হে_সখা #অক্ষরময়ী সপ্তদশ পর্ব

0
140

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সপ্তদশ পর্ব

সন্ধ্যার আকাশে হালকা লালচে আভা ছড়িয়েছে। গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে নীড়ে ফিরছে পাখির দল। ছোট্ট মেয়েটা দ্রুত পায়ে হাটতে গিয়ে কখনো একটু দৌড়ে পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ গায়ের লাল টুকটুকে ফ্রকটায় ধুলো মাখামাখি। মায়ের ধমক জুটবে নিশ্চিত। গোসলের পর পরিষ্কার পোষাক গায়ে পরিয়ে দিয়ে মা বলেছিলো, নিজ ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে৷ কিন্তু প্রজাপতি ছোটাছুটি ছাড়া থাকতে পারে নাকি! আঘাতপ্রাপ্ত ডানা নিয়ে হলেও উড়বার চেষ্টা করে৷ ছোট্ট মেয়েটি সন্তপর্ণে সবার আড়ালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো৷ সাবধানেই বৌ চি খেলাটা খেলছিলো। খেলা এই শেষ হলো বুঝি। কোথা থেকে দুষ্টু জেরিন আপুটা এসে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো৷ লাল জামাটায় ধুলো লেগে একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটি রেগেমেগে মাটিতে পরেই কান্না জুড়ে দিলো৷ বন্ধুরা ছুটে এসে ধরাধরি করে মাটি থেকে না তুলে দিলে ওখানেই গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না চলতেই থাকতো৷
– তুই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেনো?
– ধাক্কা দিলাম কখন! আমি দৌড়ে আসছিলাম, ও দেখতে পেয়েও সামনে থেকে সরেনি দেখেই তো পরে গেলাম। পাটকাঠির মতো শরীর। এই নিয়ে খেলতে আসে।
– আমি দেখেছি তুই ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিস।
– বললেই হলো। খেলতে গেলে এমন একটু পরেটরে সবাই যায়। এসব ননীর পুতুল খেলতে আসে কেনো? এই তোর কান্না থামা তো। কালকে থেকে আর খেলতে আসবি না তুই। তোকে খেলায় নিবো না। এখন ভাগ এখান থেকে।

হালকা ধাক্কা মেরে ছোট্ট মেয়েটিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মেয়েটি নিজের ক্ষুদ্র দু হাতে জেরিনকে উল্টোদিকে ধাক্কা মেরে বললো,
– তোমাদের সাথে খেলতে আমার বয়েই গেছে। আর আসবো না খেলতে৷

সামান্য ধাক্কায় জেরিন হুমড়ি খেয়ে পরে যেতেই বাচ্চারা হা হা করে হেসে উঠলো৷ ছোট্ট মেয়েটি সেই হাসি তামাশায় যুক্ত না হয়ে দ্রুত পা চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বেলা ডুবে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু বাড়ির সদর দরজায় এসে ওর পা থমকে গেলো। জেরিন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। এতো তাড়াতাড়ি এই মেয়ে এখানে কীভাবে এলো! ছোট্ট মেয়েটি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো নিজের মায়ের দিকে। মায়ের চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। পাশে যেতেই শক্ত করে হাত ধরে জিজ্ঞাসা করা হলো,
– তুই ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিস?
শক্ত বাঁধনে আটকা পরে মেয়েটি ছটফট করতে করতে বললো,
– ও আগে ধাক্কা..

ঝড়ো বেগে একটি চড় আছড়ে পরলো গালে। মনে হচ্ছে গালটি যেনো আগুনে ঝলসে যাচ্ছে৷ তীব্র চিৎকার করে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করতেই মায়ের হাতটি ওর চোয়াল চেপে ধরে বললো,
– চুপ, একদম শব্দ করবি না। যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷ তুই ওরে ধাক্কা মারছিস কেন? খন্নাসী, অপয়া, অলুক্ষণে মেয়ে। যেখানে পা দিস, সেই জায়গাই ছারখার করে ফেলিস। ধাক্কা মেরে বাচ্চা মেয়েটার দাঁত ভেঙে ফেলেছিস!

ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে জেরিনের দিকে তাকালো। ওর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে। মেয়েটি ভাবলো, ওর এইটুকুনে দু হাতে এতো শক্তি যে জেরিন আপুর দাঁত ভেঙে গেলো!
মায়ের অনবরত আঘাতে গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে৷ মেয়েটি মায়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে হাতের বাধন হতে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তা দেখে মা আরও রেগে গেলেন। পাশে রাখা ছিলো চুলায় আগুন জ্বালানোর লাকড়ি। কোনো কিছু না ভেবে সেটি তুলে নিয়ে আঘাত করতে উদ্যোত হলে জেরিনের মা এগিয়ে এসে আটকে দিলেন।
– থাক ভাবি, বাচ্চা মানুষ। এতো মাইরেন না। জেরিনের দাঁতটা আগে থেকে নড়তেছিলো। তাই হালকা আঘাত পাওয়ার সাথে উঠে গেছে। সময়ের আগে উঠে যাওয়ায় ব্যথা একটু বেশি হচ্ছে৷ প্রথমবার দাঁত উঠলো তো। রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেছে। আমি এইজন্য নালিশ করতে আসি নাই৷ আপনার মেয়ে এখনো ছোটো আছে, এখনি বড়দের গায়ে হাত তুলছে। এই অভ্যাস থেকে গেলে সমস্যা। মেয়ে মানুষের এতো গরম মেজাজ মানায় না। একটু হাঁক-ডাক দিয়েন। তাহলেই হবে। মারামারি কইরেন না। পরে লোকে বলবে আমার জন্য আপনার মেয়েটা এতো মাইর খাইলো। চল রে জেরিন। আমরা বাড়ি যাই৷ এরপর থেকে মানুষ দেখে খেলতে যাবি৷

