#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
পঞ্চম পর্ব
রেহবারের বেশিরভাগ সময় বাইরে কেটে যায়। অফিসে কাজের চাপ নেহাৎ কম নয়। গুলিস্তা সারাদিন বাড়িতে একা থাকে। সকালের দিকে ছুটা বুয়া এসে ধোয়া, মুছার কাজ করে দিয়ে যায়। রান্নাটা ও নিজে হাতে করে। আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার আগে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলো। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে উনার সাথে ভিডিও কলে কিছুক্ষণ কথা হয়। আম্বিয়া খাতুন অতি উৎসাহ নিয়ে ওখানের গল্প করে, গুলিস্তা শুধু শুনে যায়। যেটুকু ওর কাছে জানতে চাওয়া হয় সেটুকুর উত্তর দেওয়ায় কথাবার্তা বেশি দূর আগায় না।
রেহবার ভেবেছিল তার ব্যস্ততা নিয়ে স্ত্রীর থেকে অভিযোগ শুনবে, অভিমানের পর্দা নামবে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেলোও গুলিস্তার স্বাভাবিকতা দেখে রেহবার খানিক অবাক হলো। একদিন রাতে খেতে বসে সে বলল,
– সারাদিন বাড়িতে একা একা থাকতে তোমার খারাপ লাগছে না?
গুলিস্তা খাওয়া থামিয়ে রেহবারের দিকে তাকায়। তার চিরপরিচিত ঠান্ডা কন্ঠস্বরে বলল,
– নাহ। দিন তো কেটেই যাচ্ছে।
– তুমি চাইলে এখানে কলেজে ভর্তি হতে পারো। সময়ও কেটে যাবে, পড়াশোনাও থেমে থাকলো না।
– আর পড়বো না।
গুলিস্তা আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেওয়ায় রেহবার আলোচনা থামিয়ে দিতে বাধ্য হলো। আগ্রহ না থাকলে জোর করে তো আর পড়াশোনা করানো যায় না। এই বয়সেই পড়াশোনার প্রতি তিক্ততা রেহবারের ভালো লাগলো না। মেয়েরা বিয়ের পরে পড়াশোনার সুযোগের জন্য কতো যুদ্ধটাই না করে ! এদিকে গুলিস্তার হাতে সুযোগ আসলেও সে এড়িয়ে গেলো। রান্নাবান্না, ঘর গুছানো, বাগান পরিচর্যা করে একটা মানুষ কীভাবে সুখে দিন কাটাতে পারে? রেহবার ভাবলো আর কিছুদিন পর যখন বিরক্ত হয়ে যাবে তখন নিজেই কলেজে ভর্তি হতে চাইবে। তাই আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এইদিনটি রেহবার বাড়িতেই কাটায়। তবে বিয়ের পর দুটো শুক্রবার সে বাড়িতেও থাকলেও ব্যস্ততায় দিন কেটে গেছে। মা ও ভাইয়ের দেশ ছাড়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় অফিসের কিছু কাজ জমে গিয়েছিলো। কাজগুলো গুছিয়ে নিতে কয়েকদিন টানা কাজ করার পর অবশেষে বিশ্রাম নেওয়ার সময় পেলো।
সকালে নাস্তার টেবিলে এসে দেখলো ঘিয়ে ভাজা পরোটা ও পায়েস। সাথে ঘন দুধ চা। রেহবার ভীষণ ভোজনরসিক। খেতে ভালোবাসার স্বভাবের কারনে আম্বিয়া খাতুন নিজে হাতে যত্ন করে ছেলের খাওয়ার আয়োজন করতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব নীরবে কাঁধে তুলে নিয়েছে গুলিস্তা। আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার আগে রেহবারের পছন অপছন্দ সম্পর্কে গুলিস্তাকে যথেষ্ট জ্ঞান দান করে গেছেন। খেতে বসে রেহবার বললো,
– তুমি দেখছি প্রতিদিন আমার পছন্দের খাবার রান্না করে যাচ্ছো। পছন্দের খাবার খেতে হয় বিশেষ বিশেষ দিনে। প্রতিদিন খেলে সেগুলো আর বিশেষ পছন্দের থাকে না।
গুলিস্তা মনে হয় ওর মজা করে বলাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে রেহবারের দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেনো ভাবলো। তারপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করার মতো করে বললো,
– মা যে বললো আপনি এগুলোই খেতে ভালোবাসেন। অন্য কোনো পদের কথা তো আমাকে বলেনি।
রেহবার হেসে সায় জানালো।
