যে তার বিয়ের আলোচনা চলছে। রাতে খাবার দিতে এসে শর্মী বললো,
– কাল ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে তোমাকে দেখতে। পছন্দ হলে কালকেই হয়তো বিয়ে হয়ে যাবে।
যথারীতি গুলিস্তা উত্তর দেয়নি। বরং মুখ ভর্তি ভাতের মাঝে আরেক নলা ভাত নিয়ে মুখে পুরেছিলো।
সে রাতে অনেক দিন পর সীমা বেগম মেয়ের ঘরে এলেন। গুলিস্তা ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চেহারায় কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? সেই পরিবর্তন বুঝতে গভীর মনোযোগ দিয়ে বেশিক্ষন তাকিয়ে দেখতে হলো না। মেয়ের চোখে মায়ের আনন্দে ঝলমল করা চেহারাটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যদিও সীমা বেগম যথেষ্ট গম্ভীর ভাব নিয়ে রুমে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু গুলিস্তা বুঝে ফেলেছে তার মায়ের মন আজ ভীষণ ভালো। সীমা বেগম গুলিস্তার বিছানার উপর বসে ওকে বললেন,
– টুলটা নিয়ে এসে এখানে বস।
গুলিস্তা টুল নিয়ে এসে মায়ের সামনে মেঝেতে বসলো। এরপর সীমা বেগম অনেক বছর পর মেয়ের মাথায় যত্ন সহকারে তেল মালিশ করে দিতে লাগলেন। মেয়ের চুল কবে কোমড় ছুঁয়েছে তিনি মনে করতে পারছেন না। শেষ যখন তেল দিয়ে দিয়েছিলেন তখন গুলিস্তার ঝাঁকড়া চুল ছিলো। সে তখন স্কুলে পড়তো। থ্রি অথবা ফোরে ছিলো, সীমা বেগমের এখন ঠিক মনে পরছে না।
মাথায় তেল দেওয়া শেষ করে শক্ত করে একটা বেনী গেঁথে দিলেন। লম্বা, মোটা বেণী দেখে মন ভরে গেলো। দুধে আলতা গায়ের রং, কোমড় সমান কুচকুচে কালো ঘন চুল, লম্বায় ভাইদের কাছাকাছি। মেয়ে হিসেবে এককথায় সবদিক থেকে সেরা। এমন মেয়েকে দেখতে এসে ফিরে যায় এমন সাধ্য কার আছে?
তেল দেওয়া শেষে বাটিতে নিয়ে আসা ফেসপ্যাক মেয়ের মুখে মাখিয়ে দিতে শুরু দিলেন। এই ফেসপ্যাকটা তিনি আতেফ আকবরের বড় মেয়ের থেকে বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। পুরোটা সময় গুলিস্তা শান্তভাবে মায়ের আদেশ অনুযায়ী কাজ করছে। কতোদিন পর মায়ের স্পর্শ পেয়ে আর কোনো চিন্তা মাথায় আস্তানা গড়তে পারছে না। এই মুহুর্তটা শুধু তার এবং মায়ের। সীমা বেগম কাজ শেষ করে গুলিস্তাকে বললেন,
– এক ঘন্টা পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলবি। তারপর চুপচাপ ঘুমায় যাবি। কালকে যেনো দেখতে ফ্রেশ লাগে। চন্ডালের মতো দেখা গেলে মানুষজন যেই পথে আসবে ওই পথেই বিদায় নিবে। আর এমন যদি হয়, তোরে আমি নিজে হাতে খু*ন করে নদীতে ভাসা দিবো। অনেক অশান্তি দিছিস তুই আমারে। চুপচাপ বিয়ে করে বিদায় হয়ে আমাদের শান্তি দে।
মেয়ের অহেতুক ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে সীমা বেগমের মেজাজটা আরও বিগড়ে গেলো। এসব হোমমেড হেয়ার ওয়েল, ফেসপ্যাক সংগ্রহ করতে গিয়ে উনার উপর বেশ ধকল গেছে। শরীরটা বিশ্রাম চাইছে। কালকের আয়োজনের উপর আবার তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। হাজার হোক শর্মী পরের বাড়ির মেয়ে। হিংসা করে যদি খাবারের আয়োজনে ঘাটতি করে ? বরপক্ষ না করার বাহানা পেয়ে যাবে। নাহ, রান্নার দিকটা উনাকেই দেখতে হবে। বাড়িতে কুটূম আসার কথা যেনো আবার বাইরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
(চলবে)