জেরিনরা চলে যেতেই ছোট্ট বাচ্চাটির চুল মুঠো করে ধরে মা আবার জিজ্ঞাসা করলো,
– ওই জানোয়ারের বাচ্চা, তোর এতো তেজ আসে কইত থেকে?
– ও আমারে আগে ধাক্কা মারছে।
– আবার মুখে মুখে তর্ক করে। যতোটুকু প্রশ্ন করছি, ততোটুকুর উত্তর দিবি৷ বেশি কথা কইলে জিহবা টান মাইরা ছিড়া নিবো। এই তুই বাইরে গেছিস কোন সাহসে? তোরে না ঘরে ঘুমাইতে কইছিলাম।

ছোট্ট মেয়েটির মুখে কোনো উত্তর নেই। কি জবাব দিবে সে? খেলতে গিয়েছিলাম, বললে মা রেগে গিয়ে আরেক দফা মারপিট শুরু করবে। এর থেকে মৌন থাকা ভালো। বেশি কথা মায়ের পছন্দ না। কিন্তু মা নিজে অতিরিক্ত কথা বলে। এখন যেমন বলতেছে,
– ধোয়া জামাটা মাত্র গায়ে দিয়ে দিছি। কোন ক্ষেতে গড়াগড়ি দিয়ে এমন হাল করছিস? চন্ডালের মতো সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরিস। মেয়ে মানুষ, ঘরে থাকবি। তা না করে কতোগুলা রাস্তার ছেলেমেয়ের সাথে ছুটাছুটি করে, মারামারি করে। এই মাস্তান হবি তুই?

চেলা কাঠের একটা আঘাত সপাং করে গায়ে এসে পরতেই ছোট্ট মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠে দৌড় দিলো নিজের ঘরের দিকে। পেছন পেছন মেয়েটির মা-ও ছুটছে।

‘কী হলো কথা বলছো না কেনো? এই শুনতে পাচ্ছো না? এই, এই?’
গুলিস্তা চোখ মেলে চাইলো। আশেপাশে তাকিয়ে সে কোথায় আছে বুঝার চেষ্টা করলো। তন্দ্রা ভাবটা কখন গাঢ় ঘুমে পরিণত হয়েছে টেরই পায় নি। গাঢ় ঘুম না হলে কেউ স্বপ্ন দেখে নাকি! আচ্ছা, ওটা তো পুরোপুরি স্বপ্ন ছিলো না।
– তুমি কি সত্যি ঘুমাচ্ছিলে?

গুলিস্তা সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। আশেপাশে তাকিয়ে রাতের ব্যস্ত নগরীর ছুটে চলা যানবাহন দেখতে লাগলো। জেরিনের সাথে দেখা হওয়ার পরপরই ওরা রিসিপশন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন রাত প্রায় দশটা পেরিয়ে গেছে। এতো দ্রুত ঘুম পাওয়ার কথা না৷ কোনো ফাংশন এটেন্ট করার অভ্যাস গুলিস্তার নেই৷ হয়তো এজন্যই অল্পতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে।
– এই পরিস্থিতিতে কেউ এতোটা স্বাভাবিক কীভাবে থাকতে পারে! তোমাকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুমি কিছু বলছো না কেনো?

গুলিস্তা বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
– কি বলবো?
– তোমার কি আসলেই মাথায় কোনো সমস্যা আছে? এতোদিন আমার শুধু সন্দেহ ছিলো, আজকে শিওর হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে তোমার নামে এতোগুলা নোংরা অভিযোগ তুলে গেলো অথচ তুমি তাকে কিছু বললে না। আচ্ছা ঠিক আছে, ওখানে কিছু বলো নি। কিন্তু তুমি কি আমাকেও কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করছো না?

রেহবারের উত্তপ্ত মেজাজের কোনো প্রভাব গুলিস্তার উপর পরলো না। সে ভাবছে কতো দ্রুত বাড়ি পৌছাবে। জানালা দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো, ওরা এখন কোথায় আছে। দু হাতে শক্ত করে স্টেয়ারিং চিপে ধরে রেহবার নজর রেখেছে সামনের দিকে। পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেই মেজাজ সপ্ত আসমানে উঠে যাচ্ছে। তার উপর ওর হেয়ালি আচরণ সেই আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নিরবতা যে এতোটা বিরক্তির কারন হতে পারে, আগে জানা ছিলো না। কথা না বলেও মানুষকে অশান্তিতে রাখা যায়। এর ভুক্তভোগী রেহবার নিজেই।
– জাহিদ ছেলেটাকে তুমি চেনো?