– অবশ্যই এগুলো আমি খেতে ভালো বাসি। কিন্তু অন্য কিছু রান্না করলে যে খাই না এমন নয়। আমি খেতে পছন্দ করি। অনেকে আছে একটু বেশি খেলেই মোটা হয়ে যায়। কিন্তু আমি যতো খাই না কেনো শরীরে কোনো প্রভাবে পরে না। তাই বোনাস হিসেবে যা ইচ্ছে খেতে পারি। তুমি তোমার পছন্দ মতো যেকোনো কিছু রান্না করে দিলেও আমি তৃপ্তিসহ খেয়ে নিবো।
গুলিস্তাকে মনে হয় কেউ অথৈ জলে ফেলে দিয়েছে এমন মুখখানা করে সে চুপচাপ নাস্তা খেতে লাগলো। রেহবার ভেবেছিলো গুলিস্তা কিছু বলবে। কিন্তু মেয়েটা প্রতিবার ওকে নিরাশ করে দিয়ে চুপ হয়ে যায়। বাড়িতে সারাদিন চুপচাপ থাকে। সারাদিন পর রেহবার অফিস থেকে ফিরলে নীরবে, নির্লিপ্তভাবে ওর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবে। কাপড়চোপড়, জুতোজোড়া, ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখবে। রেহবার ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে আবার ছুটে যায় রান্নাঘরে। একাই নিস্তদ্ধ ঘরে ভূতের মতো পায়েচারী করে রেহবার। এই সময়টুকু তার মা ও ভাইয়ের কথা ভীষন মনে পরে। এখানে যখন সন্ধ্যা, ফ্লোরিডায় তখন সকালের অনেকটা পেরিয়ে গেছে। স্টাডি রুমে বসে মা ও ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেয়। রান্না শেষে গুলিস্তা দরজায় নক করে রুমে উঁকি দিয়ে বলে, ডিনার রেডি।
রেহবার মাঝেমধ্যে ভাবে একটা মানুষ কীভাবে এতো চুপচাপ থাকে। এই বয়সে মেয়েরা ভীষণ চঞ্চল হয়। প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ায় । ঝর্ণার মতো কলকল করে কথা বলে। বায়না ধরে, আবদার করে। অথচ গুলিস্তা শান্ত নদীর মতো। রেহবার ইচ্ছে করে সেখানে ঢিল ছুড়ে দেখেছে। আলোড়োন সৃষ্টি হলেও তা ক্ষনস্থায়ী। কিছু সময় পর শান্ত নদী নিজের রুপে ফিরে যায়। যেনো কিছুই হয়নি।
ছুটা বুয়া আসায় গুলিস্তা তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে চলে গেলো। রেহবারের ভালো লাগছিলো না। কাজের ব্যস্ততাই মনে হয় ভালো ছিলো। সময়টুকু কেটে যেতো। বিয়ের পর পুরুষ মানুষেরা কাজ শেষ করে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চায়। নারী হচ্ছে একটি বিস্ময়কর ধাঁধাঁ। সেই বিস্ময়কে জানার প্রচেষ্টা করে। নারী দেহের বাঁকে, মনের অন্তরালে লুকানো রহস্য উদঘাটনের উত্তেজনায় সারাক্ষণ মন আনচান করে। অথচ রেহবারের ক্ষেত্রে ঘটছে বিপরীত ঘটনা। বিয়ের আগেই বরং জীবনে রোমাঞ্চকতা ছিল।
সময় কাটাতে বাড়ির বাইরে এসে খানিক হাটাহাটি করছিলো গুলিস্তা এসে সামনে দাঁড়ালো। ওর প্রতিমা গড়ন মুখশ্রী হাসির দাবিবার। অথচ সেখানে সারাক্ষণ মেঘমেদুরের আনাগোনা দেখে রেহবারের ভীষন ইচ্ছে করে, ওকে কাছে টেনে আলতো করে ছুঁয়ে জিজ্ঞাসা করতে,
তোমার কি খুব মন খারাপ করেছে, ফুল?
কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। গুলিস্তার এমন নির্লিপ্ততা নতুন তো নয়। সেই শুরু থেকে এমনই দেখে এসেছে। এই মুখশ্রীতে রোদ্দুরের মতো ঝলমলে হাসি দেখলে বরং আশ্চর্য হওয়া যায়। ভাবনাকে একপাশে রেখে রেহবার জানতে চাইলো,
– কিছু বলবে?
– দুপুরের জন্য কি রাঁধবো?
মেয়েটার ভালো স্বভাবের মধ্যে একটি হচ্ছে, সে সবসময় চোখে চোখ রেখে কথা বলে। কোনো লুকোচুপি নেই। এখনো সরাসরি রেহবারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রেহবার চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
– রান্না বিষয়ে আমি কিছু জানি না, ফুল। তোমার যা ভালো লাগে রান্না করো।
গুলিস্তা কোনো উত্তর দিলো না। ওকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহবার বললো,
– আর কিছু বলবে?