গুলিস্তা ঘুরে তাকালো রেহবারের দিকে। জাহিদকে নিয়ে যখনি কোনো আলোচনা শুরু হয়, তা কোনদিকে মোড় নেয় তা গুলিস্তার জানা আছে। কথা শেষে সবাই গুলিস্তাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয়। রেহবারও কি তাই করবে? গুলিস্তা কি সেদিনের পুরো ঘটনাটা রেহবারকে বুঝিয়ে বলবে? এতে সে গুলিস্তাকে ভুল বুঝবে না৷ কিন্তু মাথার ভেতর কোথায় সুক্ষ্মভাবে ঝংকার তুলছে, “যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷”
– কথা বলছো না কেনো? উত্তর দেও।
গুলিস্তা সে কথা শুনতে পেলো কিনা কে জানে! ওর কানের কাছে মা অনবরত বলে চলেছে,
যতোটুকু প্রশ্ন করছি ততোটুকুর উত্তর দে৷ ওই তো মায়ের হাতে চেলাকাঠ৷ মারবে নাকি আবার!

গুলিস্তা ক্ষীণ স্বরে বললো,
– চিনি৷
– উনি যে ঘটনার কথাটি বললো। না মানে ওই যে স্কুল ফেরার পথে..। ওটা সত্য?

প্রশ্নটি করতে রেহবারের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন না করেও তো উপায় নেই। সত্যি জানতে হবে৷ মন খচখচ করছে৷ তবুও ক্ষীণ আশা রয়ে গেছে, হয়তো গুলিস্তা এমন কিছু বলবে যা রেহবারের আশংকাকে দূর করতে সাহায্য করবে। রেহবার চায়, সে ভুল প্রমাণিত হোক। অভিযোগের বিপরীতে গুলিস্তার সমস্ত যুক্তি তর্ক মেনে নিতে সে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। অথচ গুলিস্তা বললো,
– হ্যাঁ। সত্য।

সীটে হেলান দিয়ে গুলিস্তা চোখ বন্ধ করে নিলো। বিভীষিকাময় সেদিনের স্মৃতি সে মনে করতে চায় না। তবুও সবাই ওকে কেনো মনে করিয়ে দেয়! বারবার একই ঘটনার উল্লেখ করে কেনইবা ওকে যন্ত্রণা দেয়৷ বেশ তো ছিলো এই কয়েকটা মাস। আবার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। গায়ে ভীষণ ব্যথা। গুলিস্তা শক্ত করে চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ওদিকে রেহবার যেনো নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে৷ ভাগ্যিস রাস্তায় তেমন যানজট নেই। না হলে এতোক্ষণে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতো নিশ্চিত। কারন রেহবারের দৃষ্টি সড়কের দিকে নেই। সে অবাক চোখে চেয়ে আছে গুলিস্তার দিকে। যে খুব স্বাভাবিকভাবে নিজের অপকর্মের স্বীকারোক্তি দিয়ে এখন চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়ার পায়তারা করছে।
বাকিটা পথ একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। বাড়ির সামনে আসতেই, রেহবার ধমকে উঠলো,
– নামো গাড়ি থেকে।

গুলিস্তা ধীরেসুস্থে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
গাড়ি পার্ক করে রেহবার কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে পায়েচারি করলো। এখন কি করা উচিত? মায়ের সাথে কথা বলবে? এতো শখ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছে! গুলিস্তাকে নিজের মেয়ের মতোন আদর করে৷ এখন এমন কথা শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে। দূর দেশে থেকে অযথা অস্থিরতায় ভুগতে থাকবে৷ মাকে সেই কষ্ট দিয়ে স্বার্থপরতার পরিচয় দিতে ইচ্ছে করলো না।
গুলিস্তার সাথে কথা বলা যায়। কিন্তু রেহবার নিশ্চিত, কথা বলতে গেলে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে৷ বউয়ের গায়ে হাত তোলার মতো জঘন্য অপরাধ সে করতে চাইছে না। আর যে ব্যক্তির অপরাধবোধ নেই, তাকে কি বলা যেতে পারে! নিজের বিশ্রী অতীত স্বামীর সম্মুখে এসে গেছে, এই নিয়ে ওর কোনো চিন্তা নেই, ভয় নেই। এলোমেলো চিন্তার কোনো কূল কিনারা খুঁজে না পেয়ে রেহবার নিজের ঘরের দিকে গেলো। যদিও গুলিস্তার সামনাসামনি হওয়ার ইচ্ছে একদম নেই। তবুও কীসের আশায় যাচ্ছে কে জানে!
সে যে আশায় আসুক না কেনো, তাতে পুরো জল ঢেলে দিলো গুলিস্তা। রেহবার অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো গুলিস্তা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে অলরেডি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে৷ রেহবার আর সেখানে এক মুহুর্ত রইলো না। উল্টোপথে ফিরে গেলো গাড়ির দিকে৷ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে তবুও ফিরবে না এই বাড়িতে, এই মেয়ের কাছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here