গুলিস্তা মাথা নেড়ে না জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তা দেখে রেহবারের ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। ইচ্ছে করলো বরফ কঠিন মেয়েটার রাস্তা আটকে বলতে, কেনো কিছু বলবে না তুমি? কিছু বলো। প্রয়োজনীয় কথাবার্তার দরকার নেই। অপ্রয়োজনীয় হলেও কথা বলো। আমার এই নীরবতা ভালো লাগছে না।
কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। বাবার নিজে হাতে লাগানো বাগানে হাটাহাটি করলে রেহবারের মন ভালো হয়ে যায়। বনজ, ফলজ, ঔষধি গাছ দিয়ে ভরা বাগানের প্রতিটি গাছে হাত বুলিয়ে রেহবার বাবার কবরের পাশে এসে দাঁড়ালো। বাবার মৃত্যুর শোক সামলে উঠেছে অনেক বছর হলো। এখন বাবা ছাড়া অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষ্য জাতিকে আল্লাহ শোক সামলানোর অদ্ভুদ ক্ষমতা দিয়েছেন। যাকে ছাড়া এক মুহুর্ত টিকে থাকা সম্ভব হতো না, যাকে ছাড়া নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। তার মৃত্যুর পর আমরা আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে থাকি। একসময় ভালো থাকতেও শিখে যাই। তবুও হঠাৎ কোনো দুর্বল মুহুর্তে বাবাকে ভীষন মনে পরে রেহবারের। তখন এখানে এসে দাঁড়ালে মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় এইতো বাবা আছে। এখানেই আছে।
মাথার উপরে দাপুটে সূর্যটা খাড়াভাবে রোদ ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করেছে। খোলা আকাশের নিচে থাকা সম্ভব হলো না। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে আসতেই তার পা থমকে গেলো।
গুলিস্তা বসে আছে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কাজের মেয়ে মালা। দৃশ্যটা অস্বাভাবিক নয়, তবুও রেহবারের কাছে অদ্ভুত ঠেকলো। সে দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
– কি হয়েছে?
প্রশ্নটা গুলিস্তার উদ্দ্যেশে করলেও উত্তর দিলো মালা। মেয়েটা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
– দেহেন না ভাইজান, ভাবী সেই বেলা থাইকা এমনে বইসা রইছে।
উগ্রীব রেহবার গুলিস্তার পাশের চেয়ারে বসে ওর গালে হাতে হাত রেখে জানতে চাইলে,
– কী হয়েছে ফুল?
গুলিস্তা এতোক্ষণ মাথা নিচু করে টেবিলের উপর হাত দুটো রেখে বসে ছিলো। এতোক্ষণে রেহবারের দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। মালা আবার বলে উঠলো,
– কি রানবে জিগাইলাম। কয় এখনো ঠিক করে নাই। তরকারী কাইটা দিয়া যাইতে হইবো। ভাবী তহন থাইকা যে ভাবতাছে এহনো কিছু কইলো না। সেই থাইকা খাড়ায় রইছি।
এতোক্ষণে গুলিস্তা মুখ খুললো,
– কি রান্না করবো বুঝতেছি না।
গুলিস্তার স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে রেহবার অবাক হলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সাড়ে বারোটা পার হয়ে গেছে। মালাকে চলে যেতে বলে, গুলিস্তাকে বললো,
– কি রাধবে সেই মেনু ঠিক করতে এতোক্ষণ ভাবার কি আছে ফুল? ঘরে যা আছে সেগুলো দিয়ে কিছু একটা রান্না করে নিলেই হতো।
– ঘরে সব আছে।
– তাহলে এতো ভাবার কি আছে?
– আপনি যে বললেন, পছন্দের বাইরে কিছু রাঁধতে। আপনার পছন্দের মেনুগুলোই মা বলে গেছেন।
রেহবার খেয়াল করলো, আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার পর গুলিস্তা রেহবারের পছন্দের মেনুগুলোই ঘুরে ফিরে রান্না করেছে। হয়তো রান্না পারে না। মায়ের কাছে যেটুকু শিখেছে তাই দিয়েই কাজ চালিয়েছে।
– তুমি অন্যকিছু রান্না করতে পারো না?
– পারি।
– তাহলে এতো ভাবার কি আছে!
– কোনটা রাঁধবো সেটা সিলেক্ট করতে পারছি না।
রেহবার হতাশ হয়ে বললো
– যেকোনো একটা রান্না করলেই হয়ে যেতো। এখন আর রান্না করা লাগবে না। চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি। বিয়ের পরে কাজের চাপে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। এই সুযোগে ঘুরে আসা যাবে।
(চলবে)